আর্ক অফ কভেনেন্ট( মূসা আঃ সিন্দুক)

বনী ইসরায়েল তথা ইহুদী জাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নিদর্শন গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে এটি।এ সিন্দুকটির কথা ওল্ট টেস্টামেন্ট তথা তাওরাত, বাইবেল এবং কোরআনেও উল্লেখ্য রয়েছে।আমরা কমবেশি সবাই জানি এটা সম্পর্কে। জনপ্রিয় মুভি ইন্ডিয়ানা জোনসের প্রথম পার্টটিও এ আরক অফ কভেনেন্ট নিয়ে।যদিও শেষ পর্যন্ত এ সিন্দুকের কি হয়েছিলো তা আজও অজানা।তবুও তাওরাত, বাইবেল, ইহুদী লোককথা, কোরআন এবং তাফসীরের আলোকে যতটুকু জানা যায় তা তুলে ধরার চেস্টা করসি।

ark of covenant


💥মূসা (আঃ) মিশর থেকে ইহুদীদের নিয়ে আসার সময় ৪০ বছর মিশর ও জেরুজালেমে এর মধ্যবর্তী স্হানে মরূভূতিতে অবস্হান করেন।এ সময় টাতে ইহুদীদের মহান আল্লাহ মান্না আর সালওয়া প্রদান করেন।মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে সিনাই পর্বতে যান। Book of Exodous অনুযায়ী এ সময়টাতেই মহান আল্লাহ টেন কমান্টমেন্ট নাজিল করেন। ২ টা পাথরে এটা লিখিত অবস্হায় ছিলো।সিনাই পর্বতেই মহান আল্লাহ, মূসা (আঃ) কে এ সিন্দুক তৈরীর নির্দেশ দেন।সিন্দুক কিভাবে তৈরী করতে হবে এবং সম্পূর্ণ বিবরন তখন উনাকে দেয়া হয়।Book of Exodous এ সম্পূর্ণ মাপের কথা উল্লেখ রয়েছে। বইটি কীভাবে সিন্দুকটি তৈরি করা হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়। এটি দৈর্ঘ্য 21-22 হাত, প্রস্থ 11-22 এবং উচ্চতা 11-22 (আনুমানিক 131 × 79 × 79 সেমি বা 52 × 31 × 31 ইঞ্চি)।
মূসা (আঃ) মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ এর পর উনার লোকেদের কাছে ফিরে এসে সিন্দুক বানানোর নির্দেশ দেন।এটা বলা হয় যে Shittim wood দিয়ে সিন্দুকটি তৈরী করা হয়।প্রাথমিক ভাবে টেন কমেন্টমেন্ট লেখা ২ টা পাথর রাখার জন্যই সিন্দুকটি তৈরী করা হয়।সম্পূর্ণ সিন্দুকে সোনার প্রলেপ দেয়া হয়। Bezalel, Aholiab এ ২ জন ব্যক্তি সিন্দুটি তৈরী করেন।সিন্দুকের তার কর্নারে ৪ টি সোনার প্রলেপ থাকে এবং বহন করার জন্য ২ দিকে ২ টা সোনার তৈরী হাতল।

💥প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে তা হলো এ সিন্দুকের ভিতর ছিলো কি।এটা কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নয় যে সিন্দুকের ভিতর কি ছিলো।
Book of Exodous অনুযায়ী টেন কমান্টমেন্ট এর ওহী যে ২ টি পাথরে নাজিল হয়েছিল ওই ২ টা পাথর রয়েছে।
কিন্তু নিউ টেস্টামেন্ট তথা বাইবেল অনুযায়ী এ সিন্দুকে টেন কমান্টমেন্টের পাথরের ফলকের সাথে আরো রয়েছে হারুন (আঃ) এর লাঠি[মতান্তরে মূসা (আঃ)] এবং মান্নার বাটি [মান্না ছিলো এক প্রকার জান্নাতি খাবার যেটা শর্করার চাহিদা মেটাতো।]এ সিন্দুক এর মাধ্যমে মূসা (আঃ) এর কাছে মহান আল্লাহ ওহী পাঠাতেন এরকম ও এসেছে কিছু ইহুদী রেফারেন্স থেকে।
কোরআনে নির্দিস্ট করে বলা হয়নি যে ঠিক কি ছিলো এ সিন্দুকে।বাকারার ২৪৮ আয়াত অনুযায়ী মূসা এবং হারুন আঃ ব্যবহৃত জিনিষপত্র। কোনো কোনো তাফসীরে এসেছে যে পরিধেয় জামা ও ছিলো।

💥মূসা (আঃ) এর ইন্তেকাল হয় জেরুজালেম থেকে কিছুটা দূরে।উনার ইন্তেকালের পর এ সিন্দুকটি বহনের জন্য নতুন নিতিমালা করা হয়। উনার মৃত্যুর পর Joshua ইসরায়েলীদের নেতৃত্ব দেন।ইহুদীরা যেখানে যেতো এ সিন্দুকটি বহন করে নিয়ে যেতো।ইহুদীদের প্রমিজ ল্যান্ড তথা জেরুজালেমে এর দিকে Joshua এর নেতৃত্বে জর্ডান নদী পেরিয়ে এগিয়ে যায় ইহুদীরা।সিন্দুকটি লোক চক্ষুর আড়ালে রাখা হতো এমনকি রাবীরাও( ইহুদী ধর্মীয় জাজক) এটা দেখতেন না।কাপড় দিয়ে আবৃত থাকত সিন্ধুকটি।এরকম কথিত আছে যে জর্ডান নদী পেরোনোর সময় সিন্দুকটি কাফেলার সামনে রাখা হয়।সিন্দুক বাহী দলটি নদীর কাছে যাওয়া মাত্রই নদীর পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো।নরম্যালি কাফেলা থেকে ৮০০ মিটার সামনে থাকতো সিন্দুকটি। ৭-১০ জন এটা বহন করতো।ইহুদীরা জেরুজেলাম দখলের উদ্দেশ্যে যখন জর্ডান নদী পেরিয়ে পৌছে তখন প্যালেস্টাইনরা ছিলো প্যাগান।ওইসময়ের সিলেক্টেড পারসন ছিলো ইহুদীরা।বর্তমান সময়ে যদিও পরিস্হিতি সম্পূর্ন উল্টো।জোরুজেলামের চতুর্দিকে দেয়াল ঘেরা ছিলো যার ফলে এটা জয় করা অনেকটা অসম্ভব ছিলো।
ইহুদী বর্ননা মতে একটানা ৭ দিন ৭ জন পাদ্রী এবং অস্ত্রশস্ত্র সজ্জীত ইহুদীরা এ সিন্দুকটি নিয়ে সম্পূর্ণ দেয়াল প্রদক্ষিন করে।এবং হর্ন বাজায়।সপ্তম দিনের মাথায় সম্পূর্ণ দেয়াল ধ্বসে পরে এবং ইহুদীরা জেরুজালেম দখল করে নেয়।

💥এর কয়েক বছর পরই ফিলিস্তিনিরা আবার জেরুজালেমে দখল করে নেয়।এর মধ্যে কয়েকটি খন্ড খন্ড যুদ্ধ হয় ইহুদী এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে।ইহুদীরা মনে করত যে এ সিন্দুক থাকা অবস্হায় তারা কখনোই হারবে না।এজন্য তারা যুদ্ধে নিয়ে যায় সিন্দুকটি কিন্তু ফিলিস্তিনিদের নিকট পরাজিত হয়। প্রায় ৩০ হাজার ইহুদী মারা যায় যুদ্ধে।এ যুদ্ধের মাধ্যেমেই সর্বপ্রথম আর্ক অব কভেনেন্ট ইহুদীদের হাত ছারা হয়ে যায়।এ খবর ইহুদীদের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃস্টি করে।ওই সময়কার ইহুদীদের কয়েকজন রাবী এ খবর পাওয়ামাত্র শক নিতে না পেরে মারা যায়।বাকী সবাই ঘোষনা দিয়ে দেয় যে ইহুদীদের সৌভাগ্য ওদের ছেরে চলে গেসে।ওদের মোরালের উপর বড় আঘাত হানে এ সংবাদটি।
ফিলিস্তিনীরা সিন্দুকটিকে তাদের দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল এবং প্রতিটি জায়গাতেই তাদের দুর্ভাগ্য ঘটেছিল। আশদোদে নামক স্হানে এটি দাগনের [তখনকার সময়ের প্যালেস্টাইন দেবতা] মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছিল। পরের দিন সকালে দাগনকে তার সামনে , মাথা নত করা অবস্হায় পাওয়া যায় তো ফিলিস্তিনিরা দাগনের মূর্তিকে এ সিন্দুকের উপরে রাখে পরের দিন সকালে দাগনের মূর্তি আবার সিজদা এবং ভাঙ্গা অবস্হায় দেখতে পায়। আশদ্দোর লোকদের উপর এবং গথ নামক আরেক প্রদেশ লোকদের উপর হঠাৎ মহামারীর প্রকোপ দেখা যায়।তখন ভীষনরূপে প্লেগ ছরিয়ে পরে।অর্থাৎ সিন্দুকটি ফিলিস্তিনিদের সব জায়গায়ই দূর্ভাগ্য, রোগ বালাই বয়ে নিয়ে আসছিলো।অবশেষে তার তাদের পাদ্রীর পরামর্শে সিন্দুকটি থেকে পরিত্রান পাওয়ার পথ খোজে।

💥সিন্দুকটি কিভাবে ইহুদীরা পুনরায় ফেরত পায় এটা নিয়ে তাওরাত, বাইবেল, কোরআনের বানী ৩ রকম।
কোরআন অনুযায়ী ২ টা ফেরেশতা সিন্দুকটিকে ইহুদীদের কাছে দিয়ে যায়।অন্য বর্ননামতে ফিলিস্তিনিরা গরুর গাড়ীতে করে সিন্দুকটি ছেরে দেয় এবং ঘুরতে ঘুরতে তা ইহুদীদের কাছে চলে আসে।আবার কোন বর্ননা মতে ২ জন লোক সিন্দুকটি দিয়ে যায়।
"وَ قَالَ لَہُمۡ نَبِیُّہُمۡ اِنَّ اٰیَۃَ مُلۡکِہٖۤ اَنۡ یَّاۡتِیَکُمُ التَّابُوۡتُ فِیۡہِ سَکِیۡنَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ بَقِیَّۃٌ مِّمَّا تَرَکَ اٰلُ مُوۡسٰی وَ اٰلُ ہٰرُوۡنَ تَحۡمِلُہُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۲۴۸﴾٪

এবং তাদের নাবী তাদের বলেছিলঃ তার রাজত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট সিন্দুক সমাগত হবে, যাতে থাকবে তোমাদের রবের নিকট হতে শান্তি এবং মূসা ও হারুনের পরিবারের (পরিত্যক্ত) কিছু সামগ্রী, মালাইকা/ফেরেশতা ওটা বহন করে আনবে, তোমরা যদি বিশ্বাস স্থাপনকারী হও তাহলে ওর মধ্যে নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।

Quran 2:248

সিন্দুকটি Kirjath-jearim নামক গ্রামে রাখা হয়।ওখানে Eleazer নামক একজনের গৃহে এটি ছিলো একটানা ২০ বছর।এর মধ্যে বিভিন্ন যুদ্ধে এটি সৌভাগ্য হিসেবে নেয়া হয়।ইহুদীরা যতগুলো যুদ্ধে এটি নিয়ে যায় সবগুলোতেই তারা বিজয়ী হয়।

💥দাউদ (আঃ) এর শাসনামলে উনি এটিকে Uzzah নামক স্হানে সরানোর পরিকল্পনা করেন।এটাকে সরানোর সময় যারা বহন করছিলো তাদের একজন Perez-Uzzah নামক স্হানে আসার পর কৌতুহলী হয়ে সিন্দুকটি স্পর্শ করে এবং সাথে সাথে মারা যায়।
এ ঘটনায় দাউদ (আঃ) বিচলিত হয়ে যান এবং Uzzah তে না এনে সিন্দুকটি ওইখানেই Obed-edom নামক একজনের বাড়ীতে রাখেন।ওইখান থেকে ৩ মাস পর দাউদ (আঃ) নিজের উপস্থিতিতে সিন্দুকটি Zion এ স্হানান্তর করেন।সমগ্র ইসরায়েলবাসী তখন সিন্দুক দেখার জন্য রাস্তায় লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকে।বেশ জাঁকজমক ভাবেই সিন্দুকের স্হানান্তর ঘটে।সিন্দুকটি রাখার জন্য উনি একটি তাবু বানান এবং ওইখানেই ইহুদীদের ফার্স্ট টেম্পল বানানোর সিদ্ধান্ত নেন।
সিন্দুকের আগে লেবীয়দের মন্ত্রীর জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। নাথন নামক একজনের পরামর্শে সিন্দুকের জন্য ফার্স্ট টেম্পল তৈরির দাউদ আঃ পরিকল্পনা বন্ধ করে দেন। আর অবশালোমের ষড়যন্ত্রের সময় দায়ূদ জেরুজালেম থেকে পালিয়ে গেলে, সিন্দুক পুরোহিত সাদোককে জেরুজালেমে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সিন্দুকটি তাঁর সাথে নিয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত সোলেমান আঃ টেম্পল বানানোর কাজ শেস করেন।কথিত আছে যে সোলেমান আঃ সিন্দুকের সামনে দারিয়ে প্রার্থনা করতেন।উনার সময়েই ইহুদীদের ফার্স্ট টেম্পল বানানো হয় এবং ওইখানেই আর্ক অব কভেনেন্ট রাখা হয়।
💥সোলেমান আঃ এর ইন্তেকালের পর ইহুদীরা আবার তাদের স্বরুপে ফিরে যায়।যার ফলে তাদের উপর অভিশাপ আসে।এবার অভিশাপ হিসেবে আসে ব্যবীলিয়নের তখনকার রাজা নেবুচাদনেজার । খ্রিস্টপূর্ব 587 সালে, ব্যাবিলনীয়রা জেরুজালেম এবং সলোমন মন্দির ধ্বংস করেছিল। Kings এবং Cronicols বইয়ে সিন্দুকটি কী হয়েছিল তার কোনও রেকর্ড নেই। ইজরা বাইবেলের তৃতীয় বইয়ের এক প্রাচীন গ্রীক সংস্করণ, অনুসারে ব্যাবিলনীয়রা সিন্দুকের পাত্রগুলি নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সিন্দুকটি কেড়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ নেই।
রাব্বিনিক সাহিত্যে, সিন্দুকের চূড়ান্ত স্বভাবটি বিতর্কিত। কিছু রাব্বিদের ধারণা যে এটি অবশ্যই ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, আবার অন্যরা মনে করেন এটি অবশ্যই লুকিয়ে রাখা হয়েছিল যেন তা বাবিলনের দিকে নিয়ে যায় এবং আর কখনও ফিরিয়ে আনা হয় না। তোসেফতা নামে পরিচিত দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের রাব্বিনিক রচনায় এই রাবীদের মতামত রয়েছে যে, যিহূদার রাজা যোশিয় মান্নার পাত্র বা জার এবং পবিত্র অভিষেকের তেল সম্বলিত একটি জার, হারুনের লাঠি সহ এই সিন্দুকে সংরক্ষণ করেছিলেন। উনার সময় কাল ছিলো ৬০০BC এর আশে পাশে।তখন ইহুদীদের অব্যন্তরীন অবস্হা খুবই খারাপ ছিলো এবং প্যালেস্টাইনদের আক্রমনের আশংকা ছিলো। তাই অনেক রাবি এ ধারনা পোষন করেন যে যোশিয় সিন্দুকের ভিতরের সব মূল্যবান সামগ্রী নিরাপদে রাখার জন্য সরিয়ে রেখেছেন এবং খালি সিন্দুক রেখে দেন। রাব্বি এলিয়েজার এবং রাব্বি শিমন একই রাবিনিক রচনায় লিখেছেন যে সিন্দুকটি আসলে ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। রাব্বি ইহুদাহ ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন যে, সিন্দুকটি ফার্স্ট টেম্পলের পাশের পাহাড়ের পাদদেশের কোথায় সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
সিন্দুকের কি হয়েছিলো তা আজও রহস্য।


Writer: Anamul Hossain

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম