(১)
হাসপাতাল থেকে সবেমাত্র বাসায় এসেছি। নৈশভোজ সম্পন্ন করার আগেই বিছানায় এলিয়ে দিয়েছি সারাদিন-খাটা দেহটাকে। ক্লান্ত-অবসন্ন দেহটা নিজের শান্তির নীড় খুঁজে পেয়ে ঘুমের নেশায় মত্ত হয়ে উঠেতে শুরু করেছে। এমন সময় ঝুমকো এসে তড়িঘড়ি শুরু করে দিল — ওর বাবার নাকি শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে; আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে!
এক বাবার এক মেয়ে ঝুমকো। ঝুমকো অবশ্য ওর সত্যিকারের নাম নয়। মেয়ের বাবা নাম রেখেছিলেন শারমিন। বাবা-মায়ের-দেওয়া নামে ডাকাটা আমার অপছন্দ। তাই যে-কাউকে নিজের মনোমতো নামে ডাকি — তা সে যতোই অসম্মতি জানাক। তাই ওর নাম দিয়েছি ঝুমকোলতা, ডাকি ঝুমকো বলেই। নিজের-দেওয়া নামে নাম্নীকে অন্যরূপে কাছে পাওয়া যায়; এই রূপ অন্য নামে কস্মিনকালেও পাওয়া যাবে না।
গৃহকর্মে নিপুণা বউটি আমার স্কুলের শিক্ষিকা। সকালে বাসার সব কাজ সেরে আমাকে বিদেয় করে আমার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে যায় স্কুলে। বিকেলে ফিরে এসে আবার নিজেকে নিয়োজিত করে রাজ্যের কাজে। কিন্তু তারপরও তার মধ্যে বিরক্তির ভাব খুব কমই উদিত হয়। অজস্র গুণের মধ্যে দোষ যে কিছু নেই তেমনটা নয়। কিছু দোষ তার মারাত্মক। দোষের মধ্যে যে জিনিসটা আমার একদম অপছন্দ তা হল তার রাগ। রেগে গেলে সে নিজেকেও চেনে না। তাই সব সময় চেষ্টা করি যাতে সে রেগে না-যায়।
বদমেজাজি স্ত্রীর কথা উপেক্ষা করে আর বেশিক্ষণ শান্তির নীড়ের আলতো স্পর্শ উপভোগ করা যাবে না। অগত্যা ছুটতে হল শ্বশুরালয়ে। শ্বশুরমশায় আমজাদ আলী ছিলেন কলেজের কেরানি। কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন বছরখানেক হবে। বয়েসের ছাপ তাঁর সুদর্শন চেহারায় বিন্দুমাত্র প্রলেপ লাগায় নি। এখনও তিনি রোজ ভোরবেলা উঠে দিব্যি দৌড়ঝাঁপ করতে পারেন। ষাটোর্ধ্ব এই মানুষটা আজও বাইশ বছরের যুবকের মতো ফুরফুরে। রোগবালাইয়ের মধ্যে ওই শ্বাসকষ্টই যা। তাঁর যথাযথ ট্রিটমেন্ট সেরে বাড়ি ফিরে এলাম। ওখানেই থেকে যেতে জোর করেছিল সবাই। কিন্তু আমার মন সেই জোরটা জোর করেই প্রত্যাখ্যান করেছিল।
(২)
পরের দিন কাজের চাপ ছিল না। সন্ধ্যাতেই বাড়ি ফিরে এলাম। আবার সেই শান্তির নীড় আমাকে আপন করে নিতে চাইল। কিন্তু কোত্থেকে ছেলেটা এসে জড়িয়ে ধরে বলছে ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতে হবে।
কী সাংঘাতিক কথা! এক নিমিষের বিরাম কি নেই? সারাদিন খেটেখুটে এখন ছুটতে হবে ছেলেকে নিয়ে? "এখন বাবা ক্লান্ত। তোমাকে শুক্রবার নিয়ে যাব, কেমন?", শান্ত স্বরে সান্ত্বনা দিলাম। কিন্তু সে শুনতে নারাজ — আজই চলো, এক্ষুনি চলো!
ঝুমকোও ছেলের পক্ষে ওকালতি শুরু করল। স্বামীর চেয়েও সন্তানের প্রতি মমতা বেশি দেখে অবাক হলাম কি না ঠাওর করতে পারলাম না। আগেই বলেছি, সে বদমেজাজি। একটা এলাহি কাণ্ড বাধানোর আগেই শাফিন (আমার ছেলে)-কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মার্কেটের উদ্দেশ্যে।
শাফিনের বয়স বেশি না। পাঁচ পেরিয়ে ছয় ছুঁইছুঁই। সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। ওর মায়ের স্কুলেই পড়ে। চঞ্চল না-হলেও বড্ড জেদি। ওর মায়ের যোগ্য ছেলে বটে!
(৩)
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। চারিদিকে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের আমেজ। কেনাকাটার ধুম পড়েছে একটা। মানুষে গিজগিজ করছে চারপাশ — কেউ জামাকাপড় কিনছে, কেউ খাওয়াদাওয়া করছে; কেউ দরকষাকষি করতে গিয়ে দোকানির সাথে তর্কযুদ্ধে মেতে উঠেছে, কেউ-বা সেই তর্কে জিতে গিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে অন্য দোকানে যাচ্ছে নতুন যুদ্ধ জয়ের উদ্দেশ্যে। ব্যস্ত সবাই। কারও বিরাম নেই এক লহমা।
শাফিন কিছু খেলনা নিল — বায়না করেই। এখন ওর খেলনা নিয়ে খেলার বয়েস আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু জেদের কারণে এত লোকের মধ্যে যদি আবার হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দেয়, সেই ভয়েই সব কিনে দিলাম। একটাই ছেলে। মায়াটা তাই ছায়ার চেয়েও আপন।
ছেলের মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে দেখেই মার্কেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গেটের মুখে লোকজনের ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। পঞ্চাশ-ষাট বছর বয়সের এক বৃদ্ধা মহিলা অ্যাকসিডেন্ট করেছেন। বাইকের ধাক্কায় পড়ে গিয়েছেন রাস্তার পাশে। প্রায় সত্তর বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধ তারই হাত ধরে কাঁদছেন। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠের মর্ম বোধগম্য হল না আমার। লোকজনের এই আকস্মিক ভিড় তাদের আরও অপ্রস্তুত করে তুলেছে — এটুকু ঢের বুঝলাম।
রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। এখনই হাসপাতালে পাঠানো দরকার। কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে আমারই হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। শাফিনকে বাসায় রেখে আমিও গেলাম হাসপাতালে।
(৪)
বৃদ্ধা মহিলার সকল প্রকার চিকিৎসার বন্দোবস্ত সম্পন্ন হয়েছে। তিনি সবরকম যত্নের মধ্যেই আছেন। এই সুযোগে বুড়োর সাথে আমার দুটো কথা হয়। বয়েস হওয়ায় গলার স্বর তাঁর ভেঙে গেছে। কিন্তু সেই ভাঙা কণ্ঠে তিনি যা শোনালেন তাতে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। আমার জগতটা যেন দুমড়েমুচড়ে কেউ পায়ের তলায় নিয়ে পিষে ফেলল।
বুড়োর তিন ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেদের একজন আমার মতোই ডাক্তার, একজন কানাডায় চাকুরীজীবি, আর একজন বড়ো ব্যবসায়ী; মেয়ে একটা এনজিওতে নাকি কীসের দায়িত্বে কর্মরত, জামাই ব্যাংকার। আর বুড়ো ছিলেন মুদির দোকানী। খেয়ে-না-খেয়ে ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আশা ছিল শেষকালে ছেলেমেয়েরা দেখভাল করবে। সে গুড়ে বালি!
ডাক্তার সাহেব স্ত্রীপুত্র নিয়ে সুখে আছেন। মা-বাবার ঠাঁই তার বাসায় হয় নি। কানাডার পুত্র দেশমুখী হওয়া দূরে থাক, না-নেন খোঁজখবর, না-দেন ভরণপোষণ। আর যিনি ব্যবসায়ী তিনি তো ব্যাবসাকেই নিজের ঈশ্বর বানিয়ে রেখেছেন। সেই ঈশ্বরের আরাধনাকালে বাবা-মায়ের মতো উটকো ঝামেলা কি সহ্য হয়? বড়ো আশা করে মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিল বুড়ো-বুড়ি। দুই দিন যত্ন-আত্তি যা-ও বা হল, তৃতীয় দিন মেয়ে দুজনের হাতে এক হাজার টাকার দুটো নোট ধরিয়ে সদরদরজা দেখিয়ে দিল। এখন? ভিক্ষে করেই দিন কাটে দুজনের।
কথাগুলো বলতে গিয়ে বুড়ো কতই-না কাঁদলেন। ছেলেবেলায় নাকি বাবাকে একবার ধমক দিয়েছিলেন। তারই ফলস্বরূপ নাকি ছেলেমেয়েরা তাকে ফিরিয়ে দেয়! হাউমাউ করে কেঁদেকেটে বললেন, "আমার সেই ভুলের শাস্তি কেন এই বুড়িটা পাচ্ছে? হায় রে প্রতিফল!"
বুড়োর কথাগুলো আমার হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। জ্বালিয়ে দেয় অনুশোচনার আগুন। তাঁকে খাওয়াদাওয়া করালাম। হাসপাতালে থাকবার একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি সেই রাতের মতো চলে এলাম বাসায়।
(৫)
বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়া না-করেই শুয়ে পড়লাম। পাথরচক্ষু ফেটে আজ অশ্রুধারা নেমে আসতে চাইছে। কিন্তু কীসের যেন একটা বাধা চেপে রেখেছে দুই চোখ, গড়াতে দিচ্ছে না অশ্রুবিন্দু। চারপাশের সব রং দপ করে নিবে গিয়ে অন্ধকার করে তুলল। সেই অন্ধকার বিরাটকায় একটা সাপের রূপ পরিগ্রহ করে আমাকেই দংশন করতে লাগল।
মা মারা গিয়েছেন আমার বিয়েরও আগে। বাবার সাথেই থাকতাম। ছোটোখাটো ব্যাবসা করেই বাবা আমাদের পরিবার চালিয়েছেন। আমাকে বানিয়েছেন ডাক্তার। আমার ছোটো বোনকে ওকালতি পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাউকে না-জানিয়ে সে কার সাথে গিয়ে কোথায় যে সংসার পাতল তা আমিও জানি না। কত বছর হয়ে গেল, তার খোঁজ মিলল না।
বিয়ের দু বছর পর বাধল বিপত্তি। আমার স্ত্রীর এই শেষ কথা — একটা অকর্মণ্য বুড়োকে বাড়িতে রেখে অন্নধ্বংস করা চলবে না। অনেক বাদানুবাদ এই ব্যাপারে হয়েছিল। বাবাও টের পেয়েছিলেন বটে। হয়তো লজ্জায় বলতে পারেন নি। শেষে পরিস্থিতির নগ্ন শিকার আমি তাঁকে রেখে এলাম বৃদ্ধাশ্রমে।
তিনটা বছর পেরিয়ে গেলেও আমি তাঁর একটা খোঁজও নিই নি। আজ অনুশোচনার আগুনে হৃদয় পুড়ছে। চোখের পানিও নেই যে এই আগুন নেবাতে পারে। এ আমি কী করেছিলাম? কার কথায় তাঁকে পর করে দিলাম? সে তো ঠিকই তার বাবার অযত্নটি হতে দেয় না। আমি পরের বাবার জন্যে রাত্তিরে উঠে ছুটে যাচ্ছি, আর নিজের বাবার কথা মনেও করি না? নিজেকে ধিক্কার জানাতেও লজ্জা হচ্ছে আজ।
আমার মনে একে একে ভেসে উঠল ছেলেবেলার কথাগুলো। কত বিরক্ত করেছি বাবাকে। কত আবদার নিয়ে গিয়েছি — "বাবা, এটা চাই। বাবা, ওটা চাই।" তিনি আমায় ফিরিয়ে দেন নি। রাগান্বিত হন নি। নিজের সমস্যাকে ঢেকে রেখেই আমার দাবি পূরণ করেছেন। সে আমি টের পাই নি। আজ যখন আমার শাফিন আছে, আমি টের পাই, বিস্তর টের পাই। কেমন লাগবে আমার একদিন আমার এই কলিজার টুকরো শাফিন যদি আমাকে ...?
না। আর নয়। কাল সকালেই গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসব। — এমনটাই স্থির করলাম। ঘোর অবিচার করেছি। আমার ক্ষমা হওয়া উচিত না।
ঝুমকো এসে বলল, "শোনো, কাল সকালে একটু বাবার ওখানে যাবে। ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছে। ওষুধগুলো কিনে দিয়ে আসবে। শ্বাসকষ্ট নাকি মাঝেমধ্যেই বেড়ে যায়। মনে থাকবে তো?"
(৬)
আমি শুধু মাথা নাড়লাম এই বলে যে, যাব।
সকালেই রওনা দিলাম বৃদ্ধাশ্রমের দিকে। সারাটা রাস্তা নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, বৃদ্ধাশ্রমগুলো কেন তৈরি করা হল? কে তৈরি করল? মনের প্রশ্ন মনেই দিশে হারিয়ে মিশে গেল।
সেখানে গিয়ে কত অপরিচিত বয়স্কদের দেখলাম। সকলের ছেলেমেয়েই উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষার ওজন এতই বেশি হয়ে গিয়েছে যে, বাবা-মায়ের বাড়তি বোঝাটুকু বহন করার সাধ্য তাদের হচ্ছে না!
অফিসকক্ষে গিয়ে আমার পরিচয় ইত্যাদি দিলাম। ব্যবস্থাপক সাহেব বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, মনসুর আহমেদ। আর কিছু বিবরণ দিলাম। আমার অবসন্ন লজ্জিত দুই চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন, "পাঁচ-ছয় মাস আগে আপনার বাবা, মনসুর আহমেদ, শ্বাসকষ্টে মারা গিয়েছেন।"
Writer: Arafat Imran