কোল্ড লাইটস (সাই ফাই অনুবাদ)

“আলোটার ব্যাপারে আমার যেটা কৌতুহল লাগে তা হল এটা কতটা নিঝুম”, বলল সে, বরফে শুয়ে থেকে মাথার ওপরের সৌন্দর্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে।

তাদের মাথার ওপর ঐন্দ্রজালিক অররা বোরালিস ফিনল্যান্ডের রাতের আকাশে মানব ইতিহাসের একেবারে শুরু থেকেই নৃত্যরত রয়েছে। সবুজ এবং সাদা আলো সুরেলা সঙ্গীতের একতানের মত তমসাচ্ছন্ন তারাভর্তি আকাশে ঢেউয়ের মত খেলে যাচ্ছিল যেন কোনো মহান, অদৃশ্য মহাজাগতিক শিল্পী বাদ্যযন্ত্রের মত সেটা বাজিয়ে চলছেন।
 
Science fiction


“মানে বলতে চাচ্ছি, ওটা স্রেফ আলো, তাই সেখানে শব্দ থাকার তো প্রশ্নই আসে না,” সে বলতে থাকল, প্রতিটা শব্দ তার মুখ থেকে কুয়াশা ছড়িয়ে দিচ্ছিল উপশুন্য তাপমাত্রার বাতাসে। “কিন্তু যখন আমরা তাদের ছবি বা ভিডিও দেখি, তাদের রঙ এতটা উজ্জ্বল আর তীব্র হয় যে আমাদের মস্তিষ্ক যেন নিজে থেকেই শব্দ তৈরী করে দেয় আমাদের মনের ভেতর। কিন্তু এখানে সশরীরে আসার পর, যখন এর নিচেই শুয়ে আছি, তারা পুরোপুরি নিঝুম, নিঃশব্দ। বিন্দু পরিমাণ শব্দ তারা তৈরী করছে না। আমরা যদি আমাদের চোখ বন্ধ করে ফেলি, বা নিচে অন্যদিকে তাকাই তবে আমদের কোনো ধারণা- এতটুকু ধারণাও থাকবে না যে আমাদের মাথার ওপরেই এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্য প্রকট হয়ে রয়েছে…”

সে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইল।

“আমার অবশ্য এখনও নিজের থিওরিই বেশি পছন্দ,” তার বন্ধু হাসতে হাসতে বলল।

“কী? আসলেই?” সে বলল, “কিন্তু আমার চিন্তা তো আরো রোমান্টিক। তোমার থিওরি, মানে ওপরের আলোগুলো এলিয়েনদের যোগাযোগ করার একটা মাধ্যম, এই চিন্তাটা আসলে ঠিক রোমান্টিক নয়…”

“শালা, এখানে বরফে শুধু আমরা দুইজন ছেলে আছি,” তার বন্ধু আবার হাসতে শুরু করল, “রোমান্টিক জিনিসটা নিশ্চয়ই এখন পছন্দ করব না।”

তারা দুজনে একটু হেসে নিয়ে উঠে গিয়ে সাথে করে আনা গিয়ার বের করতে শুরু করল। হাই-কোয়ালিটি স্মার্ট ক্যামেরা যেটা আলোর বিভিন্ন রেঞ্জ- এমনকি যেগুলো মানুষের চোখে অদৃশ্য সেগুলোও- সংগ্রহ করে একটা নিউরো-নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দেয়। এই নিউরো-নেটওয়ার্কে রয়েছে বিশ্বের সমস্ত ভাষাজ্ঞান যাতে করে প্রতিটা ভাষার মাঝে প্যাটার্ন খোজার কাজে ব্যবহার করা যায়।

“সত্যি বলতে”, তার দ্রুত জমে যেতে থাকা হাত দিয়ে বাটন, তার আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সে বলল, “তোমার চিন্তাটা যুক্তিযুক্ত। মানুষ সাধারণত একে অপরের সাথে শব্দের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকে, কিন্তু এমন কোনো নিয়ম তো নেই যে অন্য কোনো জীব, বা অন্য কোনো গ্রহের জীবও একই পদ্ধতি অনুসরণ করবে। কেন এমন কোনো এলিয়েন প্রজাতি থাকতে পারে না যারা আলো তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। আলো যেহেতু শব্দের চেয়ে দ্রুত তাই এটা আরো ভাল কাজ করার কথা। এই আলোর মাধ্যমে যদি কোনো সিগন্যাল মহাকাশে ছড়িয়েও দেয়া হয়, তাহলে অনেক দূর যাত্রা করার ফলে সেই তরঙ্গ দেখা যাবে আমাদেরই সুর্য আর দিনের আলোর দূষণের ফলে আমরা দেখতে পাবো না যেমন ব্যাকগ্রাউন্ড মহাজাগতিক রশ্মির জন্য রেডিও সিগন্যাল নষ্ট হয়ে যায়। তাই কেন সেই তরঙ্গ বা আলোর তথ্য রাতের আধারে আকাশের কোণে এমন কোনো জায়গায় প্রেরণ করে প্রদর্শন করব না যেখানে কোনো আলো দূষণ নেই, সবাই সেই তথ্য ভাল করে দেখতে পারবে? তাই কেন এমন হতে পারে না যে এই উত্তরের আকাশের আলোর নাচ আসলে দূরবর্তী কোনো এলিয়েন সভ্যতার পাঠানো বার্তা? কেন নয়?”

“হ্যা দোস্ত, তাছাড়াও, পৃথিবীতেই কিন্তু মৌমাছি আর ফুল একে অপরের সাথে রঙের মাধ্যমে যোগাযোগ করে, যেটা আলো ছাড়া আর কিছু নয়”, তার বন্ধুও যোগ দিল অপবিজ্ঞান নিয়ে বক্তৃতা দেয়ার মাধ্যমে, “তাছাড়াও, পুরো মহাকাশে এনার্জির ছড়াছড়ি, নক্ষত্র কীংবা অন্যান্য আলোর উৎসও তাই, যেটা কোনো বুদ্ধিমান এলিয়েন সভ্যতা কোনোরকম কারসাজি করে ব্যবহার করতে পারে চারিদিকে সিগন্যাল পাঠানোর জন্য। এটা অনেকটা মহাকাশে একটা টেকসই রেডিও পাওয়ার মত যেটা ব্যবহার করে আমরা আমাদের কন্ঠ মহাকাশে ছড়িয়ে দিতে পারি,শুধু এলিয়েনদের ক্ষেত্রে এটা আলোর তরঙ্গ। আমরা জানি উত্তরের আকাশের এই আলোগুলো কীভাবে তৈরী হয়েছে, কিন্তু আমরা কী জানি যে এরা কেন এমন প্যাটার্নেই আলো দিয়ে থাকে? কেন এমন হতে পারে বা যে কোনো এলিয়েন সভ্যতা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে একটা টেকসই যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে? কেন নয়?”

যন্ত্রপাতিগুলো বসানো শেষ, এবার তারা তাদের হাতমোজা আবার পড়ে নিল। শুরুতে ঠান্ডা আবহাওয়ায় হাত খুলে রাখতে ভাল লাগলেও ধারালো বাতাসে চামড়া কেটে যাওয়ার উপক্রম হলে উষ্ণ অনুভূতি সাথে সাথেই বিদায় নিয়েছিল।

তার বন্ধু ক্যামেরা চালু করে দিতেই সেটা রাতের আকাশের সমস্ত আলো তরঙ্গ নিউরো-নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দিতে শুরু করল। ইনপুট দ্বিতীয়বার চেক করে নিশ্চিত হয়ে নিল যে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। নিউরো-নেটওয়ার্কের সিমুলেশন তার ল্যাপটপে দেখাচ্ছিল যে তাতে সব ডাটা ঠিকমতই লোড হচ্ছে।

“আচ্ছা,” তার বন্ধু মাথা নাড়িয়ে বলল, “এবার অপেক্ষার পালা। বিয়ার এনেছ তো?”

সে মাথা নাড়াল এবং বরফের স্তুপের ভেতর থেকে দুটো ক্যান বের করে আনল। একটা তার বন্ধুর দিকে ছুড়ে দিয়ে অপরটি নিজের জন্য খুলে বরফের আচ্ছাদনের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে আকাশের পানে সশ্রদ্ধ বিশ্ময় নিয়ে তাকিয়ে ওপরে আকাশে আলোর মহাজাগতিক নৃত্যানুষ্ঠান দেখতে থাকল।

***

সময় কেটে গেল এবং সেই সাথে ছয়টি বিয়ারের ক্যান। এরপর আরো ছয়টি সাথে কিছু স্ন্যাকস।

দূরে, আলোগুলো তখনও নেচে যাচ্ছিল আর ক্যামেরা ডাটাগুলো নিউরো-নেটওয়ার্কে পাঠিয়ে দিচ্ছিল।

“আজকের মত বাদ দেই,কী বলিস?”, সে হাই তুলতে তুলতে বলে।

“হাস্যকর, কারণ এই অরোরা ফিনল্যান্ডের আকাশে ছয় মাস ধরে থাকে”, তার বন্ধু হেসে বলে।

“হয়েছে”, সে দাড়িয়ে আড়মোড় ভেঙে বলল। “কিন্তু তুমি জানো আমি কী বুঝাতে চেয়েছি। আইডিয়াটা বেশ ভাল ছিল কিন্তু আমাদের প্রয়ো-”

পিং করে একটা জোর আওয়াজ এল ল্যাপটপ থেকে। একটা নোটিফিকেশন। নিউরো-নেটওয়ার্ক একটা বাক্য অনুবাদ করলে এমন আওয়াজের নোটিফিকেশন দেয়।

সে যে জমে গেল তার জায়গায় এরপর তার বন্ধুর দিকে ফিরল। তার বন্ধুও তার দিকে চাইল, এরপর তারা একত্রে ল্যাপটপের কাছে দৌড়ে গেল।

“এটা কিছু অনুবাদ করেছে”, তার বন্ধু বলে উঠল। “এটা সত্যিই কিছু একটা অনুবাদ করেছে…”

তারা নোটিফিকেশনের দিকে নিস্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারা আবার একে অপরের দিকে চেয়ে রইল এবং সে তার হাতমোজা খুলে ঠান্ডার মধ্যে কাঁপতে থাকা আঙুল দিয়ে ল্যাপটপের ‘এন্টার’ বাটনে চাপ দিল যাতে নোটিফিকেশনটা প্লে হয়।

নিঝুম নিস্তব্ধ ফিনল্যান্ডের আকাশে থাকা স্বর্গীয় আলোর নিচে ল্যাপটপে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর পড়ে যাচ্ছেঃ

“ এই আনুষ্ঠানিক গ্যালাক্টিক নোটিস ৪২৭ (বি) পাঠানো হচ্ছে গ্রহ ৯/৫২সিপি/৮১০৫ এর সচেতন জৈবিক সত্ত্বাদের কাছে তাদের স্টারওয়ে এম-৫২ এর প্রসারণ বশতঃ আগত উচ্ছেদ ও ধ্বংসকরণ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে অবগত করার জন্য যা তাদের স্পেস-টাইমের ভেতর দিয়ে যাবে। “মহাজাগতিক বাজেয়াপ্তকরণ আইন” মান্য করে উক্ত নোটিস ৪২৭/বি পাঠানো হচ্ছে যথেষ্ট সময়ের অবকাশ দিয়ে যতটুকু সময় একটি প্রজাতির প্রয়োজন বিবর্তনের মাধ্যমে উন্নত হয়ে সেই স্পেস-টাইম হইতে সরে যাওয়ার জন্য। “স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্টসম্পর্ক আইন” অনুযায়ী কোনো বহিরাগত প্রভাব উক্ত সময়ে গ্রহ এবং এর প্রজাতির ওপর আসবে না। নোটিস গুরুত্বসহকারে না নিলে গ্যালাক্টিক সরকার এবং তার এজেন্টরা কোনোরূপ ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী থাকবেন না। ”

ফ্যাকাশে, ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা মানুষ দুটোর অনেক ওপরে অরোরা বোরালিস অন্ধকার রাতের আকাশে পাঁক খেয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। এর সবুজ ও সাদা আলো আর মোহনীয় নয় বরং আরো শীতল, আরো আমলাতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞের আভাস দিচ্ছে যা মানবজাতি হয়তো কখনো কল্পনা করেনি !

(সমাপ্ত)

মূলঃ Keith McLachlan
অনুবাদঃ মনিফ শাহ চৌধুরী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম