Placebo হচ্ছে এমন এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি কিংবা ওষুধ ,যার আসলে কোনো ঔষধী গুনাগুন নেই; কিন্তু তারপরেও সেটা রোগীর উপরে কাজ করে তার রোগ ভাল করে ফেলে ।
একটা উদাহরন দেই । অনেক রাত পর্যন্তও রোগী ঘুমাতে পারছে না । নার্স এবং জুনিয়র ডাক্তার এসে তাকে কয়েক দফা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পড়ানোর চেষ্টা করছেন , কাজ হয়নি । খবর পেয়ে সিনিয়র ডাক্তার আসলেন। তিনি রোগীকে বললেন, আপনার রোগটা অনেক জটিল । সাধারন ওষুধে কাজ হবেনা । তবে সিঙ্গাপুর থেকে আনা খুব ভাল একটা ওষুধ আছে আমাদের কাছে । আপনাকে সেটা দেওয়া হবে ।
অফিস থেকে সিঙ্গাপুরের স্পেশাল ওষুধ এনে রোগীকে খাওয়ানো হল । রোগী একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল ।
প্রকৃতপক্ষে ডাক্তার যে ওষুধটা দিয়েছিলেন, সেই ট্যাবলেটে চিনির দানা ছাড়া আর কিছুই ছিল না । রোগীকে জাস্ট মেন্টালি মোটিভেট করা হয়েছে এই বলে যে, এই ওষুধে তোমার কাজ হবেই । রোগী ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করেছে । বিশ্বাস করার কারনে হাই পাওয়ারের মেডিসিন যে কাজ করতে পারেনি, নর্মাল গ্লুকোজ সেই কাজ করে ফেলেছে । এখানে এই গ্লুকোজের ট্যাবলেট এর কাজকে প্লাসিবো ইফেক্ট বলে।
আরেকটা ঘটনা বলি । এক লোক গেছেন ডাক্তার এর কাছে যে তার হাটুতে ব্যাথা।দীর্ঘদিন ধরেই নাকি এই ব্যথা তাকে ভোগাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন তার হাটুতে কোন সমস্যাই নাই। কিন্তু লোকটার মনে তীব্র বিশ্বাস ,ছোটবেলায় একদিন তিনি সাইকেল থেকে পড়ে গেছিলেন তাতেই হয়তো তার হাটুতে ইনজুরি হয়েছে। ডাক্তার সাহেব ঘটনা শুনে রোগীকে বললেন আপনার একটা ছোট অপারেশন করাতে হবে ।
নির্ধারিত দিনে রোগীকে অপারেশন রুমে নেয়া হলো । অ্যানেশথেশিয়া করা হলো । তার হাটুতে কাটা-ছেড়া করা হলো । সেলাই দিয়ে ডাক্তার হাসি মুখে বললেন আর কোন সমস্যা নাই । এরপর ঐ লোক আর কোনদিন তার হাটুতে ব্যাথা অনুভব করলেন না।
আসলে ডাক্তার কিছুই করেন নি।। শুধু রোগীর বিশ্বাসকে নাড়া দিয়ে তার আত্ববিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছেন যে তার কিছুই হয়নি ।
এই প্রক্রিয়াটার নামই হলো প্লাসিবো পদ্ধতি। এবং এই ধরনের ভুয়া অপারেশনকে বলে Sham Surgery.
শফিক রেহমানের সম্পাদনায় যায়যায়দিন নামে একটা পত্রিকা বের হত । এই পত্রিকায় বিভিন্ন ইশ্যু নিয়ে পাঠকরা গল্প লিখতেন । একবার 'মশা' সংখ্যায় এই ধরনের একটা প্লাসিবোর গল্প পেয়েছিলাম। দিনাজপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় ডাক্তারের পোস্টিং । রোগী এসে ডাক্তারকে বলেছে, তার পায়ু পথ দিয়ে অনেকগুলা মশা ঢুকে গেছে পেটের ভিতরে । সেগুলা এখন পেটের ভিতরে কামড়াচ্ছে । প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে । (যন্ত্রণায় রোগী গড়াগড়ি দিচ্ছিল)
ডাক্তার তখন শ্যাম সার্জারির ব্যবস্থা করলেন । সিরিঞ্জ,ক্যাথেটার, রাবার টিউব আনলেন । রোগীর পায়ুপথ থেকে মশা বের করার অভিনয় করলেন । পিওনকে দিয়ে বাইরে থেকে কিছু মশা মেরে নিয়ে আসলেন । তারপরে একটি পানিভর্তি গামলায় সেই মশাদের ডেডবডি রেখে রোগীকে বললেন, দেখ দেখ তোমার পেট থেকে সবগুলা মশা বের করে এনেছি । প্লাসিবো ইফেক্টে কাজ করল রোগীর উপরে। সে বলল যে তার আর কোনো পেট ব্যথা নেই ।
তবে সকল রোগের ক্ষেত্রে প্লাসিবো দিয়ে কাজ হয়না । মূলত নিউরোবায়োলজিকাল রোগ গুলা সাময়িকভাবে সারতে পারে প্লাসিবো। এই রোগগুলার মধ্যে আছে ব্যথা (পেট ব্যথা,মাথা ব্যথা,কোমর ব্যথা ইত্যাদি) , হতাশা, বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা , ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি । ক্যান্সার কিংবা জটিল সার্জারির কাজ প্লাসিবো দিয়ে কমপ্লিট করা যাবেনা কখনোই।
অনেক সময় রোগী মূল ধারার চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহন না করে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেন । ওষুধ না খেয়ে পানি পড়া,তেল পড়ার মাধ্যমে রোগ সারানোর চেষ্টা করেন । কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগী এই পানি পড়া খেয়েই সূস্থ হয়ে ওঠে । প্রকৃতপক্ষে এখানে পানি পড়ার কোনো ভূমিকা নেই । পানি পড়ার কেমিক্যাল গুনাগুন রোগ সারায়নি, রোগ সারিয়েছে প্লাসিবো ইফেক্ট । যে হুজুর পানি পড়া দিচ্ছে, রোগী সেই হুজুরকে বিশ্বাস করে বলে রোগীর উপরে তার পানিপড়ার প্লাসিবো ইফেক্ট কাজ করেছে।
কিছু কিছু ওষুধ কোম্পানি ও প্লাসিবো ইফেক্টের কথা মাথায় রেখেই ওষুধ ডিজাইন করে । গবেষনায় দেখা গেছে, কম দামী পাইন কিলারের চেয়ে বেশি দামী পেইন কিলার ভাল কাজ করে , ছোট ট্যাবলেটের চেয়ে সাইজে বড় ট্যাবলেট বেশি কাজ করে, সাদা ট্যাবলেটের চেয়ে রঙ্গিন ট্যাবলেট ভাল কাজ করে। ওষুধ কোম্পানি গুলাও এইভাবে আকর্ষনীয় করে ওষুধ বানায়।
আসুন , প্লাসিবোর ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি ।প্লাসিবো ল্যাটিন শব্দ । এর অর্থ হচ্ছে- I shall Please অথবা আমি সূস্থ হব। সম্ভবত ভন্ড সাধু সন্যাসীরা অনেক আগে থেকেই প্লাসিবোর ব্যবহার জানত । প্লাসিবো ব্যবহার করেই তারা কনফিডেন্টলি পানি পড়া তেল পড়া নিয়ে ব্যবসা করত । সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এর লালসালু উপন্যাসের কথা বলতে পারি। তিনি জানতেন যে গ্রামে কোনো পুরনো কবর নেই, তারপরেও জোর গলায় বললেন যে গ্রামের কোণায় মোদাচ্ছের পীরের মাজার রয়েছে । স্বপ্নে মোদাচ্ছের পীর আমাকে দেখা দিয়ে বলেছেন যে আমার কবর বাধাই করে এখানে মাজার বানাও । সেই কথিত স্বপ্ন অনুযায়ী মজিদ সেখানে মাজারের ব্যবসা গড়ে তুলল । গ্রামের মানুষ তাকে বিশ্বাস করা শুরু করল । দূর দুরান্তের মানুষ তাদের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে মজিদের কাছে আসত । মজিদও মাজারের উছিলায় পানি পড়া দিত, সেই পানি পড়া খেয়ে সবার হালকাপাতলা রোগ গুলা ভাল হয়ে যেত । ( তবে সিরিয়াস রোগ গুলা পানিপড়া দিয়ে মজিদ সারাতে পারতো না। যেমন- বন্ধ্যা মেয়েদের সন্তান এনে দিতে পারত না মজিদের প্লাসিবো পানিপড়া ) ।
ভন্ড ধর্মগুরুরা যখন থেকেই শুরু করুক না কেন , বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যার খোজ পেয়েছেন ১৬০০ সেঞ্চুরিতে । ওই সময় প্রচুর পজেজড (জিনের আছর হওয়া) রোগীর সন্ধান পাওয়া যেত । খৃষ্টান পুরোহিতরা বাইবেল, ক্রুস আর হোলি ওয়াটারের সাহায্যে জিনের আছর হওয়া মানুষদের দেহ থেকে শয়তান তাড়াতেন । কিছু যুক্তিবাদী লোক জিনের আছর হওয়া লোকদের সামনে ভুয়া ক্রুস, ভুয়া বাইবেল আর ভুয়া হোলি ওয়াটার এনে জিন ঝাড়া শুরু করল । দেখা গেল , রোগীদের ঘাড় থেকে জিন চলে যাচ্ছে , রোগীরা সূস্থ হয়ে যাচ্ছে ।এখান থেকে ঐ বিজ্ঞানীরা প্রমান করলেন যে ক্রুস, বাইবেল কিংবা হোলি ওয়াটার এর কোনো ভূমিকা নেই জিন তাড়ানোয় । পেচ্ছাপের পানি, অশ্লীল বই কিংবা বাকাতেড়া যে কোনো লাঠি দিয়েই যদি রোগীর মনে ইমপ্রেশন তৈরি করতে পারি, তাহলে তার ঘাড় থেকে জিন বা শয়তান চলে যাবে । ( প্রকৃতপক্ষে এই জিনের আছর বা এক্সরসিজম গুলো মূলত হিস্ট্রিয়া কিংবা সিজোফ্রেনিয়া রোগ। এ বিষয়ে পরবর্তী কোনো এক পর্বে আলোচনা করব)
১৬০০ সালের এই বিজ্ঞানীদের সাফল্যের পরে পরবর্তীতে প্লাসিবো নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে ।বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, একেক মেন্টালিটির মানুষদের উপরে প্লাসিবো একেকভাবে কাজ করে। এছাড়া একেক ধরনের মানসিক বা শারীরিক অবস্থায় ব্যক্তিবিশেষের উপরে প্লাসিবোর কম বা বেশি প্রভাব থাকতে পারে। এই ওষুধগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের ব্রেইন নিজে ধোকা খায় ,সে ভাবে যে আমাকে শক্তিশালী ওষুধ দেওয়া হয়েছে কাজেই আমি এখন সূস্থ । এই ভেবে সে শরীরে স্বাভাবিক কিছু হরমোন, এনজাইম নিঃসরন করে । ব্রেইন সূস্থ থাকলে বডিও সূস্থ হয়ে যাবে। আর ব্রেইন যেহেতু মনে করে যে সে সূস্থ, তাই কিছু ছোটখাট শারীরিক অসুখও সেরে যায় ( অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথা ব্যথা কিংবা পেট ব্যথা কিংবা অনিদ্রা পুরাটাই মানসিক রোগ। এখানে শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। ব্রেইনকে বুঝ দিতে পারলেই রোগ সেরে যাবে পুরাপুরি)। বর্তমানে পাশ্চাত্যের ডাক্তারদের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছে রোগীকে প্লাসিবো ওষুধ খাওয়ানো উচিত নাকি অনুচিত সেটা নিয়ে।
বাংলাদেশের মূলধারার ডাক্তাররা (এলোপেথিক ডাক্তার হিসেবে মানুষ যাদেরকে চিনে) খুব কম ক্ষেত্রেই প্লাসিবো প্রয়োগ করেন । অল্প কিছু ক্ষেত্রে কিছু সিনিয়র ডাক্তার রোগীকে সাময়িকভাবে শান্ত করার জন্য চিনির ট্যাবলেট কিংবা স্যালাইন ইঞ্জেকশন দিয়ে থাকেন ।
তবে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যে ডাক্তাররা চিকিৎসা করেন
( হোমিওপ্যাথি, ইউনানী,রেইকি, আকুপাংচার, হিজামা, রুকাইয়া, মেডিটেশন, পানি পড়া ইত্যাদি) তাদের পুরা চিকিৎসা পদ্ধতিই কমবেশি প্লাসিবো পদ্ধতিতে চলে । এই কারনে তারা রোগীদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা পারিবারিবারিক/ সামাজিক গল্প গুজব করার দিকে খুব বেশি মনোযোগী হন। অনেক সময় এই ডাক্তাররা পেশাগত পরিচয় ছাড়াও ধর্মীয় কিংবা অন্য কোনো সম্মানসূচক পরিচয় নেওয়ার চেষ্টা করেন (কারন প্লাসিবোতে, রোগীর সাথে ডাক্তারের সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডাক্তারের প্রতি রোগীর আস্থা থাকলে প্লাসিবো ওষুধে কাজ করবে । আর বিশ্বাস না থাকলে সেই ওষুধগুলা ব্যক ফায়ার করতে পারে , অর্থাৎ রোগ আরো বাড়তে পারে। রোগ বাড়ার এই ঘটনাকে বলে Nocebo Effect)
প্লাসিবো সম্পর্কে সচেতন হোন । অভিজ্ঞ ডাক্তারের দেওয়া প্লাসিবো কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর উপকারে আসতে পারে, কিন্তু টাকা পয়সা খরচ করে সত্যিকার চিকিৎসা না নিয়ে প্লাসিবোর মাধ্যমে দিনের পর দিন চিকিৎসা চালানো কোনো উপকারে আসবে না ।
তথ্যসূত্র-
https:// en.wikipedia.org /wiki/ Placebo#List_of_ medical_conditi ons
https:// en.wikipedia.org /wiki/Nocebo
http:// archive.prothom- alo.com/detail/ date/2009-11-04/ news/17149
http:// www.bigganprojuk ti.com/ বিজ্ঞানের-অমীমাং সিত-রহস্/
http:// www.somewhereinb log.net/blog/ nirbasitonirbak/ 30091840
http:// losetogainbd.com /2017/09/20/ placebo
একটা উদাহরন দেই । অনেক রাত পর্যন্তও রোগী ঘুমাতে পারছে না । নার্স এবং জুনিয়র ডাক্তার এসে তাকে কয়েক দফা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পড়ানোর চেষ্টা করছেন , কাজ হয়নি । খবর পেয়ে সিনিয়র ডাক্তার আসলেন। তিনি রোগীকে বললেন, আপনার রোগটা অনেক জটিল । সাধারন ওষুধে কাজ হবেনা । তবে সিঙ্গাপুর থেকে আনা খুব ভাল একটা ওষুধ আছে আমাদের কাছে । আপনাকে সেটা দেওয়া হবে ।
অফিস থেকে সিঙ্গাপুরের স্পেশাল ওষুধ এনে রোগীকে খাওয়ানো হল । রোগী একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল ।
প্রকৃতপক্ষে ডাক্তার যে ওষুধটা দিয়েছিলেন, সেই ট্যাবলেটে চিনির দানা ছাড়া আর কিছুই ছিল না । রোগীকে জাস্ট মেন্টালি মোটিভেট করা হয়েছে এই বলে যে, এই ওষুধে তোমার কাজ হবেই । রোগী ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করেছে । বিশ্বাস করার কারনে হাই পাওয়ারের মেডিসিন যে কাজ করতে পারেনি, নর্মাল গ্লুকোজ সেই কাজ করে ফেলেছে । এখানে এই গ্লুকোজের ট্যাবলেট এর কাজকে প্লাসিবো ইফেক্ট বলে।
আরেকটা ঘটনা বলি । এক লোক গেছেন ডাক্তার এর কাছে যে তার হাটুতে ব্যাথা।দীর্ঘদিন
নির্ধারিত দিনে রোগীকে অপারেশন রুমে নেয়া হলো । অ্যানেশথেশিয়া করা হলো । তার হাটুতে কাটা-ছেড়া করা হলো । সেলাই দিয়ে ডাক্তার হাসি মুখে বললেন আর কোন সমস্যা নাই । এরপর ঐ লোক আর কোনদিন তার হাটুতে ব্যাথা অনুভব করলেন না।
আসলে ডাক্তার কিছুই করেন নি।। শুধু রোগীর বিশ্বাসকে নাড়া দিয়ে তার আত্ববিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছেন যে তার কিছুই হয়নি ।
এই প্রক্রিয়াটার নামই হলো প্লাসিবো পদ্ধতি। এবং এই ধরনের ভুয়া অপারেশনকে বলে Sham Surgery.
শফিক রেহমানের সম্পাদনায় যায়যায়দিন নামে একটা পত্রিকা বের হত । এই পত্রিকায় বিভিন্ন ইশ্যু নিয়ে পাঠকরা গল্প লিখতেন । একবার 'মশা' সংখ্যায় এই ধরনের একটা প্লাসিবোর গল্প পেয়েছিলাম। দিনাজপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় ডাক্তারের পোস্টিং । রোগী এসে ডাক্তারকে বলেছে, তার পায়ু পথ দিয়ে অনেকগুলা মশা ঢুকে গেছে পেটের ভিতরে । সেগুলা এখন পেটের ভিতরে কামড়াচ্ছে । প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে । (যন্ত্রণায় রোগী গড়াগড়ি দিচ্ছিল)
ডাক্তার তখন শ্যাম সার্জারির ব্যবস্থা করলেন । সিরিঞ্জ,ক্যাথেটার, রাবার টিউব আনলেন । রোগীর পায়ুপথ থেকে মশা বের করার অভিনয় করলেন । পিওনকে দিয়ে বাইরে থেকে কিছু মশা মেরে নিয়ে আসলেন । তারপরে একটি পানিভর্তি গামলায় সেই মশাদের ডেডবডি রেখে রোগীকে বললেন, দেখ দেখ তোমার পেট থেকে সবগুলা মশা বের করে এনেছি । প্লাসিবো ইফেক্টে কাজ করল রোগীর উপরে। সে বলল যে তার আর কোনো পেট ব্যথা নেই ।
তবে সকল রোগের ক্ষেত্রে প্লাসিবো দিয়ে কাজ হয়না । মূলত নিউরোবায়োলজিকাল
অনেক সময় রোগী মূল ধারার চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহন না করে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেন । ওষুধ না খেয়ে পানি পড়া,তেল পড়ার মাধ্যমে রোগ সারানোর চেষ্টা করেন । কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগী এই পানি পড়া খেয়েই সূস্থ হয়ে ওঠে । প্রকৃতপক্ষে এখানে পানি পড়ার কোনো ভূমিকা নেই । পানি পড়ার কেমিক্যাল গুনাগুন রোগ সারায়নি, রোগ সারিয়েছে প্লাসিবো ইফেক্ট । যে হুজুর পানি পড়া দিচ্ছে, রোগী সেই হুজুরকে বিশ্বাস করে বলে রোগীর উপরে তার পানিপড়ার প্লাসিবো ইফেক্ট কাজ করেছে।
কিছু কিছু ওষুধ কোম্পানি ও প্লাসিবো ইফেক্টের কথা মাথায় রেখেই ওষুধ ডিজাইন করে । গবেষনায় দেখা গেছে, কম দামী পাইন কিলারের চেয়ে বেশি দামী পেইন কিলার ভাল কাজ করে , ছোট ট্যাবলেটের চেয়ে সাইজে বড় ট্যাবলেট বেশি কাজ করে, সাদা ট্যাবলেটের চেয়ে রঙ্গিন ট্যাবলেট ভাল কাজ করে। ওষুধ কোম্পানি গুলাও এইভাবে আকর্ষনীয় করে ওষুধ বানায়।
আসুন , প্লাসিবোর ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি ।প্লাসিবো ল্যাটিন শব্দ । এর অর্থ হচ্ছে- I shall Please অথবা আমি সূস্থ হব। সম্ভবত ভন্ড সাধু সন্যাসীরা অনেক আগে থেকেই প্লাসিবোর ব্যবহার জানত । প্লাসিবো ব্যবহার করেই তারা কনফিডেন্টলি পানি পড়া তেল পড়া নিয়ে ব্যবসা করত । সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এর লালসালু উপন্যাসের কথা বলতে পারি। তিনি জানতেন যে গ্রামে কোনো পুরনো কবর নেই, তারপরেও জোর গলায় বললেন যে গ্রামের কোণায় মোদাচ্ছের পীরের মাজার রয়েছে । স্বপ্নে মোদাচ্ছের পীর আমাকে দেখা দিয়ে বলেছেন যে আমার কবর বাধাই করে এখানে মাজার বানাও । সেই কথিত স্বপ্ন অনুযায়ী মজিদ সেখানে মাজারের ব্যবসা গড়ে তুলল । গ্রামের মানুষ তাকে বিশ্বাস করা শুরু করল । দূর দুরান্তের মানুষ তাদের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে মজিদের কাছে আসত । মজিদও মাজারের উছিলায় পানি পড়া দিত, সেই পানি পড়া খেয়ে সবার হালকাপাতলা রোগ গুলা ভাল হয়ে যেত । ( তবে সিরিয়াস রোগ গুলা পানিপড়া দিয়ে মজিদ সারাতে পারতো না। যেমন- বন্ধ্যা মেয়েদের সন্তান এনে দিতে পারত না মজিদের প্লাসিবো পানিপড়া ) ।
ভন্ড ধর্মগুরুরা যখন থেকেই শুরু করুক না কেন , বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যার খোজ পেয়েছেন ১৬০০ সেঞ্চুরিতে । ওই সময় প্রচুর পজেজড (জিনের আছর হওয়া) রোগীর সন্ধান পাওয়া যেত । খৃষ্টান পুরোহিতরা বাইবেল, ক্রুস আর হোলি ওয়াটারের সাহায্যে জিনের আছর হওয়া মানুষদের দেহ থেকে শয়তান তাড়াতেন । কিছু যুক্তিবাদী লোক জিনের আছর হওয়া লোকদের সামনে ভুয়া ক্রুস, ভুয়া বাইবেল আর ভুয়া হোলি ওয়াটার এনে জিন ঝাড়া শুরু করল । দেখা গেল , রোগীদের ঘাড় থেকে জিন চলে যাচ্ছে , রোগীরা সূস্থ হয়ে যাচ্ছে ।এখান থেকে ঐ বিজ্ঞানীরা প্রমান করলেন যে ক্রুস, বাইবেল কিংবা হোলি ওয়াটার এর কোনো ভূমিকা নেই জিন তাড়ানোয় । পেচ্ছাপের পানি, অশ্লীল বই কিংবা বাকাতেড়া যে কোনো লাঠি দিয়েই যদি রোগীর মনে ইমপ্রেশন তৈরি করতে পারি, তাহলে তার ঘাড় থেকে জিন বা শয়তান চলে যাবে । ( প্রকৃতপক্ষে এই জিনের আছর বা এক্সরসিজম গুলো মূলত হিস্ট্রিয়া কিংবা সিজোফ্রেনিয়া রোগ। এ বিষয়ে পরবর্তী কোনো এক পর্বে আলোচনা করব)
১৬০০ সালের এই বিজ্ঞানীদের সাফল্যের পরে পরবর্তীতে প্লাসিবো নিয়ে অনেক গবেষনা হয়েছে ।বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, একেক মেন্টালিটির মানুষদের উপরে প্লাসিবো একেকভাবে কাজ করে। এছাড়া একেক ধরনের মানসিক বা শারীরিক অবস্থায় ব্যক্তিবিশেষের উপরে প্লাসিবোর কম বা বেশি প্রভাব থাকতে পারে। এই ওষুধগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের ব্রেইন নিজে ধোকা খায় ,সে ভাবে যে আমাকে শক্তিশালী ওষুধ দেওয়া হয়েছে কাজেই আমি এখন সূস্থ । এই ভেবে সে শরীরে স্বাভাবিক কিছু হরমোন, এনজাইম নিঃসরন করে । ব্রেইন সূস্থ থাকলে বডিও সূস্থ হয়ে যাবে। আর ব্রেইন যেহেতু মনে করে যে সে সূস্থ, তাই কিছু ছোটখাট শারীরিক অসুখও সেরে যায় ( অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথা ব্যথা কিংবা পেট ব্যথা কিংবা অনিদ্রা পুরাটাই মানসিক রোগ। এখানে শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। ব্রেইনকে বুঝ দিতে পারলেই রোগ সেরে যাবে পুরাপুরি)। বর্তমানে পাশ্চাত্যের ডাক্তারদের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছে রোগীকে প্লাসিবো ওষুধ খাওয়ানো উচিত নাকি অনুচিত সেটা নিয়ে।
বাংলাদেশের মূলধারার ডাক্তাররা (এলোপেথিক ডাক্তার হিসেবে মানুষ যাদেরকে চিনে) খুব কম ক্ষেত্রেই প্লাসিবো প্রয়োগ করেন । অল্প কিছু ক্ষেত্রে কিছু সিনিয়র ডাক্তার রোগীকে সাময়িকভাবে শান্ত করার জন্য চিনির ট্যাবলেট কিংবা স্যালাইন ইঞ্জেকশন দিয়ে থাকেন ।
তবে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যে ডাক্তাররা চিকিৎসা করেন
( হোমিওপ্যাথি, ইউনানী,রেইকি, আকুপাংচার, হিজামা, রুকাইয়া, মেডিটেশন, পানি পড়া ইত্যাদি) তাদের পুরা চিকিৎসা পদ্ধতিই কমবেশি প্লাসিবো পদ্ধতিতে চলে । এই কারনে তারা রোগীদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা পারিবারিবারিক/
প্লাসিবো সম্পর্কে সচেতন হোন । অভিজ্ঞ ডাক্তারের দেওয়া প্লাসিবো কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর উপকারে আসতে পারে, কিন্তু টাকা পয়সা খরচ করে সত্যিকার চিকিৎসা না নিয়ে প্লাসিবোর মাধ্যমে দিনের পর দিন চিকিৎসা চালানো কোনো উপকারে আসবে না ।
তথ্যসূত্র-
https://
https://
http://
http://
http://
http://
Writer: Abu Rayhan