রিলেটিভিটির রিলেটিভ

রিলেটিভিটি


(এক)
“একটা টাইম মেশিন বানাবো ভাবছি!”, হঠাৎ পদার্থবিদ জ্যাকি তার এসিস্ট্যান্ট ডেরিক কে এই প্রস্তাব দিলো। ম্যাঞ্জিল প্রদেশের ছোট্ট একটা শহর জ্যানিথে অবস্থিত পদার্থবিজ্ঞানেরঅন্যতম বিখ্যাত গবেষণাগার PhCh-003। এই বছরের প্রথম দিকেই প্রফেসর জ্যাকির মুখে টাইম মেশিনের কথা শুনে একটু আগ্রহী হলেন এসিস্ট্যান্ট ডেরিক। তিনি বললেন,“প্রফেসর,টাইম মেশিন নিয়ে তো অনেক গবেষণা হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তেমন কিছুই আবিষ্কার করতে পারে নাই যেটা দিয়ে সময়ের বেগ বাড়িয়ে আমরা ভবিষ্যতে যেতে পারি! প্রফেসর জ্যাকি তখন ডেরিকের উদ্দেশ্যে স্যার আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র কে উদ্দেশ্য করে বললেন,“এখানে দেখো!”

ডেরিক আপেক্ষিকতার সূত্রটা একবার পড়তে না পড়তেই জ্যাকি নিজের চিন্তা বললেন ডেরিককে। প্রফেসরের ভাষায়,“ ইউনিভার্সের প্রত্যেকটা জিনিস একটা ধ্রুব বেগ নিয়ে নিজেদের অক্ষে কিংবা নিজেদের থেকে তুলনামূলক বড় কোনো সত্তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাহলে আমরা যদি রিলেটিভিটি অনুযায়ী বেগের সাপেক্ষে সময়ের গতিকে সংখ্যা রেখার শূন্য বিন্দুতে স্থাপন করি,তাহলে কিন্তু সময়ের বেগ দুইদিকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।একটা ধনাত্মক দিক আরেকটা ঋণাত্বক দিক!”। প্রফেসর জ্যাকির কথা গুলো ডেরিকের একপ্রকার মাথার উপর দিয়েই যাচ্ছে।কিন্তু ডেরিক প্রাণপনে চেষ্টা করে বিষয়টা বুঝে নিল। প্রফেসরের কথায় ডেরিক সম্মতি দিয়ে আলোচনার বাকি অংশের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করলো। প্রফেসর তার আলোচনা আবার শুরু করলো,“ এখন যদি আমরা ভবিষ্যতে যেতে চাই তাহলে সময়ের বেগকে সংখ্যা রেখায় ধনাত্মক দিকে বাড়াতে হবে। আর রিলেটিভিটি অনুযায়ী, এটার জন্য আমাদের বেগকে কমাতে হবে! স্যার স্টিফেন হকিংয়ের মতে,কোনো ট্রেনের বেগকে যদি যথেষ্ট বাড়িয়ে আলোর বেগের কাছাকাছি নেওয়া হয় তাহলে ট্রেনের সাপেক্ষে আমরা স্থির এবং এই অবস্থায় আমাদের অতিক্রান্ত 7 দিনের সাপেক্ষে পৃথিবীতে 65 বছর অতিক্রান্ত হবে! এইতো হয়ে গেলো আমাদের ভবিষ্যতে যাওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার!”

“কিন্তু আমাদের বেগ তো শূন্য।তাহলে কি আপনি ঋণাত্মক বেগের কথা বলছেন প্রফেসর?”বললেন ডেরিক। উত্তরে প্রফেসর বললো,“একদম Equus asinus এর মত একটা কথা বললে! এখানেই তো আমাদের চিন্তাটা কাজ করবে। পৃথিবীর সাপেক্ষে আমরা স্থির,কিন্তু পৃথিবী তো সূর্যের সাপেক্ষে গতিশীল। তাহলে বলতে পারো, আমরাও সূর্যের সাপেক্ষে গতিশীল এবং পৃথিবীর বেগের সমান গতিতে সূর্যকে আবর্তন করতেছি!”। “তাহলে প্রফেসর আপনি কি সূর্যের সাপেক্ষে আমাদের বেগ হ্রাস করে সময়ের বেগ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করেছেন?”ডেরিকের এই প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর জ্যাকি একপ্রকার উৎফুল্লতার সাথেই বললেন,“এক্সাক্টলি, এইতো বুঝতে পেরেছ!” । “কিন্তু সূর্যের সাপেক্ষে আমাদের বেগকে কমানো মানে তো পৃথিবীর বেগকে কমানো! তাহলে কি আপনার পরিকল্পনা পৃথিবীকেই সূর্যের সাপেক্ষে স্থির করে দেওয়া?”
প্রফেসরের আগের কথাটার একপ্রকার ব্যঙ্গ করেই ডেরিক এই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন! কিন্তু ডেরিক চিন্তাও করতে পারে নাই যে তার প্রফেসর ঠিক এমন কিছু একটাই পরিকল্পনা করেছেন। ডেরিকের প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর বললেন,“হ্যা! হ্যা! হ্যা!,আমি সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীর গতি সামান্য কমিয়ে দিবো।তাহলে টাইম ডায়ালেশনের থিওরী অনুসারে এই মহাবিশ্বের সাপেক্ষে আমাদের বেগ হ্রাস পাবে আর আমাদের সাপেক্ষে সময়ের বেগ সামান্য হলেও বৃদ্ধি পাবে!”

রিলেটিভিটির এই সাধারণ ধারণা থেকেই সেদিন PhCh-003 পদার্থবিজ্ঞান ল্যাবে শুরু হলো পৃথিবীর গতিকে সূর্যের সাপেক্ষে তুলনামূলক কম করার পরিকল্পনা! সত্যি কি পৃথিবীর বেগকে সূর্যের সাপেক্ষে কমায় দিয়ে জ্যাকি আর ডেরিকের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব? রিলেটিভিটির এই সাধারণ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে এবার কি সত্যি মানুষ পৌঁছে যাবে ভবিষ্যতে?

(দুই)

পৃথিবীর বেগকে সূর্যের সাপেক্ষে একটু কমানোর জন্য চিন্তা শুরু করলো প্রফেসর জ্যাকি আর সহকারী ডেরিক। গবেষণার বিষয় টা খুবই চমৎকার লেগেছে ডেরিকের কাছে। সাধারণ রিলেটিভিটি নিয়ে এমন চিন্তা আগে কেউ করেছে বলে তেমন কোনো খবর নেই। 
প্রফেসর জ্যাকির মাথায় হঠাৎ একটা কথা চলে আসলো! “আচ্ছা ডেরিক,পৃথিবী তো সূর্যের সাপেক্ষে ঘুরছে মহাকর্ষীয় বল আর নিজের অক্ষে আবর্তন কালীন গতিপথের লদ্ধি বরাবর। তাহলে যদি পৃথিবীকে ঘুর্নায়মান থাকাকালীন গতিপথের বিপরীত দিক থেকে কেউ টেনে ধরে, তাহলে তো বেগ কমানো সম্ভব,তাই না?” প্রফেসরের এই কথা শুনে ডেরিকের সেই ছোট্ট বেলার ধরাধরি খেলার কথা মনে পড়লো। একজন সামনে দিকে দৌড় দিবে আর পেছন থেকে আরেকজন টেনে ধরে তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে! কিন্তু প্রস্তাবটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না। ডেরিক আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলো,“কিভাবে প্রফেসর আপনি পৃথিবীকে গতির বিপরীতে টেনে ধরবেন? ” । “কেনো! আমাদের কাছে তো অস্ত্র আছে!”, প্রফেসরের এই কথা শুনে ডেরিক আতঙ্কিত হয়ে বললো,“অস্ত্র?”। উত্তরের প্রফেসর বললেন,“তুমি বেশি গভীর গবেষণা করতে গিয়ে বাচ্চা কালের হিসাব কি সব ভুলে গেছো? চার্জ দিয়ে একটা খুব সুন্দর হাইপোথিসিস আছে,সেটা মনে আছে?”। ডেরিক বললো,“ পৃথিবী আর চাঁদের 45 কোটি বছরের সম্পর্ক ভাঙার হাইপোথিসিসের কথা বলছেন প্রফেসর?” উত্তর আসলো, “জ্বী হ্যা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বিজ্ঞানী ডেরিক! তুমি যদি চাঁদ আর পৃথিবীতে সমান ভাগ করে মোট 324kg electron রাখতে পারো,তাহলে সেই ইলেক্ট্রনের মধ্যকার বিকর্ষণ বলের জন্য পৃথিবী আর চাঁদের আকর্ষণ বল নষ্ট হয়ে চাঁদকে বাধ্য হয়ে পৃথিবীকে ছেড়ে মহাকাশে হারিয়ে যেতে হবে!”। “কিন্তু এইটা দিয়ে আপনি পৃথিবীর গতি কিভাবে কমাবেন?”,আগ্রহী ডেরিকের আরো একটি আগ্রহী প্রশ্নের মুখোমুখি প্রফেসর জ্যাকি। কিন্তু যতই হোক প্রফেসর বলে কথা! প্রায় সব গুলো প্রশ্নের একটা না একটা উত্তর ঠিক বের করেই দিবে! 

ডেরিকের প্রশ্নের উত্তরে প্রফেসর বললেন,“ মনে করো পৃথিবী তার কক্ষপথে গতিশীল অবস্থায় X থেকে Y এর দিকে যাচ্ছে। তাহলে পৃথিবীর চলার পথ হলো ( X -> Y ) । এবার পরিকল্পনা অনুসারে ঠিক করতে হবে আমি পৃথিবীর বেগ কতটা কমাতে চাই। তারপরে সেই মন্দণ থেকে F=ma দিয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় বল বের করবো। তাহলে বিষয়টা বলা যায়, পৃথিবীর বেগকে a m/s থেকে b m/s এ নামাতে আমাদের বল প্রয়োগ করতে হবে Q N । এবার কুলম্ব বলের সূত্র দিয়ে বের করা যাবে এই Q N বিকর্ষণ বলের জন্য কি পরিমান ইলেক্ট্রন লাগবে! তারপরে পৃথিবীতে আর মহাকাশের অন্য কোনো গ্রহ,স্যাটেলাইট কিংবা অন্য কোনো উপায়ে চার্জ গুলো স্থাপন করতে পারলেই পৃথিবীর বেগ আমাদের হিসাব অনুযায়ী (a-b)m/s কমে যাবে। ডেরিক বিষয়টা বুঝতে একটু সময় নিলো। বিষয়টা বুঝে নিতেই তাৎক্ষণিক তার মাথায় একটা প্রশ্ন আসলো! “প্রফেসর! পেছন থেকে টেনে ধরতে তো আকর্ষণ বলের প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখানে যদি দুই জায়গায় ইলেক্ট্রন রাখেন তাহলে তো বিকর্ষণ বল কাজ করবে!”। প্রশ্ন টা শুনে এবার জ্যাকি হেসেই ফেললেন! হাসতে হাসতে বললেন,“তোমাকে নিয়ে আর পারা যাবে না ডেরিক,তুমি আবার থিওরীটিক্যাল পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করো! তোমার মাথায় এইটা খেয়াল হলো না যে ইলেকট্রনের ভর প্রোটনের 1800 ভাগের এক ভাগ! তাহলে মনে করো আমরা জানতে পারলাম (a-b)m/s পরিমাণ বেগ কমাতে আমাদের প্রয়োজনীয় বল দিতে পারে 300kg electron । তাহলে এবার পৃথিবীতে 150kg রাখতে হবে।আর 150kg খুব বুদ্ধি করে মহাবিশ্বে স্থাপন করতে হবে।” ডেরিক বললেন,“ বুদ্ধি করে কেনো?” উত্তরে প্রফেসর,“ আমি X থেকে Y এর কথা বলেছিলাম,মনে আছে?” ডেরিক ইতিবাচক উত্তর দিয়ে বাকিটা শুনতে আগ্রহী হলো! 
প্রফেসর পুনরায় বলতে শুরু করলেন,“তোমার সন্দেহের অবসান ঘটাতে আমার কাছে তিনটা পদক্ষেপ আছে। তবে এই তিনটা আলাদা পদ্ধতির ফল কিন্তু একেবারে একই। এদের ভাগ করা হয়েছে তোমার পরিবহন ক্ষমতার উপরে ভিত্তি করে!

(ক) যদি এই project complete করার জন্য তোমার কাছে প্রয়োজনের সীমিত পরিবহন ক্ষমতা থাকে তাহলে তুমি 150কেজি ইলেক্ট্রন Y এর দিকে মহাবিশ্বে স্থাপন করে ঠিক সেই চার্জের বিপরীতে ভূপৃষ্ঠে 150 কেজি ইলেকট্রনের স্থাপন করবে।তাহলে পৃথিবীকে তার গতিপথের বিপরীত থেকে বিকর্ষণ বল মোকাবেলা করতে গতি কমাতেই হবে। এখানে তোমাকে মোট 300 কেজি ভর নিয়ে কাজ করতে হবে।

(খ) যদি তোমার কাছে প্রয়োজনের বেশি পরিবহন ক্ষমতা থাকে তাহলে তুমি 150কেজি ইলেক্ট্রন X এর দিকে মহাবিশ্বে স্থাপন করে ঠিক সেই চার্জের বিপরীতে ভূপৃষ্ঠে 150 কেজি ইলেকট্রনের সমচার্জের প্রোটন অর্থাৎ (150 × 1800)কেজি প্রোটন বা 270000কেজি প্রোটন স্থাপন করবে। এখানে তোমাকে মোট 270150 কেজি ভর নিয়ে কাজ করতে হবে।

(গ) যদি এই project complete করার জন্য তোমার কাছে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পরিবহন ক্ষমতা থাকে তাহলে তুমি 270000 কেজি প্রোটন Y এর দিকে মহাবিশ্বে স্থাপন করে ঠিক সেই চার্জের বিপরীতে ভূপৃষ্ঠে 270000 কেজি প্রোটন স্থাপন করবে। তাহলে পৃথিবীকে তার গতিপথের বিপরীত থেকে বিকর্ষণ বল মোকাবেলা করতে গতি কমাতেই হবে। এখানে তোমাকে মোট 540000 কেজি ভর নিয়ে কাজ করতে হবে।

আমি তোমাকে তিনটা উপায় বললাম। এখন তোমাকে বিবেচনায় বলো কোনটা কার্যকরী এবং উপযোগী?”ডেরিক উত্তরে বললো,
“অবশ্যই ক!”।“এইতো আজকে সারাদিনে একবার হলেও বুদ্ধিমানের মত কথা বললে! যাক,এভাবেই তুমি তোমার বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু করতে পারো!”

তাহলে পৃথিবীর গতিকে তুলনা মূলক কমানোর জন্য ম্যাঞ্জিল প্রদেশের ছোট্ট একটা শহর জ্যানিথে অবস্থিত পদার্থবিজ্ঞানেরঅন্যতম বিখ্যাত গবেষণাগার PhCh-003 তে প্রফেসর জ্যাকি এবং সহকারী ডেরিকের গবেষণা টা যৌক্তিক হলেও বাস্তবে এটা কাজ করবে তো? 

(তিন)
“প্রফেসর,আপনার থিয়রিটিক্যাল ব্যাখ্যা তো একদম সঠিক,সেটা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নাই। আপনি চার্জের আকর্ষণ- বিকর্ষণ কে ব্যবহার করে পৃথিবীর গতিকে কমাতে পারেন।কিন্তু,এটার তো অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে!”, প্রফেসরের প্রস্তাব শোনার পরে ডেরিকের মতামত। “ প্রতিবন্ধকতা? কিসের কথা বলছো তুমি?”,প্রফেসর একটু কড়া ভাষায় বললেন।

ডেরিক বললো,“এই পুরো বিশ্ব ভূমন্ডলের সকল কিছুই একে অপরের সাপেক্ষে ধ্রুব বেগে চলছে। আপনি যদি পৃথিবীর বেগ সামান্য পরিমাণ কম করেন তাহলেই কিন্তু এই স্থিতিশীল অবস্থা ব্রেক করে একটা ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে। পৃথিবী কে কেন্দ্র করে চাঁদ ঘুরছে,কিন্তু পৃথিবীর বেগ কমে গেলে চাঁদের প্রদক্ষিণ বেগ ভারসাম্য হারাবে,পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিন কাল বৃদ্ধি পাবে। ফলে সৌরবছরের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাবে।সময় ব্যবস্থাপনা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। জোয়ার ভাটার ভারসাম্য নষ্ট হবে। এমনকি পৃথিবীর গতিশক্তি কমে গেলে লদ্ধি বলের কার্যকারিতা হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে পৃথিবী কক্ষপথে চলনের দিক পরিবর্তন করতে পারে, ফলে পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকেও ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এককথায় বলতে গেলে মহাপ্রলয় আসবে প্রফেসর! মহাপ্রলয়!”
“কথাটা তুমি খারাপ বলো নাই ডেরিক। ভবিষ্যতে যাওয়ার জন্য তো আমরা বর্তমান কে ধ্বংস করতে পারিনা। চার্জ দিয়ে আমাদের পৃথিবীর গতি কমানোর পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত। তোমার কি অন্য কোনো চিন্তা আছে?” প্রফেসর এই বলে ডেরিকের কথাটায় সম্মতি দিলেন।

“আমি একটা চিন্তা করেছি।”,ডেরিক বললো।
প্রফেসর আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন,“কি চিন্তা করেছ তুমি ডেরিক?”। বেশ আগ্রহ নিয়েই ডেরিক বলতে শুরু করলো,“ প্রফেসর, মনে করেন আপনি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে 100m/s বেগে যাচ্ছেন আর আমি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে 50m/s বেগে যাচ্ছি।এবার আমাদের সংঘর্ষ হলো। তাহলে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সাপেক্ষে আপনার আর আমার চূড়ান্ত বেগ কত হবে?” প্রফেসর একটু হিসাব করে বললেন,
“যেহেতু আমরা পরস্পরের সাপেক্ষে বিপরীত দিকে গতিশীল,তাহলে একজনের বেগকে ধনাত্মক,আরেকজনের বেগকে ঋণাত্মক ধরে কাজ করতে হবে। এখানে তুমি সাধারণ ভরবেগের সূত্র ব্যবহার করো।যদি তোমার আর আমার ভর একই হয় তাহলে আমাদের চূড়ান্ত বেগ হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে 50m/s!” 
“তাহলে এমন কি বলা যায় আমাদের দিক বিপরীত হওয়ায় বেগের লব্ধিই আমাদের চূড়ান্ত বেগ?”,ডেরিকের এই প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর বললেন,“বলতেই পারো।” 

“আরেকটা ক্ষেত্র চিন্তা করুন। ভরবেগের সূত্র তো আপনার আর আমার সাপেক্ষে হিসাব করেছি। যদি আমাদের পরীক্ষাটা একটা জিনিসের সাপেক্ষে করি তাহলে?”ডেরিক নিজের চিন্তার বর্ণনা এভাবেই শুরু করলো। “তুমি কিরকম ভাবে করতে চাচ্ছ?” প্রফেসর আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ডেরিক বলতে শুরু করলো,“ মনে করেন একটা 3×10⁴ m/s বেগে চলমান কোনো ট্রেনে আপনি ভ্রমণ করছেন পশ্চিম থেকে পূর্ব নির্ধারিত”।
ডেরিকের আলোচনার মাঝখানে হঠাৎ বাধা দিয়ে প্রফেসর বললেন,“দাড়াও! দাড়াও!কত বেগ বললে? 3×10⁴ m/s! এটা খুবই চেনা চেনা লাগছে!”। “ঠিক বলেছেন প্রফেসর!এটা খুবই পরিচিত বেগ!” উত্তর দিয়েই ডেরিক পুনরায় বলতে শুরু করলো, “আপনার ট্রেনের দৈর্ঘ্য অসীম। আপনার কাছে একটা বন্দুক আর কিছু গুলি আছে। তাহলে বাইরের কোনো একজনের সাপেক্ষে আপনার বেগ 3×10⁴ m/s। আপনার কাছে থাকা বন্দুক আর গুলির বেগও কিন্তু তার সাপেক্ষে 3×10⁴ m/s। এখন আপনি ট্রেনের ভেতরেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থাৎ ট্রেনের চলনের বিপরীত দিকে 3×10⁴ m/s বেগে গুলী ছুড়লেন। তাহলে বাইরের সেই ব্যক্তির সাপেক্ষে গুলির বেগ কত হবে প্রফেসর?”। “যদি দিক বিপরীত হয় তাহলে তো চূড়ান্ত বেগ হবে বিয়োগফলের সমান। অর্থাৎ তোমার বাইরের লোকটার সাপেক্ষে গুলির বেগ 0 m/s! তুমি কি এটাই বলতে চাচ্ছ?” প্রফেসর উত্তর দিলেন। সহকারী ডেরিক অনেকটা উৎফুল্লতার সাথেই বললেন,“হ্যা প্রফেসর!”। “কিন্তু এটার সাথে আমাদের টাইম মেশিনের সম্পর্ক কি?”,প্রফেসর নিজের প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন।
“আমার এই ব্যাখ্যাটা তে শুধু ট্রেনকে পৃথিবী, গুলিকে পৃথিবীর বাসিন্দা আর বাইরের লোকটাকে সূর্য ধরেন। আপনি উত্তর পাবেন!”

এই উত্তর শুনে প্রফেসর বললেন,“ মানে তুমি বলতে চাচ্ছ পৃথিবী নিজ অক্ষের উপরে সূর্যের সাপেক্ষে পশ্চিম থেকে পূর্বে 3×10⁴ m/s বেগে গতিশীল। পৃথিবীর বাসিন্দা হিসাবে আমাদের বেগও সূর্যের সাপেক্ষে পশ্চিম থেকে পূর্বে 3×10⁴ m/s! আর তুমি এমন একটা যন্ত্র বা বাহন বানাতে চাচ্ছ যেটা পৃথিবীর প্রদক্ষিণের বিপরীত দিকে মানে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে 3×10⁴ m/s বেগে চলতে পারবে। তাহলে সূর্যের সাপেক্ষে আমাদের বেগ হবে 0m/s!, তাইতো?”

প্রফেসরের কথার উত্তরে ডেরিক বললো,“ জ্বী প্রফেসর! আপনি বলেছেন আমাদের স্বাভাবিক বেগ সংখ্যা রেখায় শূন্য বিন্দু হলে টাইম ডায়ালেশন করতে হলে বেগকে ঋণাত্মক দিকে নিতে হবে। আমার পরিকল্পিত এই বাহন যদি 3×10⁴ m/s বেগে চলে তাহলে সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীর বেগ হবে 3×10⁴ m/s কিন্তু আমাদের বেগ হবে 0 m/s! এই পরিকল্পনায় কিন্তু আমাদের বেগকে সংখ্যা রেখায় ঋণাত্মক দিকে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,তাহলে রিলেটিভিটি অনুসারে সময়ের বেগ কিন্তু ধনাত্মক দিকে তুলনামূলক বৃদ্ধি পাবে প্রফেসর!” । “কিন্তু তুমি কি 3×10⁴ m/s বেগের কোনো বাহন ডিজাইন করতে পারবে?”, প্রফেসরের এই প্রশ্নের উত্তরে ডেরীক বললো,“স্যার স্টিফেন হকিং তো আলোর বেগে চলমান ট্রেনের সাপেক্ষে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন,আমি তো সেখানে আলোর বেগের 10% দিয়ে কাজ করতেছি,আর আমি 3×10⁴ m/s বেগ হিসাব না করে 3×10³ m/s হিসাব করি! এর ফলে অবশ্য আমাদের টাইম মেশিনের গতি কমে যাবে,কিন্তু এটা কার্যকরী প্রফেসর!” 

প্রস্তাবটির প্রশংসা করে প্রফেসর বললেন, “তোমার পরিকল্পনা সত্যি অসাধারণ। অনেকটা বাস্তব সম্মত বললেও ভুল হবে না। আমার সাথে থেকে থেকে তোমার ভালোই বুদ্ধি হয়েছে ডেরীক!”। “তাহলে কি আমরা কাজ শুরু করবো 3×10³ m/s বেগের কোনো গাড়ি বা বাহন বানানোর জন্য?”, ডেরিক জিজ্ঞেস করায় প্রফেসর বললেন,“ নিজেদেরকে আজকে অনেক শুভেচ্ছা দিতে ইচ্ছা করতেছে।তুমি নির্দ্বিধায় এমন কিছু একটা ডিজাইন করতে থাকো। কোনো প্রকার সমস্যা হলে আমি তো আছিই!”

সেদিন ম্যাঞ্জিল প্রদেশের ছোট্ট শহর জ্যানিথের PhCh-003 তে প্রফেসর জ্যাকি এবং সহকারী ডেরিকের কল্পনায় মানব ইতিহাসের সবথেকে রহস্যময় বিষয় “টাইম মেশিন” বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপে আশার একটা অতীব ক্ষুদ্র আলোকরশ্মি উপলব্ধি করতে পারলো। কোনোদিন কেউ কি ভেবেছিল যে ভরবেগ আর রিলেটিভিটির সুপরিচিত সূত্রের অন্তরালেই লুকিয়ে আছে টাইম মেশিন! 
এই পরিকল্পনা কি সত্যি বাস্তবায়ন করতে পারবে এই দুই পদার্থবিদ?

Writer: Mahmud Ul Hassan

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম