বল পয়েন্ট কলম কিভাবে কাজ করে?



মানুষের হাতে স্মার্টফোন আসার আগ পর্যন্ত তার সর্বাধিক ব্যাবহারকৃত টুল ছিলো কলম। কলমের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতই প্রাচীন। তবে এই রঙচঙা ইতিহাসে সবচেয়ে বৈপ্লবিক সংস্করণ নিঃসন্দেহে বল পয়েন্ট কলম। তা কি করে কাজ করে সেটা সম্পর্কে আজ আমরা জানবো।

এই কলমের মেকানিজম জানার আগে এর উৎপত্তির সুত্রপাত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত করে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। প্রয়োজনিয়তাই উদ্ভাবনের জনক প্রবাদটি অনেক ভালো ভাবে খাটে বল পয়েন্টের সফলতার সাথে। বল পয়েন্টের পুর্বসুরী যে কলমগুলো ছিলো হোক তা ফাউন্টেইন পেন,কুইল কিংবা ধাতব কাঠি সবগুলোই ক্যাপিলারি অ্যাকশন(১) ব্যাবহার করে কালি চ্যানেল করতো। ডার্ক ইন্ডিয়া ইংক ব্যাবহার করায় তা শুকাতে অনেক সময় লাগতো আর তারাতাড়ি শুকালে কলম জ্যাম হয়ে লিখতে ব্যাবহারের অনুপযোগী হয়ে যেতো।এর সাথে সব সার্ফেসে লিখতে না পারা, অসম,এবরো-থেবরো লেখা আসা আর কালি রীফিল করা সহ নানান রকম জটিলতা দেখা দিতো।বাঁশ-পাখির পালক ব্যাবহারের অসুবিধা আশা করি বলা লাগবেনা। বল পয়েন্ট কলমের কালি ফুরোতে অনেক সময় লাগা,দাম কম হওয়া, সব সার্ফেসে লিখতে পারা ইত্যাদি সুবিধা তার উত্তরসুরীদের কালের অতল গহবরে ঠেলে দিয়েছে। তবে কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকেছে কমার্শিয়াল এয়ারলাইনগুলো। ভাবতে পারেন "বিমানের সাথে আবার কলমের ব্যাবহারের কি সম্পর্ক?"।সম্পর্ক একটা আছে, সিভিলিয়ান এয়ারক্রাফট গুলো যখন একটা নির্দিষ্ট উচ্চতার উপর দিয়ে যাত্রা শুরু করে তখন ই এক বিশাল সমস্যা দেখা দেয়, কলম(ফাউন্টেন পেন-কুইল) গুলো থেকে তখন অতিরিক্ত পরিমানে কালি চুইয়ে পড়তো। সেটা কতটা অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতায় ঠেলে দেয় পোস্ট সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার সময়ে ভাবতেই পারেন(২) । এইসব নানাবিধ কারন এক্সটার্নাল কালির কলমগুলোকে অবসোলীট করে দেয় এবং বল পয়েন্ট কলমের স্বর্ণযুগ আসে পৃথিবীতে।

বল পয়েন্ট কলমের উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের এমন একটা যন্ত্র দেওয়া যা যথেষ্ট পুরু কিন্তু দ্রুত শুকাবে এমন কালি কাগজ বা অন্য সার্ফেসে ডিস্ট্রিবিউট করে দিতে পারবে কিন্তু কলমের ভেতর কালি শুকিয়ে যাবেনা।সেটি করতে কোনো আলাদিনের চেরাগ ব্যাবহার করা না হলেও ব্যাবহার করা হয়েছিলো ঘুর্ণায়মান বল যা জাদুর মতই কাজ করেছে। বলটি পিতল,ইস্পাত কিংবা টাংস্টেন দিয়ে বানানো হয় সাধারনত।বলটি একাধারে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কালি শুকানো প্রতিরোধ করার মাধ্যম এবং কাগজ বা অন্য সার্ফেসে কালি ডিস্ট্রিবিউট করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।বল আর কালির স্টোরেজ(সাধারণত কলমের শিষ) এর মাঝে সংযোগ তৈরী করতে একটি সকেটের মত যন্ত্রাংশ ব্যাবহার করা হয় যার মাঝে বল টি আটকে থাকে। বলটির ব্যাসের চারপাশে অতি সুক্ষ একটি বলয় রয়েছে যা আসলে খালি,এটি বলটির ঘুর্ণনে সহায়তা করে এবং এই খালি ছিদ্রটি দিয়েই কালি নিচে নেমে আসে। কোনো সার্ফেসে এই কলম রেখে একটু চাপ প্রয়োগ করলেই বলটি ঘুরতে শুরু করে এবং গ্র‍্যাভিটির সহায়তায় তরল কালি বলের গা ঘেষে কাগজের সার্ফেসে নেমে আসে এবং বলের গতিপথ যে অভিমুখে সেই পথে কালি ডিস্ট্রিবিউট হয়।এখানে ক্যাপিলারি অ্যাকশন কলমের কাজ করার পেছনের মুল ড্রাইভিং ফোর্স হলেও প্রধান অনুঘটক হলো গ্র‍্যাভিটি।আমরা জানি যে নিচ থেকে উপরে লেখা যায়না কিন্তু তার সমাধানে প্রেসারাইজড কার্ট্রিজ(কার্তুজ) এর কলম আবিষ্কার হয় যা সকল সার্ফেসে লিখতে পারে যা পরবর্তীতে বিভিন্ন স্পেস প্রোগ্রামে ব্যাবহার করা হয়। জিরো গ্র‍্যাভিটিতে যে বল পয়েন্ট কলম কাজ করেনা এটাও একটা মিথ, কলম ফাংশন করে ক্যাপিলারি অ্যাকশনের মাধ্যমে কিন্তু উপর নিচে লিখতে পারিনা কারন তা গ্র‍্যাভিটির বিরুদ্ধে কাজ করার মত শক্তিশালী না, এখানে গ্র‍্যাভিটি প্রভাবক বা অনুঘটক;সরাসরি মাধ্যম হিসেবে কাজ করেনা। মহাশুন্যে যে জায়গায় গ্র‍্যাভিটি ই অনুপস্থিত সে জায়গায় বল পয়েন্ট কলম পার্ফেক্টলি ফাংশন করে(৩)।যে স্পেস পেন গুলো ব্যাবহার করা হয়েছিলো সেগুলো মুলত পৃথিবীতে নিচ থেকে উপরে লিখতে কাজ করবে।মহাশুন্যে সেগুলা কেবলই একটা কলম, অন্য বল পয়েন্ট কলমের সাথে এদের কোনো বিশেষায়িত পার্থক্যই নেই।

বল পয়েন্টের আকার ছোট হওয়াতে আপনাদের ব্যাপারটা ভিজুয়ালাইজ করতে কষ্ট হতে পারে তাই আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি যা সহজলভ্য এবং যার মাধমে অতি সহজেই কলমের মেকানিজম বুঝতে পারবেন। সেটি হলো আতরের বোতল।বোতল যদি ট্রান্সপারেন্ট হয় এবং আতর রঙ্গিন তাহলে তা বুঝতে আরো সুবিধা হবে। দেখবেন, বোতলগুলোর মুখে একটা বলের মত আটকানো আছে, যখনই বোতলটা শরীরের সাথে লাগিয়ে নাড়াচাড়া করবেন তখন বলের মুভমেন্ট অনুভব করতে পারবেন এবং দেখতে পারবেন যে বল যেদিকে গেছে কিছু সময়ের জন্য সেই অভিমুখে লিকুইড আতরের ট্রেইল রয়ে গেছে।


১.ক্যাপিলারি অ্যাকশনঃ https://bit.ly/2H7s18E
২।সাদা পোশাক প্রত্যক্ষভাব প্রায় ২শত বছর উপমহাদেশের পরাধীনতার জন্য দায়ী ছিলো,পশ্চিমারা তাদের পোশাক নিয়ে কতটা সচেতন ভেবেই দেখুন।
৩।Pedro Duque's diary from space: https://bit.ly/37mTxcN

বি.দ্রঃ যাদের জন্য লিংক গুলো কাজ করছেনা তারা দয়া করে ভিপিএন ব্যাবহার করে লিংক অ্যাকসেস করতে চেষ্টা করুন।


লিখাঃ সোহান

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম