বিজ্ঞানের কাছে এখনো অবধি অনেক বিষয়ের প্রতি অবিসংবাদিত কোনো ইশতেহার নেই। এর মধ্যে একটি হলো- চৈতন্য যাকে ইংরেজিতে বলা হয় consciousness. চৈতন্য জিনিসটা এর মূল কলকব্জা উদ্ধার করা যায়নি বলেই শুধু জটিল তাই নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে- দর্শন ও Anthropocene(প্ৰকৃতির সবকিছু মানুষকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হওয়ার ধারণা)।
প্রথম প্রশ্ন- চৈতন্য কি নিছক যান্ত্রিক প্রক্রিয়া? মানে বৈজ্ঞানিক পরিভাষা দিয়ে ব্যাখ্যা করার মতোই এলগরিদম? নাকি আসলেই প্রতিটি মানুষ ধারণ করে বিশেষ অকাট্য কোনো সত্ত্বা(soul or individuality)? বিজ্ঞানীরা এখনো উঠে পড়ে লেগেছে এগুলোর প্রকৃত রূপরেখা অনুসন্ধানে।
যদি চৈতন্য যান্ত্রিক এলগরিদমের মতোই জৈবিক এলগরিদম হয়ে থাকে, তাহলে মানুষ তার সামাজিক প্রথা, ধর্ম ও অধিবিদ্যা দিয়ে মানুষের চেতনা ও প্রাণকে যে বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছে অন্যান্য প্রাণীর চেতনার উপর, তাহলে তা ধোপে টিকে না। আমি যদি স্বীকার করে নেই, আমিও নিছক যন্ত্র, ব্যাকটেরিয়াও তাই। কিন্তু মূল পার্থক্য, আমি জটিল যন্ত্র ও ব্যাকটেরিয়া তুলনামূলক সাদামাটা।
তাহলে কিন্তু আমি আর আমাকে সামাজিক প্রথা, ধর্ম ও অধিবিদ্যা দিয়ে আমার চেতনাকে মূল্যায়িত করতে পারবো না। আমাদের সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এ ব্যাপারে কি বলে? বিজ্ঞানীরা মানুষের চেতনাকে কোন বাটন দিয়ে নির্ধারণ করেন? "যান্ত্রিক" বাটনে নাকি "বিশেষ সত্ত্বা"র বাটনে?
এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের প্রথমে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়? সেটা হলো- "মুক্ত ইচ্ছা" বা Free Will.
মানুষ যদি যন্ত্র না হয়ে থাকে, সে যদি তার শরীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে থাকে বরং নিয়ন্ত্রিক হয় তার মধ্যেকার বিশেষ কোনো সত্ত্বা দ্বারা, তাহলে অবশ্যই তার মুক্ত ইচ্ছা থাকবে। আর যদি তার আউটপুট তার শরীর দ্বারা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে নিশ্চিত হওয়া যায়, মানুষ এলগরিদমিক যন্ত্র বা মানবদেহ জৈবিক এলগরিদম।
মানুষের দেহের মধ্যে কি আদৌ কোনো আত্মা বা এমন অভ্যন্তরীন বিশেষ সত্ত্বা রয়েছে যেটা একদমই স্বাধীনভাবে, দেহ ও পরিবেশ দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়? বিজ্ঞানের কড়া জবাব- নেই। কারণ মানুষ যখনই যা করে তার কিছুক্ষণ আগেই তাঁর মস্তিষ্কে নিউরন উদ্দীপ্ত হয়, সিগনালের সঞ্চালন ঘটে। অর্থাৎ ব্যক্তি বুঝে উঠার খানিক আগেই তার দেহ প্রস্তুতি ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আমরা যা কিছুই করি, সবকিছুই আমাদের শরীরের অধীন।
কিন্তু আমাদের ধর্ম, অধিবিদ্যা ও উদার মানবতাবাদী দল ও আদর্শগুলো প্রতিনিয়ত ব্যক্ত করে চলেছে যে- প্রতিটি মানুষের ভেতরেই একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে। রয়েছে একটি "বিশেষ সত্ত্বা"।
যাকে অনেকে মোটাদাগে বলেন- "নিজেকে শুনো, তোমার মৌলিক সত্ত্বা কি বলে শুনো" দিয়ে প্রকাশ করেন।
কিন্তু আমাদের ভেতরে কি কেউ আদৌ বাহ্যিক পরিবেশ ও নিজের দেহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে একদমই মৌলিকভাবে আমাদের পথনির্দেশ করতে পারে? নাকি এটা নিছকই একটা পুরাণ? প্রকৃতপক্ষে আমাদের ইনার সেল্ফ বা এই যে ভেতরের কোনো সত্ত্বা যা আমাদের মৌলিকভাবে পথনির্দেশ করে বলে মনে করা হয়, তা আদৌ ঠিক নয়। বরং আমাদের এই দাবি করা "সত্ত্বা"টিও পরিবেশ ও জৈবিক অস্তিত্বের দাস। আমেরিকান বা বাংলাদেশি কিশোর কিশোরীর সত্ত্বা তাদেরকে তাদের আর্থ-সামাজিক ও তার জৈবিক তাড়নার দীর্ঘপ্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়েই নির্দেশ দিবে। এই ভেতরের সত্ত্বা কখনোই উদ্ভট বা বিরল কিছুর নির্দেশ দেয় না। বরং পরিবেশ ও জৈবিক ক্রিয়ার জটিল মিশ্রণেই সে পথ দেখায়।
তাই মানুষ যে সত্ত্বাকে বলছে "মৌলিক" তাই যদি জৈবিক ও পরিবেশের দাস হয়ে যায় তাহলে তার মৌলিকত্ব কি? বিশেষত্ব কি? আদৌ এটাকে জীবের দেহের একটি জটিল প্রক্রিয়ারই প্রতিধ্বনি ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়না। মানুষের এই বিশেষ সত্ত্বা বলে যাকে দাবি করা হয় তা আসলে বহু অভিজ্ঞতা ও অতীত কর্মের একটি নির্যাস ছাড়া কিছুই নয়। যার অভিজ্ঞতা ও অতীত কর্ম বলে কিছুই নেই তার ইনার সেল্ফ বা বিশেষ সত্ত্বা বলেও কিছু নেই। যেমন নবজাতক শিশু। সে যতদিন অভিজ্ঞতার বাইরে থাকে ততদিন পরিবেশে বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো আউটপুট রাখতে পারে না।
সবশেষে বলা যায়, মানুষের মধ্যে বিশেষ সত্ত্বা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে ধরে নিলে এবং তাকে নিয়ে গবেষণায় নামলেই শতশত পরস্পরবিরোধী সমস্যা ও জটিলতা দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু যদি নির্মোহভাবে এ নিয়ে গবেষণা চালানো হয়, তাহলে দেখা যায়- মানুষের মধ্যে বিশেষ সত্ত্বা বলে কোনো কিছুর বৈজ্ঞানিক কোনো অস্তিত্ব নেই। বরং মানুষের প্রতিটি প্রাকৃতিক ক্রিয়াই কার্য-কারণের অন্তর্ভুক্ত।
এজন্য বিজ্ঞানীরা আজকাল দাবি করতে শুরু করেছেন- মানুষসহ সকল জীবই হচ্ছে জীববৈজ্ঞানিক যন্ত্র। যন্ত্রের মধ্যে যেমন আমরা তিনটা অংশ দেখতে পাই- "ইনপুট, প্রসেসিং ও আউটপুট" তেমনি মানুষসহ প্রতিটি জীবের মধ্যেও একই ধরনের কলকব্জা।
বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে জীবকে বলতে শুরু করেছেন জীববৈজ্ঞানিক মেশিন বা এলগরিদম। কারণ এর মধ্যে বিশেষ সত্ত্বা দ্বারা পরিচালিত হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ নেই, বরং যন্ত্রের মতো প্রক্রিয়াকরণই দেখা যায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তকে দুর্বল একটি প্রশ্নের সম্মুখীন করা যায় - "যন্ত্রের মধ্যে ইনপুট দিলে আউটপুট কি আসবে তা আমরা এর ভেতরের প্রসেসর সম্পর্কে অবগত হয়ে জানতে পারি, একই প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থায় এই ইনপুটের জন্য সকল যন্ত্র একই আউটপুট দিয়ে থাকে, কিন্তু জীব বিশেষত মানুষের বেলায় কি তা খাটে?"
নিঃসন্দেহে খাটে না। একটি বদমেজাজি বাচ্চা কর্কশ স্বরে আপনার ও আপনার বন্ধুর সামনে বসে চিৎকার করছে বেশ সময় ধরে। আপনারা দুজনই কমবেশি বিরক্ত হবেন। এতটুকুই মিল। কিন্তু দুজনের বিরক্তির মাত্রা, মৌখিক প্রতিক্রিয়া ও মানসিক ভাবনা কি একই হবে? হয়তো দেখা গেলো- আপনি বাচ্চাটিকে নানা কথা বা ফুঁসলিয়ে চুপ রাখতে চাইছেন আর আপনার বন্ধু তিতি বিরক্ত হয়ে পারছে না ধমক দিতে।
এখানে বাচ্চার কান্না ইনপুট। আপনি ও আপনার বন্ধু প্রসেসর এবং আপনাদের পরবর্তী ক্রিয়া হলো আউটপুট। ইনপুট একই ছিল। কিন্তু প্রসেসর দুটো ভিন্ন জীব। ফলে আউটপুটও ভিন্ন। এখানেই মূল পার্থক্য। বিজ্ঞানীদের দাবি জীব মৌলিক তার বিশেষ কোনো সত্ত্বার জন্য নয়, বরং দেহের জন্য। এক দেহ আউটপুট দিবে অন্য দেহের চেয়ে ভিন্নভাবে, তার দেহের মৌলিক হরমোন, পিগমেন্ট, নার্ভ কিংবা তার দেহের ক্রোমোজোমে থাকা মিলিয়ন বছরের অতিক্রান্ত ডিএনএতে লেখা কোডের উপর ভিত্তি করে। যেমনটা প্রসেসর ভিন্ন হলে যন্ত্র ভিন্ন ভিন্ন ইনপুট দেয়।
কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে বেশ কয়েকজন মানুষকে রাখলে এবং একটি নির্দিষ্ট ইনপুট প্রয়োগ করলে মানুষগুলোর ইনপুট কেমন হবে তা কি আগে থেকে জানা সম্ভব? সম্ভব, কিন্তু এর জন্য বিজ্ঞানকে প্রথমত consciousness, neuroscience ও দৈহিক সকল কলকব্জা উদ্ধার করতে হবে। এটা এমন এক জটিল কলকব্জা যা তৈরি হয়েছে কয়েক বিলিয়ন বছরের সংখ্যাতীত ডিএনএ প্রতিলিপনের মাধ্যমে, সংখ্যাতীত মিউটেশন ও আমূল বিবর্তন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে।
আগামীতে সৌরজগতের বিশাল অংশে অভূতপূর্বভাবে বিচরণ করতে, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসংখ্য রহস্য উদ্ধার করতে মানুষকে যতটা বেগ পেতে হবে, তার চেয়ে অকল্পনীয় পরিমাণ বেগ পেতে হবে মানুষের নিজের দেহ সম্পর্কিত এসব বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক সমস্যার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের অকাট্য সমাধান বের করতে।
যদি মানুষের একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে নির্দিষ্ট ইনপুটের জন্য আউটপুট আগে থেকে উক্ত মানুষের জীববৈজ্ঞানিক তথ্য থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়(যেহেতু মুক্ত ইচ্ছা বলে কিছুই নেই, সবই যান্ত্রিক) তাহলে মানুষের জীবনের অর্থ, মূল্যায়ন ও সম্ভাবনা আমূল পাল্টে যাবে। সবকিছুই হয়তো উল্টে পাল্টে যাবে।
Yuval Noah Harari এর Homo deus এর আলোকে লেখা
Writer: Mehedi Hassan