চৈতন্য বা ইংরেজিতে consciousness জিনিসটা নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠি হারারির Homo deus পড়তে গিয়ে। চৈতন্য জিনিসটা প্রথমবার শুনলে মনে হয়, যেন খুবই জলভাত একটা ব্যাপার। যদি কাউকে জিজ্ঞেস করি, চৈতন্য বা চেতনা জিনিসটা কি? যারা ব্যাপারটা গুরুত্বের সহকারে নিবে না তখন বলবে এটা আবার কেমন প্রশ্ন! এটা তো খুবই সহজ ব্যাপার। চৈতন্য মানে জাগরণ বা জেগে থাকা। বা যত সহজে কাছাকাছি সমর্থক শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় সেভাবে তারা বুঝাবে।
কিন্তু, যদি আপনি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব গুরুত্বের সাথে consciousness নিয়ে এগুতে চান, আপনাকে প্রথমেই নাজেহাল হতে হবে। প্রথম প্রশ্ন দাঁড়াবে- consciousness এর সংজ্ঞা কি? আর সংজ্ঞা নির্ধারণ করার অর্থই হলো- আসলেই consciousness অস্তিত্বশীল হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও দর্শনের এখানেও জড়তা। এর অস্তিত্ব নিয়ে রয়ে গেছে প্রশ্ন।
প্রায় ২০০০ বছর ধরে চৈতন্যের বিষয়টার মুখোমুখি হয়েছে শুধুমাত্র ধর্ম ও অধিবিদ্যা। তারা চৈতন্যকে নিজ নিজ চিন্তা ও অনুভূতি প্রসূত সংজ্ঞা তৈরি করেছে। এবং পুরো এ দুটো সহস্রাব্দ বিজ্ঞান রীতিমতো একে এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু ২১ শতকের বিজ্ঞানের সম্মুখে সমূহ প্রশ্ন ও ধাঁধা। ইংরেজিতে বলা যায় ডিলেমা(dilemma)। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে বিজ্ঞানকে অবশ্যই consciousness এর মুখোমুখি হতে হবে। যেমন- অদূর ভবিষ্যতে পুরোপুরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা(AI) নিয়ন্ত্রিত একটি পৃথিবীতে মানুষের "বিশেষ" কোন গুণটির জন্য নির্ধারিত হবে যে- মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চেয়েও অর্থপূর্ণ?
ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা "অচেতন" বা unconscious এলগরিদম মানুষের সবধরনের দক্ষতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সেজন্য মানুষের সামনে অচেতন বুদ্ধিমত্তা ও চেতন বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জানার ও "বিশেষ" পার্থক্য করার সময় চলে এসেছে।
প্রথমে যাই সংজ্ঞার দিকে। আসলে চৈতন্য বা consciousness কি? ১৯৭৪ সালে থমাস নেগেল বলেছেন- যদি কোনো বস্তু, ব্যক্তি, পশু বা মেশিনের উদ্দেশ্যে তার দেহ-মন অস্তিত্বে বাস করার অনুভূতি কেমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, তবে ধরে নিতে হবে উক্ত বস্তু, প্রাণী বা মেশিনটি conscious. যেমন বাদুড় হওয়ার অনুভূতি কেমন? এই প্রশ্নের উত্তরে যদি বাদুড়ের নিজস্ব কোনো উত্তর থাকে তবে বাদুড় conscious. কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- কিভাবে বাদুড় আমাকে জানাবে যে- সে আসলেই তার অস্তিত্বের জন্য একটা অনুভুতি পেয়ে চলেছে? তার প্রকাশের ভাষা নেই।
মানুষের বেলায় এই প্রশ্ন প্রয়োগ করলেও জটিলতা রয়ে যায়। মানুষ হয়তো মুখ দিয়ে বলতে পারবে- মানুষ হওয়ার জন্য সে দুর্দমনীয় সব অনুভূতি পেয়ে থাকে যেটা তাকে জানান দেয় সে অস্তিত্বশীল। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমি কিভাবে নিশ্চিত হবো- তার এসব স্বীকারোক্তি নিছক বুদ্ধিমত্তার কারণেই দেওয়া উত্তর নয়? কারণ উন্নত এলগরিদমিক মেশিনও তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এরকম উত্তর অনায়াসে দিতে পারে। যদি কোনো মেশিনকে প্রশ্ন করা হয়, তার অস্তিতের জন্য তার কেমন অনুভূতি হয় এবং প্রশ্নের উত্তরে সে তার এলগরিদমিক বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তার অস্তিতের কারণে যে অনুভূতি হয় তার উত্তর দিতে পারে। এটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য একদমই নিছক ব্যাপার। এ অবস্থায়- মেশিন নিজেকে অনুভূতিশীল বা subjectivity সম্পন্ন দাবি করলেও আদৌ সেটা শুধু মানুষের জোড়াতালি দেওয়া জটিল ও নিষ্প্রাণ কলকব্জার বুদ্ধিতাত্ত্বিক কারসাজি নাকি আসলেই নিষ্প্রাণ কলকব্জার মধ্যেও "অন্যের" ধরাছোঁয়ার বাইরেও রয়েছে একটা subjectivity? যেই যুক্তিতে আমরা এমন বুদ্ধিসম্পন্ন যন্ত্রের উত্তরকে উপেক্ষা করবো- মানে- বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ- একই বাহ্যিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষের উত্তরকেও অবজ্ঞা করা যায়। কারণ মানুষের subjectivity ও ওই যন্ত্রের মত আমরা সরাসরি জানতে পারি না। দুই ক্ষেত্রেই মৌখিক স্টেটমেন্ট।
মানুষের কোন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে আমি ধরে নিবো সে conscious? বুদ্ধি? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দুয়েক দশক আগেই মানুষকে বুদ্ধিতে ছাড়িয়ে গেছে? অনেকেই দাবি করবেন- মানুষ যে conscious সেটা বুঝার একটা উপায়- মানুষ শিল্প ও নান্দনিকতা বুঝতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়- এই শিল্প ও নান্দনিকতা অর্থ যদি সৌন্দর্য হয়(যা মূলত তৈরি হয় প্যাটার্ন রিগনিশনের মাধ্যমে) তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের চেয়েও অনেক সুন্দর ও নিখুঁতভাবে নান্দনিক। বুদ্ধিমত্তা ও নান্দনিকতার দিক থেকে মেশিন ও মানুষের তেমন কোনো বিশেষ ফারাক নেই।
consciousness এর মূল ঘাঁটি- আমাদের বৈষয়িক বাস্তবতায়। ইংরেজিতে বলে- Subjective Reality.
কোনো একটি বস্তুর লাল রঙ আমার কাছে কতটুকু লাল(তীব্রতা), কোনো শব্দের প্রতি আমার কতটুকু বিরক্তি- সেটা আমি আরেকজনকে মুখে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ শব্দ দিয়ে বলতে পারি। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো- অন্যকে কখনোই আমার এই "কতটুকু লাল" মনে হলো সেটা বুঝানো সম্ভব নয়। প্রতিটি জীবের সমগ্র স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, রক্তসংবহনতন্ত্র কিংবা লসিকা তন্ত্র যেখানেই আমরা ব্যবচ্ছেদ করে আমাদের সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি নিযুক্ত করিনা কেন- তবুও আমরা সরাসরি জানতে পারবো না- শব্দতরঙ্গ ভিত্তিক জগতে বাদুড় কেমন অনুভব করে বা আমার একটি থাপ্পড়ে আমার ছোট ভাই কেমন অনুভব করে।
মানুষ মুখ দিয়ে ভাষা প্রকাশ করতে পারে, তবে সেটা রোবটও পারে। রোবটকে যদি আঘাতসংবেদী করে গড়ে তোলা হয়, তখন সে আরো অনেক বেশি নিখুঁতভাবে বলতে পারবে সে কতটুকু ব্যথা পেলো। হয়তো গাণিতিক পরিমাপও দেখাবে। যেটা আপনার নয়, বরং তারই দেওয়া আউটপুট। মানুষ হোক আর মেশিন, কারো বৈষয়িক বাস্তবতা আমাদের সরাসরি অনুভব করার কোনো উপায় এখন অবধি নেই।
কিন্তু যারা বস্তুবাদী তাদের জন্য এটা বেশ অস্বস্তিকর। বস্তুবাদীদের দাবি, বিশ্বের সবকিছুই- বস্তু। বস্তুর ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমেই সবকিছুর তৈরি। কিন্তু বস্তুর এসব বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপে এমন গভীর subjectivity তৈরি হয় যেটা আমরা প্রতিটা মানুষ দাবি করি- সেটা কিভাবে সম্ভব? আমাদের মস্তিষ্ক হচ্ছে objective reality মানে এটাকে সবাই প্রকৃতিতে একই রকমে দেখতে পারছে। কিন্তু প্রকৃতিতে একই রকমে একটি জিনিস থাকলেও সেটার গুণাবলী যেমন রঙ, আকার আমার আমাদের subjective reality তে তৈরি করি। সেখানে সবার reality এক নয়।
এই যে, বস্তু জাতীয় একটি মস্তিস্ক, তার মধ্যেই কিভাবে subjective experience তৈরি হয়? এই subjective experience ও কি বস্তুবাদ দিয়ে বস্তুবাদীরা ব্যাখ্যা করতে পারবেন? যদি বস্তুবাদীরা এর উত্তর হ্যাঁ বলতে চান- তাহলে অবশ্যই তাদেরকে consciousness সম্পর্কিত সকল জটিলতাকে অস্বীকার করতে হবে। কিন্তু তারা এমন এক যুগে বাস করছে যে যুগে মানুষ ও মেশিনের মধ্যেকার দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার তফাৎ শূন্যের কোঠায় এবং সামনে মেশিন বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাল্লা নীচে পড়বে। তাই এর আগেই বস্তুবাদীরাও অন্তত consciousness নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে শুরু করেছে। যেহেতু অধিকাংশ বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বস্তুবাদঘেঁষা, তাই পরিশ্রমটা সবচেয়ে তাদেরই বেশি।
অন্যদিকে আছে ফাংশনালিস্টরা, যারা দাবি করে যেসব বস্তু বা প্রাণী সুনির্দিষ্ট কাজ সমাধা করে তারাই conscious. যদি তাই হয়, তাহলে বর্তমানে মানুষের চেয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি conscious. কারণ তাদের কাজ আরও বেশি সুষ্ঠু ও নির্ধারিত।
ফাংশনালিস্টরা খুব সহজেই ব্যাপারটার সমাধান করে ফেলেছে। তবে এর জন্য তাদের একটি বিশাল বড় ত্যাগও দিতে হয়েছে। মানুষ বা প্রাণীর যে "বিশেষ" চৈতন্য যা তাকে জড় বুদ্ধিমত্তা থেকে আলাদা রেখা টেনে দিয়েছে এবং "বিশেষ" গুণে রেখেছে বলে যে দাবি সভ্যতার প্রতিটি ধর্মীয় গ্রন্থের, প্রতিটি বিগত শতাব্দীর মতাদর্শ ও ভাবাদর্শের অঘোষিত মূলমন্ত্র ছিল সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
কিন্তু বস্তুবাদী বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা এখনো সংশয়ী। মস্তিষ্কের মতো বস্তুগত একটি পদার্থ কিভাবে Subjectivity জন্ম দেয়- এবং মেশিনের যে অভ্যন্তরীন প্রসেসিং তাতেও কি মিশে আছে subjectivity? এই প্রশ্নগুলো বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানী, স্নায়ুবিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানীদের ঘুম হারাম করে ফেলেছে। বিশ্ববিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী স্টিভেন পিঙ্কারের অকপট স্বীকারোক্তি: we may be able to understand most of the detail of how the mind works, yet consciousness itself may remain forever beyond our reach.
পরিশিষ্ট : যতই মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান নিয়ে গভীর গবেষণা হচ্ছে ততই consciousness এর জায়গা সঙ্কুচিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, সবধরনের কার্যক্রম তৈরি হয়- প্রকৃতি ও দেহের জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যদি অন্তিম গবেষণায় দেখা যায়- আসলেই মানুষ যা করে তার মধ্যে consciousness বলে কোনো কিছু নেই, তাহলে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব কার হাতে যাবে? অধিক বুদ্ধিদীপ্ত, কার্যক্ষম ও উচ্চ স্মৃতি ধারণক্ষমতার nonconscious AI এর হাতে নাকি অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিদীপ্ত ও নিম্ন স্মৃতিধারণ ক্ষমতার nonconscious মানুষের হাতে? বিজ্ঞানীরা রীতিমতো ইঁদুরদৌড় শুরু করেছেন এ ব্যাপারে- কারণ AI এর উপর বিশেষত্ব(কর্তৃত্ব নয়) অর্জনের মানুষের সর্বশেষ অস্ত্র(?) Consciousness.
Further Reading:
1. Consciousness: A very short introduction By Susan Blackmore
2. Consciousness Explained By Daniel C Dennett
3. Homo deus By Youval Noah Harari
Glossary:
Subjectivity: https://en.m.wikipedia.org/wiki/
Subjectivity
Subjective Reality: https://en.m.wikipedia.org/wiki/Subjective_character_of_experience
Objective Reality: https://en.m.wikipedia.org/wiki/
Objectivity_(philosophy)
consciousness: https://en.m.wikipedia.org/wiki/
Consciousness
Writer: Mehedi Hassan