যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি আপনার দেখা সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য কী?তাহলে আপনার উত্তর কী হবে?উওরটি হয়তো রাতের আকাশের দিকে তাকালেই পাওয়া যাবে,তাই না?এই মহাবিশ্ব যেনো এক সুদক্ষ রচয়িতার রচনা,তাই না?আর আমি যদি বলি সেই রচনার খুঁটি স্রেফ ছয়টি সংখ্যা, তাহলে বিশ্বাস করবেন?বিশ্বাস করুন আর না করুন,সত্যি কথা হচ্ছে এই ছয় সংখ্যা যদি না থাকতো আপনাকে আর কষ্ট করে বিশ্বাস করাতে হতো না।করাবোই বা কী করে!আপনি থাকলেই তো!শুধু আপনি নন,সেই সুদক্ষ রচনয়ীতার রচনা ও থাকতো না।এই সংখ্যা গুলোই প্রকৃতির নিয়ম গুলোকে আগলে রেখেছে।
সেই যাদুকরী সংখ্যা নিয়ে প্রখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিদর মার্টিন রিজ একটি বই ও লিখেছেন। নামঃজাস্ট সিক্স নাম্বারসঃ ডিপ ফোর্সেস দ্যাট শেইপ দ্য ইউনিভার্স।চলুন না জেনে আসি কারা সেই জাদুকর!!
১)প্রথম জাদুকর হলেন N=10^40। এটি সেই সংখ্যা যা মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্রীড়ানক তড়িৎ-চুম্বকীয় বল এবং মহাকর্ষ বলের আপেক্ষিক সবলতার অনুপাত।আচ্ছা এই অনুপাতের মাহাত্ম্য জানার আগে জাদকরের লাঠি সম্পর্কে জেনে আসি চলুন ।
প্রথমেই বলি তড়িৎ চুম্বকীয় বল এর কথা।এটা হলো একটা গফ ও বফ এর কাপল।এর গফ হলো তড়িৎ আর বফ হলো চুম্বক।এরা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারেনা।একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তাদের রিলেশন তৈরি করে। তড়িৎ যেখানে চুম্বক সেখানে থাকবেই।পৃথিবীর সবকিছুতেই যেন এদের সম্পর্কের ছড়াছড়ি।এই মহাবিশ্ব এর গহীনে যান।দেখবেন কোটি কোটি পরমাণু। সেই পরমাণু গুলোর ইলেকট্রন-প্রোটন,প্রোটন-ইলেক্ট্রন,প্রোটন-প্রোটন একে অপরকে ফোটন নামক কণিকার বিনিময়ে এই বল দিয়ে টানছে ও ঠেলছে। টানা ঠেলায় সবকিছু অস্থির।
আবার মহাকর্ষের দিকে তাকান। সে খুবই আত্মীয়। কাউকে ঠেলে না।সবাইকে টানে।তবে তার টানার জোর খুবই কম।তবে বিশাল পরিসরে এটি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।সে জন্যই তো ব্ল্যাক হোল আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ বেগের আলোও তার সান্নিধ্যের বাইরে যেতে পারে না।
এবার দুইজনকে একসাথে তুলনা করুন।একটি চিরুনি মাথায় ঘষুন। তারপর তাকে একটি কাগজের দিকে তাক করুন। দেখবেন কাগজটি উঠে এসেছে।স্রেফ সামান্য একটি চিরুনির তড়িৎ চুম্বকীয় বল এই বিশাল পৃথিবীর মহাকর্ষ বলকে হারিয়ে দিল। এমনই দূর্বল সে।হিসাব কষে পাবেন মহাকর্ষের তুলনায় তড়িৎ চুম্বকীয় বল ১০^৪০গুণ বেশি শক্তিশালী। এটাই সেই সংখ্যা। এর একটু হেরফের হলে সব শেষ। যদি একটু কম হতো!!প্রাণের অস্তিত্ব অসম্ভব হতো।নক্ষত্রের মধ্যে ফিউশনের ফলে যে চাপ সৃষ্টি হয় তা চায় নক্ষত্রকে বাইরের দিকে প্রসারিত করতে আর মহাকর্ষ চায় গুটিয়ে ফেলতে।দুটোর মিলিত প্রভাবে নক্ষত্র ভারসাম্য থাকে। N=10^40 না হয়ে যদি আরেকটু কম হতো অর্থাৎ মহাকর্ষ যদি এরেকটু শক্তিশালী হতো সূর্যের মতো সব নক্ষত্র মহাকর্ষের প্রভাবে ঘুটিয়ে যেতো।বুঝতেই পারছেন N=10^40 কীভাবে মহাবিশ্বকে টিকিয়ে রেখেছে।
২)পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন।এখানেই পরমানুর সমস্ত ভর।তবে এওমন হতো না যদি এখানে আরেক যাদুকর না থাকতো।প্রোটন ধনাত্মক চার্জ।ধনাত্মক ধনাত্মককে বিকর্ষণ করে নিউক্লিয়াসের মরণ হওয়ার কথা।কিন্তু সেই মরণঘাতক হার মেনে নেয় প্রকৃতির আরেক শক্তিশালী বলের কাছে।
সবল নিউক্লিয় বল।বলটি নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রনকে একত্রে ধরে রাখে।যে শক্তি আজ আমারা সূর্য থেকে পায় তার কাজের কাজী হলো ফিউশন।সেখানে হাইড্রোজেন রা মিলিত হয়ে হিলিয়ামে পরিণত হয়।হাইড্রোজেন এর নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন।আর হিলিয়ামে দুটো প্রোটন,বাড়তি দুটো নিউট্রন ও থাকে।তাদের ধরে রেখেছে সেই সবল নিউক্লিয় বল।কিন্তু দুটো প্রোটন ও নিউট্রন এর মোট যে ভর, হিলিয়ামে থাকে মাত্র তার ৯৯.৩ভাগ।
বাকী০.৭ শতাংশ গেলো কোথায়??সেটা নির্গত হয় শক্তি হিসেবে।সেই সামান্য ভর E=mc^2 এর মাধ্যমে বিশাল শক্তির রুপ ধারণ করে।এ কারণেই সূর্য আজ কোটি বছর ধরে এতো শক্তি দিয়েও নিঃশেষ হয়নি।এমন চলবে আরো বহুকাল।
কিন্তু কেমন হতো যদি ফিউশন বিক্রিয়ায় নক্ষত্র আরো বেশি বা কম ভর হারাতো?হারানো ভরের পরিমাণ দশমিক সাত শতাংশ না হয়ে ০.০০৬হতো তার অর্থ হলো সবল নিউক্লিয় বল অনেক দূর্বল।তখন নিউক্লিয়াসের কণা গুলো শক্তভাবে গেঁথে থাকতে পারতো না।হিলিয়ামের মতো বড় বড় পরমাণুরাও আর তৈরি হতো না।মহাবিশ্ব ভরপুর থাকতো শুধুই হাইড্রোজেন দিয়ে।রসায়ন নামে কোন শাস্ত্র তৈরি হতো না।হবেই বা কীভাবে? কে করবে সে কাজ?আর তার চর্চাই বা কে করবে?প্রাণই তো নেই জগতে।
এবার উল্টো করেই ভাবুন!ধরুন ধ্রুবকটির মান ০.০০৮।এ ক্ষেত্রে বলটি অনেক শক্তিশালী। বিগ ব্যাং এর পরপরই মহাবিশ্বের সব হাইড্রোজেন উবে যেতো।শক্ত হয়ে গেঁথক গিয়ে হয়ে যেতো হিলিয়াম।নক্ষত্রের জীবন শুরু হয় হাইড্রোজেন দিয়ে।সেই হাইড্রোজেন নেই।পানিরও তো অন্যতম উপাদান হাইড্রোজেন। আর প্রাণের মূলে আছে পানি।ফলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা হতো অসম্ভব।
৩)এবারের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে মহাবিশ্বের মোট ভরশক্তি ও সংকট ঘনত্বের অনুপাতের মধ্যে।নাম তার ওমেগা।
সমীকরণ আকারে লিখলে হয় ওমেগা=রো/রো(cr)
এখানে রো হলো মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব এবং রো(cr) হলো মহাবিশ্বের সংকট ঘনত্ব।
এই ধ্রুবকটিই নির্ধারণ করবে মহাবিশ্বের ভবিষ্যত।জানেন তো,মহাবিশ্বের সবকিছুই একে অপর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।যে যত দূরে সে পালিয়ে যাচ্ছে তত দ্রুত। মানে কী?মানে হচ্ছে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।কিন্তু আজীবন কি প্রসারিত হয়েই যাবে?এই মহাবিশ্ব কি উন্মুক্ত? নাকি বদ্ধ,কোন একসময় আবার পিঁছু হাটতে শুরু করবে?নাকি কোনটাই না,সমতল!সে বার্তা দিবে আমাদের ওমেগা নামের সেই ধ্রুব সংখ্যাটি।এর মান যদি এক এর চেয়ে কম হয় তবে প্রসারণ চলতেই থাকবে।কারণ এক্ষেত্রে মহাকর্ষ খুবই দূর্বল।আবার উল্টোটা হলে মহাকর্ষ এতোই শক্তশালী হবে যে সবকিছুই আবার পিঁছু হাটতে থাকবে।সবকিছুই ঘুটিয়ে যাবে।এ অবস্থার নাম বদ্ধ মহাবিশ্ব।
বর্তমান পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এ ধ্রুবকের মান এক এর চেয়ে সামান্য কম।সেটি হলো ০.০৩।আর এটি পরিমাপ করা হয়েছে দৃশ্যমান বস্তুর সাপেক্ষে।কিন্তু আমরা জানি মহাবিশ্বের ২৬শতাংশ ডার্ক ম্যাটার যা এখনও দৃষ্টির অগোচরে।তাদের হিসাবে আনলে ওমেগার মান হয় ০.৩। মানে ভরশক্তির মান সংকট ঘনত্বের চেয়ে অল্প কম।তার মানে মহাবিশ্ব বদ্ধও নয় উন্মুক্ত ও নয় বরং সমতল।
কিন্তু ওমেগার মান যদি ১ এর চেয়ে অনেক কম হতো তবে কেমন হতো?তাহলে মহাবিশ্ব অনেক দ্রুত প্রসারিত হতো।প্রসারণের ধাক্কায় ছায়াপথ, নক্ষত্র, গ্রহ কারো জন্ম হতো না।জন্মাবেই বা কি করে? পদার্থ গুলো নিবিড় স্থানই নিতে পারছেনা।প্রাণের ভাগ্য ধোঁয়াশা।
উলটো অবস্থায়?মানে ওমেগার মান ১ এর চেয়ে অনেক বড় হলে?সেক্ষেত্রে মহাকর্ষের টানে জন্মের পরপরই মহাবিশ্ব সংকুচিত হয়ে যেতো এবং আর কোন নক্ষত্র জন্ম নিতে পারতো না।
৪)আইন্সটাইনের মতো পন্ডিতও একবার এক বড় ভুল করে বসেছিলেন।১৯১৫ সালে প্রণীত ত্র সার্বিক আপেক্ষিকতা থেকে বুঝা যাচ্ছিল মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।কিন্তু তিনি যে স্থির মহাবিশ্বেই বিশ্বাসী।তাই তিনি সমীকরণে একটি নতুন ধ্রুবক লাগিয়ে দিলেন।ফলে তাত্ত্বিক ভাবে বন্ধ হলো প্রসারণ।এক দশকের মধ্যেই হাবল প্রমাণ করলেন,প্রসারণকে জোর করে বন্ধ করাটা কোন কাজের কাজ ছিলো না।তখন এটাকে আইন্সটাইন তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল বলেছিলেন।ফলে আর প্রসারণ ধ্রুবকটির আর দরকার পড়েনি।ধ্রুবক্টির গ্রন্থগত নাম মহাজাগতিক ধ্রুবক।প্রকাশ করা হয় বড় হাতের গ্রীক অক্ষর ল্যামডা দিয়ে।কিন্তু নব্বয়ের দশকে আবার ডাক পড়ল তার।দেখা গেলো মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে ত্বরিত গতিতে।মানে,যত প্রসারিত হচ্ছে,প্রসারনের হার তত বাড়ছে।এর জন্য দায়ী করা হয় ডাক এনার্জি নামক অদৃশ্য শক্তিকে।একে শূন্য স্থানে উপস্থিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ করা হয়।সঠিক মানটি এখনো জানা যায়নি।তবে জগতের সুণিপূনতার পিঁছনে এর ভূমিকা ও গুরুত্বপূর্ণ।অতএব বলা যায়,আইন্সটাইন এর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটাও এক অর্থে ভুল বলা ছিলো না।তবে ভুল তিনিও করেছিলেন বহু বিষয়ে।সেটা অন্য কোন সময় আলোচনা করা যাবে।
৫)মহাবিশ্বের একটি বৈশিষ্ট্য হলো,আমরা যেদিকেউ তাকাই মহাবিশ্ব কে একই রকম দেখি।হ্যাঁ ছোট মাপকাঠি তে একথা সত্য নয়।চিন্তা করতে হবে ছায়াপথের মতো বড় মাপকাঠি তে।তার মানে,মহাবিশ্ব সুষম আকৃতির।তাহলে মহাবিশ্বের সূচনা ঘটেছে সুষম আকৃতি নিয়েই।আসলেই তাই।তবে শতভাগ নয়।
মহাবিশ্ব কেমন সুষম তা নির্ধারিত হয় Q নামক ধ্রুবক এর মাধ্যমে।এটি হলো মহাবিশ্বের স্থান-কালের ভাঁজ।
শুরুতে মহাবিশ্ব এ ছোট ছোট সাইজের ভাঁজ বা কুঞ্চন ছিলো।শুরুতে মহাবিশ্ব সুষম থাকলে আজও তেমনি থাকতো।জন্ম নিতে পারতোনা নক্ষত্র,ছায়াপথ কিংবা মানুষের।
আবাড় ভাঁজ যদি বড় বড় হতো,তাহলে মহাবিশ্বের উপাদান বস্তু নিয়ে গড়ে উঠত বড় বড় বস্তুপিন্ডের।মহাবিশ্ব ভরপুর থাকতো বিশাল বিশাল কৃষ্ণবিবর এ।ভাঁজের সাইজ( Q) ঠিক কত হওয়া উচিত,তা নিয়ে অবশ্য এখনও নিশ্চিত হতে পারেন নি বিজ্ঞানীরা।
৬)আমদের জগত ত্রিমাত্রিক। এখানের মাত্রা বলতে স্থানের মাত্রার কথা বলছি।জগতের মাত্রার সংখ্যা( D) টিও একটি ধ্রুবক।যদি মাত্রার সংখ্যা দুই বা চার হতো!!তাহলে মাত্রার জীবনের উদ্ভব ঘটা সম্ভব ছিল না।চার মাত্রার জগতে সূর্যের চারদিকে গ্রহদের কক্ষপথ হতো অস্থিতিশীল। ফলে একটু এদিক ওদিক হলেই গ্রহরা সর্পিল পথে সূর্যের দিকে চলে যেতো।অথবা ছিটকে যেতো বাইরের দিকে।অবশ্য বাস্তবে এটা হতো না।তার কারম আরো মারাত্মক।সূর্য নিজেই ভারসাম্যে থাকতো না।বাইরেত দিকে ফিউশন চাপ ও মহাকর্ষের টান সোয়ানে সোয়ানে লড়তে পারতো না।সমস্যা শুধু বড় মাপকাঠিতেই নয়,পরমাণুর নিউক্লিয়াসও হতো অস্থিতিশীল। এইভাবে বিভিন্ন সমস্যা হতো দুই বা অন্য কোন মাত্রা নিয়ে ও।
বুঝলেন তো!!!সংখ্যা গুলোর মাহাত্ম্য কতটুকু!!তারাই জগতকে টিকিয়ে রেখেছে অসাধারণ সব নিয়ম দিয়ে।
শেষ করছি পিথাগোরাস এর একটা উক্তি দিয়ে।তিনি বলেছিলেন "সবকিছুইই সংখ্যা"। এটা দ্বারা তিনি ঠিক কি বুঝিয়েছেন, তা আজও বিতর্কের বিষয়।তবে সংখ্যাকে মহাবিশ্বের উপাদান হিসেবে ব্যাখ্যা করা নেহাত খারাপ নয়।
সূত্রঃ
১)জাস্ট সিক্স নাম্বারস,ডিপ ফোর্সেস দ্যাট শেইপ দ্য ইউনিভার্স।(মার্টিন রিজ)
২)কসমিক নাম্বারস,নাম্বারস দ্যাট ডিফাইন আওয়ার ইউনিভার্স(যেমন স্টেইন)
৩)আ ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম,গিজমাডো(স্
টিফেন হকিং)
Writer: Mohammad Fahim Uddin