ভাইরাস কি জীব না জড়?


আপনার ঠাকুর্দা কি বেঁচে আছেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ যদি বলেন উনি আসলে বেঁচে নেই, কিন্তু ঠিক মরেও যে গেছেন তা নয়- বরং ইহলোক আর পরলোকের মাঝামাঝি কোথাও আছেন- তাহলে সেই উত্তর সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। তার কারণ বাঁচামরা একটা বাইনারি বিষয়। কেউ হয় একালে থাকবেন নাহয় ওকালে। স্বর্গে নাহয় মর্ত্যে। অবস্থা বেশি খারাপ হলে পাতালে। মাঝামাঝি বলে তো কথা নেই।

অথচ ভাইরাস কি জীব নাকি জড়- এই প্রশ্নের ক্ষেত্রে এরকম যাচ্ছেতাই উত্তরই আমরা গ্রহণযোগ্য বানিয়ে ফেলেছি। হাইস্কুলের বইপত্রে পলিটিক্স করে লেখা থাকে, ভাইরাস জিনিসটা না জীব না জড়। এটা দু'য়ের মাঝামাঝি অবস্থা।
এই কথাটার আদৌ কোন অর্থ নেই। এর স্থান সুকুমার রায় কিংবা লুইস ক্যারলের গল্পে।
ধারণাটা কীভাবে আসল তা অবশ্য সহজেই বোঝা যায়। ভাইরাসের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখলে বলতে ইচ্ছে করে এরা জীব। যেমন- জীব মাত্রের মধ্যেই যেসব ইটকাঠবালু থাকে, ডিএনএ-আরএনএ-প্রোটিন, ভাইরাসের মধ্যেও তা আছে। জীবের বিবর্তন হয়, ভাইরাসেরও হয়। জীব বংশবিস্তার করে, ভাইরাসও তাই করে। আবার কিছু বৈশিষ্ট্য দেখলে বলতে ইচ্ছে হয় এরা জড়। যেমন এদের শক্তি উৎপাদনের কোন প্রক্রিয়া নেই।

কিন্তু তার মানে তো এই না যে আপনি গোঁজামিল দিয়ে বলে দেবেন এটা জীব-জড় উভয়ই। কিছু প্রমাণ যদি আসামীর পক্ষে যায়, কিছু যদি তার বিপক্ষে যায়, তার মানে কী বলবেন? আসামী খুন করেছে এবং করেনি?
এজন্য ভাইরাস জীব এবং জড়র মাঝামাঝি অবস্থা শুনলেই আমার মেজাজটা তিড়িং করে ওঠে।
ভিনসেন্ট র্যাকানিয়েলো বেশ নামকরা ভাইরাসবিদ। তার একটা বিখ্যাত পডকাস্ট আছে, মিডিয়া-টিডিয়াতেও মাঝেমধ্যে চেহারা দেখান, এজন্য তার খানিকটা সেলেব্রিটি স্ট্যাটাসও আছে। তিনি ভাইরাসের জীবন আছে কি নেই এই রহস্যের উত্তর দিয়েছেন এভাবে- ভাইরাস কখনও জীব, কখনো জড়। সে যখন কোষের বাইরে থাকে যখন সে জড়। কারণ কোষের বাইরে তার বংশবিস্তার কি বিবর্তন কিছুই হয় না। কিন্তু কোষের ভেতরে থাকলে সে জীব। কাজেই সে একই সাথে জীব আর জড় না, মাঝামাঝিও না- বরং ডে শিফটে জীব, নাইট শিফটে জড়।
এই কথাটার তাও মানে আছে। এটা সত্য না মিথ্যা তা জানি না, কিন্তু কথাটা দিয়ে একটা কিছু বোঝায়। অন্যদিকে "জীব-জড়ের মাঝামাঝি" কথাটা দিয়ে কিছুই বোঝায় না। এটা নেহায়েতই ননসেন্স (উঁচুতলার ভাষায় বলতে গেলে- কথাটার মধ্যে কোন semantic content নেই)।
যাইহোক, এই লেখাতে আমি বিষয়টা নিয়ে সংক্ষেপে আমার মত দেব। আমার মত হচ্ছে, ভাইরাস জিনিসটা জড়। সব অবস্থাতেই, কোনরকম যদিকিন্তু ছাড়াই জড়। র্যাকানিয়েলোর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি।
আলোচনায় ঝাঁপ দেওয়ার আগে দু'লাইনে বলে নেই ভাইরাস জিনিসটা কী- যদিও লেখার মূল পয়েন্ট বোঝার জন্য ভাইরাসের গঠন সম্পর্কে অত বিস্তারিত জানার দরকার নেই। ভাইরাস হচ্ছে প্রোটিন দিয়ে মোড়া একখণ্ড ডিএনএ বা আরএনএ। এই ডিএনএ বা আরএনএর মধ্যে ভাইরাস বানানোর নকশাটা লেখা থাকে। সেই নকশা আবার প্রোটিনের খাপের মধ্যে আটকানো থাকে, যাতে বাইরের আবহাওয়ায় তার ক্ষয়ক্ষতি না হয়। প্রোটিনের মোড়কটার বাইরে আবার কিছু বিশেষ চাবিও বসানো থাকে, সেই চাবিগুলো ব্যবহার করে এরা কোষের মধ্যে ঢুকে বংশবিস্তার করে। হয়ে গেল আপনার বিনামূল্যে ভাইরোলজি ১০১ কোর্স।
যাই হোক, ওপরে যেমনটা বললাম, ভাইরাসকে জীব মনে করার পেছনে মূল যুক্তি হচ্ছে এরা কোষের মধ্যে বংশবিস্তার করে। বংশবিস্তার মানেই তো জীবিত, তাই নয় কি?
উত্তর দিচ্ছি, কিন্তু আগে আমার সাথে এক মিনিট একটু ল্যাবরেটরিতে চলুন। একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হবে।
মনে করুন- একটা কোষের মধ্যে আমরা একটুকরো ডিএনএ ঢুকিয়ে দিলাম। আজকের যুগে এটা করা কোন ব্যাপারই নয়। যেকোন জিনিসের কোষ নিলেই হবে- ধরুন কোন ব্যাকটেরিয়ার কোষই নিলাম, এদের নিয়ে কাজ করা সহজ। ডিএনএ তৈরি করাও কোন ব্যাপার নয়, প্রচুর সংস্থা ব্যবসায়িকভাবেই ডিএনএ তৈরি করে। তো তাদের কাছ থেকে একটুকরো ডিএনএ অর্ডার করে সেটাকে কোষের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। এর পরিণতি কী হবে?
যদি ডিএনএটা সহি সালামতে কোষের একদম ভেতরে- যেটাকে বলে নিউক্লিয়াসে- পৌঁছে থাকে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে একটা মজার ব্যাপার হবে। এই ডিএনএটা কোষের মধ্যে "বংশবিস্তার" করা শুরু করবে।
কোষ ক্রমাগত বিভাজন হতে থাকে জানেন তো। ঠিকমত খাবারদাবার পেলে সে একটা থেকে দু'টো, দু'টো থেকে চারটা- এভাবে বাড়তে থাকে। প্রত্যেকবার বাড়ার আগে তার ভেতরের ডিএনএটুকুকে তার ফটোকপি করে নিতে হয়। বিভাজনের সময় দুই বাচ্চা কোষের মধ্যে একটা করে কপি সুড়সুড় করে ঢুকে পড়ে। তার মানে ডিএনএ ফটোকপি করার যে কারখানা- সেটা কোষের মধ্যে প্রায় সবসময়ই খুটুরখাটুর করে চলতে থাকে। সেই কারখানার সামনে যদি একচিলতে ডিএনএ পড়ে, সে বাছবিচার করে না এই ডিএনএ কি কোষের নিজের, নাকি বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।

কার্টুনের মধ্যে দেখেছেন না- কারখানায় জিনিসপত্র প্যাকিং এর কনভেয়র বেল্ট যখন চলতে থাকে, তার মধ্যে ফট করে টম কিংবা জেরি গিয়ে পড়লে কী হয়? তারা শুদ্ধু প্যাকেজিং হয়ে যায়। যন্ত্র বাছবিচার করে না তাকে কী প্যাকিং করতে বলা হচ্ছে। কোষের ভেতরকার যন্ত্রপাতির সাথে মানুষের বানানো জিনিসের তফাত সেরকম নেই- দু'টোই নির্বোধ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। যার কাজ হাতুড়ি মারা, সে সামনে যাই পড়ুক তার ওপরে গদাম বসাবে।
একইভাবে কোষের ডিএনএ ফটোকপি করার কলকব্জার সামনে যখন জলজ্ব্যান্ত খানিকটা ডিএনএ পড়ে, তখন তারও প্রতিলিপি তৈরি হতে থাকে। মানে ডিএনএর বংশবিস্তার হয় আরকি।
এই পরিস্থিতিতে আপনি কী বলবেন? ডিএনএর টুকরোটা জীবিত? কোষের মধ্যে একচিলতে ডিএনএ ছুঁড়ে দিয়ে আপনি প্রাণ সৃষ্টি করে ফেলেছেন?
আমি অন্তত সেটা বলব না। অথচ ভাইরাসের বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই হয়। এর চেয়ে বেশি এমন কিছু না।
ভাইরাসের ডিএনএ বা আরএনএটুকু যখন কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে পড়ে, কোষ তখন সেটা থেকে হাজারটা প্রতিলিপি তৈরি করে ফেলে। আরেকধাপ এগিয়ে সেই ডিএনএগুলোতে লেখা নির্দেশনা অনুযায়ী সে প্রোটিনও বানিয়ে ফেলে। কোষের মধ্যে প্রোটিনের কারখানা ঐ ডিএনএর মতই একইরকম নির্বোধ- সামনে যা পায় তাই দেখেই জিনিস বানিয়ে যায়। এরকম ভাইরাসের অনেক অনেক প্রোটিন আর ডিএনএ তৈরি হয়ে কোষ যখন ভর্তি হয়ে যায়, তখন এগুলো জায়গার অভাবে একটার সাথে আরেকটা টক্কর খেতে থাকে। এই টক্কর খেতে খেতে ভাইরাসের প্রোটিন আর ডিএনএ জোড়া লেগে লেগে নতুন ভাইরাস তৈরি হয়।
এই হচ্ছে কাহিনী। এই পুরো বিবরণের কোথাও ভাইরাস নিজে থেকে কিছু করছে না- কোত্থাও না। তার ডিএনএ কোষের ভেতর গিয়ে পড়ছে, বাকি সমস্ত কাজ কোষই বোকার মত করে দিচ্ছে।
এই পর্যায়ে কেউ হয়ত আপত্তি করবেন, আমি ভাইরাস জিনিসটার প্রকৃতি একটু বেশি সরলীকরণ করে ফেলছি। কারণ ভাইরাসের মধ্যে তার ডিএনএ বা আরএনএর প্রতিলিপি তৈরি করার যন্ত্র থাকে। নিজের যন্ত্র সে নিজেই বহন করে। যেমন করোনাভাইরাসের মধ্যেও তার নিজের আরএনএ কপি করার একটা যন্ত্র আছে। কাজেই সে যে একদম শতভাগ অথর্ব তা তো না।

কিন্তু এই একখণ্ড যন্ত্র দিয়ে তো তার কোন কাজই হয় না। সেই যন্ত্রও কাজে লাগতে হলে তাকে কোষের কারখানার মধ্যে গিয়ে পড়তে হয়। মানে যন্ত্র হয়ত তার আছে, কিন্তু সেই যন্ত্র চালানো তার বাপের সাধ্যি নয়। কোষের "মেশিনারী" ব্যবহার করেই তার যন্ত্রটা চলে।
এই আলোচনা থেকেই ভাইরাসকে জড় বলার যুক্তিটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। আমরা কথ্য ভাষায় ভাইরাসের অনেক কাজকর্মের কথা বলি- যেমন ভাইরাস বংশবিস্তার করে, ডিএনএর প্রতিলিপি তৈরি করে, বিবর্তন ঘটায়, ইত্যাদি। কিন্তু আক্ষরিকভাবে এই একটা কথাও সত্য নয়। ভাইরাসের বংশবিস্তার করানো হয়, কোষের মাধ্যমে। এর ডিএনএর প্রতিলিপি তৈরি করা হয়, কোষের কারখানা দিয়ে। এর বিবর্তন ঘটানো হয়, কোষের কারিশমাতেই।
আমরা ভাইরাসকে জীবিত বলতে চাই তার একমাত্র কারণ হচ্ছে আমরা একে সবসময় বাক্যের কর্তৃবাচ্যে রাখি। সেটা কথার সুবিধার জন্য। আসলে কিন্তু এর স্থান কর্মবাচ্যে। যেসমস্ত যুক্তি দিয়ে বলা হয় ভাইরাস জীবিত, তার কোনটাই আসলে ভাইরাসের জীবনের পক্ষে যুক্তি নয়- বরং যে কোষটার মধ্যে তার বংশবিস্তার হচ্ছে, তার জীবনের পক্ষে যুক্তি। সে ব্যাটাই গোড়া থেকে ভাইরাসের ঘানি টানছে।
শেষ করি আরেকটা ব্যাপার দিয়ে। ভাইরাসের যে জীবন নেই, এই ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য আপনার সাথে আমি যে কোষের মধ্যে ডিএনএ ছেড়ে দেওয়ার এক্সপেরিমেন্টটা করলাম- সেটা আসলে করার কোন দরকার ছিল না। প্রকৃতিতে এই উদাহরণ এমনিতেই আছে।
আমাদের- মানে মানুষের আরকি- ডিএনএর মধ্যে এমন কিছু অংশ আছে, যারা ডিএনএর মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে। ব্যাপারটার পেছনে মনোরম কিছু প্রাণরসায়নের কলকব্জা আছে, কিন্তু এখানে সেই আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না। আপাতত ধরে নিন এই ডিএনএর অংশগুলোর সাথে এমন কিছু যন্ত্র থাকে, যার মাধ্যমে এরা নিজেদের একজায়গা থেকে উঠিয়ে অন্যত্র কোথাও বসিয়ে দিতে পারে। কোষের মধ্যে এদেরও প্রতিলিপি তৈরি হয়, এবং ক্ষেত্রবিশেষে এরা এক কোষ থেকে বের হয়ে আরেক কোষে চলেও যেতে পারে।
এদেরকে বলা হয় মোবাইল জেনেটিক এলেমেন্টস। আরেকটু সাধারণ ভাষায়- জাম্পিং জিনস।
এদের কাজকর্মের সাথে কিন্তু ভাইরাসদের আদৌ পার্থক্য নেই। এরা এক কোষ থেকে আরেক কোষে যায়, সেখানে তাদের প্রতিলিপি তৈরি হয়, সেই প্রতিলিপি থেকে প্রোটিন তৈরি হয়, কিছু ক্ষেত্রে প্রতিলিপি তৈরির যন্ত্র এরা নিজেরাই বহন করে। এদের বিবর্তনও হয়।

আজ পর্যন্ত আমি দুনিয়ার কোন বিজ্ঞানীকে দেখিনি যারা এই ডিএনএর টুকরোগুলোকে জীবিত বলেছেন। বললে খুব হাস্যকর একটা ব্যাপার হয়- তাহলে বলতে হয় মানুষের জিনোমের বেশ খানিকটা অংশ আসলে স্বতন্ত্রভাবে "জীবিত"। জীববিজ্ঞান ক্লাসরুমে বলতে হয়- আমাদের ডিএনএ দু'প্রকার- মরা ডিএনএ আর জ্যান্ত ডিএনএ।
সেই একই যুক্তিতে, ভাইরাসদেরকেও জীবিত বলার কোন কারণ নেই। এরা কিছু নিষ্ক্রিয় রাসায়নিক পদার্থ। কোষের কলকারখানার আঙ্গিনায় পড়লে কোষ এদের নিয়ে এমন কিছু কাজ করে, যার ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এদের জীবন আছে।
ঐ আপাতদৃষ্টিতে কথাটাই গুরুত্বপূর্ণ আরকি।

Writer: Hassan uz Zaman Shamol   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম