যেকোন বিষয় সম্পর্কে জানার শুরুতে একটা প্রশ্ন করা খুব খুব জরুরি। সেটা হল- এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানার উপায় কী?
বাস্তব জীবনে এর গুরুত্ব কিন্তু আমরা ভালই বুঝি। স্কুলের লাইব্রেরিটা কোন রুমে, এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আপনি দপ্তরি বা ঘণ্টিওয়ালা মামার কাছ থেকে পেতে পারেন। বাইরে কাগজ পেতে বসে থাকা গার্জিয়ানদের এসব জিগেস করে অতটা লাভ নেই। এগুলো কমন সেন্স।
আমরা আছি একটা বিজ্ঞান গ্রুপে। কমবেশি সবারই উদ্দেশ্য বিজ্ঞান সম্পর্কে জানা। কাজেই আমাদেরও আর সবকিছুর গোড়াতে জেনে নেওয়া উচিত- বিজ্ঞান সম্পর্কে নির্ভেজাল জ্ঞানের উৎসটা আসলে কী। সেটা কি ফেসবুকের পোস্ট? জনপ্রিয় লেখকদের বই? নাকি অন্য কিছু?
এই একটা ব্যাপার জেনে গেলেন মানে আপনার মনে বিজ্ঞানের ভিত্তিটা পোক্ত হয়ে গেল।
গবেষণাপ্রবন্ধ বা পেপার
ছোটবেলায় আর্কিমিডিসের গল্প আমরা সবাই পড়েছি- পানির উপচে পড়া নিয়ে কী যেন একটা আবিষ্কার করে বিজ্ঞানী ইউরেকা ইউরেকা বলে রাস্তায় এসে উদ্দাম নৃত্য করেছিলেন।এখনকার বিজ্ঞান আরেকটু অন্যরকম, বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার ফল নিয়ে রাস্তায় নেমে মাইকিং করেন না। অন্তত প্রথমেই না। তাদের গবেষণার ফল জিনিসটার গায়ে "বিজ্ঞান" তকমা লাগার জন্য বেশ কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়।
এজন্য তারা যেটা করেন- প্রথমে তাদের গবেষণার ইতিবৃত্তান্ত নিয়ে সুন্দর করে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। প্রবন্ধগুলোতে প্রথমে লেখা হয়, তাদের এই গবেষণার উদ্দেশ্য কী। আগে এই নিয়ে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা কী কাজ করেছেন। কেন এই বিষয়ে নতুন গবেষণার প্রয়োজন হল। তারপর তারা লেখেন তাদের গবেষণাটা তারা কীভাবে করেছেন, কোন পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, পরীক্ষাগারে কীসের সাথে কী মিলিয়েছেন, অঙ্ক কষে থাকলে কীভাবে কষেছেন। তারপর তারা লেখেন তাদের গবেষণার ফল। সবশেষে লেখেন তাদের কাজের মধ্যে কী কী সীমাবদ্ধতা ছিল, আর এই ব্যাপারে গবেষণা সামনে এগোতে হলে আর কী কী করা বাকি আছে।
স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বিজ্ঞানের ল্যাবখাতা বানিয়েছিলেন না? মোটামুটি ঐ জিনিসই।
প্রবন্ধের ভাষা ও ছবি
প্রবন্ধগুলো লেখা হয় খুব কাঠখোট্টা ভাষায়। এর কারণ আছে। তাদের এই প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের তাদের কাজের ফলাফল জানানো (কেন সেটা নিচে ব্যাখ্যা করছি)। তো পড়বেন যখন অন্য বিজ্ঞানীরাই, তাদের জন্য তো আর অত সহজ করে লেখার দরকার নেই। কঠিন কথা লিখলেও তারা ঠিকই সব বুঝে নেবেন।দ্বিতীয় কারণটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। কঠিন কঠিন কথা ব্যবহার করলে খুব অল্প কথায় কাজ সারা যায়। কিন্তু সহজ করে বলতে গেলে অনেক ফিরিস্তি পোহাতে হয়।
উদাহরণ দেই। ধরুন আপনি আমাকে প্রশ্ন করলেন- নতুন করোনাভাইরাসটার চেহারার সাথে প্রকৃতিতে যেসব ভাইরাস পাওয়া যায়, তাদের হুবহু মিল নেই কেন।
আপনি যদি জীববিজ্ঞান সম্পর্কে সেরকম কিছু না জানেন, তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর আমার শুরু করতে হবে ভাইরাসের গঠন থেকে। করোনাভাইরাসের মধ্যে দু'টো জিনিস থাকে, আরএনএ আর প্রোটিন। প্রথমটা হচ্ছে এর জীবনের নীলনকশা। তারপর বলতে হবে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন প্রজাতি সম্পর্কে। একেক প্রজাতি একেক প্রাণীর মধ্যে থাকে। বিশেষ করে বাদুড়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের অনেকরকম প্রজাতি দেখা যায়। তারপর বলতে হবে, বিভিন্ন প্রাণীর করোনাভাইরাসের মধ্যে আরএনএর আদানপ্রদান হতে পারে। এইসব আদানপ্রদানের নির্দিষ্ট কিছু সিস্টেম আছে। সেই সিস্টেম বোঝাতে হলে ভাইরাস কীভাবে অসুখ করে তা বলতে হবে। অসুখ করার সময় সে যে কোষের ভেতর ঢোকে, তখন একই কোষের মধ্যে একাধিক ভাইরাসের মোলাকাত হতে পারে, হলে কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় আরএনএর অংশবিশেষের আদানপ্রদান হতে পারে- ইত্যাদি হাজারটা জিনিস নিয়ে বিশাল প্যাঁচাল পারতে হবে।
একজন জীববিজ্ঞানী এই সমস্ত আলাপকে শুধু দু'টো শব্দ ব্যবহার করে বুঝিয়ে দিতে পারেন- homologous recombination.
এইজন্যই বিজ্ঞানীরা তাদের প্রবন্ধ লেখার সময় বিশেষজ্ঞ ভাষা ব্যবহার করেন। এর ফলে কম কথায় কাজ সারা যায়, অন্য বিজ্ঞানীরা ইশারা পেয়েই মূল বক্তব্য বুঝে নেন। গবেষণার সহজ প্রচার-প্রসারের জন্য এই ব্যাপারটা খুবই জরুরি।
এই প্রবন্ধগুলোর আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছবি। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার সারাংশ বোঝানোর জন্য জটিল কিছু ছবির সাহায্য নেন। ছবিগুলো হতে পারে গ্রাফ, কোন মডেল, ফ্লোচার্ট, তাদের গবেষণার কোন অংশের ফোটো, বা অন্য কিছু। যেকোন গবেষণা প্রবন্ধের প্রাণ হচ্ছে এই ছবিগুলোই। এগুলো দেখেই অন্য বিজ্ঞানীরা মোটামুটি কাজের ধরণ সম্পর্কে মূল আইডিয়াটা করে নেন। এগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে বড় বড় প্রবন্ধের ক্ষেত্রে অনেকসময় বিজ্ঞানীরা এসব ছবি নিজে বানান না, পেশাদার আর্টিস্টদের সাহায্য নেন।
কমেন্টে একটা ছবির লিঙ্ক দিলাম- গিয়ে একটু দেখতে পারেন। এই এক ছবিতেই বিজ্ঞানীরা তাদের সমস্ত কার্যপ্রণালী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। আপনি দেখলে হয়ত বুঝবেন না, কিন্তু এই লাইনের অন্য বিজ্ঞানী দেখলে ঠিকই ধরতে পারবেন।
তো প্রবন্ধ লিখে তারপর বিজ্ঞানীরা কী করেন?
জার্নাল ও পিয়ার রিভিউ
খেলাধূলা কিংবা ফ্যাশনের জন্য যেরকম আলাদা সাময়িকী আছে, বিজ্ঞান সমাজেরও সেরকম আলাদা কিছু সাময়িকী আছে। এদেরকে বলা হয় জার্নাল। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণাকে এভাবে প্রবন্ধ আকারে লিখে জার্নাল বরাবর জমা দেন।জমা দিলেই যে জার্নাল কর্তৃপক্ষ তা ছাপিয়ে ফেলেন, তা কিন্তু নয়। প্রত্যেক জার্নালের পক্ষ থেকেই বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী মোতায়েন করা থাকে। তারা প্রবন্ধটার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, কোথাও ভুল হল কিনা দেখেন, ভুল হলে শুধরোনোর উপায় কী তা বাতলান। যেমন ধরুন, কোন পরীক্ষা ঠিকমত হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে যদি তাদের সন্দেহ থাকে, তাহলে তারা পরীক্ষাটার ফলাফলের ছবি দেখতে চান। ছবি নকল হলে সেটা ধরার সিস্টেমও তাদের জানা আছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা একই পরীক্ষা আরেকবার করে আবার প্রবন্ধ নতুন করে জমা দিতে বলেন। তাদের তীক্ষ্মদৃষ্টি পেরিয়ে তারপরই এটা জার্নালে আসে।
গবেষণা প্রবন্ধগুলোর এরকম চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াকেই বলা হয় পিয়ার রিভিউ। পিয়ার মানে সমকক্ষ। বিজ্ঞানীদের গবেষণা অন্য বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেন- যেন সমকক্ষরা একজন আরেকজনের কাজের পর্যালোচনা করছেন। যে জার্নাল যত বড়, তার পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়া তত কঠিন।
এই প্রক্রিয়াটা থেকে আমরা বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রচার সম্পর্কে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর পাই- সেটা হল বিজ্ঞানীরা প্রথমেই তাদের গবেষণা নিয়ে বই লিখে ফেলেন না কেন। এর কারণ হল, অন্য বিজ্ঞানীদের খেয়ে দেয়ে প্রচুর কাজ আছে। তাদের সারাদিন অন্যদের গবেষণা পড়ার সময় নেই। কাজেই আপনি আপনার নিজস্ব গবেষণা নিয়ে দুশ' পৃষ্ঠার বই লিখবেন, আর অন্য বিজ্ঞানীরা কাজকর্ম ভুলে সেই বই লাইন ধরে ধরে পড়ে গবেষণার ভুল বের করার চেষ্টা করবেন- ব্যাপারটা খুবই অসুবিধাজনক। অন্যদিকে এই প্রবন্ধ সিস্টেমের সুবিধা হল, বিজ্ঞানীরা প্রবন্ধ লেখার সময় চেষ্টা করলেও খুব বেশি গবেষণা নিয়ে একেবারে লিখতে পারেন না। প্রত্যেকটা প্রবন্ধে তাদের গবেষণার সীমিত একটা অংশ নিয়ে মোটামুটি সর্বাধিক বিশ পৃষ্ঠার মধ্যেই যা লেখার লিখতে হয়। এর ফলে অন্য বিজ্ঞানীরা সেটা সহজে পড়তে পারেন, মন্তব্য করতে পারেন। পুরো প্রক্রিয়াটার মধ্যে একটা স্বচ্ছতা থাকে।
ওপরে ঐ ছবির কথা বললাম না? ওটার উদ্দেশ্যই একই। প্রবন্ধের বক্তব্য অন্য বিজ্ঞানীদের সহজে বোঝানো। বিজ্ঞান জগতে স্বচ্ছতা বজায় রাখার এটা একটা চমৎকার উপায়।
জার্নালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধগুলোই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে জানার সবচেয়ে নির্ভেজাল উপায়। বিজ্ঞানীরা প্রথমে খেটেখুটে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বের করেন, তারপর সেটা প্রবন্ধ আকারে লিখে জার্নালে জমা দেন, সেখানে অন্য বিজ্ঞানীরা তাদের তথ্য আর যুক্তিতর্কে সন্তুষ্ট হলে তারপরই সেটা প্রকাশিত হয়।
যত জায়গায় বিজ্ঞান সম্পর্কে যত কথা দেখেন, যদি তা ঠিক হয়ে থাকে- ঘুরে ফিরে তাদের সবকিছুরই জন্ম হয় এই প্রবন্ধগুলোতে। বিজ্ঞানীরা ইন্টারেস্টিং কোন গবেষণা করার পর সাংবাদিকরা তার দলবলের সাক্ষাৎকার নিতে চান। সেই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে (এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রবন্ধের বক্তব্য পড়ে) সংবাদমাধ্যমগুলোতে বৈজ্ঞানিক খবর আসে।
আর এখানেই সমস্যার শুরু।
কখনো সংবাদমাধ্যমে খবর ঠিকভাবে আসে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আসে ভুলভাবে। বিজ্ঞান সম্পর্কে যত লোকের যত ভুল ধারণা, সবকিছুর গোড়াতেই আছে মূল গবেষণাপ্রবন্ধগুলো না পড়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোথাও থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করা। বিশেষ করে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের হাতে বিজ্ঞান কীভাবে নাজেহাল হতে পারে, সেটা নিয়ে আমি অনেক আগে একটা লেখা লিখেছিলাম। কমেন্টে সেটার লিঙ্ক দিলাম- উৎসাহীরা পড়ে দেখতে পারেন।
Writer: Hassan uz Zaman Shamol
Tags:
Science