আমরা আলোচনা করছিলাম বিজ্ঞান সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার উপায় নিয়ে। গত পর্বে বলছিলাম, বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন কীভাবে, এবং পেপার-জার্নাল-প িয়ার রিভিউ কথাগুলোর অর্থ কী। কমেন্টে আগের পর্বের লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি।
আজকে আমরা আরেকটু নোংরা একটা বিষয় নিয়ে কথা বলব। সেটা হল- এই যে বিজ্ঞানের গবেষণাপ্রক্রিয়া - গবেষণা করা, প্রবন্ধ লেখা, জার্নাল বরাবর জমা দেওয়া, পিয়ার রিভিউ হওয়া- এগুলোর মধ্যে কি মাঝেমধ্যে ভুলত্রুটি থাকতে পারে? এমন কি হতে পারে পিয়ার রিভিউ করা গবেষণাপত্রেও ভুল তথ্য এসেছে?
লেখার শুরুতেই এর উত্তর এক কথায় আপনাদের জানিয়ে দেই- আলবত পারে। পিয়ার রিভিউ করা গবেষণাপত্রেও ভুল আসতে পারে। বিজ্ঞানী সমাজ আদৌ ভুল বা (কিছু ক্ষেত্রে) অপরাধের উর্ধ্বে নন।
কিন্তু- এবং এই কিন্তুটাই অনেকে মিস করেন- এটা আসলে অত বড় কোন সমস্যা নয়।
আমরা সবাই জানি জাল টাকা বলে একটা বস্তু আছে। হয়ত অসাবধানে আপনার হাত দিয়েও দু'টো একটা জাল নোটের পাচার হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কি আমরা টাকাপয়সা ব্যবহার করা বন্ধ করে দেই?
মোটেই না। কারণ জাল থেকে ভাল টাকা আলাদা করার কিছু উপায় আছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য- ভেজাল থেকে নির্ভেজাল বিজ্ঞান আলাদা করার উপায় আছে।
উপায়টা এক কথায় এরকম- কোন বিষয়ে একটা-দু'টা গবেষণাপত্রে ভুল আসা অস্বাভাবিক না। যেটা অস্বাভাবিক- এবং প্রায় অসম্ভব- সেটা হল একই ব্যাপারে অনেকগুলো গবেষণাপত্রে ভুল তথ্য আসা।
বিজ্ঞানীরা কখনো একক গবেষণাপত্রের কথা চোখকান বন্ধ করে বিশ্বাস করেন না। তারা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা গবেষণাটা আরেকবার করে ফলাফলকে বাজিয়ে দেখেন। এভাবে কোন একটা ফলাফল যদি পৃথিবীর বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে আলাদা আলাদাভাবে প্রমাণ করেন- তাহলে সেই ব্যাপারটা নির্ভেজাল বিজ্ঞানের পর্যায়ে উঠে আসে।
এই প্রক্রিয়াটাকেই বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি reproducibility বা পুনরাবৃত্তিকরণ।
এটা আসলে বেশ লম্বা এবং কিছু ক্ষেত্রে জটিল আলোচনা, কাজেই পুরো ব্যাপারটাকে কয়েক পর্বে ভেঙ্গেচুরে লিখছি। আজকের পর্বে মূল আলোচনায় ঢুকব না, আগে আপনাদেরকে একটা মজার ওয়েবসাইট দেখাব। এই ওয়েবসাইটটা একই সাথে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা ও সৌন্দর্যের একটা চমৎকার প্রমাণ।
সাইটটার নাম রিট্র্যাকশান ওয়াচ। কমেন্টে লিঙ্ক দিয়ে দিলাম।
মাঝেমধ্যে জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পরও দেখা যায়, প্রবন্ধে কোথাও ভুল আছে। হয় উপাত্তেই ভুল, অথবা দু'নম্বুরী, পিয়ার রিভিউ ঠিকমত হয়নি, অথবা অন্য কোথাও কোন গণ্ডগোল। এরকম ধরা পড়লে অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীকে বাধ্য করা হয় তার প্রবন্ধ ফিরিয়ে নিতে। এটাকে বলা হয় রিট্র্যাকশান। প্রবন্ধ রিট্র্যাকশান হওয়া একজন বিজ্ঞানীর জন্য খুবই অসম্মানের বিষয়। এর ফলে বিজ্ঞানী হিসেবে তার দক্ষতা- এবং কিছু ক্ষেত্রেও সততাও- প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। একবার একটা প্রবন্ধ রিট্র্যাকশান হয়েছে বলে বিজ্ঞানীর পদোন্নতি আটকে গেছে, এরকম নজির আমি নিজে দেখেছি।
তো যে ওয়েবসাইটটার কথা বলছি, তারা যত জায়গায় বিজ্ঞানের যত প্রবন্ধের এরকম রিট্র্যাকশান হয়- সব দলিলপত্র জমিয়ে রাখে। এখন পর্যন্ত ওয়েবসাইটটাতে তেইশহাজার তিনশ' আটষট্টিটা এরকম প্রবন্ধ দেখতে পাচ্ছি, যারা প্রথমে জার্নালে এসেছিল, কিন্তু নানা সমস্যার জন্য পরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওয়েবসাইটটাতে গেলে আপনি দেখতে পারবেন কোন প্রবন্ধের গবেষণা বা রিভিউ প্রক্রিয়ায় কোথায় কবে ভুল হয়েছে, কেন হয়েছে, ধরা পড়ল কীভাবে, ইত্যাদি।
সাইটটার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং অংশ হল নতুন করোনাভাইরাস সম্পর্কিত পেপারগুলো। এ যাবত এই নিয়ে বিগত কয়েক মাসে পনেরোটা পেপার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে- কোনটা পিয়ার রিভিউ হওয়ার পরে, কোনটা তার আগেই। বোঝাই যাচ্ছে, করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য পৃথিবীর তাবৎ বিজ্ঞানী রীতিমত হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। এই ভাইরাস নিয়ে আমরা কেউই কিছু জানি না, গবেষণার জন্য তাই রীতিমত সোনার খনি। এত তাড়াহুড়োয় প্রবন্ধ লিখে ছাপাতে গিয়েই সমানে এদিক-সেদিক ভুলভ্রান্তি হচ্ছে।
এই পনেরোটা পেপারের বিষয়বস্তু যদি দেখেন, খেয়াল করবেন অধিকাংশই একটু "চাঞ্চল্যকর" টাইপের- কেউ দাবি করে বসেছেন করোনাভাইরাস এসেছে এইচআইভি থেকে, কেউ দেখানোর চেষ্টা করেছেন এসি বাসের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ভাইরাস ভেসে ভেসে গেছে, কিংবা নতুন কোন ওষুধে করোনা ভাল হয় তার বৃত্তান্ত। এসব দেখে আমরা সহজেই আঁচ করতে পারি ঘটনা কী হয়েছে- বিজ্ঞানীরা তাড়াহুড়ো করে ভাইরাসটা নিয়ে নতুন গরমাগরম চাঞ্চল্যকর কিছু গবেষণা ছাপাতে গেছেন। পরে বোঝা গেছে আগে থেকেই এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক হয়নি। আরেকটু ধীরস্থির হয়ে গবেষণাটা করার দরকার ছিল।
বিজ্ঞান গবেষণায় কী ধরণের ভুলত্রুটি হয়- এই মর্মে আমার যেকোন ব্যাখ্যার চেয়ে এই ওয়েবসাইটটা শতগুণে কাজের। সে রীতিমত হাতেকলমে আপনাকে বাস্তবতা শিখিয়ে দেবে। এখানে অন্তত তেইশ হাজার তিনশ' আটষট্টিটা প্রমাণ আছে যে, বিজ্ঞানের জগত ভুলের উর্ধ্বে নয়। যতই খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ আর পিয়ার রিভিউ থাকুক।
Writer: Hassan uz Zaman Shamol
Tags:
Science