১।
ধরুন আপনার ছোটবেলা থেকেই কোনকিছুর শখ। সেটা হতে পারে ঘুড়ি ওড়ানো বা মাছ ধরা। আমার সবসময়কার ঝোঁক ছিল ভিডিও গেম। সেই বাচ্চাকাল থেকেই। ধরে নিলাম আপনার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। আপনি একজন সাংঘাতিক পর্যায়ের ‘গেমার’।
একদিন আপনার মাথায় চিন্তা এল- আচ্ছা, ভিডিও গেম জিনিসটাকে তো আমি খুবই পছন্দ করি। এমনটা কি করা যায় না যে এইসব ভিডিও গেম নিয়েই আমি বাকি জীবন কাটাব? ভিডিও গেম খেলার চাকরি বলে কি কিছু আছে?
ব্যাপারটা নিয়ে আপনি একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলেন, গেম জার্নালিস্ট বলে আসলেই একটা বস্তু আছে। এই পেশার মানুষদের কাজ হল যখন যত ভিডিও গেম বের হয় একধার থেকে সব খেলা এবং রিভিউ করা।
একটু লেখার হাত থাকলে এর চেয়ে ভাল চাকরি আপনার জন্য আর হয় না। এতদিন বড়দের কথা কানে তুলেই ভুল করেছেন। সারাদিন ভিডিও গেম নিয়ে পড়ে থাকাতেই আসল মুক্তি।
কিন্তু এরকম পেশাদার গেমারদের সাক্ষাৎকার ইত্যাদি যখন শুনলেন, তখন ব্যাপারটা আপনার কাছে একটু কেমন কেমন ঠেকল। এই মানুষগুলো দিনরাত ভিডিও গেম খেলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা তাদেরকে একটা কড়া গঠনতন্ত্রের মধ্যে থেকে করতে হয়। এদের কাজ হচ্ছে নতুন ভিডিও গেম বের হওয়ার সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব সেটা আগাগোড়া খেলা শেষ করে রিভিউ বের করা। এর ফলে গেমটা কেমন যেন গিলে ফেলতে হয়, আস্বাদন করা হয় না। আর সবসময় সব গেম খেলতে তো ভালও লাগে না। মনে করুন আপনার খেলতে ইচ্ছে করছে চাষবাসের গেম। কিন্তু উপরতলার লোকেরা হয়ত বলছে- চাষবাস সামনের মাসে, এই সপ্তাহে ঐ রক্তারক্তির গেমটা নিয়ে লিখতে হবে। কাজেই সেটা আপনার এখনই খেলতে বসতে হবে। পরীক্ষার আগের রাতে যেরকম চা-কফির সাগরে ভেসে পুরো সিলেবাস নিয়ে বসতে হয়, সেরকম এখানে আপনার রাত দু'টো তিনটে চারটে পর্যন্ত শত্রু মারতে হবে।
চাকরি মানেই হল কোন একটা কাজের বিনিময়ে আপনাকে টাকাপয়সা দেওয়া। অর্থই অনর্থের মূল জানেন তো। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত উপরতলার লোকেরা আপনার জীবন খানিকটা বিষিয়ে তুলতে না পারছেন, ততক্ষণ যেন টাকাটা উসুল হয় না।
উদাহরণ দিলাম ভিডিও গেমের, কিন্তু জীবনের আরো সিরিয়াস বিষয়ের ক্ষেত্রে এই কথা আরো বেশি প্রযোজ্য। যেমন বিজ্ঞান।
আমাদের দেশের সদ্য জীববিজ্ঞান গ্র্যাজুয়েটদের জন্য আইসিডিডিআর,বি নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্যারিয়ার অপশন, অন্তত প্রথম ক'টা বছর। আমি গ্র্যাজুয়েশানের পরপরই আইসিডিডিআরবি,তে যোগদান করি, এবং টেক্সাসে পিএইচডি করতে আসার আগ পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর এখানে কাজ করি। এই পুরো সময়টার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গেলে বই হয়ে যাবে। আমার এই লেখাটার উদ্দেশ্য আরো সীমিত- আইসিডিডিআর,বিকে প্রেক্ষিত হিসেবে ব্যবহার করে চাকরিজীবনে বিজ্ঞানচর্চা ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা। একজন জীববিজ্ঞানের ছাত্র যখন তার ইউনিভার্সিটির ল্যাবে গবেষণা করে, সেটার সাথে টাকার বিনিময়ে গবেষণা করার চেহারা প্রকৃতির কিছু গুরত্বপূর্ণ ফারাক আছে। মিলও আছে, কারণ বিজ্ঞানচর্চা তো বিজ্ঞানচর্চাই। কিন্তু ফারাকগুলো সম্পর্কে জানাই মনে হয় বেশি জরুরি।
২।
সিরিয়াস কথায় যাওয়ার আগে আইসিডিডিআর,বিতে কাজ করার সবচেয়ে স্থূল সুবিধাগুলো বলে নেই। একজন জীববিজ্ঞান ছাত্রের জন্য এক চাকরির দু'টো বাহ্যিকভাবে স্পষ্ট সুবিধা আছে।
প্রথম হল টাকা। দ্বিতীয় প্রেস্টিজ।
আইসিডিডিআর,বিতে যোগ দেওয়ার সাথে সাথে ইদানিং একজন জীববিজ্ঞান গ্র্যাজুয়েট কমপক্ষে সিনিয়ার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট (গ্রেড-৪) পদে বেতন পায়। আমি থাকা অবস্থায় এই পদে বেতন ছিল ত্রিশ হাজারের কিছু বেশি। বছর বছর বাড়ার ফলে এখন সেটা পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি থাকার কথা। আমার জানামতে দেশের ফার্মাসিউটিকালসগুলোতে এন্ট্রি লেভেলে আমাদের বেতন এই পর্যায়েরই (বা কিছু কম) হয়। কপাল আরেকটু ভাল হলে রিসার্চ অফিসার (গ্রেড-৫) পদেও সার্কুলার হয়, সেখানে বেতন পঁয়তাল্লিশ হাজারের মত। এন্ট্রি লেভেল চাকরি হিসেবে গবেষণা লাইনে এটা নিঃসন্দেহে বেশ মোটা অঙ্কের বেতন।
আইসিডিডিআর,বিতে প্রোমোশান পলিসি একেক ল্যাবে একেক রকম, কোথায় কীরকম ফান্ড আছে তার ওপর নির্ভর করে- কিন্তু মোটামুটি ধরে নেওয়া যায় বছর দুই বা বেশি হলে তিনের মাথায় প্রোমোশান হবে। আমার নিজের ক্ষেত্রে দুই বছর পূর্ণ হওয়ার কিছু আগেই প্রোমোশান হয়েছিল (গ্রেড-৫ থেকে গ্রেড-৬ এ), কিন্তু এটা আসলে নির্ভর করে আপনি যে ল্যাবে আছেন সেখানকার প্রোজেক্টে টাকার পরিমাণ, কাজের ধরণ আর সুপারভাইজারের তুষ্টির ওপর।
এই গেল টাকা।
প্রেস্টিজের ব্যাপারটা যদি এক কথায় বলি- আপনি বাংলাদেশের যেখানেই যান না কেন, আইসিডিডিআর,বি বা কলেরা হাসপাতালকে সবাই এক নামে চিনবে। আপনার কোন আত্মীয় বন্ধু বান্ধব সিনিয়র কেউই কখনও প্রশ্ন করবে না- আইসিডিডিআর,বিটা যেন কোথায়? ব্যাঙ্ক ট্যাঙ্ক নাকি? এক শব্দে নিজের চাকরির জায়গার পরিচয় দিতে পারা এবং বলার সাথে সাথে সবাই সেটা বুঝে যাওয়ার মধ্যে একটা শান্তি আছে। গ্র্যাজুয়েশানের পরপর যারা বিয়ের চিন্তা করেন, তাদের এই ব্যাপারটা মাথায় রাখা উচিত (যদিও বিসিএস ক্যাডারের সাথে নিজের অবস্থানকে তুলনা করবেন না)।
এছাড়াও আইসিডিডিআর,বিতে থাকার কারণে আপনার এমন কিছু অভিজ্ঞতা হবে যা আপনার ব্যাচমেট দেশের অন্য জায়গায় ওভাবে পাবে না। মাঠেঘাটে গবেষণার জন্য গেলে মাঝে মধ্যে আপনাকে আমজনতার মধ্যে বুদ্ধিজীবীর মত ইন্টারভিউ দিতে হবে, দেশী-বিদেশী অর্গানাইজেশানের হর্তাকর্তারা আইসিডিডিআর,বির অফিসার হিসেবে আপনার কথা কাজ গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন। সাথে আইসিডিডিআর,বির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য-টৈতিহ্যের কথা মাথায় আসলে একটু ইয়ে অনুভব করা তো আছেই। এই শেষের ব্যাপারটা আলাদা করে মনে রাখার কিছু নেই- বিশেষ করে আপনার সুপারভাইজার যদি বুড়ো গোছের হয়ে থাকেন তাহলে তিনি উঠতে বসতে এগুলো আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবেন। এরকম টুকিটাকি ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিন্তু স্মৃতি হয়ে থাকে আরকি। পরিবার পরিজনকে বলে আনন্দ পাবেন।
আরেকটু বেহায়া হলে চাকরি ছাড়ার পর আইসিডিডিআর,বির অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লাইক কামানোর ধান্ধাও হয়ত করবেন।
তো এসব গেল। এবার আসি বিজ্ঞানে।
৩।
বিশেষ করে গ্র্যাজুয়েশানের পর আমাদের অনেকের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধারণাটা থাকে খুব সরলরৈখিক। গবেষণার প্রোডাক্টিভিটি মানে আমাদের কাছে ল্যাবে কাজ করা এবং কয়েক মাস/বছর অন্তর অন্তর গবেষণাপত্র প্রসব করা। ইউনিভার্সিটির ল্যাবে মাগনা গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আসলেই তাই।আইসিডিডিআর,বির মত সংস্থায় গবেষণার প্রোডাক্টিভিটির চেহারাটা এর চেয়ে অনেক জটিল, এবং সেই চেহারা আপনার পছন্দ হতেও পারে, নাও হতে পারে।
এটা বুঝতে গেলে আগে আপনার ইউনিভার্সিটির ল্যাব আর আইসিডিডিআর,বির মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। আপনি যখন গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট ছিলেন, আপনার কাজ ছিল মোটামুটি একজন টেকনিশিয়ানের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনার সুপারভাইজার স্যার বা ম্যাডাম বলে দিয়েছিলেন অমুক অমুক কাজগুলো কর, আপনি সেগুলো করেছেন, এবং পুরো সময়টাতে আপনার সৃজনশীলতা বা মুক্তচিন্তার একমাত্র জায়গা ছিল গবেষণার প্রোটোকল নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে 'অপ্টিমাইজ' করা। কখনও হয়ত আপনি গবেষণায় নতুন কোন অংশ জোড়া লাগিয়েছেন, কিন্তু আপনার অধিকাংশ কাজই যে টেকনিশিয়ান-টাইপের তাতে সেরকম সন্দেহ নেই।
আপনি বিজ্ঞানের যে অংশটুকুর সাথে এতদিন পরিচিত ছিলেন, সেটা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার শুরু নয়, বরং শেষ।
গবেষণা করতে গেলে ল্যাবে পরীক্ষা করার আগে আরো অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়, যেগুলো একজন ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট ছাত্র হিসেবে হয়ত এতদিন আপনার অ্যান্টেনায় বাঁধেনি। এতদিন আপনাকে একটা গবেষণাগারভর্তি রসদপত্র সাজসরঞ্জাম তৈরি করে দিয়ে স্যার-ম্যাডামরা বলেছিলেন- নাও অমুক কাজটা কর। কিন্তু সেই রসদ কোথা থেকে এল?
যেকোন ধরণের গবেষণা করার জন্য প্রথমে যে বস্তু লাগে সেটা হল টাকা। পৃথিবীর বেশ কিছু অনুদান সংস্থা শুধু এই উদ্দেশ্যেই টাকার বস্তা নিয়ে বসে আছে। বিজ্ঞানীদের দরখাস্ত সাপেক্ষে তারা তাদের সাগর থেকে বালতি বালতি করে পানি দেয়।
এই টাকা আনার পথ ঊষর কণ্টকাকীর্ণ।
সাধারণত আইসিডিডিআর,বিতে টাকা আনার প্রক্রিয়া শুরু হয় কোন বৈজ্ঞানিক পার্টনার বা কোলাবরেটর জোগাড় করার মাধ্যমে- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা বিদেশের কোন গবেষক দল। তারপর শুরু হয় তাদের সাথে মিলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে দিন নেই রাত নেই করে স্টাডির নকশা করা, বাজেট বানানো, অনুদান হাতানোর জন্য দরখাস্ত লেখা। এই সময়টাতে অফিসে রাত এগারোটা-বারোটা বাজা অস্বাভাবিক না। অবশেষে প্রতীক্ষার পর কপাল ভাল থাকলে পনেরো-বিশ শতাংশ ক্ষেত্রে টাকা মঞ্জুর হয়।
টাকা মঞ্জুর হওয়া গবেষণার প্রথম ধাপ। এরপর লিগ্যালে গিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমওইউ করো রে, ফাইন্যান্সে দৌড়ে বাজেট মঞ্জুর করো রে, রিসার্চ অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের সাথে কথা বলে ইন্সটিটিউশান রিভিউ বোর্ডের একশ' পাতার প্রোটোকল বানাও রে, শ'খানেক লোকের কাছে হাজার সাইনের জন্য হুটোপুটি করে বেড়াও রে, লোকলস্কর আনার জন্য এইচআরকে ধরো রে- বিজ্ঞান অতিশয় কুৎসিত বস্তু। এই সব কিছু পার করে প্রজেক্ট শুরু করতে পারলে তারপর জিনিসপাতি অর্ডার করা, গ্র্যান্টের টাকা ঠিকঠাকমত আনার জন্য ইনভয়েস করা, মাঠে কাজ থাকলে (না থাকার সম্ভাবনা কম) সেদিককার যুদ্ধকৌশল ঠিক করা- কবে কোথায় যাওয়া হবে, কার কী দায়িত্ব, যাওয়ার জন্য টাকাপয়সা কোত্থেকে আসবে, ফাইন্যান্সের লোকজন সেটা মানবে কিনা, কোলাবরেটর ঘাড়ত্যাড়ামি করবে কিনা, ইত্যাদি লাখো চিন্তার পর তারপর ল্যাবের মধ্যে পা দেওয়ার সৌভাগ্য হয়।
আইসিডিডিআর,বিতে আপনাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে একজন অফিসার হিসেবে, টেকনিশিয়ান হিসেবে নয়। কাজেই ক্ষেত্রবিশেষে এই পুরো প্রক্রিয়ার যেকোন অংশের সাথে আপনাকে যুক্ত থাকতে হতে পারে। আমি কাজ করার সময় এর এমন কোন অংশ ছিল না যার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলাম না- দরখাস্ত জমা দেওয়া থেকে নিয়ে পানি সংগ্রহের বোতল কেনা পর্যন্ত।
আমার বক্তব্য হল বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রোডাক্টিভিটি জিনিসটাকে নব্য গ্র্যাজুয়েটরা অনেক ক্ষেত্রে যেরকম সীমিতভাবে দেখে থাকেন, আইসিডিডিআর,বি বা কোন গবেষণা সংস্থা অনেক ক্ষেত্রেই সেভাবে দেখবে না। এমন হতেই পারে যে আপনি যোগদান করলেন রিসার্চ অফিসার পোস্টে, কিন্তু বছর শেষে দেখলেন আপনার মূল প্রোডাক্টিভিটি হল বাজেট করতে করতে এক্সেলটা মোটামুটি শিখে যাওয়া। আবার অন্যদিকে হয়ত আপনি প্রতিদিনই ল্যাবে 'গবেষণা' করছেন- শ'খানেক বোতল পানি টেস্ট করছেন- কিন্তু এগুলোর শেষে কোন পাবলিকেশান নেই, কারণ এগুলো আইসিডিডিআর,বির সেবামূলক কাজের অংশ।
৪।
এবার আসুন বিজ্ঞানের ধরণ নিয়ে একটু কথা বলি। আপনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে চান বটে, কিন্তু আমি মোটামুটি নিশ্চিত আপনি যেকোন ধরণের গবেষণা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন না। আপনি করতে চান আপনার "লাইনের" গবেষণা। এতদিন যদি আপনি প্রাণরসায়ন পড়ে আসেন, তাহলে আজ পরিসংখ্যানবিদ হতে বললে আপনি হয়ত একটু দোনোমোনো করবেন। মোটকথা কী ধরণের বিজ্ঞানচর্চা আপনি করতে চান- সে বিষয়ে আপনার কিছু ধারণা বা আশা-ভরসা আছে।
আমি যখন গ্র্যাজুয়েশানের পর আইসিডিডিআর,বিতে ভাইভা দিয়ে আসলাম, তখন এই সংস্থায় কী ধরণের সায়েন্স করব সেটা সম্পর্কে আমারও কিছু ধারণা ছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমি আমার মাস্টার্স থিসিসে যা কাজ করেছি, একটা আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিডিডিআর,বিতে করা কাজ তার চেয়ে বেশি জটিল এবং 'উন্নতমানের' হবে। জীববিজ্ঞান ছাত্রদের জন্য বলছি- পুরো মাস্টার্সে আমার কাজ ছিল ডিএনএ এক্সট্র্যাকশান করে পিসিআর অপটিমাইজ করা, তারপর সিকোয়েন্স ডেটা আসলে ফাইলোজেনি নিয়ে খানিকটা নাড়াচাড়া।
আইসিডিডিআর,বিতে আমাকে প্রথম যে প্রজেক্টে নেওয়া হল সেটার "অণুজীব বিজ্ঞান" অংশ ছিল চাঁদপুরের মতলব থেকে বোতল বোতল পানি এনে সেখানে পায়খানার জীবাণুর সংখ্যা গোনা।
এটুকুই।
এমনিতে প্রজেক্টটার উদ্দেশ্য ছিল ইন্টারেস্টিং- গ্রামের মানুষের দারিদ্র্য, পেশা, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ইত্যাদির সাথে তাদের খাওয়ার পানির গুণাগুণ বা ডায়ারিয়ার প্রকোপের কোন সম্পর্ক আছে, কিনা সেটা তলিয়ে দেখা। কিন্তু এই প্রজেক্টের পঁচানব্বই ভাগ হচ্ছে সমাজবিদ্যা আর অর্থনীতি, বাকি পাঁচ ভাগ অণুজীব বিজ্ঞান। সেই পাঁচ ভাগও শুধুমাত্র রোবটের মত পানি টেস্ট।
আইসিডিডিআর,বিতে আমার করা আরো কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট- আর্সেনিকমুক্ত পানি দীর্ঘদিন সরবরাহ করার ফলে স্থানীয় মানুষজনের মূত্রে আর্সেনিকের পরিমাণ কমেছে কিনা সেটা দেখা, ল্যাট্রিন থেকে বের হওয়া ব্যাকটেরিয়া আশেপাশের ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষতি করতে পারে কিনা দেখা, ইত্যাদি।
তবে ক্ষুরধার বিজ্ঞানের কাজ যে একেবারে করিনি তা নয়। বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির সাথে ঢাকার জলাশয়গুলোর অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে খুবই চমৎকার একটা কাজ আমরা করেছিলাম, যেটার অংশ হিসেবে গত বছর ইংল্যান্ডে যাওয়ার সৌভাগ্যও হয়েছিল। বাংলাদেশের একজন সদ্য গ্র্যাজুয়েটের ক্ষেত্রে এরকম ডাকাবুকো প্রফেসরের সাথে কাজের সুযোগ পাওয়া বিশাল ব্যাপার। আর সবার অভিজ্ঞতা আমার সাথে মিলবে এমন ভাবার কারণ নেই। আইসিডিডিআর,বির ভেতরে স্থান-কালের প্রভাব অনেক- একেক স্থানে এবং একেক সময়ে গবেষণার মান একেকরকম দেখা যায়।
আমার উদ্দেশ্য তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পুরো সংস্থাটার সরলীকরণ করা নয়। আইসিডিডিআর,বিতে ঢুকলে আপনার জনস্বাস্থ্যের কাজ করার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রের বাস্তবতা। এটুকু নিয়েই কথা বলছি।
এটার প্রেক্ষিতে একটা জিনিস বুঝুন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির বা নর্থ সাউথের ল্যাবরেটরিতে আপনি যে কাজ করে এসেছেন, আইসিডিডিআর,বিতে করা কাজ যে তার চেয়ে বেশি "এক্সাইটিং" হবে, সেটা ভাবার কোন কারণ নেই। এটা বোঝার জন্য আপনার তখনকার আর এখনকার পরিস্থিতির দু'টো পার্থক্য বুঝতে হবে। প্রথম ব্যাপারটা সেই টাকার বিনিময়ে ভিডিও গেম খেলার মত। ভার্সিটির ল্যাবে থিসিস করার সময় আপনার কাজ ছিল একটা এবং কেবলমাত্র একটা- নির্দিষ্ট করে দেওয়া কোন একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করা। কিন্তু আইসিডিডিআর,বিতে আপনি একজন বেতনভোগী কর্মচারী। এখানে আপনি নিজের মনের আনন্দে গবেষণা করে বেড়ান খুব ভাল কথা, কিন্তু সেই গবেষণা যদি টাকা আনতে না পারে, তাহলে আপনাকে বেতন দিয়ে রেখে ল্যাব ও সুপারভাইজারের লোকসান। সাংগঠনিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে আপনি টাকা আনা বা আনীত টাকা উসুলের একটা হাতিয়ার মাত্র।
দ্বিতীয়ত, আমরা গরীব দেশের মানুষ। আমাদের এখানে সবচেয়ে দামী বিজ্ঞান হল জনস্বাস্থ্য। ভিব্রিও কলেরির ইন্টিগ্রেজ জিনগুলোর ফাইলোজেনি বের করা আপনার মাস্টার্স থিসিসের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কলেরার ভ্যাক্সিন পরীক্ষা করা তার চেয়ে বহুগুণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই বাংলাদেশের এক নম্বর গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিডিডিআর,বিও একই নীতিতে বিশ্বাসী হবে এটা স্বাভাবিক- তারা দেশে বড়সড় প্রভাব রাখে এমন গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে চাইবে। এজন্যই এখানের গবেষণা হল গরীবদুখীর দুঃখ মোচনের গবেষণা- শ'খানেক ভ্যাক্সিনকৃত মানুষের রক্তের নমুনা নিয়ে এসে সেটার মার্কার দেখা, মলের নমুনায় জীবাণু পরীক্ষা করা, হাতধোয়া পানিতে কয়টা করে জীবাণু থাকে সেটার গোনাগুনতি, এইগুলো হচ্ছে এসব রিসার্চের থিম বা ভাব।
বাংলাদেশে এসব বিজ্ঞানের বৈষয়িক মূল্যই বেশি। এজন্যই গঠনগত ভাবেই প্রতিষ্ঠানটার ঝোঁক একটু জনস্বাস্থ্য-ঘেঁষা বিজ্ঞানের দিকে। আপনি ইউনিভার্সিটি থেকে অতিআণুবীক্ষণিক জগত আর কাটিং-এজ সায়েন্সের প্রতি যে বুকভরা কৌতুহল নিয়ে বেরিয়েছেন, সেই কৌতুহলটার অর্থমূল্য বাংলাদেশে কম।
এটাই বাস্তবতা।
৫।
এই সমস্যাগুলোর এড়ানো আসলে খুব কঠিন নয়। এর জন্য আপনাকে প্রথমে বুঝতে হবে, আইসিডিডিআর,বি কোন একটা প্রতিষ্ঠান নয়, অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি। আইসিডিডিআর,বির একেকটা গবেষণাগার প্রায় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের মত আচরণ করে। কাজেই একেক জায়গার পরিবেশ একেক রকম, এবং সেটা নির্ভর করে দু'টো বিষয়ের ওপর- কোথায় পয়সাকড়ি কেমন আছে, আর নৌকার হাল কার হাতে।
যেমন ধরুন, আপনি চিন্তা করছেন আইসিডিডিআর,বির দ্বিতীয় তলায় কোন একটা ল্যাবে ঢুকবেন। আপনার যদি বিজ্ঞানচর্চার প্রতি খুব মোহ থাকে, তাহলে একটু ল্যাবের অন্যান্যদের সাথে কথা বলে জানুন যে ল্যাবে তাদের দৈনন্দিন জীবন কীরকম। হয়ত তারা বলবেন ল্যাবের খুব ভাল সময় যাচ্ছে, আর তারা খুব ইন্টারেস্টিং গবেষণা করছেন। অন্যদিকে, হয়ত তারা বলতে পারেন এই ল্যাবের অ্যাডমিনিস্ট্রেশান দেখার জন্য আলাদা লোক নেই, কাজেই সুপারভাইজার তার জীববিজ্ঞান গ্র্যাজুয়েটদের নিয়েই বাজেটপত্র বানান বা ইনভয়েস করেন। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরেকটু জটিল হয়ে দাঁড়াবে। আবার এমনও হতে পারে যে ল্যাবটা বিজ্ঞান করে ঠিকই, কিন্তু সেটা গবেষণার বিজ্ঞান নয়, সেবামূলক বিজ্ঞান। সেক্ষেত্রে আপনার কাজ হয়ত হবে সারাদিন রোবটের মত শত শত বোতল পানি টেস্ট করা আর দিনশেষে রিপোর্ট প্রিন্ট করে খামবন্দী করা।
তবে আপনার উদ্দেশ্য যদি থাকে বাইরের দেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যাওয়ার, তাহলে আইসিডিডিআর,বি কথাটা আপনার ভর্তি দরখাস্তে সুন্দর দেখাবে। এতে সন্দেহ নেই, তা আপনি আইসিডিডিআর,বিতে যাই করুন না কেন। এই সুবিধা, টাকাপয়সা, আর মানসম্মান- এই তিন জিনিসে যদি আপনার না পোষায়, তাহলে বিজ্ঞানচর্চার কালচার সংক্রান্ত কয়েকটা ব্যাপার আগে থেকে জেনে তবেই এখানে চাকরিতে ঢোকা উচিত।
=========================
পরিশিষ্ট
আগেই বলেছি, আমার লেখাটার উদ্দেশ্য ছিল চাকরিজীবনে বিজ্ঞান করতে আসলে যেসব জটিলতার সম্মুখীন হতে হয় সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা বলা। এজন্য এই লেখাটাতে হয়ত আইসিডিডিআর,বিতে কাজ করার অসুবিধামূলক দিকগুলোই বেশি এসেছে। কিন্তু আইসিডিডিআর,বিতে কাজ করার অনেক সুবিধাও আছে। আমি আজ পর্যন্ত বিশ্বাস করি আমার আইসিডিডিআর,বি জীবনে লোকসানের চেয়ে লাভ বেশি। সেগুলো নিয়ে হয়ত অন্য কোনদিন লিখতে বসব।
দ্বিতীয়ত, আইসিডিডিআর,বিতে গবেষণা করার আরো অজস্র জটিলতা আছে, যেগুলো এই ক্ষুদ্র পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। আইসিডিডিআর,বির বর্তমান বা প্রাক্তন কেউ হয়ত আমার লেখা দেখে মনে করবেন আসল জটিলতাগুলোই এখানে আসেনি। অন্যান্য জটিলতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কর্মচারীদের ওপর সুপারভাইজারের প্রভাব (যেটা কিছু ক্ষেত্রে একচ্ছত্র), ফিল্ডওয়ার্ক করতে যাওয়ার অসুবিধা-কষ্ট, সুপারভাইজার ও ল্যাবগুলোর মধ্যকার পলিটিক্স, ক্ষেত্রবিশেষে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনাড়িপনা, ইত্যাদি।
এগুলো অবশ্য দেশের অন্যান্য গবেষণার চাকরিতেও হয়ত কমবেশি থাকে।
Writer: Hassan uz Zaman Shamol
Tags:
Biology