১।
আমরা আজ শিখছি ঈশ্বরের ভাষা- যে ভাষায় তিনি জীবন সৃষ্টি করেছেন।
কথাগুলো মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের।
এবং কথাগুলো স্রেফ ভাঁওতাবাজি।
স্কুলের জীববিজ্ঞান থেকে আমরা জানি, আমাদের দেহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষ দিয়ে তৈরি। সেই কোষের মধ্যে একরাশ সুতোর মত যে জিনিসটা থাকে তার নাম ডিএনএ। এই ডিএনএই হচ্ছে আমাদের জীবন রহস্যের ধারক ও বাহক। আমাদের দেহের গঠন, কর্মপদ্ধতি, শারীরতত্ত্ব, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদি যাবতীয় তথ্য ডিএনএর মধ্যে চারটি বর্ণমালায় "লেখা" থাকে। মানুষের ডিএনএতে অক্ষরের সংখ্যা মোটামুটি তিনশ' কোটি। সংবাদমাধ্যমে "জিনোম সিকোয়েন্সিং" বলে যে একটা কথা মাঝেমধ্যে আসে- সেটার মানে এই অক্ষরগুলো সব পড়ে ফেলা।
তো মানুষের কোষের এই তিনশ’ কোটি অক্ষর পড়ার প্রক্রিয়াটা বিজ্ঞানীরা শেষ করলেন আজ থেকে ষোল বছর আগে, দু'হাজার তিন সালে। তার কিছুদিন আগে ক্লিনটন এই প্রেক্ষিতে উক্তিটা করেছেন। কিন্তু যেমনটা বললাম, এরকম কথা নেহায়েতই ভাঁওতাবাজি। কারণ অক্ষর চেনা আর ভাষা শেখা এক কথা নয়।
ধরুন আমি আপনাকে আরবি ভাষায় লেখা একটা প্রবন্ধ দিলাম। আপনি মুসলমান পরিবারে বড় হয়ে থাকলে হয়ত ছোটবেলায় হুজুরের কাছে কোরান শিখেছেন- সেই হুজুরলব্ধ জ্ঞানের ধ্বংসাবশেষ খাটিয়ে আপনি প্রবন্ধের অক্ষরগুলো চিনতে পারবেন। এমনকি জের জবর পেশ দেওয়া থাকলে উচ্চারণ করে খানিকটা পড়েও যেতে পারবেন। তার মানে এই না যে আপনি আরবি ভাষা বোঝেন বা শিখেছেন।
তেমনি জিনোম সিকোয়েন্সিং করা মানে শুধু অক্ষরজ্ঞান হওয়া। অন্যদিকে জীবনের ভাষা শেখা মানে আমাদের ডিএনএতে তিনশ' কোটি অক্ষর পাশাপাশি সাজানোর ফলে কী কী শব্দ গঠিত হয়েছে, শব্দগুলো পাশাপাশি বসে কীভাবে বাক্যগঠন করছে, সেই বাক্যগুলো একসাথে হয়ে কীরকম অনুচ্ছেদ হয়েছে, সেই শব্দ-বাক্য-অনুচ্ছেদের আক্ষরিক অর্থ কী, রূপক অর্থ কী, এক অনুচ্ছেদের সাথে অন্য অনুচ্ছেদের সম্পর্ক কী, একেক শব্দের অর্থ একেক অনুচ্ছেদে একেকরকম কিনা- ইত্যাদি সহস্র জটিল ভাষাতাত্ত্বিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া। সে পর্যায়ে মানুষের ডিএনএর মর্মোদ্ধার করা আজ থেকে ষোল বছর আগে তো সম্ভব হয়ই নি, এমনকি আজকেও বিজ্ঞানীরা তার যে খুব একটা কাছে এসেছেন তা বলা যায় না।
তবে এই ভাঁওতাবাজি প্রধানমন্ত্রী একা করেননি। নিচের ছবিটা দেখুন- এটা টাইম ম্যাগাজিনের জুলাই ২০০৩ সংখ্যার প্রচ্ছদ। ছবিতে জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রকল্পের দুই মোড়লকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রচ্ছদের ওপরের শিরোনামটা খুবই আপত্তিকর। Cracking the code মানে গোপন সংকেতের মর্মোদ্ধার করা। কিন্তু এই জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রকল্পের উদ্দেশ্য আদৌ ডিএনএর মর্মোদ্ধার করা ছিল না, ছিল শুধু এর অক্ষরগুলোর ক্রম বের করা- আরবি প্রবন্ধের আলিফ বা তা সা এর ক্রম বের করার মত। সেদিক থেকে দেখলে আরো সার্থক শিরোনাম হত Finding the code। সেটার অবশ্য বাজারমূল্য হয়ত খানিক কম হত।
এরকম ভাঁওতাবাজির উদ্দেশ্য অবশ্য বোঝা কঠিন নয়, তবে এর জন্য একটা অমোঘ এবং তেতো সত্য প্রথমে গিলতে হবে।
বিজ্ঞানের যদি ইঞ্জিন বলে কিছু থাকে, তাহলে সেই ইঞ্জিনটার নাম টাকা।
টাকা গবেষকদের পকেট থেকে আসে না, আসে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অনুদান থেকে। অনুদান তারা তখনই দেবে যদি তারা বোঝে আপনার কাজের আসলেই গুরুত্ব আছে। মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সিং এর কাজ করার জন্য ফ্রান্সিস কলিন্সের গ্রুপকে সরকারের কাছ থেকে প্রায় তিনশ' কোটি মার্কিন ডলার বাগাতে হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি মাথায় রাখলে আজকে এর পরিমাণ হত পাঁচশ কোটি। প্রকল্পটার গুরুত্ব একটু বাড়িয়ে চাড়িয়ে না বললে জনগণের করের এতগুলো টাকা সরকার দিতে রাজি হত কিনা সন্দেহ।
দয়া করে কেউ ভুল বুঝবেন না- মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সিং আসলেই জীববিজ্ঞানের একটা বিপ্লব। আজকের জীববিজ্ঞানের অনেক আবিষ্কারই এই কাজটা করা না থাকলে সম্ভব হত না, বিশেষ করে ক্যান্সার গবেষণা বা রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে।
কিন্তু সেসময়কার বিজ্ঞানী আর রাজনীতিবিদরা ব্যাপারটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রায় আগুন আবিষ্কারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই একটা প্রকল্প শেষ হলেই চিকিৎসাশাস্ত্রে একটা নতুন যুগের সূচনা হয়ে যাবে- এই জাতীয় অদ্ভুত কথাবার্তা তখন শোনা যেতে লাগল। ক্লিনটন সেখানে ঈশ্বরকে টেনে এনে ব্যাপারটাকে আরো মহার্ঘ করে তুললেন।
যদিও ডিএনএর ভাষা শেখার কাজ তখনও শুরুই হয়নি।
শুরু যেদিন হল, সেদিন বিজ্ঞানীরা একটা বড়সড় ধাক্কা খেলেন।
২।
ডিএনএর কাজ যে এমনিতে কী, সেটা অবশ্য বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই জানতেন। ডিএনএ থেকে তৈরি হয় আরএনএ, আরএনএ থেকে প্রোটিন। প্রোটিন আমাদের দেহের যাবতীয় কাজকর্ম করে।
ব্যাপারটাকে একটা উদাহরণ দিয়ে এভাবে বোঝানো যেতে পারে।
ডিএনএ হচ্ছে একটা রান্নার বই। রান্নার বইতে যেরকম বিভিন্ন খাবারের রেসিপি দেওয়া থাকে, ডিএনএতে সেরকম নানারকম প্রোটিন তৈরির রেসিপি লেখা থাকে। প্রতিটি কোষ তার ডিএনএতে লেখা রেসিপি দেখে প্রয়োজনমাফিক প্রোটিন বানিয়ে নিতে পারে।
সাধারণত খুব দামি বই বা পাণ্ডুলিপি ঘরে ঘরে থাকে না- থাকে গ্রন্থাগারে বা লাইব্রেরিতে। ডিএনএ নামক রান্নার বইটাও অসম্ভব দামি। কাজেই এটা কোষের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে না, নিউক্লিয়াস নামক লাইব্রেরিতে সযত্নে রাখা থাকে। এই বইকে লাইব্রেরির বাইরে আনার অনুমতি নেই।
উদাহরণটার এই জায়গায় এসে আমরা একটা ঝামেলার সম্মুখীন হচ্ছি। বইতে লেখা রেসিপি দেখেই কোষকে প্রোটিন রান্না করতে হবে, কিন্তু বইটাকে আবার লাইব্রেরির বাইরে নেওয়া যাবে না। তার মানে রান্না করতে হলে লাইব্রেরির মধ্যেই করতে হবে। এটা তো কোন কাজের কথা নয়। শেষ কবে আপনি লাইব্রেরিতে রান্নার চেষ্টা করেছেন?
এই ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য কোষ যেটা করে- যখন তার যে প্রোটিনের প্রয়োজন হয়, সে ডিএনএ থেকে তার রেসিপির একটা ফটোকপি বানিয়ে নেয়। এই ফটোকপিটার নামই হচ্ছে আরএনএ। আরএনএতে লেখা ফটোকপি প্রয়োজনমাফিক পৌঁছে যায় কোষের বিভিন্ন রান্নাঘরে, আর সেই ফটোকপি দেখে কোষ প্রোটিন বানায়।
মোটামুটি কোষের মধ্যে ডিএনএর কাজ এরকম বলেই বিজ্ঞানীরা জানতেন। ডিএনএ থেকে আরএনএ থেকে প্রোটিন। মানুষের জিনোম সিকোয়েন্স করার সময় তাই বিজ্ঞানীরা আশা করছিলেন, গোটা ডিএনএ জুড়ে লাখের পর লাখ প্রোটিনের রেসিপি লেখা থাকবে। সেই রেসিপিগুলো বোঝা মানে জীবনকে বোঝা।
জীববিজ্ঞান অত সহজ নয়।
জিনোম সিকোয়েন্সের কাজ শেষ হওয়ার পর গোটা জীববিজ্ঞান সমাজ বিস্ফারিত চোখে দেখলেন- আমাদের ডিএনএর মোটে দুই থেকে তিন শতাংশে প্রোটিনের রেসিপি লেখা। অর্থাৎ আমাদের ডিএনএর তিনশ' কোটি অক্ষরের মাত্র নয় কোটি অক্ষরে প্রোটিন বানানোর নির্দেশনা, বাকি দুশ' একানব্বই কোটি অক্ষর যেন হিজিবিজি।
সেই বিস্ময়ের ধাক্কা আমরা আজ পর্যন্ত ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কোন মানে হয় এর?
বিজ্ঞানীরা অবশ্য হাল ছাড়ার পাত্র নন। তারা ছুরিকাঁচি নিয়ে নতুন উদ্যমে ডিএনএর স্তূপে ঝাঁপ দিয়েছেন।
আজকের জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে সক্রিয় গবেষণাক্ষেত্রগুলোর একটা হল সেই বাকি দুশ' একানব্বই কোটি অক্ষরের মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করা। এগুলো যে পুরোটাই একেবারে ফেলনা নয় সেটা মোটামুটি বিজ্ঞানীরা মেনেছেন, কারণ অনেক অসুখবিসুখের সাথেই এই হিজিবিজি অক্ষরগুলোর একটা যোগ পাওয়া গেছে। এই মর্মোদ্ধারের কাজ করতে গিয়ে ডিএনএ সম্পর্কে আমাদের পুরোনো অনেক ধারণাই বদলাতে হয়েছে।
যেমন ধরুন- আগে যেমনটা বললাম, এতদিন আমরা ডিএনএকে প্রোটিনের রেসিপি বই ভেবে এসেছি। ডিএনএতে সারি সারি নির্দেশনা দেখে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এর একমাত্র কাজ হল কোষের তথ্যসম্ভার হিসেবে কাজ করা- ডিএনএ "পড়ে" কোষ তার কাজকর্ম বুঝে নেয়। কিন্তু ডিএনএকে এরকম "বই" হিসেবে ভাবার একটা সমস্যা আছে।
আপনি আপনার কাছাকাছি রাখা বইটার কথা চিন্তা করুন। এই জিনিসটা দিয়ে কি আপনি শুধু পড়াশোনাই করতে পারবেন?
হ্যাঁ, বইটা লেখা হয়ত হয়েছে পড়ার জন্য, কিন্তু তার উপযোগিতা সেখানে সীমাবদ্ধ নয়। পড়াশোনা ছাড়াও বইটা দিয়ে আপনি আরো হাজারটা কাজ করতে পারবেন- হার্ডকভার হলে সেটা দিয়ে কাউকে ঠ্যাঙাতে পারবেন, রুমের মধ্যে শর্ট পিচ ক্রিকেটের ব্যাট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন, বইয়ের প্রতি সেরকম মায়াদয়া না থাকলে তেলাপোকা মারতে পারবেন, এর কাগজ ছিঁড়ে চুলায় আগুন জ্বালানো থেকে নৌকো পর্যন্ত বানাতে পারবেন। আমরা বই জিনিসটাকে সম্মানের চোখে দেখি বলে এর এতসব অন্যান্য কাজকর্মের কথা ভাবি না।
ডিএনএকে যেদিন আমরা বই ভাবা শুরু করলাম- সেদিন থেকেই মনে করলাম এর একমাত্র কাজ কোষের পাঠ্য হিসেবে কাজ করা। কিন্তু প্রাণিকোষ আপনার-আমার থেকে অনেক চালাক- সে ডিএনএর মত এত চমৎকার একটা বই খালি পড়ালেখার কাজে ব্যবহার করতে নারাজ। সে তাই ডিএনএ দিয়ে হাজার প্রয়োজনের কাজ করতে লাগল।
কোষের মধ্যে ডিএনএ অজস্র বিচিত্র ধরণের কাজ করে- কখনো ক্রোমোজোমের প্রান্তে টুপির মত বসে থাকে, কখনো কোষের পুরো গঠনটাকে ধরে রাখে, কখনো আরএনএর ফ্যাক্টরি বানায়।
ডিএনএ দিয়ে এসব অদ্ভুত কাজ করার জন্যই হয়ত এর সেই বাকি সাতানব্বই শতাংশে প্রোটিনের রেসিপি লেখা নেই, কারণ সেগুলো কোষের অন্যান্য কাজে আসে। এর জন্য যে পুরো ডিএনএটাই সবসময় লাগে তা অবশ্য নয়, এর বিভিন্ন অংশ দিয়ে বিভিন্ন কাজ হয়। একটা কাগজের নৌকো বানাতে তো আর পুরো বইটা ছত্রখান করার দরকার হয় না।
সত্যি কথা বলতে, ডিএনএর কাজ যে আসলে কী তার সম্পূর্ণ তালিকা এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে নেই, এবং সেই তালিকা আসতে আরো বহুদিন লাগবে। কিন্তু আমরা যে ডিএনএকে শুধু পাঠ্যবই হিসেবে দেখা থেকে বের হতে পেরেছি, এটা নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
চলুন ডিএনএর এরকম অদ্ভুত আরো দুয়েকটা কাজ দেখে আসি।
৩।
প্রথমে কথা বলি ডিএনএ দিয়ে প্যাকেট বানানো নিয়ে।
মানুষের ক্রোমোজোম তেইশ জোড়া- এই কথা মোটামুটি হাই স্কুল জীববিজ্ঞান থেকে আমরা জানি। ডিএনএ সুতোর মত মানলাম, কিন্তু সে বাটিতে রাখা নুডলসের মত কোষময় ছড়িয়ে থাকে না। কোষ তাকে কয়েকটা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সাজিয়ে রাখে। প্রত্যেকটা ভাগকে বলা হয় ক্রোমোজোম। একেক প্রাণীর কোষে এরকম ভাগের সংখ্যা একেক- মাছির থাকে আটটা ভাগ, কেঁচোর থাকে বারোটা, ইঁদুরের চল্লিশটা। মানুষের কোষে এরকম তেইশ জোড়া অর্থাৎ ছেচল্লিশটা ক্রোমোজোম বা ডিএনএর টুকরো আছে।
এই ক্রোমোজোমের সবগুলো সবসময় সক্রিয় থাকা কাজের কথা নয়- ক্ষেত্রবিশেষে দু-একটা ক্রোমোজোমকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলার দরকার হতে পারে। এর উপায় হল ক্রোমোজোমকে প্যাকেটে ভরে ফেলা। এই প্যাকেটজাত করার প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে মজার।
আগেই বলেছি আমাদের ডিএনএ থেকে তৈরি হয় আরএনএ। আমাদের একটা ক্রোমোজোম থেকে খুব অদ্ভুত একজাত আরএনএ তৈরি হয়। এদের গায়ে কোন প্রোটিনের রেসিপি লেখা থাকে না, কারণ এদের একমাত্র কাজই হল ক্রোমোজোমকে 'প্যাকেট' করা। এটার জন্য কোষ যেটা করে- ডিএনএ থেকে প্রথমে ফটোকপি করে অনেক অনেক আরএনএ তৈরি করে। এই আরএনএগুলো তারপর ক্রোমোজোমের গায়ে একের পর এক জমা হতে থাকে। জমা হতে হতে এক পর্যায়ে তারা ক্রোমোজোমটাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে। এই করতে করতে ক্রোমোজোম দুমড়ে মুচড়ে ভাঁজ হয়ে একদম ছোট্ট একটা গিট্টু হয়ে যায়। ব্যাস, সে নিষ্ক্রিয় হয়ে বাকি জীবন বসে থাকে- কোষের মধ্যে কোন সমস্যা করে না।
লক্ষ্য করুন, ডিএনএ এই প্রক্রিয়ায় কোষের তথ্যসম্ভার বা পাঠ্যবই নয় মোটেই। বরং তার কাজ হল প্যাকেট করা। বইয়ের উদাহরণটা এখানে খানিকটা প্রযোজ্য- বই পড়া যায় মানলাম, কিন্তু এর পাতা ছিঁড়ে প্যাকেজিং এর কাজেও ব্যবহার করা যায়। কোষ সেটাই করছে।
ডিএনএর এরকম অদ্ভুতুড়েমির দ্বিতীয় উদাহরণটা আরো মজার।
আমার মতে জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে অদ্ভুত শাখাগুলোর একটা হল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের দেহ যে কায়দাকানুনগুলো করে সেগুলো আশ্চর্যরকম জটিল, এবং এই সিস্টেমের ক্ষুদ্রতম অংশটুকু বুঝতে গেলেও এক জীবন পেরিয়ে যাবে।
খুব সহজভাবে বলতে গেলে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হচ্ছে দেহের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সীমান্তরক্ষীদের মনে তাও যতটুকু দয়ামায়া থাকে, আমাদের দেহের ততটুকুও নেই- তার পলিসি হচ্ছে রোগজীবাণু দেখামাত্র আক্রমণ। এই নির্মম বাহিনীর অংশ হিসেবে দেহ বিভিন্ন ধরণের কোষ তৈরি করে রাখে। এদের কাজ হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় টহল দেওয়া, এবং রোগজীবাণু পেলে ঝাঁপিয়ে পড়া। এই ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্যাপারটা একেক কোষ একেকভাবে করে। কেউ গোলাগুলি করে, কেউ হেডকোয়ার্টার থেকে নতুন সৈন্যসামন্ত চেয়ে বসে, কেউ বিমান হামলা চালায়, আবার কেউ নিউক্লিয়ার ছাড়ে। এসবের আঘাতে মাঝেমধ্যে আমাদের দেহেরও ক্ষতি হয়, কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য থাকে শত্রুকে বিদেয় করা।
তো আমাদের দেহের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক অগ্রদূত সেনাসদস্যের নাম হল নিউট্রোফিল। দেহে কোন জীবাণু ঢুকলে প্রথম ডাক পড়ে এদেরই। এদের শত্রুকে পরাস্ত করার এক আশ্চর্য উপায় আছে।
যখন নিউট্রোফিল দেখে রক্তের মধ্যে কেহ বা কাহারা অসৎ উদ্দেশ্যে এদিক ওদিক ঘুরছে, তখনই শুরু হয় তার প্রস্তুতি। সাধারণত আমাদের কোষের মধ্যে ডিএনএ থাকে মোটামুটি জমাট বাঁধা অবস্থায়। নিউট্রোফিল শত্রুর উপস্থিতি টের পেলে তার ডিএনএটার জটটা আস্তে আস্তে ছাড়াতে থাকে। খুলতে খুলতে পুরো ডিএনএটা টেনেহিঁচড়ে সে বিশাল একটা জালের মত বানিয়ে ফেলে। সেখানেই শেষ নয়, তারপর সে ডিএনএর জালের মধ্যে বিষাক্ত কিছু রাসায়নিকের প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। শত্রু কাছাকাছি আসলেই নিউট্রোফিল তার ভেতর থেকে ডিএনএর সেই বিষাক্ত জালটাকে স্পাইডারম্যানের মত ছ্যাঁত করে ছুড়ে মারে। বেচারা জীবাণুর আর পালানোর পথ সেরকম থাকে না, সে এই জালের মধ্যে কাতরাতে কাতরাতে মারা পড়ে।
বইপত্র বিদ্যার বস্তু মানলাম, কিন্তু কেউ যদি খুব নিবেদিতপ্রাণ হয়- তাহলে সে একটা হার্ডকাভার বই দিয়ে পিটিয়ে কাউকে মেরেও ফেলতে পারবে। নিউট্রোফিল তার ডিএনএ দিয়ে মোটামুটি সেটাই করছে।
৪।
দেহের এরকম আরো সহস্র রকমের কাজে আমাদের ডিএনএ ব্যবহৃত হয়। এজন্যই এর কোন একক কার্যকারিতা নেই- কোষ তার সুবিধেমত যখন যা কাজ পায় তাতেই ডিএনএকে ব্যবহার করে। প্যাকেটজাত করা আর আক্রমণের জাল ছাড়াও কখনো কোষ ডিএনএকে ব্যবহার করে জিনিসপত্র পাচারের গাড়ি হিসেবে, কখনো তার কাজকর্মের সময় মাপার ঘড়ি হিসেবে, কখনো বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ শুষে নেবার স্পঞ্জ হিসেবে, কখনো খানাখন্দ ভরাট করার বালু হিসেবে। প্রত্যেকটা গল্পই মজাদার। আপনি এক লাইব্রেরী বইয়ের কথা চিন্তা করুন- এই বইগুলোর কাগজপত্র মলাট দিয়ে আপনি হেন কাজ নেই যা করতে পারবেন না। এটা শুধু কল্পনার ব্যাপার। আমাদের কোষ আমাদের চেয়ে আরো অনেক বেশি কল্পনাপ্রবণ।
বিজ্ঞানীরা এখন ডিএনএর এসব নানাবিধ অদ্ভুত কাজকর্ম একটা একটা করে আবিষ্কার করছেন। এর সেরকম কোন শর্টকাট রাস্তা নেই- আমাদের মূল কাজ ল্যাবরেটরিতে বসে টুকরো টুকরো ডিএনএর গতিবিধি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আস্তে আস্তে ডিএনএর একের পর এক নতুন কাজকর্ম আলোতে আসছে।
এই যাত্রা কবে শেষ হবে এখনই বলা মুশকিল। হয়ত সামনের কোন একদিন আমরা এক পাহাড় তথ্য উপাত্ত গবেষণার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পারব ডিএনএর সম্পূর্ণ কাজের লিস্টিটা কীরকম।
সেদিন যদি ক্লিনটন ঈশ্বরের ভাষা-টাষা নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেন, তাকে হয়ত আমরা অতটা দোষ দেব না।
--------------------------------------
তথ্যসূত্র
এই লেখার প্রত্যেকটা বিষয়ই মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত, কাজেই আলাদা করে তথ্যসূত্র উল্লেখ করার এমন কিছু নেই। জিনোম সিকোয়েন্সিং এর ইতিহাস, ডিএনএর মূল কাজ, X ক্রোমোজোমের ইন্যাক্টিভেশান (আমি যেটাকে বলেছি প্যাকেটজাতকরণ)- এই সবকিছুই জেনেটিক্স বা বায়োকেমিস্ট্রির গোড়ার দিকের কথা।
ব্যতিক্রম হচ্ছে নিউট্রোফিলের জাল। এই জালগুলোকে বিজ্ঞানী মহল ডাকেন Neutrophil Extracellular Trap, আর জাল বানানোর প্রক্রিয়াটাকে বলেন NETosis। গুগলে সার্চ করলেই এ সম্পর্কে একরাশ গবেষণাপত্র পেয়ে যাবেন।
Writer: Hassan uz Zaman Shamol
Tags:
Biology