তানভীরের বাবা মারা গিয়েছেন কয়েকদিন আগে। ওর মা মারা গিয়েছেন গত বছরই। এখন সে তার বড় বোন মিথিলার(বিবাহিত
একদিন তানভীর তার এসব চিন্তার কারনে নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে। অনুতপ্ত হয়ে সে তাদের কথা আর শিশুকালের স্মৃতি মনে করার জন্য একদিন তার বাবা-মা যে বাসায় ছিল সেখানে যায়। সেই বাড়ির চাবি সে চুপিচুপি এনেছে। বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই সে তার বাবা-মার রুমটায় যায়। রুমটা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে খোলা হয়নি। রুমটায় ঢুকেই তানভীরের চোখ পড়ল তার বাবার বইয়ের সমাহারের উপর। রুমের একপাশ পুরোটা জুড়ে একটা দানব আকৃতির বুক শেল্ফ। বুক শেল্ফটার পাশেই একটা জানালা এবং তার সামনে একটা টেবিল আর চেয়ার। রুমের অন্যপাশে একটা খাট আর আলমিরা। বুক শেল্ফটায় বেশির ভাগ বই হিউম্যান ব্রেইন নিয়ে। যদিও ওর বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। একসময় নাকি ওর বাবা ব্যবসায় খুবই পারদর্শী ছিলেন ব্যবসায়। বিয়ের কয়েক বছর পর সেই পারদর্শীতা আর টিকেনি - এমটাই বলেছিল মিথিলা। তানভীর বাবাকে প্রায়ই এইসব বই নিয়ে দেখত। ব্যবসা সংক্রান্ত বই নিয়ে ওর বাবাকে সে কখনোই দেখেনি, হয়তো এক-দুবার। বুক শেল্ফ এর বই গুলো এখনো পরিষ্কার। তানভীর বুক শেল্ফটার কাছে গিয়ে প্রথমেই দৃষ্টি অর্পণ করে 'ডু নো হার্ম' বইটার উপর, হেনরি মার্শের লিখা। বাবা মারা যাওয়ার আগে এই বইটা পড়তে দেখেছে সে। বইটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে রেখে দেয় সে। তারপর সে যায় টেবিলটার দিকে। টেবিলটার উপর অল্প ধুলো। সে চেয়ারটা বিনা শব্দে আলতো করে টান দেয় এবং তাতে বসে পরে। এই চেয়ারেই সে তার বাবাকে কাঠের মতো স্হির ভাবে বসে থাকতে দেখে ছোটবেলায় ভয় পেত।টেবিলের উপর একটা টেবিল ল্যাম্প আছে। তাতে ধুলো জমে যেন এর সৌন্দর্য আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। সে খেয়াল করে যে টেবিলের নিচের দিকে একটা ড্রয়ের হালকা খোলা। তানভীর ড্রয়েরটি টান দিয়ে খুলে দেখে ভিতরে কয়েকটা হিসাব নিকাশের কাগজ। ড্রয়েরটি পরিষ্কার তবে কোনা দিয়ে একটা কাগজের ছোট টুকরা যেন কাঠের নিচ থেকে উকি দিচ্ছে। সেটা টান দিতেই কাঠের ড্রয়েরের নিচের কাঠটি নড়ে উঠে। সে ভাবলো ড্রয়েরটি সে ভেঙে ফেললো কিনা। সে কাঠের টুকরোটি তুললে দেখতে পায় তার নিচে আরেকটি কাঠের স্তর এবং তার উপর অনেক মাকড়সার জালে মোড়ানো একটা ডায়েরি। সে অবাক হলো, বিস্মিত হলো কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারল না। ডায়রিটা হাতে নিয়ে ফুঁ দিতেই সব মাকড়সার জাল ঊড়ে গেল। ডায়রিটা পুরনো এবং কালচে খয়েরি রঙের। ছোট একটা কম পেজের ডায়েরি। কভারটার একটা কোনা ছেড়া। তানভীর খুবই রোমাঞ্চিত এই পুরানো ডায়েরি দেখে। কি আছে তাতে দেখার জন্য সে আগ্রহী। বাবা তাকে নিয়ে কি ভাবত তা জানতে সে প্রবল উৎসাহী ।কভারের উপর কোনো লিখা নেই। কভারটা উল্টোতেই প্রথম পৃষ্ঠা থেকে খুবই স্পষ্ট এবং নিপুণ অক্ষরে কালো কালি দিয়ে লিখা লাইনগুলো দেখে সে। কোনো সময়ের উল্লেখ নেই কোথাও।
ডায়রিকি এমন হয় নাকি? - ভাবল সে। তারপর ডায়রিটা পড়া শুরু করল তানভীর।
ডায়রিকি এমন হয় নাকি? - ভাবল সে। তারপর ডায়রিটা পড়া শুরু করল তানভীর।
ডায়রির লিখা -
" আমি ডায়রি লিখি না। লিখার অভ্যাসও নেই। তাই আমি বিশেষ এই ঘটনার কথা বলছি আজ। এটা লিখে যাচ্ছি আমি কারন এই মহা পাপের কথা আমি কখনো বলতে পারব না। আর আমি চাই না যেন এটা সবসময় অজানা থাকুক। তাই এই লিখা। তুমি যেই হউ না কেন, আমার পাপের কথাটা মনযোগ দিয়ে পড় এবং আমি কি ক্ষমার যোগ্য কিনা তা জানিয়ে দিও। কেউ আমার এই পাপের কথা জানলে আমি স্বস্তি বোধ করব বলেই আমার ধারনা। আর এটা পড়ার পর ডায়রিটা পুড়িয়ে ফেলো। এই ডায়রিতে কোনো তারিখ লিখব না। কেন তা জানি না। লিখত ইচ্ছে হচ্ছে না। হয়তো আমি ভয় পাচ্ছি আমি কে তা তোমরা জেনে যাবে বলে। তোমার দায়িত্ব এটা পড়ে পুড়িয়ে ফেলা। আর যদি পার ক্ষমা করে দেয়া।
" আমি ডায়রি লিখি না। লিখার অভ্যাসও নেই। তাই আমি বিশেষ এই ঘটনার কথা বলছি আজ। এটা লিখে যাচ্ছি আমি কারন এই মহা পাপের কথা আমি কখনো বলতে পারব না। আর আমি চাই না যেন এটা সবসময় অজানা থাকুক। তাই এই লিখা। তুমি যেই হউ না কেন, আমার পাপের কথাটা মনযোগ দিয়ে পড় এবং আমি কি ক্ষমার যোগ্য কিনা তা জানিয়ে দিও। কেউ আমার এই পাপের কথা জানলে আমি স্বস্তি বোধ করব বলেই আমার ধারনা। আর এটা পড়ার পর ডায়রিটা পুড়িয়ে ফেলো। এই ডায়রিতে কোনো তারিখ লিখব না। কেন তা জানি না। লিখত ইচ্ছে হচ্ছে না। হয়তো আমি ভয় পাচ্ছি আমি কে তা তোমরা জেনে যাবে বলে। তোমার দায়িত্ব এটা পড়ে পুড়িয়ে ফেলা। আর যদি পার ক্ষমা করে দেয়া।
আমরা তিন বন্ধু। আমি, ক এবং খ (আমি কারোর নামও উল্লেখ করব না)। আমি ছোটো থেকেই মেধাবী। ব্রেইন নিয়ে ছিল প্রচুর আগ্রহ। মেডিকেল কলেজে থাকার সময় আমার মেধা দেখে আমাকে বিদেশে পড়ার জন্য পাঠানো হয় (কোন দেশ তাও বলব না)। সেখানে আমি আমার দুই বন্ধু ক ও খ এর সাথে প্রথম দেখা করি আর ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। কেননা আমরা তিনজনই খুবই মেধাবী এবং ব্রেইন নিয়ে অনেক আগ্রহী ছিলাম। ব্রেইন নিয়ে অনেক গবেষণাও আমরা তিনজন করি একত্রে, শুধু আমরা তিনজন গোপনে। ফাইনাল ইয়ারে আমি আমার বন্ধুদের একটা প্রজেক্টের কথা বলি। আমার ব্যক্তিগত দীর্ঘদিনের একটা গবেষণা পত্র তাদের দেখাই। ব্রেইন ট্রান্সফার নিয়ে পত্রটি। খুবই বিবৃত এবং ব্যাখ্যা করা গবেষণা পত্রটি ক ও খ উভয়েই পড়ল। বেশ ভুলও বের করল। কিন্তু সেই সাথে খুবই উৎসাহিত হলো কেননা আমি এতে এমন এক পদ্ধতির কথা বলেছি যার মাধ্যমে যৌক্তিক ভাবে ব্রেইন ট্রান্সফার সম্ভব ( গবেষণা পত্রটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আর এই পদ্ধতির কথাও আমি বলব না)। আমরা ব্রেইন ট্রান্সফারের সমস্যা গুলো সমাধান করতে মনযোগী হলাম। কখন যে ডাক্তার হয়ে বিদেশের এক হাসপাতালে চাকরি করা শুরু করেছি বলতেই পারলাম না। আমি দেশে কিছুদিন পর আসলাম। আসার সপ্তাহ খানিক পর বাবা-মা মারা যান (কি কারনে বলব না)। কিছুদিন পর আমি সেখানে এক মেয়ের প্রেমে পড়লাম। কিন্তু ছুটি শেষ বলে আবার বিদেশে গেলাম। সেখানে চাকরি আর আমাদের তিনজনের গবেষণা করতে করতে অনেক সময় কাটল(৩ বছরের বেশি)। অবশ্যই বুঝতে পারছ আমরা তিনজন খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। ক ও খ দুজনের বাড়িই বিদেশে ছিল। তাই তাদের বাসায়ও আমার আনাগোনা ছিল। আমরা ক্রমে বড় পদে উঠে আসলাম। তখন আমরা ব্রেইন ট্রান্সফারে অনেক দূর এসেছি। তেমন কোনো সমস্যাও সামনে ছিল না। তাই এখন এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। প্রথম করলাম দুটো কুকুরের উপর। সেটা ব্যর্থ। এরকম আরো গবেষণা, সমস্যা, সমাধান শেষে অনেক সময় ( কত সময় পর বলব না) পর আমরা প্রথম সাফল্য লাভ করি। এবং সাধারণ সাফল্য না, অসাধারণ সাফল্য।একটি কুকুর যেন আরেকটিতে চলে গেছে। এবং নড়তে, দৌড়াতে পারে, প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, হাসতে পারে। তবে মাঝে মাঝে কাঠের মতো স্হির থাকত। এই যা। আমি এই সাফল্যের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করলাম। আমি চাচ্ছিলাম মানুষের ব্রেইন প্রতিস্থাপন করে এক সাথে পুরো পৃথিবীতে বোমা ফাটাতে। কিন্তু ক ও খ দুজনে এর ঘোর বিরোধী। কোনোভাবে তাদের রাজি করে প্রথম মানুষের উপর পরীক্ষা করি আমরা। আমরা তখন অনেক উচুঁ পদে তাই মানুষের ব্যবস্থা করা কোনো সমস্যা হয়নি। পরীক্ষাটা ব্যর্থ হয়। দুজনই মারা যায়। ক ও খ আতঙ্কিত এবং অনুতপ্ত হয়। তারা এই গবেষণা বাদ দিয়ে নিজের পরিবারের প্রতি নজর দিবে বলে জানায় ( তারা বিবাহিত ছিল, আমি ছিলাম অবিবাহিত)। আমি তাদের ছাড়াই পরীক্ষার সমস্যা গুলো পরখ করে সমাধান করি। কিন্তু আমিও একসময় একাকিত্ব বোধ করতে থাকি। তখন আমি দেশে ফিরি। ঐ মেয়েটার কথা মনে আছে যাকে আমার ভালো লেগেছিল? তার বিয়ে হয়ে বাচ্চাও হয়। মেয়ে। পুরো তার মতো (বাচ্চার বয়স বলা হবে না)। আমি খুবই একা অনুভব করলাম। একাকিত্ব, এতিম এই আমাকে গ্রাস করে। ভাই,বোন,বাবা,মা ,আত্মীয়,বন্ধু কেউই নেই আমার। হঠাৎ একদিন শুনি ঐ বাচ্চারও বিয়ে হয়েছে। স্বামী নামকরা ব্যবসায়ী। আমি কেন যেন রাগান্বিত হই। নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। মনে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। আমি ততদিনে মাদক গ্রহন করে পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছি। চাকরি,সম্পত্তি সব হারিয়ে ফেলেছি। পঠাৎ একদিন পুরনো বই ঘাটতে গিয়ে গবেষণাপত্র গুলো পাই। আর আমার মনে একটা নীল নক্সা তৈরি হয়। আমার দুই বন্ধু ক ও খ কে আমি আমার দেশে বিভিন্ন কথা বলে আনাই (কি কথা বা কারন দেখিয়ে আনাই বলব না)। তারপর তাদের আমি একটা অনুরোধ করি। কি অনুরোধ করেছি বলে মনে হচ্ছে? হুম। সেটাই। আমি ঐটা লিখব না। এটা লিখার সৎসাহস আমার নেই। দেশে যখন তাদের আনতে পেরেছি তখন তাদের হুমকি দিয়ে কাজ করানো আর বড় কি বিষয়। তাদের কাছে আমার সেই মানুষের উপর এক্সপেরিমেন্টের সংশোধিত গবেষণা পত্র দেই এবং ব্যবসায়ীকে অজ্ঞান করে এক হাসপাতালে নিয়ে আসি। ক ও খ তখন এত বড় পদে যে তারা রীতিমতো যা বলে তাই আইন। তাই ভিনদেশে একটা হাসপাতাল কেনা আর কি অসম্ভব কাজ তাদের জন্য?
সেই হাসপাতালে এক রাতে ক ও খ মানুষের আগমনের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত যত আবিষ্কার আছে প্রায় সবগুলোকে ছাপিয়ে এক অমর কীর্তি করে, যার কথা কেউই জানবে না। অন্যের চোখকে নিজের মনে হয় আমার। অন্যের রক্ত অন্যের ধমনী আর শিরা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আমাকে বাচিয়ে রাখে। আর সেই মাতাল, ফকির, সকলের উপেক্ষিত এবং অচেনা আমার মৃতদেহ পাশে দেখলাম অন্যের চোখ দিয়ে। যার শরীরে আমার আবাস সেই পাশের এক পানি ভরা পাত্রে। আমি দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েও হলাম না। আর আমার এই অস্তিত্বহীনতা কেউ অনুভবও করল না।
আমার নব-আগমনের পর প্রথম কাজটা কি ছিল বলতে পারবে? সেই গবেষণাপত্র এবং এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে পুড়িয়ে ফেলা।
*
*
*
ধীরে ধীরে আমার একাকিত্ব দূর করে অন্য এক ব্যক্তির সহধর্মিনী। কিন্তু ক্রমে আমি তাকে আমার করে নিই। কিছু সময় পর আমার এক ফুটফুটে বাচ্চা হয়। সে বাচ্চার কথা জানতে চাও কি? এত অজানা তথ্যের পর একটা বিশেষ তথ্য তোমাকে জানিয়ে দিলে হয়তো স্বস্তি বোধ করবে তাই না? ঐ ফুটফুটে বাচ্চাটা একটা ছেলে।
আমার নব-আগমনের পর প্রথম কাজটা কি ছিল বলতে পারবে? সেই গবেষণাপত্র এবং এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে পুড়িয়ে ফেলা।
*
*
*
ধীরে ধীরে আমার একাকিত্ব দূর করে অন্য এক ব্যক্তির সহধর্মিনী। কিন্তু ক্রমে আমি তাকে আমার করে নিই। কিছু সময় পর আমার এক ফুটফুটে বাচ্চা হয়। সে বাচ্চার কথা জানতে চাও কি? এত অজানা তথ্যের পর একটা বিশেষ তথ্য তোমাকে জানিয়ে দিলে হয়তো স্বস্তি বোধ করবে তাই না? ঐ ফুটফুটে বাচ্চাটা একটা ছেলে।
আমার গল্প পরেছ, আশা করি বুঝেছ এবং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধীর কথা ও তার অপরাধের কথা জানতে পেরেছ। তোমার কাছে আমি প্রথমে যা জানতে চেয়েছিলাম তা না জানালেও হবে। আমি কষ্ট পাব না। শুধু এই ডায়রিটা পুড়িয়ে ফেলো।
আমার আসল নাম কি? দুঃখিত, আমি এত বড় কাপুরুষ যে তা বলার সাহসটুকুনও আমার নেই। আমি দুঃখিত।আমি দুঃখিত। আমি দুঃখিত।
ইতি
আমি"
আমি"
***তানভীরের ডায়রি পড়ার ৩ দিন পর-
মিথিলা - তানভীর! পোড়া গন্ধটা কিসের দেখতো! তানভীর?
মিথিলা তানভীরের রুমে গিয়ে একটা পুড়ত থাকা ডায়রি আর তানভীরের ঝুলন্ত নিথর দেহ খুজে পায়।
Writer: Moshiur Rahman Anondo
Tags:
Science Fiction