রকেট সাইন্স


মানব সভ্যতার ইতিহাস এ রকেট আমাদের একটি দুর্দান্ত আবিষ্কার! রকেট আবিষ্কার এর সূচনা হয় প্রায় ১০০০ বছর আগে চীন এ। চীনের একটি ম্যানুস্ক্রিপ্ট এ প্রথম গান পাউডার এর ইনগ্রেডিয়েন্ট গুলোর নাম ও এদের অনুপাত উল্লেখ করা হয়েছিল। বর্ত্তমানে এই রকেট কে কেন্দ্র করে মানুষের সবচেয়ে বড় বড় আবিষ্কার এর সুচনা হয়েছে।
মুল কথায় আসি,
রকেট জিনিস টা সম্পূর্ণ নিউটন এর ৩য় সূত্র(ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া) দ্বারা চালিত হয়। যেমনে একটি বেলুনকে মুখ হাল্কা খুলে ছেড়ে দিলে তা বাতাসের প্রতিক্রিয়া বলের কারনে সরে যেতে থাকে, তেমনি রকেটও একটি বল দ্বারা ধাক্কা দেয় যার রিএকশন স্বরূপ রকেট উপরে যায়। এই প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয় রকেট এঞ্জিন এর মাধ্যমে।রকেট এঞ্জিন এ দুইটি অংশ থাকে।
১)কম্বাশ্চন চেম্বার 
২)নজল। 
স্ট্যান্ডার্ড প্রোপেলান্ট হিসেবে বর্তমানএ ব্যবহৃত হয় লিকুইড রকেট ফুয়েল। যেখানে ২ টি লিকুইড ২টি আলাদা আলাদা ট্যাংক এ থাকে। একটি জারক বা oxidizer. অন্যটি জ্বালানী। যেমন ম্যাচ এর মধ্যে জ্বালানী থাকে কাঠ এবং জারক হিসেবে বাতাসের অক্সিজেন। কিন্তু যেহেতু মহাকাশ এ কোন অক্সিজেন নাই, তাই আমাদের এমন একটি মিশ্রণ ব্যবহার করতে হবে যেটা একি সাথে ফুয়েলও দিবে আবার অক্সিডাইযার হিসেবেও সাপ্লাই দিবে। এ জাতিয় প্রোপেলান্টকে বলে হাইপারগলিক প্রোপেলান্ট। এটিও রাশানদের একটি অত্যন্ত বড় আবিষ্কার। কোন কোন রকেটএ ফুয়েল হিসেবে কেরসিন এবং জারক হিসেবে লিকুইড অক্সিজেন ব্যবহার করা হয়। এখন আসি মিশ্রণটির কথায়, আমরা যদি জারক হিসেবে নেই NO2 এবং ফুয়েল হিসেবে নেই এনিলিন(এক প্রকার জ্বালানী)। ২টি লিকুইডকে মেশানো হবে দহন কক্ষ বা combustion chamber এ। আর নির্দিষ্ট মাত্রায় এই দুটি তরলকে ট্যাংক থেকে কক্ষে আনার জন্য ব্যাবহৃত হয় ২টি আলাদা পাম্প। আবার এই ২টি পাম্পকে চালানোর জন্য দরকার হয় একটি টারবাইন। টারবাইন ও দুটি পাম্প একসাথে একটি শ্যাফট দ্বারা যুক্ত থাকে এবং টারবাইনটিকে পরিচালনের জন্য একটি গ্যাস জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। এই সম্পূর্ণ অংশটাকে বলে টার্বোপাম্প এঞ্জিন। এর মাধ্যমেই তেল এবং জারককে নির্দিষ্ট অনুপাতে দহনকক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়। এবার দহনের পালা, দহনের ফলে অতি উচ্চচাপ ও উচ্চতাপমাত্রায় গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং তা দহন কক্ষের নিচে দিয়ে বেরিয়ে এসে নজল সেকশন এ আসে। এই উচ্চচাপ ই মূলত রকেট কর্তৃক প্রদত্ত বল। কিন্তু দহনকক্ষ থেকে যেই এক্সহস্ট গ্যাস নির্গত হয় তা রকেট এর উত্তলন এর জন্য যথেষ্ট না। তাই এই নযল সেকশন এর প্রয়োজন। নজল এর ডিজাইন টি করা হয় এমনভাবে যাতে করে দহনকক্ষ হতে নির্গত গ্যাসটির গতি নজল থেকে বের হওয়ার সময় প্রচণ্ড দ্রুত গতিসম্পন্ন হয়। এই নযল কে বলা হয় converging diverging Nozzle. এর বাংলানাম আমার জানা নেই। এই নজল এর ১ম অংশের গ্যাস এর গতি সাব-সনিক এবং পরের অংশে তা সুপারসনিক গতিতে রূপান্তর হয় (বোঝার সুবিধার্তে কমেন্ট এ ছবি দেওয়া হলো)। এরপর এই উচ্চচাপ ও গতিসম্পন্ন গ্যাস এর ধাক্কার প্রতিক্রিয়া বল হিসেবে রকেট থ্রাস্ট পায়। যা রকেটকে অভিকর্ষএর বিরুদ্ধে উপরে নিয়ে যায়। কখনো কখনো এইভাবে আরোও বেশি উপরে নেওয়ার জন্য রকেটে এরকম ২/৩ টি স্টেজ এ এঞ্জিন থাকে। এবং সলিড রকেট বুস্টারও ব্যবহৃত হয়।

রকেট স্টেজিং হয় মূলত মালটি স্টেজ রকেটের। আমি রকেটকে অনেক বেশী উচচতায় নেওয়ার জন্য রকেটে ২ বা ৩ টি এঞ্জিন আলাদা আলাদা স্টেজে ব্যবহার করা হয়, যেগুলো কানেক্টর দিয়ে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে এবং এই স্টেজগুলোর জ্বালানী নির্দিষ্ট। তাই নির্দিষ্ট উচ্চতায় রকেটকে ঠেলে দিয়ে ব্যবহৃত জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার পরে স্টেজগুলোকে সেপারেট করে দেওয়া হয়। এর ফলে যেমনি অতিরিক্ত বোঝা কমে গেলো। তেমনি ভর কমে যাওয়ার পরে রকেটের ত্বরণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তাই স্টেজিং এর এই প্রসেসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যতম আলোচিত স্পেস শাটল রকেট বা অরবিটার (বর্তমানে বন্ধ প্রোজেক্ট) এর উড্ডয়নের ক্ষেত্রে মেইন ইঞ্জিনের পাশাপাশি ২ টি বুস্টার ইঞ্জিন ব্যবহার করা হতো, যেগুলো সলিড প্রোপেলান্ট দিয়ে চালানো হয়। অত্যাধিক থ্রাস্ট ক্ষমতাসম্পন্ন এই বুস্টারের সাথে সাধারণ এঞ্জিনের পার্থক্য এইযে, সাধারণ এঞ্জিনের ফুয়েল বার্ন কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এমনকি বন্ধ করে আবার রিস্টার্ট করা যায়। তবে বুস্টারকে একবার ইগনাইট করা হলে তা আর নিভানোর কোন উপায় থাকে না। যতক্ষণ না জ্বালানী শেষ হয়। আর জ্বালানী শেষ হওয়ার পর পরেই তা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় রকেট থেকে আলাদ করে ফেলে দেওয়া হয়। [[নিশ্চয় ভাবতে পারেন এতোবড় দামী একটা বস্তু এভাবে ফেলে দেওয়া হলো?]] এটার উত্তর আপনি শেষেই পাবেন। এই ধাপটির নাম বুস্টার সেপারেশন। এবার আসি পরবর্তী ধাপে। Delta-2, Delta-4, Atlas-5 ইত্যাদি এসব রকেটগুলো নাসার ব্যবহৃত হয় লো আর্থ অরবিটে যাওয়ার জন্য বা স্পেস স্টেশনে সাপ্লাই নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই রকেটগুলোর বুস্টারের সেপারেশনের পরেও মেইন এঞ্জিনের দহন চলতে থাকে এবং যথারীতি তার ফুয়েলও একসময় ফুরিয়ে যায় এবং তাকেও মুক্ত আকাশে রকেট কর্তৃক পরিত্যাগ করা হয়। এই অংশটাকে বলে MAIN ENGINE CUT OFF (MECO)। একিভাবে এর উপরের ইঞ্জিন কিংবা তারোও উপরের ইঞ্জিনের স্টেজটিকে তাদের প্রয়োজনীয়তা শেষে আলাদা করে দেওয়া হয়। এছড়াও আরোও একটা জিনিশ এর আলাদা করা লাগে তা হলো ফেয়ারিং (Fairing)। রকেটের এই অংশটি হলো রকেটের মাথার দিকে বসানো স্যাটেলাইট বা যে বস্তুটিকে স্পেস এ নেওয়া হবে তাকে রকেটের উড্ডয়নের সময় বাতাসের ঘর্ষণ এবং প্রচন্ড তাপ থেকে রক্ষা করা। একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় গিয়ে এটাকেও এবানডন করা হয়। যা রকেটের মাথা থেকে ২ ভাগে বিভক্ত হোয়ে খসে পড়ে। শেষে একটি মাত্র মডিউল বা আলাদা কোন এঞ্জিন দিয়ে স্যাটেলাইটকে অরবিটাল স্পিড দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। অথবা অন্যান্য মিশনের ক্ষেত্রে সর্বশেষ মডিউলটিকে অন্য একটি ইঞ্জিনযুক্ত স্টেজ দিয়ে পরিচালনা করে স্পেস এ মেনুভারিং করা হয়।
এবার আসি এসব পরিত্যক্ত পার্টসগুলোর রিকভারির বিষয়টি নিয়ে। মূলত আমেরিকার লঞ্চিং সাইট গুলো সমুদ্রের কাছাকাছি হয়। যার ফলে বুস্টার এবং অন্যান্য এঞ্জিন গুলোর সেপারেশ শেষে তারা বেশ কিছুদূরে গিয়ে প্যারাসুট দিয়ে সমুদ্রে এসে পড়ে এবং পরবর্তিতে তা জাহাজ বা লঞ্চ দিয়ে গিয়ে টেনে আনা হয়(পুনঃ ব্যবহারযোগ্য) আবার রাশান রকেট যেমন Soyuz.। এই শক্তিশালী রকেটটির বুস্টার এবং এঞ্জিনটি সাইবেরিয়ার বা ওরকমি জনশূন্য স্থানে গিয়ে পরে এবং পরে উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি স্পেস এক্স কোম্পানির একটি রকেট Falcon-9 নতুন রেকর্ড তৈরি করে। এটির ব্যবহৃত ১ম স্টেজের ইঞ্জিনটি স্পেস থেকে নেমে এসে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ল্যান্ড করতে সক্ষম এবং তা পুনরায় ব্যবহারও করা যাবে।
মহাকাশে কিভাবে রকেট পরিচালন করা হয় তা নিয়ে হয়তো পরবর্তি পোস্টে আপনাদের সামনে আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ।
As Always Thanks For Reading.

Writer: Md. Shifat 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম