জীবনে আগুন দেখেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। অনেকে হয়ত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে আছেন। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ আগুনকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষেরাও নিরাপত্তা ও রান্নার কাজে আগুন ব্যবহার করতো। বর্তমানকালেও মানবসমাজে রান্নায় আগুনের ব্যবহার অব্যহত আছে। পৃথিবীর সকল দেশেই আগুনের নানাবিধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সবসময় যে আগুনকে ভালো কাজে ব্যবহার করা হয়েছে তা কিন্তু নয়। তবে এর বিধ্বংসী ক্ষমতা কিংবা উপযোগীতা বিবেচনায় মানবসমাজে আগুনের গুরুত্ব অপরিসীম।
এত পরিচিত একটা জিনিস হওয়া সত্ত্বেও, আগুন নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। নিয়ন্ত্রিত আগুন উপকারী হলেও অনিয়ন্ত্রিত আগুন বিভীষিকায় রূপ নিতে সক্ষম। সেজন্য আগুনের প্রতি জনমনে একধরনের ভীতিও কাজ করে। ভয়ের কারণেই হয়ত কৌতূহলটাও একটু বেশী।
ইতিহাসের দুর্দিনগুলোতে মানবতাবিরোধী কুচক্রীরা আগুনের অপব্যবহার করতে মোটেও কুণ্ঠিত হয়নি। হিটলারের শাসনামলে নাৎসি বন্দিশিবিরগুলোতে জার্মান ইহুদীদের জীবন্ত পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হতো। স্বাধীনতাপূর্ব কিংবা পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসেও প্রচুর বড় ধরণের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একাত্তরে সারা দেশব্যপী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ইয়ত্তাহীন অগ্নিসংযোগ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নৃশংস অধ্যায় হয়ে আছে। পরবর্তীকালে আমাদের প্রজন্মেই বিভিন্ন বহুতল ভবন ও গার্মেন্টস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এক কথায় বলতে গেলে, “অগ্নিকাণ্ড” শব্দটি বিবিধ কারণে আমাদের অবচেতন মানসপটে অনড়ভাবে গেঁথে গেছে। তবে এই নিবন্ধে আমার আলোচনার মূল বিষয় ‘অগ্নিকাণ্ড’ নয়। আগুন সম্পর্কে দুকথা বলতে গেলে আপনা থেকেই অগ্নিকাণ্ডের কথা চলে আসে। তাই প্রথমেই বক্তৃতার শুরুতে হালকা কাশি দেওয়ার মতো করে গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিলাম আরকি! আপাতত আমি আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্নিশিখা (flame) নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
শিখার কথা ভাবলেই আমাদের মনে জ্বালানী, দহন, উত্তাপ, বিক্রিয়া, ঝুল বা ছাই এই জাতীয় শব্দগুলো চলে আসে। বস্তুত আপনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বুঝুন কিংবা নাই বুঝুন, এই শব্দগুলো ছাড়া কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের কাছে আগুন ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। তাই আমি আগেই বলে রাখছি কারণ, এই শব্দগুলো আমি অনেকবার ব্যবহার করতে যাচ্ছি।
এবার আসল কথায় আসি।
আগুনের সংজ্ঞা কি? সর্বজনস্বীকৃত হবে কিনা জানি না, তবে উপমা ব্যবহার করে একটা সাহিত্যিক বা শৈল্পিক সংজ্ঞা দাঁড় করানো যেতে পারে। শিল্প-সাহিত্যের কথা বলতে, এই মুহূর্তে, সদ্য প্রয়াত কন্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারের সেই কালজয়ী গানটি খুব মনে পড়ছে-
“তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়?
বুকের দহনে, করুণ রোদনে, তিলে তিলে তার ক্ষয়,
তিলে তিলে তার ক্ষয়।”
আগুনের সংজ্ঞা কি? সর্বজনস্বীকৃত হবে কিনা জানি না, তবে উপমা ব্যবহার করে একটা সাহিত্যিক বা শৈল্পিক সংজ্ঞা দাঁড় করানো যেতে পারে। শিল্প-সাহিত্যের
“তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়?
বুকের দহনে, করুণ রোদনে, তিলে তিলে তার ক্ষয়,
তিলে তিলে তার ক্ষয়।”
বিজ্ঞানের আগুন রোমান্টিসিজম কিংবা সাহিত্যিক উপমার ধার না ধারলেও, অক্সিজেনের দহন কিন্তু সব তিলে তিলে ক্ষয় করে দেয় ঠিকই। আগুনে যা দেবেন সব জ্বলে যাবে- সেটা রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলীই হোক কিংবা ডায়নোসরের হাড্ডি!
এই গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা ভাবুক মন ও রসায়নের মিশ্রণে মোটামুটি একটা সংজ্ঞা পেয়ে গেছি- জ্বালানী ও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে ঘটা দহন বিক্রিয়াই আগুন। অবশ্য সেটা তিলে তিলে ঘটবে কিনা সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছি না, কারণ বিস্ফোরণের আগুন তাৎক্ষণিক ও দ্রুতগতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পরে। কিন্তু আগুন জিনিসটা আসলে কি দিয়ে তৈরি? এটা কি কোন পদার্থ, নাকি শক্তি? আগুনের কি ওজন আছে? হাত না পুড়ে গেলে কি আগুন ধরা যেতো? উত্তাপহীন আগুনের কি কোন অস্তিত্ব আছে? আগুন কখন জ্বলে ওঠে আর কখনইবা নিভে যায়?
মানব সভ্যতার সকল যুগেই এই চিরায়ত প্রশ্নগুলো চিন্তাশীল মানুষদের অনেক ভাবিয়েছে। প্রাচীন গ্রীক দর্শন ও উপকথাতেও ‘অগ্নি’ তার সকল রং-রূপে আবির্ভূত হয়েছে। গ্রীক মিথোলজিতে প্রোমিথিয়াস নামে এক দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায় যে মানবজাতিকে রক্ষার স্বার্থে মাউন্ট অলিম্পাস থেকে আগুন চুরি করে আনে এবং মানুষকে আগুনের কার্যক্ষমতা বুঝিয়ে দেয়। এভাবে সে মানব সভ্যতার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। গ্রীকদের পাশাপাশি প্রাচীন ভারতীয়, মিশরীয়, ব্যবলনীয় ও চৈনিক দর্শনে আগুনকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান বলে মনে করা হতো। তখনকার দিনের ভাববাদী দার্শনিকরা মাটি, পানি, বায়ু ও অগ্নিকে পর্যায় সারণির মৌলগুলোর মতো বস্তুজগতের মৌলিক গাঠনিক একক মনে করতেন। এমনকি হেরাক্লিটাস নামে এক দার্শনিক বিশ্বাস করতেন যে মানুষের আত্মা আগুন ও পানি দিয়ে গঠিত! যখন কেউ নির্বাণলাভ করে তখন তার আত্মা শুদ্ধ হয়ে পুরোপুরি আগুনে পরিণত হয়। অবশ্য ডেমোক্রিটাস এর ব্যতিক্রম ছিলেন, কারণ তিনি বস্তুবাদী ঘরানার দার্শনিক ছিলেন। বলা বাহুল্য, ডেমোক্রিটাসই পদার্থের অবিভাজ্য কণা বুঝাতে atom বা পরমাণু শব্দের প্রবর্তন করেন। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এধরণের যুগান্তকারী ধারণা বৈপ্লবিক ছিল বৈকি! উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পদার্থবিদ জন ডাল্টন এই ‘পরমাণুবাদকে’ আধুনিক বিজ্ঞানে সন্নিবেশিত করেন।
সঙ্গত কারণেই অতীতচারণের প্রয়োজন ছিল। কারণ এরপর আমি যা বলতে যাচ্ছি সেখানে এই অতীতচারণ কাজে লাগবে। কারণ ডেমোক্রিটাসের সেই ‘অবিভাজ্য কণাতেই’ লুকিয়ে আছে আগুনের যাবতীয় রহস্য!
পরমাণু সম্পর্কে সম্ভবত আমাদের সবারই অল্পবিস্তর ধারণা আছে। ১৯১৩ সালে পদার্থবিদ নিলস বোর হাইড্রোজেন পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যায় সহজবোধ্য একটি মডেল প্রস্তাব করেন। সেসময় এটি রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের চেয়ে উন্নত ছিল। এই মডেল অনুসারে নিউক্লিয়াসের বাইরে পরমাণুগুলো শুধু নির্দিষ্ট শক্তি সম্পন্ন অনুমোদিত কক্ষপথেই বিচরণ করতে পারবে। যদিও বোরের পরমাণু মডেল এখন অচল, তবে তুলনামূলক সহজবোধ্য হওয়ায় এখানে আমি সেটাই ব্যবহার করছি। (আমার মতে একে মডেল না বলে পরস্পরবেষ্টিত বৃত্তাকার বলয়ের লেখচিত্র বলা উচিৎ।)
আগুন জ্বালাতে হলে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ প্রয়োজন- একটি দাহ্য পদার্থ, তাতে অগ্নিসঞ্চার কিংবা শুধুমাত্র অক্সিজেনের রাসায়নিক সংশ্লিষ্টতা ও তাপোৎপাদী বিক্রিয়া (exothermic reaction)। এটা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায়। তাই আগুন জ্বালানো শিখতে রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই! কিন্তু দাহ্য পদার্থকে অবশ্যই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ার উপযোগী হতে হবে। তবে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করলেই যে আগুন লাগবে এমন কোন কথা নেই। দাহ্য বস্তুর অণুতে যথেষ্ট ভঙ্গুর আন্তঃপারমাণবিক বন্ধন থাকতে হবে যেগুলোর ভাঙনে পরমাণুতে থাকা ইলেকট্রনগুলো উত্তেজিত হয়ে নিউক্লিয়াস থেকে দূরবর্তী শক্তিস্তরে বা কক্ষপথে উন্নীত হবে। পরমাণুর বোর মডেলে এই নির্দিষ্ট শক্তি সম্পন্ন কক্ষপথগুলোকে শেল (shell) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরমাণুর কেন্দ্র থেকে শেলের দূরত্ব যত বাড়ে, শেলগুলো ততটাই অধিক শক্তি সম্পন্ন হয়। দূরবর্তী শেলগুলোতে নিয়ে যেতে ইলেক্ট্রনগুলোকে অধিক শক্তির যোগান দিতে হয়। এই শক্তি আসে দাহ্য পদার্থের অণুর পারমাণবিক বন্ধনের ভাঙন কিংবা পারিপার্শ্বিক কোন তাপগতীয় উৎস থেকে। এজন্য ঘর্ষণ কিংবা শর্টসার্কিটের ফলেও অনেক সময় আগুন জ্বলে ওঠে। কারণ ঘর্ষণ বল কিংবা বিদ্যুৎপ্রবাহ এই বাড়তি তাপগতীয় শক্তির যোগান দিতে সক্ষম যা দাহ্য পদার্থের অনুগুলোকে গতিশীল ও উত্তেজিত করে তুলে। এধরণের তাপগতীয় ক্রিয়া দহন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
অনেকে হয়ত ভাবতে পারেন, অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া মানেই আগুন। ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম নয়। রসায়ন থেকে আমরা জানি যে, অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া একইসাথে দহন (combustion) ও জারণ (oxidation)। অনেক ক্ষেত্রে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ার সময় জারণ ঘটলেও, দহন ঘটে না। উদাহরণ হিসেবে লোহায় মরিচা পড়ার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশুদ্ধ লোহার জারণ একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। বহুদিন ধরে জলীয় বাষ্প (পানি) ও অক্সিজেনের সংস্পর্শে থাকলে লোহার পাতের উপরিভাগে মরিচার প্রলেপ পরে। উল্লেখ্য যে বিশুদ্ধ লোহা রাসায়নিকভাবে খুবই সক্রিয়। তাই একে মরিচারোধক করার জন্য অন্যান্য কম সক্রিয় ধাতুর (যেমন নিকেল) প্রলেপ দেয়া হয়। সাইকেলের হাতলের চকচকে অংশে কিংবা কাঁটাচামচের ওপরে এই কম সক্রিয় স্তর থাকে।
সুতরাং আমরা দেখছি যে, রাসায়নিকভাবে আগুন তৈরির জন্য তপোৎপাদী বিক্রিয়া অপরিহার্য। কিন্তু অগ্নিশিখার সুনিপুণ অবয়বের সাথে কি শুধু এই একটি বিষয়ই জড়িত?
আমি পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলোর উচ্চ শক্তি সম্পন্ন শেলে অধিগমনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি, কারণ ক্ষুদ্র স্কেলে আগুনের উৎপত্তি মূলত এখান থেকেই ঘটে। ইলেকট্রনগুলো পদার্থের পরমাণুসমূহের বন্ধন ভাঙনের ফলে নির্গত শক্তি বা বাইরে থেকে প্রাপ্ত তাপগতীয় শক্তি শোষণ করে নিম্ন শক্তিসম্পন্ন শেল থেকে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন শেলে অধিগমন করে। এই ঘটনাকে কোয়ান্টাম লম্ফ (quantum leap) বলে। অর্বিটালে বা কক্ষপথে বিদ্যমান ইলেকট্রনগুলো সবসময় নিম্ন শক্তি সম্পন্ন অর্বিটালে অবস্থান করতে চায়। কারণ এই অর্বিটালগুলো অনেক বেশী স্থিতিশীল। এই নিম্ন শক্তি সম্পন্ন অর্বিটালে অবস্থানরত ইলেকট্রনগুলোর দশাকে ভূমি দশা (ground state) বলা হয়। উত্তেজিত হয়ে কোয়ান্টাম লম্ফ সম্পন্ন করার পরেই ইলেকট্রনগুলো আবার ভূমি দশায় ফিরে আসার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। উচ্চ শক্তির অর্বিটালে অধিগমনের সময় ইলেকট্রনগুলো কিছু শক্তি শোষণ করে। আবার ভূমি দশায় প্রত্যাবর্তন বা স্থিতিশীল নিম্ন শক্তি সম্পন্ন অর্বিটালে ফিরে আসার সময় ঠিক ঐ পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে। শক্তির নিত্যতা সূত্র অনুযায়ী শোষিত শক্তি ও বিকীর্ণ শক্তির পরিমাণ সর্বদা সমান থাকে। কিন্তু এই শোষিত কিংবা বিকিরিত শক্তির সাথে নির্গত বর্ণালীর সম্পর্কটা কি?
আগুন থেকে তাপ উৎপন্ন হয়। সেই তাপ আবার রঙ-বেরঙের আলো ছড়ায়। সব রঙ যে আমাদের রক্তমাংসের চোখে ঠিকভাবে ধরা দেয় তা কিন্তু নয়। কোন কিছু পুড়তে থাকলে সেটি থেকে বিভিন্ন কম্পাঙ্কের ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাড়িৎচৌম্বক বিকিরণ নির্গত হয়। এই বিচিত্র সব বিকিরণের সমাবেশে থাকা যেসব বিকিরণ দৃশ্যমান আলোর বর্ণালী সীমার মধ্যে অবস্থান করে কেবল সেগুলোই আমরা আলো বা আগুন হিসেবে দেখতে পাই। এছাড়াও অদৃশ্য অবলোহিত তরঙ্গের (infrared) মতো কিছু বিকিরণ ঘটে যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না। অনেকেই হয়ত জানেন যে, প্রিজমের (prism) মধ্য দিয়ে গমনের সময় আপতিত আলো বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত হয়ে নির্গত হয়। নির্গত আলো দেখতে তখন রঙধনুর মতো মনে হয়। স্যার আইজ্যাক নিউটন এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু অদৃশ্য বর্ণালীর কোন হদিস বের করতে পারেন নি। ১৮০০ সালের দিকে বিজ্ঞানী উইলিয়াম হারশেল প্রিজমের মধ্য দিয়ে প্রতিসরিত আলোর বিভিন্ন বর্ণের তাপমাত্রা পরিমাপ করে দেখেন যে, বর্ণালীর একটি অদৃশ্য অংশের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশী। এই অদৃশ্য বর্ণালী লাল আলোর বর্ণালীর নিচে অবস্থান করে। তখন বিজ্ঞানীদের এই অদ্ভুত বিকিরণ সম্পর্কে জানা ছিল না। বর্তমানে আমরা একে অবলোহিত বা অবলাল আলো বলি। উত্তপ্ত বস্তু থেকে তাপ তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। তাড়িতচৌম্বক বর্ণালীর অবলাল অংশই অধিকাংশ তাপ বয়ে নিয়ে আসে। এই বিকিরণ তাপ পরিবহনের জন্য মধ্যবর্তী মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল নয়। তাই মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে সূর্য কিংবা এরকম কোন নক্ষত্র থেকে পৃথিবীর মতো গ্রহে তাপ বয়ে আনতে সক্ষম। খালি চোখে দেখতে না পেলেও, আমাদের ত্বক দিয়ে উষ্ণতা হিসেবে আমরা এই তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ অনুভব করতে পারি। ওভেনে উৎপন্ন মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ এভাবেই খাবার গরম করে।
সকল পদার্থই অণু দিয়ে গঠিত। অণুগুলো পরমাণু দিয়ে গঠিত। পরমাণুর চেয়ে অণু মোটামুটি স্বাধীন। এই অণুগুলো সর্বদাই গতিশীল থাকে। অণুগুলোর গতিশক্তিই তাপে পরিণত হয়। সকল পদার্থ থেকেই কম বেশী তাপীয় বিকিরণ ঘটে। এই বিকিরণ স্বতঃস্ফূর্ত এবং পদার্থের তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল। তাপমাত্রা বাড়লে তাপীয় বিকিরণের পরিমাণও বাড়ে। অণুগুলো যেহেতু কখনই পুরোপুরি স্থির হয় না, সেহেতু সকল বস্তুরই একটি অন্তর্নিহিত তাপ শক্তি থাকে। এই শক্তি কখনই শূন্য হয় না। জগৎসংসারের দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান সবকিছুই এর বাইরের পরিবেশের সাথে তাপগতীয় সাম্যাবস্থায় (thermodynamic equillibrium) থাকতে চায়। ঠিক যেমন ইলেকট্রনগুলো নিম্ন শক্তি সম্পন্ন স্থিতিশীল অর্বিটালে ফিরে যেতে চায়। চলচ্চিত্র কিংবা বাইশ গজের তারকাদের প্রতি যেমন এদেশের মানুষের মনে দুর্দমনীয় আকর্ষণ কাজ করে, ঠিক তেমনি স্থিতি ও সাম্যাবস্থার প্রতি প্রকৃতির মনেও দুর্দমনীয় এক ঝোঁক কাজ করে। উনবিংশ শতাব্দীতে তাপগতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই উত্তপ্ত বস্তু থেকে নির্গত তাপীয় বিকিরণের (thermal radiation) কারণ ও কার্যপ্রণালীর সন্ধানে ছিলেন।
Writer: Monzurul Alam
আগুন থেকে তাপ উৎপন্ন হয়। সেই তাপ আবার রঙ-বেরঙের আলো ছড়ায়। সব রঙ যে আমাদের রক্তমাংসের চোখে ঠিকভাবে ধরা দেয় তা কিন্তু নয়। কোন কিছু পুড়তে থাকলে সেটি থেকে বিভিন্ন কম্পাঙ্কের ও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাড়িৎচৌম্বক বিকিরণ নির্গত হয়। এই বিচিত্র সব বিকিরণের সমাবেশে থাকা যেসব বিকিরণ দৃশ্যমান আলোর বর্ণালী সীমার মধ্যে অবস্থান করে কেবল সেগুলোই আমরা আলো বা আগুন হিসেবে দেখতে পাই। এছাড়াও অদৃশ্য অবলোহিত তরঙ্গের (infrared) মতো কিছু বিকিরণ ঘটে যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না। অনেকেই হয়ত জানেন যে, প্রিজমের (prism) মধ্য দিয়ে গমনের সময় আপতিত আলো বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত হয়ে নির্গত হয়। নির্গত আলো দেখতে তখন রঙধনুর মতো মনে হয়। স্যার আইজ্যাক নিউটন এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু অদৃশ্য বর্ণালীর কোন হদিস বের করতে পারেন নি। ১৮০০ সালের দিকে বিজ্ঞানী উইলিয়াম হারশেল প্রিজমের মধ্য দিয়ে প্রতিসরিত আলোর বিভিন্ন বর্ণের তাপমাত্রা পরিমাপ করে দেখেন যে, বর্ণালীর একটি অদৃশ্য অংশের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশী। এই অদৃশ্য বর্ণালী লাল আলোর বর্ণালীর নিচে অবস্থান করে। তখন বিজ্ঞানীদের এই অদ্ভুত বিকিরণ সম্পর্কে জানা ছিল না। বর্তমানে আমরা একে অবলোহিত বা অবলাল আলো বলি। উত্তপ্ত বস্তু থেকে তাপ তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। তাড়িতচৌম্বক বর্ণালীর অবলাল অংশই অধিকাংশ তাপ বয়ে নিয়ে আসে। এই বিকিরণ তাপ পরিবহনের জন্য মধ্যবর্তী মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল নয়। তাই মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে সূর্য কিংবা এরকম কোন নক্ষত্র থেকে পৃথিবীর মতো গ্রহে তাপ বয়ে আনতে সক্ষম। খালি চোখে দেখতে না পেলেও, আমাদের ত্বক দিয়ে উষ্ণতা হিসেবে আমরা এই তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ অনুভব করতে পারি। ওভেনে উৎপন্ন মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ এভাবেই খাবার গরম করে।
সকল পদার্থই অণু দিয়ে গঠিত। অণুগুলো পরমাণু দিয়ে গঠিত। পরমাণুর চেয়ে অণু মোটামুটি স্বাধীন। এই অণুগুলো সর্বদাই গতিশীল থাকে। অণুগুলোর গতিশক্তিই তাপে পরিণত হয়। সকল পদার্থ থেকেই কম বেশী তাপীয় বিকিরণ ঘটে। এই বিকিরণ স্বতঃস্ফূর্ত এবং পদার্থের তাপমাত্রার উপর নির্ভরশীল। তাপমাত্রা বাড়লে তাপীয় বিকিরণের পরিমাণও বাড়ে। অণুগুলো যেহেতু কখনই পুরোপুরি স্থির হয় না, সেহেতু সকল বস্তুরই একটি অন্তর্নিহিত তাপ শক্তি থাকে। এই শক্তি কখনই শূন্য হয় না। জগৎসংসারের দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান সবকিছুই এর বাইরের পরিবেশের সাথে তাপগতীয় সাম্যাবস্থায় (thermodynamic equillibrium) থাকতে চায়। ঠিক যেমন ইলেকট্রনগুলো নিম্ন শক্তি সম্পন্ন স্থিতিশীল অর্বিটালে ফিরে যেতে চায়। চলচ্চিত্র কিংবা বাইশ গজের তারকাদের প্রতি যেমন এদেশের মানুষের মনে দুর্দমনীয় আকর্ষণ কাজ করে, ঠিক তেমনি স্থিতি ও সাম্যাবস্থার প্রতি প্রকৃতির মনেও দুর্দমনীয় এক ঝোঁক কাজ করে। উনবিংশ শতাব্দীতে তাপগতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরেই উত্তপ্ত বস্তু থেকে নির্গত তাপীয় বিকিরণের (thermal radiation) কারণ ও কার্যপ্রণালীর সন্ধানে ছিলেন।
Writer: Monzurul Alam