শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক বিভাগ


ছোটবেলা থেকেই আমরা যখন 'Aim in Life' সম্পর্কে পড়ি তখন থেকেই কমন যেই শিক্ষাটা পাই তা হলো বড় হয়ে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হব। আবার বিশেষ করে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের জিজ্ঞেস করলে আপনার সন্তানকে কি বানাতে চান, সহজ একটা উত্তর দিবে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই। তাদের কাছে পড়ালেখার উদ্দেশ্য মানেই বড় হয়ে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার ইত্যাদি হওয়া। অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উঠার সময় বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি শ্রেণীবিভাগ করে দেয়। তুমি ভালো স্টুডেন্ট মানেই তুমি সাইন্স পড়বা। এরপর একটু ভালো মানে তুমি কমার্স পড়বা। অনেকসময় জোর করে চাপিয়ে দেয় পরিবার। নামমাত্র স্টুডেন্ট মানে আর্টস বা মানবিকে পড়বা। শহর এলাকায় অনেক বিদ্যালয়ে মানবিক শাখার কার্যক্রমও নেই।

এভাবেই মানবিকের শিক্ষার্থীরা একটি অবহেলিত গ্রুপ হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকে। ভালোদের স্থান দিতে দিতে শেষ পর্যায়ে মানবিকে স্থান পাওয়া শিক্ষার্থীরা পরবর্তী চারটি বছর বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। মানবিকের শিক্ষার্থী হিসেবে কাউকে পরিচয় দিতেই যেন মাথাটা নিচু হয়ে যায়, গলার স্বর কমে যায়। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে তুমি কোন গ্রুপে পড়ো তখন সাইন্স-কমার্সের শিক্ষার্থীরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারে সাইন্স বা কমার্সে পড়ি। কিন্ত আর্টস বা মানবিকের শিক্ষার্থীদের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও হীনমন্যতায় ভোগে। কারণ মানবিক মানে ভালো শিক্ষার্থী নাও হতে পারে। ফলে দেখাই যাচ্ছে মানবিকে তেমন ভালো শিক্ষার্থী এসএসসি লেভেলে পাওয়া যায়না।

আবার সাইন্স থেকে অহরহ জিপিএ-৫ আসে কিন্ত সেই তুলনায় মানবিক থেকে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা নগন্য। কারণ মানবিক থেকে রেজাক্ট ভালো করাটা একটু কঠিন। তাদের সম্পূর্ণ মার্ক্স লিখে অর্জন করতে হয়। সাইন্সের মত প্রেক্টিক্যাল মার্ক্স থাকলে তারাও ভালো রেজাল্ট করতো। ফলে সাইন্সের স্টুডেন্টরা বুক ফুলিয়ে বলতে পারে জিপিএ-৫। কিন্ত মানবিকের তারা সেটা পারেনা।

এসএসসি এর পর অনেক শিক্ষার্থী সাইন্স কমার্স থেকে আর্টস বা মানবিক গ্রুপে চলে আসে। এই সিদ্ধান্তটা কেউ একান্ত নিজের ইচ্ছায় নেয় তাইলে পরবর্তী কলেজ লাইফের দুইটা বছর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের কাছে সবচেয়ে অপদার্থ হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকে। কারণ সবাই বলে আর্টসে পড়ে ভবিষ্যতে কিছুই করা যায়না। ইতিহাস/ভূগোল এসব পড়ে বর্তমান প্রযুক্তির যুগে কিছু করা যায়না। হুদাই পড়ালেখা করতেছো। এতে করে অনেকেই পড়ালেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।

মানবিকে পড়ে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়না এমন শিক্ষার্থী কমই পাওয়া যাবে। কারণ ভার্সিটি লেভেলে আসার আগ পর্যন্ত আমরা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই জানিনা পরবর্তী লাইফে কি অপেক্ষা করছে। কিন্ত আমাদেরও জানতে হবে মানবিকে পড়ে আমার ভবিষ্যৎ কি হতে পারে। সবাই সাইন্স কমার্স নিয়ে এতো নাচানাচি করে আর আমি আর্টসে পড়ি বলে পাত্তা পাব না তা হয়না। কারণ সাইন্স কমার্স পড়ে জীবনে যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার হচ্ছে ঠিক মানবিকের শিক্ষার্থীরাও পেশাজীবনে কম পজিশনে নেই।

প্রথমত, সাইন্স/কমার্সের তুলনাত মানবিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া তুলনামূলক অনেক সহজ। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিকের জন্য পর্যাপ্ত সীট সংখ্যাই আছে। সেক্ষেত্রে মানবিক থেকে রেজাল্ট তুলনামূলক কম হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স অনেক সহজ। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ বলে বেড়ানো সাইন্সের অনেক স্টুডেন্ট নামীদামী কোচিং-এ পড়েও কোন পাবলিকে চান্সই পায়না। এমন স্টুডেন্ট এর সংখ্যা অহরহ। সারাবছর জিপিএ-৫ নিয়ে বড়াই করা শিক্ষার্থীরা যখন দেখে তার চেয়ে কম রেজাল্ট নিয়েও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়তেছে তখন বলে বন্ধু কোপাইয়া দিছো একবারে৷

দ্বিতীয়ত, একটা সাইন্স এর স্টুডেন্ট চার বছরে প্রাইভেট/কোচিং এর পিছনে কতটাকা খরচ করে তার হিসাব নেই। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর মত সামর্থ কয়টা ফ্যামিলি রাখে? অধিকাংশ গ্রাম এলাকায় তো ভালো টিচারের অভাবে ঠিকমতো ব্যাসিকও ভালো করতে পারেনা। কিন্ত মানবিকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। একজন মানবিকের শিক্ষার্থীর পিছনে প্রাইভেট কোচিং নিয়ে অহরহ টাকা খরচ করতে হয়না। পরিবারের সামর্থ্য না থাকলেও নিজের ইচ্ছায়, নিজের পরিশ্রমে ভালো করতে পারে। কারণ মানবিকের পড়াটা নিজে নিজে পড়েও ভালো আয়ত্তে আনা যায়।

তারপর আসি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবজেক্ট এর বিষয়ে। মানবিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০টিরও বেশি সাবজেক্ট আছে। কোন কোন সাবজেক্টকে অনেকে ছোট বলে তুচ্ছার্থক করতে পারে। সাইন্স/কমার্সের অনেকে বলতে পারে এসব সাবজেক্টে পড়ার চেয়ে না পড়াই ভালো। কিন্ত ঐ শিক্ষার্থীরাই যখন নিজের গ্রুপ থেকে চান্স পায়না কোন জায়গায় তখন শেষ ভরসা হিসেবে গ্রুপ পরিবর্তন পরীক্ষা দেয়। তখন বুঝে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাবজেক্ট এর মূল্য কতটুকু। এছাড়া মানবিক থেকে অনেক সাবজেক্ট আছে যা বর্তমান চাকরির বাজারে সাইন্স কমার্স থেকে কোন অংশে কম নয়৷ Law, Economics, English, Development Studies, IR, Journalism, Public Administration এরকম অনেক সাবজেক্ট আছে সাইন্স কমার্সের সাবজেক্ট এর সাথে তুলনা করলে কোন অংশে কম নয়।

সাইন্স/কমার্স থেকে যদি গোল্ডেন জিপিএ-৫ নিয়েও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলা যায় সেখানে মানবিক থেকে মুটামুটি ভালো রেজাল্ট নিয়ে ভালো করে প্রিপারেশন নিতে পারলে ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো একটা সাবজেক্ট থাকে নিশ্চিত বলা যায়। এর কারণ মানবিকের জন্য ঢাবি বা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যে কতটুকু সহজ তা আমরা বুঝতেই পারিনা। তাই বলি মানবিক গ্রুপের স্টুডেন্টরা যতই অবহেলিত হোক না কেন পাবলিক ভার্সিটিতে তারাই রাজত্ব করে। কর্মক্ষেত্রেও কোন অংশে পিছিয়ে নেই মানবিকের শিক্ষার্থীরা।

তাই মানবিকের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতে কখনো নিজেকে ছোট মনে করব না। অন্য সবার মত মানবিক থেকে ভালো কিছু করা যায়। সবার মত গর্ব করেই বলব আমি মানবিকিয়ান।

এসএসসির পর গ্রুপ চ্যাঞ্জ করলে নিঃসন্দেহে নিজের পরিশ্রমটা চালিয়ে যাই। আমি নিজে এসএসসিতে জিপিএ-৫ নিয়েও এইচএসসিতে মানবিকে পড়ি। এখন আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করবেনা কোন গ্রুপে পড়ছো, কি রেজাল্ট করছো। তাই বলি, চারপাশের মানুষ কি বলে না বকে এসব এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবে। সময় আসলেই উপযুক্ত জবাব দিবে। নিজের চেষ্টাশক্তি আর পরিশ্রম সবসময় সফলতা আনে। সেটা আসতে পারে যেকোন অবস্থান থেকে।

শুভ কামনায়
Md Mahiuddin
Department of Law,
University of Dhaka.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম