শৈবাল থেকে তেল উৎপাদন করা যায় যার গুণগত মান পেট্রোল থেকে বেশি। শৈবাল তেলে বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান গন্ধক থাকে না। এই তেল উৎপন্ন করা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ হলেও গত কয়েকদশক ধরে এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীতে ভয়ানক জ্বালানি সঙ্কট দেখা দেবে, আর মাত্র তিন দশকের মধ্যেই যার আলামত প্রকাশ পেতে পারে। এতোকাল আমরা প্রাকৃতিকভাবে লব্ধ জ্বালানি ব্যবহার করেছি যার মধ্যে রয়েছে কয়লা, বায়োগ্যাস ও পেট্রোলিয়াম। এগুলো সবই একপ্রকার ফসিল-জ্বালানি (Fossil fuel)। সব ফসিল জ্বালানিরই মূল উপাদান হাইড্রোকার্বন, অর্থাৎ হাইড্রোজেন ও কার্বন। বর্তমান দশকের গোড়ার দিকে শৈবাল থেকে তেল তৈরি হয়েছে এবং তা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারও হয়েছে। ২০১১ সালে শিকাগো থেকে হিউস্টন একটি ফ্লাইট গিয়েছিল ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের, যাতে ব্যবহার করা হয়েছিল শৈবাল তেল। জাপান ২০২০ সালে টোকিও অলিম্পিকে কমার্শিয়াল ফ্লাইটগুলো শৈবাল তেল ব্যবহার করার কথা চিন্তা করছে।
লক্ষ লক্ষ বছর আগে অগভীর সমুদ্রে শৈবাল, গুল্ম ও ব্যাক্টেরিয়ার প্রাচুর্য ছিল। মৃত্যুর পর এরা সমুদ্রের তলদেশে জমা হতে থাকে স্তূপীকৃতভাবে। ক্রমবর্ধমান ওজনের কবলে পড়ে এই স্তূপে প্রচণ্ড চাপ ও তাপের সৃষ্টি হয় যা থেকে কালক্রমে সৃষ্টি হয় ফসিল-জ্বালানি যেমন, কয়লা, গ্যাস কিংবা পেট্রোলিয়াম (Crude Oil)। কালের আবর্তে নানা ভূতাত্বিক কারণে সমুদ্র শুকিয়ে গেলে ভূভাগের নিচে তেলের স্তর থেকে যায় যা মাটির উপরের দিকে স্বল্প চাপের এলাকায় উঠে আসতে থাকে। ঊর্ধগতিসম্পন্ন এই স্তরীভূত তেল এক সময় দুর্ভেদ্য পাথরের নিচে আটকে যায় এবং তৈরি হয় রিজার্ভার। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে শক্ত শিলায় বাধাপ্রাপ্ত না হলে মাটির উপরিভাগেও এসব তেল উঠে আসতে পারে। রিজার্ভারের তেল ড্রিল করে উত্তোলন করা হয়। মুঠোহাত ব্যাসের এই সিলিন্ড্রিক্যাল ড্রিল-যন্ত্রের মাঝখানের ছিদ্র দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বাতাসের প্রবাহ তৈরি করা হয়। বাতাসের চাপে উপরে উৎক্ষিপ্ত হয় ড্রিলের ব্লেডে কাটা শিলা যার নমুনা থেকে ভূগর্ভস্থ নানা স্তরের খবর পাওয়া যায়। এক সময় শিলার সঙ্গে উঠে আসে তেল যা ফুঁসে উঠতে পারে ১০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান উচ্চতায়। প্রযুক্তির মাধ্যমে এই তেলের গতিকে নিয়ন্ত্রিত ও সংযত করা হয়।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এর অবিরাম উত্তোলন চলছে তিনটি প্রাথমিক এলাকা, মধ্যপ্রাচ্য, টেক্সাস ও স্কটল্যান্ড-নরওয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে। বেশিরভাগ তেলকূপ খননের জন্য ডাঙাতে রোটারি ড্রিলিং রিগ (Rig) থাকলেও সমুদ্রেও রয়েছে তেলকূপ খননের জন্য অনুরূপ প্ল্যাটফর্ম। কখনো প্ল্যাটফর্মের কর্মচারীদের কোয়ার্টারও থাকে সেখানে। সমুদ্র থেকে তেল উত্তোলন করা বেশ ব্যয়বহুল, এবং এতে কিছু পরিবেশগত ঝুঁকিও থাকে। কোনো আকস্মিক কারণে বা রিগ সারাইয়ের প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ ব্যারেল তেল জলের উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়, বিশেষত পাখিদের। তেলের সংস্পর্শে পাখির পালকের উড্ডয়ন ও ওয়াটারপ্রুফিং ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ঠাণ্ডায় মারা যায় হাজার হাজার পাখি।
রিজার্ভার পর্যন্ত ড্রিল করার পর একটি তেলকূপ থেকে দিবারাত্র ৩০ বছর ধরে যতই তেল সংগ্রহ করা হোক কখনোই তা জটিল শিলাস্তর থেকে পরিপূর্ণভাবে উত্তোলন করা সম্ভব হয় না। কখনো পানি ঢেলে তেলকে উপরে ভাসিয়ে আনা হয়, আবার কখনো অতি গভীরে ড্রিল করে গ্যাসের চাপে কিছু অতিরিক্ত তেল উপরে তোলা যায়। কিন্তু ভূগর্ভের অতি গভীরে যে সব তেলের খনি আছে তা সনাক্ত করা থেকে শুরু করে নিঃশেষিতভাবে তেল উত্তোলন করার মতো অর্থ ও প্রযুক্তি পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের এখনো নেই। এখন সময় এসেছে বিকল্প পথে তেল উৎপাদন করার। ডাঙায় উৎপাদিত ভুট্টা, ইক্ষু, সয়বিন, জ্যাট্রোফা, ক্যাপায়িবা ইত্যাদি থেকে বিজ্ঞানীরা জ্বালানি তেল উদ্ভাবন করেছেন অনেক আগে কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়াতে তা ব্যবহার করার সুযোগ হয়নি আমাদের। শৈবাল থেকে যে তেল পাওয়া যায় তার পরিমাণ ডাঙার সবজির তুলনায় ৩০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। এক দশক আগে এর উৎপাদন খরচ ছিল ফসিল ফুয়েলের ৩ গুণ। কিন্তু এই অসহ ঋণাত্বক উচ্চমূল্য-অবস্থার দ্রুত অবসান ঘটছে।
বিজ্ঞানীরা এখন অনুসন্ধান করছেন তেল উৎপাদনের জন্য উপযোগী বিশেষ জাতের শৈবাল (Strain), যার ভিতর থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ তেল (Lipid) পাওয়া যাবে। শৈবাল ডিন-এন-এতে জিনগত পরিবর্তন এনে কোনো কোনো কোম্পানি অধিক পরিমাণ তেল উৎপাদনের জন্য তৈরি করে নিচ্ছেন উপযুক্ত হাইব্রিড। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) চাষের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে রেসওয়ে সদৃশ পুকুর বা ‘রেসওয়ে পন্ড’ এবং স্বচ্ছ পাইপ সদৃশ ‘ফটোবায়োরিয়্যাক্টর (Photobioreactor)। তুলনামূলকভাবে রেসওয়ে পন্ড তৈরির খরচ অনেক কম। এগুলো দেখতে লম্বাটে ধাতব বা কংক্রিটের পুকুরের মতো যার মাঝখানে পার্টিশন করা থাকে। শৈবালের স্বাস্থ্যরক্ষার নিমিত্তে, খাদ্য ও পুষ্টির সুষম বন্টনের জন্য ব্যবহার করা হয় বৈদ্যুতিক ‘পেডাল হুইল’ যা পানিকে হালকা গতিতে চলমান রাখতে পারে। মাইক্রোসফট্ কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিল গেইটস্ সৃষ্টি করেছেন ‘স্যাফায়ার এনার্জি’ কোম্পানি যা নিউ মেক্সিকোতে নির্মাণ করেছে বিশাল দৈর্ঘ্যের কিছু রেসওয়ে পন্ড, যার দুটি যোগ দিলে সিকি মাইল হয়ে পারে। এই কোম্পানি বর্তমানে তৈরি করছে ১০০ ব্যারেল ‘গ্রিন ক্রুড অয়েল’। ২০১৮ সাল থেকে দৈনিক ৫০০০ ব্যারেল তেল উৎপন্ন করলে পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে।
রেসওয়ে পন্ডগুলো সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। এতে হঠাৎ অনাকাঙ্খিত কোনো ভিন্ন জাতের শৈবাল বংশবিস্তার করতে পারে। আবার ফসফরাস ও নাইট্রোজেন ইত্যাদি পুষ্টির সরবরাহ অতিরিক্ত হলে শৈবাল বিস্ফারণ ঘটে তাদের বংশনাশ হতে পারে। এসব কারণ বিবেচনায় রেখে তৈরি হয়েছে উন্নতমানের ফটোবায়োরিয়্যাক্টর, যার উৎপাদন খরচ রেসওয়ে পন্ডের তুলনায় অনেক বেশি হলেও তা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিসম্পন্ন। এতে আলোর পরিমাণ, জলের তাপমাত্রা ও গতিবেগ, খাদ্য ও পুষ্টির পরিমাণ অনেক সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে কোনো অনির্বাচিত শৈবালও সহজে মূল শৈবালের চাষ নষ্ট করতে পারে না।
ফ্লোরিডার অ্যালজেনল (Algenol) কোম্পানি শৈবাল থেকে ইথানল (Alcohol), গ্যাসোলিন, ডিজেল এবং জেট-ফুয়েল তৈরির জন্য পেটেন্ট বা সরকারি সনদপত্র পেয়েছে। এই কোম্পানি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ইথানল তৈরি করে। এদের উদ্দেশ্য, প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে বিশেষ জাতের শৈবাল থেকে সরাসরি ইথানল তৈরি করা। এসব শৈবালকে অন্ধকারে লালন করা হয়। এই পদ্ধতির একটি ব্যবসায়িক গোমর হচ্ছে, শৈবালের উপর এক ধরনের চাপ বা স্ট্রেস (Stess) সৃষ্টি করা যাতে সরাসরি ইথানল তৈরি হয়। প্রকৃতিতে এভাবে উৎপাদিত ইথানলের পরিমাণ খুব কম, তাই অধিক মাত্রায় ইথানল তৈরির জন্য কোম্পানির গবেষকরা শৈবালের জিনকে রূপান্তর (Genetically modified) করে নিয়েছেন। ফটোবায়োরিয়্যাক্
টরের পাইপের মধ্যে উদ্বায়ী ইথানল গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে, অতএব কোম্পানি শুধু ইথানল সংগ্রহ করে এবং শৈবালগুলো রয়ে যায়, নষ্ট নয় না। নিকট অতীতে ভারতের গুজরাট এলাকায় অ্যালজেনল কোম্পানি একটি ডেমনেস্ট্রেশন প্রোজেক্ট তৈরি করেছে।
শৈবাল তেল থেকে প্রকারন্তরে প্রস্তুত গ্যাসোলিন, বায়োডিজেল, বায়ো গ্যাস আধুনিক মানুষের যান্ত্রিক জীবনে প্রভূত কাজে লাগলেও এই তেলের অসাধারণ কিছু স্বাস্থ্যবিষয়ক উপযোগিতা প্রমাণিত হয়েছে। আজকাল পুষ্টিজগতে প্রায়ই শোনা যায় DHA এবং EPA-র কথা, যেগুলো যথাক্রমে ডাইকোসা-হেক্সিনয়িক এবং আইকোসা-পেন্টিনয়িক এসিড, পুষ্টিজগতে যা ওমেগা-থ্রি (Omega-3 fatty acids) নামে পরিচিত। শৈবাল তেলের ভিতর এই উপাদানগুলো প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। মস্তিষ্কের নিউরন-কণাদের মধ্যে সুষ্ঠু অভ্যন্তরীন যোগাযোগ, স্মৃতিশক্তি, মস্তিষ্ক চালনা, এবং চোখের রেটিনার জন্য DHA একটি অসাধারণ উপাদান। তৈলাক্ত মাছের ভিতরেও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়, যার পরিমাণ সব্জি-বাদাম-দানাশস্য থেকে ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। তবে মাছ থেকে প্রাপ্ত ওমেগা-থ্রির সঙ্গে পারদ বা অন্যন্য ভারী ধাতুর ক্ষতিকর দূষণ থাকতে পারে। মাছের সঙ্গে এস্কিমোদের তুলনায় ইউরোপীয় মাতাদের সংস্পর্শ কম বলে, তাদের দেহে DHA এর পরিমাণও এস্কিমো নারীর মাত্র ৬ ভাগের একভাগ। গর্ভবতী নারীর শেষ ৩ মাসে, বাচ্চার মস্তিষ্ক উন্নয়নের জন্য ৩-৫ গুণ বেশি DHA প্রয়োজন হয়। এই পুষ্টি ব্যাহত হলে মায়ের মস্তিষ্ক থেকে DHA সরবরাহ যায়, যে কারণে মায়ের স্মৃতিশৈথিল্য এবং মানসিক কর্মক্ষমতা লোপ পেতে পারে। যারা বিশুদ্ধ নিরামিষভোজী এবং সামুদ্রিক খাদ্যে যাদের এলার্জি হয় তাদের জন্যে শৈবাল ট্যাবলেট একটি সুন্দর বিকল্প পথ। ভিটামিন সমৃদ্ধ এই তেল প্রদাহনাশক, গলগণ্ড, থাইরয়েড রোগ, হার্টের অসুখ, মানসিক উত্তেজনা, চুল ও ত্বকের জন্য বিশেষ উপযোগী। শৈবাল থেকে উৎপাদিত DHA ফিল্টার করে বিশুদ্ধভাবে চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহৃত হতে পারে।
বাংলাদেশ একটি শৈবালসমৃদ্ধ দেশ, কিন্তু নানা কারণে, বিশেষত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখানে শৈবাল গবেষণা তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। ইদানীং শৈবালকৃষির ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন চট্টগ্রাম ম্যারিন সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ডক্টর মোহাম্মদ জাফর ও অন্যান্য কিছু গবেষক। বর্তমানে আমাদের দেশে সমুদ্রতটে ‘রেসওয়ে পন্ড’ ধরনের শৈবাল-প্রযুক্তি
কে পরীক্ষামূলকভাবে চালু রাখা ব্যয়সাপেক্ষ নয়। এ ছাড়া ল্যাবেও প্রচুর গবেষণা হতে পারে; কোন প্রজাতির ভিতর কি পরিমাণ লিপিড বা তেল আছে তা নির্ধারণ করা, অধিক তেল উৎপাদনের জন্য কোন প্রজাতির ভিতর কতোটুকু জিনগত পরিবর্তন আনতে হবে তা প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। বাংলাদেশে সেন্টমার্টিন্স থেকে শুরু করে টেকনাফ-চট্টগ্রাম হয়ে বাগেরহাট পর্যন্ত শৈবাল চাষের উপযোগী প্রায় ২৫ হাজার বর্গমাইল এলাকা রয়েছে। শৈবাল প্রযুক্তিকে সফলভাবে ব্যবহার করতে পারলে ভবিষ্যতে গোটা দেশের সম্পূর্ণ জ্বালানির দায়ভার দেশ নিজেই নিতে পারবে, এমনকি অন্যদেশেও রফতানি করতে সক্ষম হবে।
Zayed Farid
Bangladesh University of Engineering and Technology
লক্ষ লক্ষ বছর আগে অগভীর সমুদ্রে শৈবাল, গুল্ম ও ব্যাক্টেরিয়ার প্রাচুর্য ছিল। মৃত্যুর পর এরা সমুদ্রের তলদেশে জমা হতে থাকে স্তূপীকৃতভাবে। ক্রমবর্ধমান ওজনের কবলে পড়ে এই স্তূপে প্রচণ্ড চাপ ও তাপের সৃষ্টি হয় যা থেকে কালক্রমে সৃষ্টি হয় ফসিল-জ্বালানি যেমন, কয়লা, গ্যাস কিংবা পেট্রোলিয়াম (Crude Oil)। কালের আবর্তে নানা ভূতাত্বিক কারণে সমুদ্র শুকিয়ে গেলে ভূভাগের নিচে তেলের স্তর থেকে যায় যা মাটির উপরের দিকে স্বল্প চাপের এলাকায় উঠে আসতে থাকে। ঊর্ধগতিসম্পন্ন এই স্তরীভূত তেল এক সময় দুর্ভেদ্য পাথরের নিচে আটকে যায় এবং তৈরি হয় রিজার্ভার। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে শক্ত শিলায় বাধাপ্রাপ্ত না হলে মাটির উপরিভাগেও এসব তেল উঠে আসতে পারে। রিজার্ভারের তেল ড্রিল করে উত্তোলন করা হয়। মুঠোহাত ব্যাসের এই সিলিন্ড্রিক্যাল ড্রিল-যন্ত্রের মাঝখানের ছিদ্র দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বাতাসের প্রবাহ তৈরি করা হয়। বাতাসের চাপে উপরে উৎক্ষিপ্ত হয় ড্রিলের ব্লেডে কাটা শিলা যার নমুনা থেকে ভূগর্ভস্থ নানা স্তরের খবর পাওয়া যায়। এক সময় শিলার সঙ্গে উঠে আসে তেল যা ফুঁসে উঠতে পারে ১০ তলা বিল্ডিংয়ের সমান উচ্চতায়। প্রযুক্তির মাধ্যমে এই তেলের গতিকে নিয়ন্ত্রিত ও সংযত করা হয়।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এর অবিরাম উত্তোলন চলছে তিনটি প্রাথমিক এলাকা, মধ্যপ্রাচ্য, টেক্সাস ও স্কটল্যান্ড-নরওয়ের মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে। বেশিরভাগ তেলকূপ খননের জন্য ডাঙাতে রোটারি ড্রিলিং রিগ (Rig) থাকলেও সমুদ্রেও রয়েছে তেলকূপ খননের জন্য অনুরূপ প্ল্যাটফর্ম। কখনো প্ল্যাটফর্মের কর্মচারীদের কোয়ার্টারও থাকে সেখানে। সমুদ্র থেকে তেল উত্তোলন করা বেশ ব্যয়বহুল, এবং এতে কিছু পরিবেশগত ঝুঁকিও থাকে। কোনো আকস্মিক কারণে বা রিগ সারাইয়ের প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ ব্যারেল তেল জলের উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়, বিশেষত পাখিদের। তেলের সংস্পর্শে পাখির পালকের উড্ডয়ন ও ওয়াটারপ্রুফিং ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ঠাণ্ডায় মারা যায় হাজার হাজার পাখি।
রিজার্ভার পর্যন্ত ড্রিল করার পর একটি তেলকূপ থেকে দিবারাত্র ৩০ বছর ধরে যতই তেল সংগ্রহ করা হোক কখনোই তা জটিল শিলাস্তর থেকে পরিপূর্ণভাবে উত্তোলন করা সম্ভব হয় না। কখনো পানি ঢেলে তেলকে উপরে ভাসিয়ে আনা হয়, আবার কখনো অতি গভীরে ড্রিল করে গ্যাসের চাপে কিছু অতিরিক্ত তেল উপরে তোলা যায়। কিন্তু ভূগর্ভের অতি গভীরে যে সব তেলের খনি আছে তা সনাক্ত করা থেকে শুরু করে নিঃশেষিতভাবে তেল উত্তোলন করার মতো অর্থ ও প্রযুক্তি পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের এখনো নেই। এখন সময় এসেছে বিকল্প পথে তেল উৎপাদন করার। ডাঙায় উৎপাদিত ভুট্টা, ইক্ষু, সয়বিন, জ্যাট্রোফা, ক্যাপায়িবা ইত্যাদি থেকে বিজ্ঞানীরা জ্বালানি তেল উদ্ভাবন করেছেন অনেক আগে কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়াতে তা ব্যবহার করার সুযোগ হয়নি আমাদের। শৈবাল থেকে যে তেল পাওয়া যায় তার পরিমাণ ডাঙার সবজির তুলনায় ৩০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। এক দশক আগে এর উৎপাদন খরচ ছিল ফসিল ফুয়েলের ৩ গুণ। কিন্তু এই অসহ ঋণাত্বক উচ্চমূল্য-অবস্থার দ্রুত অবসান ঘটছে।
বিজ্ঞানীরা এখন অনুসন্ধান করছেন তেল উৎপাদনের জন্য উপযোগী বিশেষ জাতের শৈবাল (Strain), যার ভিতর থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ তেল (Lipid) পাওয়া যাবে। শৈবাল ডিন-এন-এতে জিনগত পরিবর্তন এনে কোনো কোনো কোম্পানি অধিক পরিমাণ তেল উৎপাদনের জন্য তৈরি করে নিচ্ছেন উপযুক্ত হাইব্রিড। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) চাষের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে রেসওয়ে সদৃশ পুকুর বা ‘রেসওয়ে পন্ড’ এবং স্বচ্ছ পাইপ সদৃশ ‘ফটোবায়োরিয়্যাক্টর (Photobioreactor)। তুলনামূলকভাবে রেসওয়ে পন্ড তৈরির খরচ অনেক কম। এগুলো দেখতে লম্বাটে ধাতব বা কংক্রিটের পুকুরের মতো যার মাঝখানে পার্টিশন করা থাকে। শৈবালের স্বাস্থ্যরক্ষার নিমিত্তে, খাদ্য ও পুষ্টির সুষম বন্টনের জন্য ব্যবহার করা হয় বৈদ্যুতিক ‘পেডাল হুইল’ যা পানিকে হালকা গতিতে চলমান রাখতে পারে। মাইক্রোসফট্ কোম্পানির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিল গেইটস্ সৃষ্টি করেছেন ‘স্যাফায়ার এনার্জি’ কোম্পানি যা নিউ মেক্সিকোতে নির্মাণ করেছে বিশাল দৈর্ঘ্যের কিছু রেসওয়ে পন্ড, যার দুটি যোগ দিলে সিকি মাইল হয়ে পারে। এই কোম্পানি বর্তমানে তৈরি করছে ১০০ ব্যারেল ‘গ্রিন ক্রুড অয়েল’। ২০১৮ সাল থেকে দৈনিক ৫০০০ ব্যারেল তেল উৎপন্ন করলে পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে।
রেসওয়ে পন্ডগুলো সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। এতে হঠাৎ অনাকাঙ্খিত কোনো ভিন্ন জাতের শৈবাল বংশবিস্তার করতে পারে। আবার ফসফরাস ও নাইট্রোজেন ইত্যাদি পুষ্টির সরবরাহ অতিরিক্ত হলে শৈবাল বিস্ফারণ ঘটে তাদের বংশনাশ হতে পারে। এসব কারণ বিবেচনায় রেখে তৈরি হয়েছে উন্নতমানের ফটোবায়োরিয়্যাক্টর, যার উৎপাদন খরচ রেসওয়ে পন্ডের তুলনায় অনেক বেশি হলেও তা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিসম্পন্ন। এতে আলোর পরিমাণ, জলের তাপমাত্রা ও গতিবেগ, খাদ্য ও পুষ্টির পরিমাণ অনেক সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে কোনো অনির্বাচিত শৈবালও সহজে মূল শৈবালের চাষ নষ্ট করতে পারে না।
ফ্লোরিডার অ্যালজেনল (Algenol) কোম্পানি শৈবাল থেকে ইথানল (Alcohol), গ্যাসোলিন, ডিজেল এবং জেট-ফুয়েল তৈরির জন্য পেটেন্ট বা সরকারি সনদপত্র পেয়েছে। এই কোম্পানি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ইথানল তৈরি করে। এদের উদ্দেশ্য, প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে বিশেষ জাতের শৈবাল থেকে সরাসরি ইথানল তৈরি করা। এসব শৈবালকে অন্ধকারে লালন করা হয়। এই পদ্ধতির একটি ব্যবসায়িক গোমর হচ্ছে, শৈবালের উপর এক ধরনের চাপ বা স্ট্রেস (Stess) সৃষ্টি করা যাতে সরাসরি ইথানল তৈরি হয়। প্রকৃতিতে এভাবে উৎপাদিত ইথানলের পরিমাণ খুব কম, তাই অধিক মাত্রায় ইথানল তৈরির জন্য কোম্পানির গবেষকরা শৈবালের জিনকে রূপান্তর (Genetically modified) করে নিয়েছেন। ফটোবায়োরিয়্যাক্
টরের পাইপের মধ্যে উদ্বায়ী ইথানল গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে, অতএব কোম্পানি শুধু ইথানল সংগ্রহ করে এবং শৈবালগুলো রয়ে যায়, নষ্ট নয় না। নিকট অতীতে ভারতের গুজরাট এলাকায় অ্যালজেনল কোম্পানি একটি ডেমনেস্ট্রেশন প্রোজেক্ট তৈরি করেছে।
শৈবাল তেল থেকে প্রকারন্তরে প্রস্তুত গ্যাসোলিন, বায়োডিজেল, বায়ো গ্যাস আধুনিক মানুষের যান্ত্রিক জীবনে প্রভূত কাজে লাগলেও এই তেলের অসাধারণ কিছু স্বাস্থ্যবিষয়ক উপযোগিতা প্রমাণিত হয়েছে। আজকাল পুষ্টিজগতে প্রায়ই শোনা যায় DHA এবং EPA-র কথা, যেগুলো যথাক্রমে ডাইকোসা-হেক্সিনয়িক এবং আইকোসা-পেন্টিনয়িক এসিড, পুষ্টিজগতে যা ওমেগা-থ্রি (Omega-3 fatty acids) নামে পরিচিত। শৈবাল তেলের ভিতর এই উপাদানগুলো প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। মস্তিষ্কের নিউরন-কণাদের মধ্যে সুষ্ঠু অভ্যন্তরীন যোগাযোগ, স্মৃতিশক্তি, মস্তিষ্ক চালনা, এবং চোখের রেটিনার জন্য DHA একটি অসাধারণ উপাদান। তৈলাক্ত মাছের ভিতরেও ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়, যার পরিমাণ সব্জি-বাদাম-দানাশস্য থেকে ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। তবে মাছ থেকে প্রাপ্ত ওমেগা-থ্রির সঙ্গে পারদ বা অন্যন্য ভারী ধাতুর ক্ষতিকর দূষণ থাকতে পারে। মাছের সঙ্গে এস্কিমোদের তুলনায় ইউরোপীয় মাতাদের সংস্পর্শ কম বলে, তাদের দেহে DHA এর পরিমাণও এস্কিমো নারীর মাত্র ৬ ভাগের একভাগ। গর্ভবতী নারীর শেষ ৩ মাসে, বাচ্চার মস্তিষ্ক উন্নয়নের জন্য ৩-৫ গুণ বেশি DHA প্রয়োজন হয়। এই পুষ্টি ব্যাহত হলে মায়ের মস্তিষ্ক থেকে DHA সরবরাহ যায়, যে কারণে মায়ের স্মৃতিশৈথিল্য এবং মানসিক কর্মক্ষমতা লোপ পেতে পারে। যারা বিশুদ্ধ নিরামিষভোজী এবং সামুদ্রিক খাদ্যে যাদের এলার্জি হয় তাদের জন্যে শৈবাল ট্যাবলেট একটি সুন্দর বিকল্প পথ। ভিটামিন সমৃদ্ধ এই তেল প্রদাহনাশক, গলগণ্ড, থাইরয়েড রোগ, হার্টের অসুখ, মানসিক উত্তেজনা, চুল ও ত্বকের জন্য বিশেষ উপযোগী। শৈবাল থেকে উৎপাদিত DHA ফিল্টার করে বিশুদ্ধভাবে চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহৃত হতে পারে।
বাংলাদেশ একটি শৈবালসমৃদ্ধ দেশ, কিন্তু নানা কারণে, বিশেষত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখানে শৈবাল গবেষণা তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। ইদানীং শৈবালকৃষির ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন চট্টগ্রাম ম্যারিন সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ডক্টর মোহাম্মদ জাফর ও অন্যান্য কিছু গবেষক। বর্তমানে আমাদের দেশে সমুদ্রতটে ‘রেসওয়ে পন্ড’ ধরনের শৈবাল-প্রযুক্তি
কে পরীক্ষামূলকভাবে চালু রাখা ব্যয়সাপেক্ষ নয়। এ ছাড়া ল্যাবেও প্রচুর গবেষণা হতে পারে; কোন প্রজাতির ভিতর কি পরিমাণ লিপিড বা তেল আছে তা নির্ধারণ করা, অধিক তেল উৎপাদনের জন্য কোন প্রজাতির ভিতর কতোটুকু জিনগত পরিবর্তন আনতে হবে তা প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। বাংলাদেশে সেন্টমার্টিন্স থেকে শুরু করে টেকনাফ-চট্টগ্রাম হয়ে বাগেরহাট পর্যন্ত শৈবাল চাষের উপযোগী প্রায় ২৫ হাজার বর্গমাইল এলাকা রয়েছে। শৈবাল প্রযুক্তিকে সফলভাবে ব্যবহার করতে পারলে ভবিষ্যতে গোটা দেশের সম্পূর্ণ জ্বালানির দায়ভার দেশ নিজেই নিতে পারবে, এমনকি অন্যদেশেও রফতানি করতে সক্ষম হবে।
![]() |
অ্যালজেনল ডেমন্সট্রেশন প্রোজেক্ট, ইন্ডিয়া |
Zayed Farid
Bangladesh University of Engineering and Technology
Tags:
জানা-অজানা