পবিত্র দৌমফল

মদিনা নগরীর ঐতিহাসিক কুবা মসজিদের চাতাল ঘেঁষে ছোট ছোট মসলার দোকান। চার-পাঁচটা ঝুড়ি সামনে নিয়ে মাটিতেই বসে আছে কিছু বোরকা ও নেকাব পরা মহিলা। ধর্মবিশ্বাস থেকে তারা জানে, মাটি থেকেই তাদের জন্ম হয়েছে, তাই মাটিতে বসতে তাদের কোনো দ্বিধা-সংকোচ নেই। আরবি ‘কাবসাহ্’ অর্থাৎ বিরিয়ানি পাকানোর যাবতীয় ভারতীয় মসলা বিক্রি করছে তারা। কিন্তু লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, প্রায় প্রতিটি দোকানে মশলাপাতি ছাড়াও আছে দুটো অতিরিক্ত জিনিস, কাফ মরিওম ও দৌমফল।
কাফ মরিয়মকে আমরা অনেকে মরিয়ম ফুল বলে জানি। তবে ফুলের মতো দেখতে হলেও আদতে তা শুকিয়ে কুকড়িমুকড়ি গোল হয়ে যাওয়া একপ্রকার মরু-উদ্ভিদ (Anastatica hierochuntica)। আমাদের উপমহাদেশসহ আরো কিছু দেশে সন্তান প্রসবের সময়ে এই মরিয়ম ফুল পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় এই ভেবে যে, এই ফুল যত খুলবে, জরায়ূ তত বিস্তৃত হবে, কষ্ট লাঘব হবে। দ্বিতীয় বেমানান জিনিষটা এক ধরনের শুকনো ফল, ৫-৭ সেন্টি লম্বা, আকৃতি ও রং খেজুরের মতো। কিন্তু এর ছাল এত শক্ত যে এই ফল ছুঁড়ে মাড়লে কারো মাথা ফেটে যেতে পারে। এমন একটি কঠিন শুকনো ফল আর তার বীজ করাত দিয়ে কাটতে সময় লাগে ২০-২৫ মিনিট। বাজারে বিক্রির কারণ, এই ফল থেকে নানারকম ওষুধ তৈরি হয়।
দৌমফলের গাছ আরবের মরুদ্যানগুলোতে, এমন কি ইন্ডিয়ার শুকনো অঞ্চলেও কিছু দেখা যায়। এদের প্রকৃত আস্তানা নীল নদের দুই তীর। ৪২০০ মাইল লম্বা নীলনদ পৃথিবীর দীর্ঘতম, গঙ্গানদীর আড়াইগুণ। এর ইংরেজি নাম নাইল যার দুটি উপনদী, ব্লু-নাইল আর হোয়াইট নাইল। ব্লু নাইল নাম হয়েছে এর ঘোলাপানি দেখতে কালো বলে, যা ইথিওপিয়ার পর্বতমালা থেকে ঊর্বর কাদামাটি বয়ে আনে; সুদানের আঞ্চলিক ভাষায় কালো আর নীল বোঝাতে একই শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেহেতুই ব্লু-নাইল। ভিক্টোরিয়া লেক থেকে জন্ম নিয়ে হাল্কা বাদামি রঙের পানি বহন করে বলে অন্যটির নাম হোয়াইট নাইল। দুটো নদীর সঙ্গম হয় খার্তুমে তারপর উত্তরে গিয়ে বিলীন হয় ভূমধ্যসাগরে। পলিবাহিত এই ঊর্বর নদীর পাড়েই খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০০ সাল থেকে ফেরাউনদের বিশাল সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ২০০৭ সালে রূপসী রাণী নেফেরটিটির সৎ ছেলে রাজা টুটেনখামুনের সমাধিসৌধ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে ৮ ঝুড়ি দৌমফল। তাদের বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পরে মানুষ আবার পুনর্জীবিত হয়, তখন যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য পোশাক-আশাক, খাদ্যসামগ্রী, আসবাব, সোনাদানার অলঙ্কার ও নিত্য ব্যবহার্য সব কিছু সমাধিতে রাখা হতো। প্রয়োজনীয় হাজার কয়েক আইটেমের মধ্যে ঝুড়ি ভরা দৌমফলও ছিল অন্যতম। গুণাগুনের কারণেই হয়ত এই ফলকে তারা পবিত্র ফল মনে করত এবং এ-কারণে ফেরাউনদের সমাধিতে এদের প্রায়শ দেখতে পাওয়া যায়।

দৌমগাছের বৈজ্ঞানিক নাম হাইফিনে থিবাইকা (Hyphaene thebaica)। ফলের গায়ে কঠিন আঁশের জন্য হাইফিনে এবং ‘থিবাইকা’ একটি প্রাচীন মিশরীয় নগর যেখানে এর প্রাপ্তি ছিল প্রচুর। সুদীর্ঘ নীলনদ, মিশর সুদানসহ ১০টি দেশের মধ্য দিয়ে গেছে, যার সব জায়গাই দৌমগাছ জন্মানোর জন্য অনুকূল। এই ডাইকোটমাস (Dichotomous) গাছদের ইংরেজি ‘Y’ আকৃতির ডালপালা দেখে দূর থেকে সহজেই চেনা যায়। নীলনদের তীরবর্তী গ্রামগুলোতে হাতে গোনা যে কয়েকপ্রকারের মরু-গাছ জন্মায় তার ভিতর দৌম অন্যতম। মর্যাদার প্রতীক এই একটি গাছ থেকে এলাকাবাসী খাদ্য, ওষুধ, পাত্র অনেক কিছুই তৈরি করে নেয়। এর তালগাছের মতো পালমেট পাতা থেকে তৈরি হয় নানা রকমের ঝুড়ি, মাদুর, দড়ি, ঝাঁটা, হ্যাট ইত্যাদি; কেনিয়াতে লন্ড্রি-বাস্কেট উৎপাদিত হয় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। কাণ্ড ব্যবহৃত হয় ঘরবাড়ি ও আসবাব নির্মাণে। ফল দেখতে ছো্ট হলেও খেজুরের চেয়ে নারকেলের সঙ্গেই এর সাদৃশ্য বেশি। পাকা ফলের আঁশগুলো মিষ্টি ঘ্রাণযুক্ত, অন্তত আধা সেন্টি পুরু, নারকেলের তুলনায় নরম, যা শুকিয়ে শক্ত হওয়ার আগে চিবিয়ে খাওয়া যায়। ফলের আঁশ থেকে সুস্বাদু পানীয় তৈরি হয়। কচি অবস্থায় এর বীজের শাঁসও খাওয়া যায়। একবার ভালমত শুকিয়ে গেলে ভিতরের সাদা শাঁস ভয়ানক শক্ত হয়ে যায়, দেখে মনে হয় পালিশ করা আকিক পাথর। এ-জাতীয় পাম-ফলের শক্ত শাঁসকে অনেকক্ষেত্রে ভেজিটেবল আইভরি বলা হয়। এর থেকে তৈরি হয় বোতাম ও কৃত্রিম মোতি। উপরের ছাল ছড়িয়ে তৈরি হয় ছোট ভাস্কর্য, লকেট ইত্যাদি।
হাইফিনে গণের মোট ২৬টি প্রজাতির মধ্যে কেনিয়া, তানজানিয়া ও ইথিয়পিয়া অঞ্চলে এর আরো দুটো প্রজাতি দেখা যায়, হাইফিনে কমপ্রেসা (Hyphaene Compressa) এবং হাইফিনে কোরিয়াকিয়া (Hyphaene Coriacea)। কম্প্রেসা প্রজাতির ফল বেশ বড়, ১০-১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, পাশে ৭-৮ সেন্টি। এই ফলের ভিতর যে বীজ থাকে তা আকারে বড় বলে ভেজিটেবল আইভরির পরিমাণও বেশি থাকে। এই গাছ ৩০ বছর পরে ফলবতী হয়, টিকে থাকে কমপক্ষে ১০০ বছর। ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার ছেলেরা শুকনো ফল পোড়া দেয় আঞ্চলিক ‘মগোগো’ চুলায়, তারপর ভেঙে নিয়ে আলাদা করে ফেলে বীজ। এই বীজের ভিতর পেরেক ঠুকে সুন্দর এক ধরনের লাটিম তৈরি করে। লাটিমের এক পাশে ছোট্ট একটু ছিদ্র করে দিলে ঘোরার সময় ভোঁ ভোঁ আওয়াজ করে। এই বীজ হাতি, বেবুন ও বানরের প্রিয় খাবার। এরাই দূরবর্তী অঞ্চলে এই গাছের বীজ বিসরণ ঘটায়।
দৌম গাছের শিকড় ‘বিলহার্জিয়া নামক একটি অসুখের চিকিৎস্যায় ব্যবহার হয়, যে অসুখের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা গেছে মিশরীয় মমি থেকে। ফলের পেস্ট বুকের ব্যথার জন্য বেশ ফলপ্রদ, ফল থেকে প্রস্তুত পানীয় জন্ডিসের জন্য উপকারী। পাতা জ্বাল দেয়া পানি চোখ ওঠার জন্য উত্তম কাজ করে। কাঁচা ফল পেটের পীড়া, হার্ট, কিডনি ও ডায়াবেটিস অসুখের জন্য ব্যবহৃত হয়। কেনিয়াতে ফুল হওয়ার আগে খেজুর গাছের মতো কাণ্ড চেঁছে নিয়ে রস বের করা হয় যা পরবর্তীতে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় গুড় ও মদ্য। কিন্তু সঠিকভাবে এই কাজটি করতে না পারলে, কাটার গভীরতা বেশি হয়ে গেলে গাছ প্রায়ই মরে যায়। তাপ দিয়ে এর ফল-নিঃসৃত রস থেকে প্রস্তুত করা আঠা মমি র্যাপিংয়ের কাজ করা হতো এক সময়। এই আঠা কিছু মরু-কবিরাজ এলার্জির ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করেন।
ঔপন্যাসিক তায়িব সালেহ সুদানের তথা বিশ্বের সাহিত্য পরিমণ্ডলের একজন খ্যাতিমান লেখক। তার একটি বিখ্যাত ছোট গল্পের নাম, ‘দি ডোউম ট্রি অব ওয়াদ হামিদ’। এই গল্পের ভিতর এক জায়গায় গাছটির সৌন্দর্যের বর্ণনায় তিনি বলেছেন, এর কাণ্ডের গড়ন দেখে মনে হয় যেন অপরূপ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে এক আকর্ষণীয় নারী, আর দৌমের ঝাঁকড়া মাথাগুলো যেন ছুটন্ত ঘোড়ার কেশর’। এমন সুন্দর উপকারী একটি গাছ আধুনিক নগরায়নের চাপে বিলীন হওয়ার পথে। বাণিজ্যিকভাবে দৌম লাভজনক নয়, তবে এর সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণাও অপ্রতুল। গবেষণার সুফল প্রকাশ হতে হতে হয়ত দৌমের অস্তিত্বে টান পড়বে। তবু যারা এখনো এই গাছের পরিবেশে জীবন কাটায় তাদের প্রাত্যহিক জীবন শুধু নয় স্বপ্নকেও প্রভাবিত করে দৌমগাছ, এর ছায়ায় গিয়ে বসে তারা, একে স্পর্শ করে, এর সাথে জীবনের কথা বলে।

গাছে দৌম ফল
সূত্রঃ ইব্রাহিম শাম্বেল
ডালপালা বিশিষ্ট দৌমগাছ-
সূত্রঃ মুনতাদিয়াত আগনাম আর্কাইভ

মাঝখান থেকে কাটা ফল ও বীজ (ভেজিটেবল আইভরি)


Zayed Farid
Bangladesh University of Engineering and Technology

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম