আফাফ আর এসিপি ফাহাদ তিন তিনটা লাশের সামনে দাড়িয়ে আছে। লাশগুলোকে সিলাই করা হয়েছে।তবুও কোন কোন জায়গায় গোশত পচে গিয়ে সেলাই খুলে খুলে গিয়েছে।লাশ ভাল মতো আইডেন্টিফাই করা যায় নি। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুয়ায়ী দুটো লাশ নয়নার শশুর-শাশুরি আর একটা নয়নার স্বামীর।ডা. বিজয়ের মতে লাশকে দাই বা ভারী অস্ত্র দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে।
লাশের এমন অবস্হা দেখে এসিপি আর আফাফ দুজনেই বেশ নড়েচড়ে উঠল।সাত সাতটা খুন।তাও আবার এমন বিভৎষ্য ভাবে।কিন্তু কোন ক্লু কিছুতেই পাচ্ছেন না তারা।খুনি যে এসিপি আর স্পাই আফাফকে এমন সাত প্যাচের জাতাকলে ফেলেছে,সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।এ যেন শুন্যতেই শুরু আবার শুন্যতেই শেষ।
- "না,এবার দেখছি কিছু একটা করতেই হবে।খুনিকে যদি লকাপে না ঢুকিয়েছি তাহলে আমার নাম আফাফ নয়।"
মর্গ থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল স্পাই আফাফ।এসিপি ফাহদ আর ডা. বিজয় অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল স্পাই আফাফের যাওয়ার দিকে।
·
"বুঝলেন স্যার।মালডারে নতুন দেখছি।এক্কেবারে পাকা হাত।দয়া-মায়া নাই বললেই চলে।পুরাই পাথর। ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে খুন করে" - হুইচকে খেতে খেতে বলল ফারুক।
"কতদিন হলো শহরে এসেছে?"
"এই ধরুন এক মাস"
"মাত্র এক মাসই এত জনপ্রিয় হয়ে গেল?"
আফাফের কথায় ফারুক সতর্ক দৃষ্টিতে একবার চারপাশটা ভাল করে দেখে নিল। এরপর চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের উপর ঠেস দিয়ে স্পাই আফাফের কানে কানে বলল:
"স্যার।ব্যাডায় মাল কম গোনে কাজ পাকা।এ জন্যই এত ডাক"
"একে কোথায় পাওয়া যাবে?"
"স্যার,ওরে পাইবেন না।গত এক সপ্তাহ ধরে ওরে দেহি না।মনে হয়,গাঁ ঢাকা দিছে।তয় আপনে যদি আমারে...." - মাথা নিচু করে বলল ফারুক।
"ফারুক।আমি তোমাকে কখনো হতাশ করেছি?"
"না,স্যার।তা করেন নি অবশ্য।"
"তাহলে?"
"কিছু না স্যার।"
এই বলে পকেট থেকে একটা হলুদ রঙের চিরকুট বের করে দিল স্পাই এজেন্ট আফাফের হাতে।চিরকুটটা কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে দেখল আফাফ।- "হ্যা,এটাই চেয়েছিলাম।"
খুশিতে গদগদ করে চকচকে দুটো হাজার টাকার নোট ফারুকের হাতে গুজে দিয়ে আফাফ পিছন ফিরে হাটতে লাগল।
আফাফের প্রথম থেকেই নয়নার কাকা শশুর সুধীরের উপর বেশ গাঢ় ভাবে সন্দেহ হয়েছিল।নেহাত হাতে কোন প্রমান ছিল না।নয়না আর নয়নার শশুর বাড়ির লোকদের উপর যে ছিল না সেটাও নয়।ব্যাপারটা ঠিক এরকম।সুধীরের উপর ৪০% আর বাকি দু-পক্ষের উপর ৩০% করে।সুধীর বাবু বেশ ভালই চাল চেলেছে।তবে শেষ রক্ষা হয় নি।মৃদুল আর জয়া সবই বলে দিয়েছে।
নয়না আসলে সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত।এই রোগে আক্রান্ত রোগীরা বাস্তব জগতের বাইরে নিজের কল্পনার এক জগত তৈরি করে।নয়নাও করেছিল।সে মাধুর্যকে নিজের পুতুল মনে করেছিল।কল্পনায় নিজের আদ্ধ্যাতিক শক্তি আছে ভেবে,সেই শক্তি দিয়ে মাধুর্যকে নিজের দিকে প্রভাবিত করবতে চেয়েছিল।নয়না মনে করেছিল নয়নার শশুরবাড়ির লোকেরা ওকে মারতে চায়।ওকে খুন করতে চায়।আর এই মৃর্ত্যু ভয়টাই এই খুনের মেইন পয়েন্ট হয়ে দাড়ায়।রোগী নিজেও বুঝতে পারে না সে আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছে।অবশ্য পাগল কখনো বুঝে না সে পাগল।
নয়না ধীরে ধীরে মৃর্ত্যু ভয়ে তটস্থ থাকতে শুরু করে। সব সময় আতঙ্কিত থাকে।এই যেন কেউ তাকে খুন করে মারবে, না বিষ দিয়ে মারবে। আর সুধীর বাবু সেটারই সুযোগ নিয়েছেন।
·
সুধীর বাবু পেশায় একজন সাইক্রেটিস।তবে শিক্ষার ভুল প্রয়োগের ফলে তার লাইসেন্স বাতিল হয়।তাই সেখানকার ল্যাটা চুকিয়ে গত দু-বছর হলে এখানে এসেছেন।নয়নাকে এমনিতে ভালবাসা দেখালেও তিনি যে নয়নাকে শুধু একটা দাবার গুটি বানিয়েছেন সেটা কোন কাকপক্ষীও টের পায় নি।
L. S. D.। পুরো নাম Lysergic acid diethylamide। এটা একধরনের আসক্তিবিহীন ড্রাগ।১৯৫০-১৯৬০ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় এটা জাস্ট ঔষুধ হিসেবেই ব্যবহার করা হতো।কিন্তু পরে ইউ এস সরকার এটাকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে।এই ড্রাগ মানুষের মনে প্রবলভাবে হ্যালুসুলেশনের সৃষ্টি করে।অদ্ভুত সব চিন্তাধারা মাথায় তৈরি করে।কোন একটা ব্যাপারের দিকে বেশি প্রভাবিত করে।রোগী ডিপ্রেশন আর ফ্রাস্টেশনে ভোগে।ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।।
·
আর সুধীর বাবু এই ড্রাগই নয়না সিরেঞ্জের মাধ্যেমে রোজ দিয়ে যেতেন।১০-১২ ঘন্টা মেয়াদের এই ড্রাগই আসলে নয়নার শশুরবাড়ির লোকদের কাল হয়ে দাড়িয়ে ছিল।নয়নার শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের বলা হতো,এটা এক প্রকার ভিটামিন।নয়নার শরীর দুর্বলতার জন্য দেওয়া হচ্ছে।
"মি. আফাফ আপনি এতোকিছু জানলেন কি
ভাবে?"
এসিপি ফাহাদের কথায় আফাফ মৃদু হেসে বলল:
"সিজোফ্রেনিয়া রোগটা সম্পর্কে মৃদুলের কাছেই জেনেছিলাম।আর বাকিটা বিখ্যাত সাইক্রেটিস্ট ডা. আসাদ আর কিছু বই ঘাটাঘাটি করে জেনেছি।"
"বলতেই হবে মি. আফাফ আপনার তুলনা নেই।শূন্য থেকে শুরু করে কতটা এগিয়েছেন আপনি?"
"হা হা।এসিপি স্যার ক হতে কলিকাতা বের করা আমার ডিউটি আর খুনিকে খুজে বের করে জেলে ঢোকানো আপনার ডিউটি।"
"তা যা বলেছেন মি. আফাফ।তবে!"
"তবে কি?"
"তবে সুধীর বাবু এসব করতে যাবেন কেন? এর পিছনে মোটিভ কি? এ বিষয়ে কিছু জানতে পারলেন?"
"জেনেছি।তবে শিউর না।যতদুর জেনেছি উনি একজন নাস্তিকবিদ।শয়তা
নের পুজারী।শয়তানকে মানুষকে ভোগ দেওয়ার জন্যও এমনটা করতে পারেন।এমনটাও হতে পারে,হয়তো তার ভাইয়ের সাথে তার বড় ঝামেলা ছিল?"
"আমার মনে হয় দ্বিতীয়টাই হবে?"
"হবে হয়তো"
"স্যার,সুধীর বাবু নেই? সমস্ত বাড়ি ভালভাবে তল্লাসি নিয়েছি।কিন্তু কোথাও পাই নি।মনে হয় পালিয়েছি"
স্পাই আফাফের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই কনস্টেবল নিলয় হন্তদন্ত হয়ে এসে কথাটা বলল।নিলয়ের কথা শুনেই এসিপি ফাহাদ বিষম খেয়ে বলল:
"হোয়াট? কি বলছ এসব।ওহ মাই গড।ওমন একটা জানোয়ার এই শহর ছেড়ে পালিয়ে যেখানেই যাবে সেখানেই এমন বিভৎষ্য কাজ ঘটাবে।"
মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল এসিপি ফাহাদ। সব শেষ।এই জানোয়ারটাকে কিভাবে ধরবেন তিনি? ওদিকে আফাফ এসিপি ফাহাদের কান্ড দেখে মুচকি হাসতে থাকল।এসিপি ফাহাদ প্রচন্ড বিরক্ত হলেন।এমন সিরিয়াস পরিস্থিতিতে হাসলে প্রচন্ড রাগ হওয়া স্বাভাবিক।
"কি হলো আপনি হাসছেন কেন?"
"হাসব না।আপনি যা করছেন?"
"মানে?"
"এই নিন।জিপিএস লিংক।স্পাই আফাফ এতো কাচা হাতের খেলোয়ার নয়।আমি আগে থেকেই সব ভিকটিমের গাড়িতেই জিপিএস লাগিয়ে রেখেছি।"
বলেই হো হো করে হাসতে লাগল আফাফ।এসিপি ফাহাদ নিজের কর্মকান্ডের জন্য একটু লজ্জা পেল।এক্ষুনি চটে গিয়ে আফাফকে কিনা কি বলতে যাচ্ছিলেন।অথচ ছেলেটা কত কাজের? কিছুক্ষন পর কনস্টেবল ফিরোজকে জিপিএস লিংকটা গুগল ম্যাপে এড করতে বললেন।
·
শহর থেকে বাইরের এক সুনসান জায়গা।এখানে খুব সহজেই একটা মানুষকে মেরে গুম করে দেওয়া যাবে।এমন একটা জায়গায় সুধীর বাবুর গাড়িটা থেমে আছে।ব্যাপারটা কেমন গাঁ ছমছম ঠেকছে? এসিপি ফাহাদের।আর যাই হোক জানোয়ারটার উপর এতটুকু ভরসা নেই তার।
"স্যার,আর মাত্র পঞ্চাশ মিটার"
কনস্টেবল নিলয়ের কথায় আফাফ আর এসিপি দুজনেই বেশ চমকে উঠল।এরপর খুব সতর্কতার সাথে পা টিপে টিপে এগিয়ে যেতে থাকল।হঠাৎ আফাফ থেমে গেল। পিছনে হাত নাড়িয়ে সবাইকে থামতে বলল।মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে বসে পড়ল সবাই।
চোখের সামনে এমন বিভৎষ্য দৃশ্য যেন ইংলিশ হরহর সিনেমাকেও হার মানাবে।জলন্ত আগুনের মধ্যে লাল রঙের কাগজ ফেলে দিয়ে তাতে বোতলের পর বোতল রক্ত ঢেলে যাচ্ছে সুধীর বাবু আর তার স্ত্রী।আর সাথে এক বুড়ো করে পুরোহিত বেশে এক লোক অদ্ভুত সব মন্ত্র যপে যাচ্ছে।এবার আর কারোরিই বুঝতে বাকি রইল আসলে এখানে কি হতে যাচ্ছে?
এসিপি ফাহাদ আর চুপ থাকতে পারল না।রিভালবারটা আকাশের দিকে তাক করে ফায়ার করলেন।আর সাথেই সুধীর বাবু আর উনার বউ পিছন ফিরে প্রানপন দৌড়াতে লাগলেন।কিন্তু বিধি গাছের শিকরের সাথে খুব জোড়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে দুরে পড়ে গেল দুজনে।এসিপি ওদের কাছে পৌছানোর আগেই আফাফ তার লাইসেন্স করা ডিজার্ট ঈগল গানটা সুধীর বাবুর মাথায় ঠেকাল।
"হা হা।মি. সুধীর আপনার সব খেল খতম পয়সা হজম।" - বলেই হো হো করে হেসে উঠল আফাফ।
হ্যান্ডকাফ পড়িযে গাড়িতে তোলা হয়েছে সুধীর বাবু আর তার স্ত্রীকে।পুরেহিত সাজের লোকটা গুলির শব্দেই জ্ঞান হারিয়েছে।সবাইকে জিপে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।এসিপি ফাহাদ আর আফাফের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে,আজকের জুগেও কেউ এমন একটা জঘন্য কাজ করতে পারে।ছয়টা প্রানের জন্য একটা প্রান ফিরে পাওয়া।- "ছিঃ।এরা কি মানুষ?"
আসলে সুধীর বাবু L.S.D. ড্রাগ দিয়ে নয়নার মস্তিষ্কে একটা ভ্রান্ত ধারনা সৃষ্টি করেতে চেয়েছিলেন।আর সফলও হন।নয়নাকে বোঝানো হয়েছিল মাধুর্য পরিকিয়ার আক্রান্ত।ও নয়নাকে তালাক দিতে চায়।নয়নার শশুেবাড়ির লোকেরা ওকে মেরে ফেলতে চায়।আর যার কারনেই মানসিক ভারসাম্যহীন নয়নাকে দ্বারা সবাইকে খুন করে ফেলা খুব একটা কঠিন হয় নি।কিন্তু নয়নার বোন জয়া আর মৃদুল কিভাবে বেচে গেছে সে সম্পর্কে জানা যায় নি।
তবে এই কেসে এসিপি ফাহাদ আর আফাফ মধ্যেযুগীয় হিংস্রত খুজে পেয়েছেন।কেউ নিজের সন্তান লাভের জন্য ছ-ছটা মানুষকে খুন করতে পারে,সেটা এবার মুখোমুখি ফেস করেছে তারা।
কিন্তু এতো কিছুর পরও পুলিশ সুপার তারেক রহমানকে কে মেরেছে? কেন মেরেছে? জানা যায় নি।ইনভেস্টিকেশন চলছে।হয়তো জানা যাবে হয়তো যাবে না।
অজ্ঞাত লাশটার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।যদিওবা ফেস আইডেন্টিফাই করা যায় নি।ডা. বিজয় আগন্তুক লাশটির একটা অনুমানিক 3D ছবি প্রিন্ট করেছেন।এ ছাড়া এই আগন্তুক সম্পর্কে আর এভিডেন্স পায় নি এসিপি ফাহাদ আর স্পাই আফাফ।
...…....…......সমাপ্ত...................
Written By - Sohanur Rahman Sohan
Tags:
Thriller