স্যার,আমাকে বাচান। প্লিজ হেল্প মি স্যার.!!
ধপ করে হেনা ভাইয়ের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল।নিলকে কিছু না বলেই দৌড় দিলেন হাসপাতালের দিকে। প্রানপনে ছুটছেন হেনা ভাই। হাসপাতালের সামনে এসেই তার হাত-পা অসার হয়ে আসল।কনস্টেবল মতিনের দেহ বিহীন মন্ডুটা সামনেই পড়ে আছে। তাজা রক্ত গুলো ফিনকি দিয়ে মাটিতে পড়ছে।হেনা ভাই মতিনের দেহটা দেখেই কিছুক্ষনের জন্য নীলান্তার কথা ভুলে গেলেন। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। হঠাত আবার নীলান্তার কথা মনে হতেই চিৎকার করে নীলান্তাকে ডাকতে লাগলেন। না,কেউ নেই। হঠাত একজন খাকি পোশাক পরা লোক হেনা ভাইয়ের দিকে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলেন।
'খুন' 'খুন'
হেনা ভাইয়ের এই মহুর্তে কি করা উচিত তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। উনার সামনে কনস্টেবল মতিনের দেহ পড়ে আছে আর তার সাথে নীলান্তা নেই। সবটা কেমন জানি গোলমেলে লাগছে। লোকটার ডাকে ধীরে ধীরে মানুষ জড়ো হতে লাগল। গোল করে ঘিরে ধরল হেনা ভাই আর লাশের চারপাশটা। ঠিক তখনি কনস্টেবল নীল হাপাতে হাপাতে বলল,
- স্যার,এইসব কি ভাবে হলো?
হেনা ভাই পিছনে তাকাতেই দেখলেন কনস্টেবল নীল দাড়িয়ে আছে। নীলের প্রশ্নে তিনি কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারছেন?
·
সকাল ১০ টা।হেনা ভাই ফরেনসিক রুমের বাইরে বসে আছেন। দুই হাত থুথুনিতে দিয়ে তিনি ভাবছেন। কি হচ্ছে এসব? আর কেনই বা হচ্ছে? কনস্টেবল মতিন মারা গেল-নীলান্তা গায়েব-পকেটের গোল্ডেন ওয়াচটা নেই। সব মিলে হেনা ভাই এখনো রহস্যের অন্ধকারেই আছেন। একটা মাত্র অ্যাবিডেন্স আছে তার কাছে।হাইডিং ডোর। কিন্তু সেখানে দুটো ট্রলি ছাড়া আর কিছুই পান নি তিনি। কনস্টেবল নীল স্কেনার দিয়ে জায়গাটা সার্চিং করছে। তবে এসবের মাঝে হেনা ভাইয়ের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার যে এটা কোন ভুতের কারবার নয়। এটা একটা চক্র। এর পিছনে যে বড় কোন রহস্য আছে সেটা হেনা ভাই এখন বেশ বুঝতে পারছেন।
চার সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। হেনা ভাই তাদের প্রধান। হেনা ভাই সম্পূর্ন ব্যাপারটা আরেকবার ভাবতে লাগলেন,
প্রথমে ভৌতিক অভিনয়,তারপর গোরস্থানে অজ্ঞান হওয়া,হাসপাতালে নীলান্তার অজ্ঞান,তারপর কনস্টেবল মতিনের অস্বাভাবিক মৃর্ত্য,আর সর্বশেষ
নীলান্তার গায়েব হওয়া।
হঠাত হেনা ভাই চিৎকার করে উঠলেন- 'পেয়ে গেছি।খুনি কে পেয়ে গেছি'
হেনা ভাইয়ের হঠাত চিৎকারে এসিপি হারুন চমকে উঠলেন। অবাক হয়ে বললেন,
- কি পেয়েছেন স্যার?
- খুনিকে পেয়ে গেছি?
- কি বলছেন? আর কেই-বা খুনি? জানোয়ারটার নাম বলুন,তারপর দেখুন আমি ওর কি অবস্থা করি?"
হেনা ভাই এসিপি হারুনের কথা শুনে মৃদু হাসলেন।এরপর পিছন ফিরে হাটতে লাগলেন। এসিপি হারুন হেনা ভাইয়ের এমন কাজ দেখে অবাক হয়ে পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে বললেন,
- কি হলো হেনা ভাই? কোথায় যাচ্ছেন?
হেনা ভাই এবারও মৃদু হেসে বললেন- আমি রহস্যের পূজারী,যেখানে রহস্য সেখানে আমি।
এসিপি হারুন চরম বিরক্ত হয়ে হেনা ভাইকে অনুসরন করতে লাগলেন।
·
গাড়ি চলছে। হেনা ভাই,এসিপি হারুন আরও দুজন কনস্টেবল হাসপাতালে যাচ্ছেন। দুপুর দুটো।হাসপাতালের ভিতরে ঢুকছে হেনা ভাইয়ের টিম।লোকজন নেই। সম্পুর্ন হাসপাতাল ফাকা। হাসপাতাল কমিটি আগামী এক মাসের জন্য হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছে।
এই দিনের বেলাতেও সম্পুর্ন হাসপাতাল কালো তিমিরে ঢাকা। কেমন একটা গাঁ ছমছম পরিবেশ সারা হাসপাতাল জুড়ে। টর্চ জ্বালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হেনা ভাইয়ের টিম।মর্গের সামনে এসে আটকে গেলেন তিনি।মর্গের দরজা খোলা। ভিতর থেকে কেমন যেন ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হচ্ছে।হেনা ভাই থেমে গেলেন। হাত দিয়ে পিছনের সবাইকে থামতে বললেন। ধীরে ধীরে খুব সতর্কতার সাথে ভিতরে ঢুকতে লাগল ভিতরে ঢুকেই হেনা ভাইয়ের তদন্তের টিম। ভিতরে ঢুকেই হেন ভাই চিৎকার করে বললেন,
- ওহ মাই গড।
সম্পুর্ন মর্গে লাশের ছড়াছড়ি। লাশগুলো দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কোন লাশের'ই চোখ আর দাঁত নেই।হেনা ভাই আরও এগিয়ে গেলেন। ভাল করে চেক করতে লাগলেন।একটা বিচ্ছিরি গন্ধে ছেয়ে গেল তার নাঁক। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাঁকে দিলেন।
এই মহুর্তে প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে হেনা ভাইয়ের। হেনা ভাইয়ের হাসি দেখে এসিপি হারুন বললেন,
- স্যার,এই রকম মোমেন্টেও আপনি হাসছেন? দেখছেন লাশগুলোর অবস্থা?
হেনা ভাই আরও কিছুক্ষন হেসে বললেন - বুঝলেন এসিপি হারুন। আমার এতদিন থেকে যা দেখে এসেছি,সেটা আসলে একটা মরিচিকা।আসল জিনিস আমাদেন এখন চোখে পড়ল?
এসিপি হারুন অবাক হয়ে বলল - মানে?
- মানে হলো প্রতিটি মানুষেরই তিনটে চোখ আছে।আর সেই তিন নাম্বার চোখ দিয়ে সব কিছু দেখলেই সব কিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।
এসিপি হারুনের এবার খুব রাগ হলো। প্রচন্ড রাগ আর বিরক্তি নিয়ে বলল,
- স্যার,যা বলবেন সেটা পরিষ্কার করে বলেন না? এত প্যাচাচ্ছেন কেন?
- আসলে এসিপি লাশ চুরিতে কোন ভুতের কারবার নেই। এটা চক্র।
লাশ গুলোর দিকে ভাল করে দেখুন। প্রত্যেকটি লাশের চোখ,দাত আর কোমড়ের জায়গায় ফাকাঁ। মানে এখান থেকে এই সব অঙ্গ আগেই বের করা হয়েছে।
হেনা ভাইয়ের কথায় এসিপি হারুন প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল - স্যার,আপনি বলতে চাচ্ছেন এতে কোন ভুতের কারবার নেই? তাহলে এইসব করেছে কে? আর কি জন্যই বা করল?
- না,এসিপি সাহেব এটা কোন ভুতের কারবার না। আর এইসব করেছে কে? ওই যে বললাম না আমরা যা দেখেছি সেটা একটা মরিচিকা।
এই লাশগুলো চুরি নয় গুম করা হয়েছে। কারন লাশের এমন অবস্থা দেখলে সকলেই জেনে যাবে চিকিৎসার নামে এখানে দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গের বিক্রি চলে। আর সেই জন্যই লাশ চুরির এমন অভিনয় করা হয়েছে।
- কিন্তু হাসপাতালের মালিক এমনটা কেন করবে? উনি তো ইচ্ছা করলে এমনিতেই লাশগুলো থেকে শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ গুলো বিক্রি করতে পারতেন? সেটা না করে চুপিসারে করছেন এই সব কাজ। আর কেউ নিজের পাপ কর্ম নিজেই প্রকাশ করবে কেন?
- এসিপি হারুন,আসলে এই সব লাশ তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেওয়ার আগেই হাসপাতালের মালিক মানে ডা. দেওয়ান খান্না লাশগুলো চুরি করে দেন। আর পরে সবাইকে বলেন মর্গ থেকে লাশ চুরি হয়েছে। আর পুলিশ যেহেতু এত ইনভেস্টকেশন করে কিছু পাই নি।যার ফলে লাশ চুরির দোষ ডা. খান্নার উপর পরবে না। সাপও মরবে,লাঠিও ভাঙবে না।
হেনা ভাইয়ের কথা শেষ হতেই এসিপি হারুনের কিছু বলার আগেই পিছন থেকে কনস্টেবল নীল বলে উঠল,
- ওহ মাই গড। হেনা ভাই,আপনি আসলেই একটা জিনিয়াস।
নীলের কথায় হেনা ভাই আবারও মৃদু হেসে বললেন - না,আমি কোন জিনিয়াস নই।আসলে প্রত্যকটা মানুষই জিনিয়াস। কিন্তু তারা তাদের বুদ্ধির সঠিক ব্যবহার করে না।.."
- কিন্তু স্যার তাহলে মতিনের মৃর্ত্যু আর নীলান্তা ম্যাডাম গায়েব হলো কেন?
হেনা ভাইয়ের কথা শেষ হতেই এসিপি হারুন থুথুনিতে হাত দিয়ে প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে বলল কথাটা।
- আমার যতটা বিশ্বাস,নীলান্তা হয়তো লাশের এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। আর সেটা হয়তো মতিনকে বলেছিল। যেটা হয়তো এই চক্রের কেউ জেনে ফেলেছিল। আর সেজন্যই হয়তো মতিনকে মেরে নীলান্তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।
·
রহস্যর বেড়াজাল থেকে বের হয়ে হাসপাতাল থেকে বেড় হলো সবাই। সবার মুখে স্বস্তির ছাপ। ইতিমধ্যেই সমস্ত হাসপাতাল সিল করা হয়েছে। জিপে চরার আগে হেনা ভাইয়ের ফোনটা আবার কেপে উঠল। থানা থেকে ফোন দিয়েছে।ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল,
- স্যার,দারোয়ান সব স্বীকার করেছে। নীলান্তা ম্যাডামকে আমরা শহরের শেষ প্রান্তের ম্যান হোল থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেছি।
ওপাশ থেকে আর কিছু বলার আগেই হেনা ভাই কল কেটে দিল। কেউ হয়ত ভাবে নি এত্তোবড় হসপিটালে এমন জঘন্য কুকর্ম চোখের আড়ালে দিব্বি ঘটে যাচ্ছে।আসলে আমরা যা দেখি সেটা মসৃন দেয়ালের চকচকে পিঠ মাত্র। মসৃনতার আবরন সরালেই বেরিয়ে আসে খাঁজ কাটা বিভিৎষ্য এক বাস্তবতা।
·
হেনা ভাইয়ের সবকিছু গাড়িতে তোলা হয়েছে।শেষ বারের মতো পিছনে ঘুরে তাকালেন। এই ব্যাস্ত শহরের অতিথির জায়গাটা তিনি বেশ ভালই মিটিয়েছেন। এখন ফিরে যাবার পালা। বাড়িতে গিয়েই প্রথমে গিন্নির রাগ ভাঙানো হবে তার প্রথম কাজ। এরপর না হয় আবার কোন রহস্যের ফেরারি হয়ে ঘুরবেন দেশ-দেশান্তর।
.
.
.................সমাপ্ত....................
[কিছু কথা – হেনা ভাইয়ের পকেট থেকে রোলেক্সের গোল্ডেন ঘড়িটার কি হয়েছে? সেটা কি হারিয়েছে নাকি পকেট থেকে পড়ে গেছে এ বিষয়ে হেনা ভাই কোন কিছু খোলসা করেন নি।করলে জানাতাম।ধন্যবাদ।এখন শুধু অপেক্ষা 'ডিটেকটিভ হেনা ভাই'য়ের নতুন কোন সিরিজের।]
Written by- Sohanur Rahman Sohan