রাতে ঘুম না হওয়া খুব সাধারণ একটি সমস্যা।
সম্ভবত এমন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যার জীবনে দু’ একবার ঘুমের অসুবিধা হয়নি। তবে সমস্যা হলো এটা যখন প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ দীর্ঘদিন রাতে ঘুম না হলে তার কুপ্রভাব আমাদের শরীর ও মন দু’টোরই উপর পড়ে। বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষ যে শুধু প্রয়োজনে বা ইচ্ছাকৃতভাবে রাত জাগে তা নয় বরং এমন কিছু রোগও আছে যাতে মানুষ ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাত জাগতে বাধ্য হয়। এরকমই একটি মানসিক রোগের নাম ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা। শুনতে অবাক লাগলেও পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ বিভিন্ন মাত্রার নিদ্রাহীনতায় (INSOMNIA) ভুগছেন।আসুন এই রোগটি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চেষ্টা করি।
নিদ্রাহীনতা নির্ণয়ঃ ঘুমের সমস্যা খুব সাধারণ একটি ব্যাপার।কিন্তু ঘুমের সমস্যা কোন পর্যায়ে গেলে তাকে ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা বলা হবে তার একটি আর্ন্তজাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন।Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders (DSM-V) এর নিদ্রাহীনতা নির্ণয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো-
১)ঘুম নিয়ে অতৃপ্তি সেটা সময় বিচারে হোক (Quantity of sleep) বা মান বিচারে হোক (Quality of sleep)।*ঘুমাতে গেলে সহজে ঘুম না আসা কিংবা *বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া ও ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর ঘুম না আসা অথবা *খুব সকালেই ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এবং আর খুব না আসা।
২)ঘুমের অতৃপ্তি এতটাই অস্বস্তিকর যে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিক ক্ষেত্রে,পেশাগত ক্ষেত্রে,শিক্ষা ক্ষেত্রে,আচরণে ও জীবনের অন্যন্য ক্ষেত্রে সমস্যা বা ক্ষতির সম্মুখীন হন বা অদক্ষতার পরিচয় দেন।
৩)নিদ্রাহীন রাত পার করার ইতিহাস কমপক্ষে সপ্তাহে ৩দিন থাকতে হবে এবং অন্তত ৩মাস যাবৎ এ ধরণের অসুবিধা বোধ করার হিস্ট্রি থাকতে হবে।
তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে ঘুমের স্বাভাবিক পরিবেশ থাকার পরেও যদি কারো উপরোক্ত সমস্যাগুলো হয় তবেই তাকে ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতার রোগী হিসাবে বিবেচনা করতে হবে।
নিদ্রাহীনতার প্রকারভেদঃ
স্থায়ীত্বের উপর ভিত্তি করে নিদ্রাহীনতা ৩ ধরণের হতে পারে-
১)ক্ষণস্থায়ী নিদ্রাহীনতা(Transient insomnia)-নিদ্রাহীনতার সমস্যা যদি ৭দিন বা তারচেয়ে কম সময় স্থায়ী থাকে তাকে ক্ষণস্থায়ী নিদ্রাহীনতা বলে।যেমন নতুন কোথাও বেড়াতে গেলে প্রথম কয়েক রাত ঘুমের সমস্যা হতে পারে যা ক্ষণস্থায়ী।
২)স্বল্পমেয়াদী নিদ্রাহীনতা(Acute insomnia)-নিদ্রাহীনতার সমস্যা ৭দিনের বেশী কিন্তু ৩০দিনের কম স্থায়ী হলে তাকে স্বল্পমেয়াদী নিদ্রাহীনতা বলে।যেমন শেয়ার বাজারে বড় ধ্বসের পর অনেকেই আর্থিক ক্ষতির দুশ্চিন্তায় ১-২ সপ্তাহ ঠিকমত ঘুমাতে পারেন না।
৩)দীর্ঘমেয়াদী নিদ্রাহীনতা(Chronic insomnia)-নিদ্রাহীনতার সমস্যা ১মাসের বেশী হলেই তাকে দীর্ঘমেয়াদী নিদ্রাহীনতা বলে।এ ধরণের নিদ্রাহীনতায় স্ট্রেস হরমোনের (কর্টিসোল) অনাবশ্যক আধিক্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে।এ ধরণের নিদ্রাহীনতাতেই নানা অস্বস্তিকর উপসর্গ বা জটিলতা বেশী দেখা যায়।
কারণের উপর ভিত্তি করে নিদ্রাহীনতা ২ রকমের-
১)প্রাইমারি নিদ্রাহীনতা (Primary insomnia)-এক্ষেত্রে নিদ্রাহীনতার জন্য দায়ী কোন আনুষঙ্গিক রোগ বা অন্য কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।এ ধরণের ইনসোমনিয়া তুলনামূলক কম দেখা যায়।
২)সেকেন্ডারি নিদ্রাহীনতা (Secondary insomnia)-এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন কারণ বা অসুখের একটি উপসর্গ হিসাবে নিদ্রাহীনতা দেখা দেয়।যেমন সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের নিদ্রাহীনতা।এসব ক্ষেত্রে মূল অসুখ বা কারণের চিকিৎসা করলে আপনা-আপনি নিদ্রাহীনতার সমস্যা দূর হয়ে যায়।সকল ধরণের ইনসোমনিয়ার মধ্যে প্রায় তিন চতুর্থাংশই সেকেন্ডারি ইনসোমনিয়া।
সম্ভাব্য কারণসমূহঃ
১)বিভিন্ন মানসিক রোগ যেমন বিষণ্নতা,ম্যানিয়া বা বাতিকগ্রস্থতা, সিজোফ্রেনিয়া, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি), বীভৎস দৃশ্য দেখা বা অভিজ্ঞতা পরবর্তী মানসিক চাপজনিত রোগ (post-traumatic stress disorder), সর্বব্যাপী অস্থিরতার রোগ (generalized anxiety disorder), ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখা রোগ (Night terror), ভয়রোগ(Phobia), আতঙ্ক রোগ (Panic disorder) ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিদ্রাহীনতা দেখা দিতে পারে।
২)ব্যক্তি জীবনে নানা রকম ভয়-ভীতি, মানসিক চাপ, অস্থিরতা, টেনশন, অতি আবেগ, মাত্রাতিরিক্ত কাজ করা, আন্তঃব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন, অস্বস্তিকর বা ভীতিকর কর্মস্থল, ব্যর্থতা, আর্থিক অনটন, সন্তান প্রসব পরবর্তী সময়ের মানসিক পরিবর্তন, নিকটজনের জটিল অসুখ বা মৃত্যু ইত্যাদি কারণেও নিদ্রাহীনতা দেখা দিতে পারে।
৩)দীর্ঘমেয়াদী ব্যথাযুক্ত অসুখ যেমন পেপটিক আলসার,এসিড রিফ্লাক্স,বুক জ্বালাপোড়া করা,দূর্ঘটনাজনিত শরীর ব্যথা,হাঁড় ভাঙ্গা,রক্তনালী সংকোচনজনিত অসুখ যেমন বার্জারস ডিজিজ,বাত বা আথ্রাইটিস ইত্যাদিতেও নিদ্রাহীনতা দেখা দিতে পারে।
৪)স্নায়ু উত্তেজক দ্রব্য সেবন করা যেমন ক্যাফেইন (চা, কফি, চকোলেট, কোলা ও এনার্জি ড্রিংকসে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়), নিকোটিন (যেমন সিগারেট সেবনে), কিছু চাইনিজ হার্বস ইত্যাদি।
৫)ঘুমের ঔষধ,নেশার ঔষধ,ওপিয়াম তথা মরফিন জাতীয় ব্যথানাশক ঔষধ সেবন হঠাৎ বন্ধ করে দিলে (Withdrawal Phenomemena)।
৬)ঘুমের মধ্যে পায়ের অতিরিক্ত নড়চড়াজনিত রোগ যেমন Restless Leg Syndrome (RLS) ও Periodic Limb Movement Disorder(PLMD)।
৭)ঘুমের পরিচ্ছনতার অভাবে (Poor sleep hygiene)
৮)রাত জেগে কাজ করলে(night shift) ও দীর্ঘক্ষণ বিমান ভ্রমণে (jet lag)।
৯)মেয়েদের সেক্স হরমোনের বড় ধরণের পরিবর্তনকালে যেমন মাসিকের পূর্বের কয়েকদিন, মাসিক বন্ধ হওয়ার পর (মেনুপজ), বাচ্চা প্রসবের অব্যবহিত পরে।
১০)হৃদরোগের কারণে যেমন PND (Paroxysmal Nocturnal Dydpnoea)। এ রোগে ঘুমাতে গেলেই হার্টের দূর্বলতা হেতু ধীরে ধীরে ফুসফুসে পানি জমতে শুরু করে।এক পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং রোগী ঘুম ভেঙ্গে অনবরত কাশতে থাকে।PND হার্টফেইলের সাথে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ।
১১)শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেমন নাকের পর্দা বাঁকা (Deviated Nasal Septum), ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া (Sleep apnoea), হাঁপানীর সমস্যায়, ক্রনিক ব্রংকাইটিসে নিদ্রাহীনতা দেখা দিতে পারে।
১২)থায়রয়েড হরমোনের আধিক্যে (Hyperthyroidism)।
১৩)রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার কারণে।এ সমস্যা যাদের প্রস্টেট বৃদ্ধিজনিত সমস্যা (BPH) আছে তাদের এবং যারা রাতে ঘুমের আগে প্রচুর পানি পান করেন তাদের কিংবা যারা প্রস্রাব ধরে রাখতে পারেন না (Urinary Incontinence) তাদের হতে পারে।
১৪)অতিরিক্ত ব্যায়াম করেন যারা বিশেষতঃ ক্রীড়াবিদরা। অতিরিক্ত ব্যায়াম করার কারণে বিছানায় যাওয়ার পরেও দীর্ঘসময় ঘুম নাও আসতে পারে।
১৫)মারাত্মক ধরণের নিদ্রাহীনতা (Fatal Familial Insomnia)–যদিও এ অবস্থা খুব বেশী দেখা যায় না তথাপিও এ অবস্থাটি রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের জন্যই বেশ জটিল।এ রোগে রোগী বছরের পর বছর এক মিনিটের জন্যও না ঘুমিয়ে জীবন কাটান।
১৬)ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়-আমরা সচরাচর গ্রহণ করে থাকি এরকম বেশকিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও নিদ্রাহীনতা হতে পারে।যেমন বিষন্নতাবিরোধী ঔষধ, মৃগীরোগের ঔষধ, ব্লাড প্রেসারের ঔষধ (বিটাব্লকার-টেনোরেন, এটিনোলল), ব্যথানাশক ঔষধ, উচ্চমাত্রায় জন্ম নিয়ন্ত্রণের হরমোন, হাঁপানীর ঔষধ (সালবিউটামল, থিওফাইলিন), মিথাইলফেনিডেট, মোডাফিনিল,অ্যারিপাইপ্রাজল ইত্যাদি।
১৭)বিভিন্ন স্নায়ু রোগে-যেমন অ্যালজেইমার্স রোগ,পার্কিনসন্স রোগ,ব্রেনে আঘাতজনিত সমস্যায়,বয়সজনিত ব্রেনের কার্যকারিতা পরিবর্তনের ফলে ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
১৮)অতিরিক্ত মদ্যপান।
যারা বেশী ঝুঁকিতে আছেনঃ
যে কোন বয়সে যে কোন লিঙ্গের মানুষ যে কোন সময় নিদ্রাহীনতায় আক্রান্ত হতে পারেন।তবে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে নিদ্রাহীনতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়-
১)যাদের বয়স ৬০ বছরের উপরে।
২)যারা বিভিন্ন ধরণের মানসিক রোগে ভূগছেন।
৩)যারা অধিক আবেগপ্রবণ।
৪)যারা নিজের কষ্ট ও দুশ্চিন্তা ম্যানেজ করতে বা শেয়ার করতে পারেন না।
৫)জীবনের কোন অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক ঘটনা পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট সেই ব্যক্তি।
৬)মানসিক চাপ প্রবল পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা।
৭)যারা রাত জেগে কাজ করেন।
৮)যারা বিভিন্ন টাইম জোনের মধ্য দিয়ে প্রায়ই দীর্ঘসময় বিমান ভ্রমণ করেন।
৯)ঘুম হওয়া না হওয়া নিয়ে যারা মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভোগেন।
১০)যারা ঘুমের পরিচ্ছন্নতা (sleep hygiene) এর ব্যাপারে উদাসীন।
নিদ্রাহীনতার ক্ষতিকর প্রভাবসমূহঃ
সাধরণত ক্ষণস্থায়ী ও স্বল্প মেয়াদী নিদ্রাহীনতায় শরীরের তেমন বড় ধরণের ক্ষতি না হলেও দীর্ঘমেয়াদী নিদ্রাহীনতায় নানা রকম সমস্যা তৈরী হয়।আপনাদের অবগতির জন্য নিদ্রাহীনতার ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে কিছুটা আলাপ করা হলো-
মানসিক রোগঃ
যারা রাতে ঠিকমত ঘুমায় না বা রাত জেগে থাকে তাদের মধ্যে বিষণ্নতা (Depression), অস্থিরতা (Anxiety),বিরক্তি (Irritability),
হ্যালুসিনেশন (Hallucination),মানসিক অবসন্নতা সহ নানাবিধ মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব বেশী দেখা যায়।আর যারা ইতোমধ্যে এসব রোগে ভূগছেন তাদের রোগ বেড়ে যায়।তাছাড়া আত্মহত্যা করার চিন্তা বা চেষ্টার প্রবণতা বেড়ে যায়।
স্মৃতি বা মেমরি কমে যায়ঃ
আমরা সারাদিন যা শিখি বা জানি তা ব্রেনে স্থায়ীভাবে ধরে রাখতে ঘুম অপরিহার্য্য। ঘুমের মধ্যে স্মৃতির Consolidation প্রক্রিয়ায় স্থায়ীরূপ লাভ করা সহজ হয়।রাতে ঠিকমত না ঘুমালে বা অপর্যাপ্ত ঘুমালে অর্জিত তথ্য স্মৃতিতে স্থায়ীরূপ লাভ নাও করতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে রাত জাগা ও অপর্যাপ্ত ঘুমানো ছাত্রদের একাডেমিক পারফর্মেন্স যারা স্বাভাবিক ঘুমায় তাদের তুলনায় কম।
সতর্ক থাকার সক্ষমতা হ্রাস পায়ঃযারা নিদ্রাহীনতায় ভোগেন তাদের Alertness বা সতর্ক থাকার সক্ষমতা হ্রাস পায় ফলে তারা নানা ধরণের দূর্ঘটনার সম্মুখীন হন।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসঃ
দীর্ঘদিন ধরে নিদ্রাহীনতার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়।বিশেষতঃ ভাইরাসজনিত রোগবালাই এ ভোগার সম্ভাবনা বেশ বেড়ে যায়।
মেজাজজনিত সম্পর্কের অবনতিঃ
রাত জাগা মানুষদের দিনের বেলায় অস্থিরতা,বিরক্তি,অস্বস্তি বিরাজ করায় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিষণ্নতা কাজ করায় কিংবা কথা ভুলে যাওয়ার প্রবণতার কারণে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক সুস্থভাবে বজায় রাখা কঠিন হতে পারে;সেক্ষেত্রে মনোমালিন্য,কথা কাটাকাটি ও সহজেই উত্তেজিত হওয়ার কারণে নিকটজনদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।আরও একটি অদ্ভূত সমস্যা হতে পারে যাকে ভুল স্মৃতি বা False memory বলে।যেমন এক ব্যক্তি রাতে তার স্ত্রীকে হয়ত কিছুই বলেনি অথচ তিনি সকালে হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিতে পারেন এই বলে “তোমাকে কাল রাতে বললাম না খুব সকালেই আমাকে বেরুতে হবে,কাজেই নাস্তা রেডি রাখিও।”
ওজন বৃদ্ধিঃইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায় যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।আর এই গ্লুকোজের রেসপন্সে বেশী করে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়।কিন্তু রাতের বেলা মাংসপেশীর নড়াচড়া কম থাকায় বা খাদ্যের চাহিদা কম থাকায় ইনসুলিন এই গ্লুকোজকে ফ্যাট সেলে চর্বি হিসাবে জমা হতে সাহায্য করে।তাছাড়া রাত জাগার কারণে ক্ষুধা নিবারণকারী লেপটিনের(Leptin) মাত্রা কমে যায় এবং ক্ষুধা উদ্রেককারী গ্রেলিনের(Ghrel
in)মাত্রা বেড়ে যায়।ফলে সামগ্রিক ক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদে শরীরের ওজন বাড়ে।
ডায়াবেটিসঃ
ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।অর্থাৎ নিঃসুত ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়ায় তা ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।গবেষণায় দেখা গেছে পরপর ৪ রাত ঠিকমত না ঘুমালে ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা ১৬% কমে যায় যা ওজন বৃদ্ধি,প্রি-ডায়াবেটিক ও ডায়াবেটিক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় এবং নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসকে অনিয়ন্ত্রিত করতে পারে।
হার্টের সমস্যাঃ
যারা ইনসোমনিয়ায় ভোগেন তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগার বা নিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা বেশী।তাছাড়া রাতজাগা রোগীদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাবও বেশী দেখা যায়।
পেটের সমস্যাঃ
যারা নিদ্রাহীনতায় ভোগেন তাদের মধ্যে বুক জ্বালাপোড়া করা,পেপটিক আলসার,বমি বমি ভাব,বমি হওয়া,নাস্তা গ্রহণে অনীহা, ইরিটেবল বাউয়েল সিনড্রোম(IBS),ডায়রিয়া,কোষ্ঠকাঠিন্য সহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রিপ্রডাকশন ও সেক্সঃ
ইনসোমনিয়াক মহিলাদের অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা,অকালে সন্তান প্রসব,কম ওজনের সন্তান হওয়া,ব্যাথাযুক্ত মাসিক,মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সন্তান না হওয়ার মত সমস্যা হতে পারে।বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত ঘুমকে বন্ধ্যাত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে বিবেচনা করছেন। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে যেসব নারী-পুরুষ রাতে ঠিকমত ঘুমায় না তাদের যৌনাকাঙ্খাও (Libido) কমে যেতে পারে।
মাথাব্যাথা,শরীর ব্যাথা ও ম্যাজম্যাজ করাঃ
যাদের রাতে ঠিকমত ঘুম হয় না তাদের মাথাব্যাথা, শরীরে ব্যাথা বা ম্যাজম্যাজভাব লেগেই থাকে।চিকিৎসা শাস্ত্রে শরীর ব্যাথার Fibromyalgia নামক রোগটি বা রোগটির উপসর্গের তীব্রতা রাত জাগা মানুষদের মধ্যে তুলনামূলক বেশী দেখা যায়।কোন কোন গবেষক রাতজাগাকে low-grade chronic inflammation বা স্বল্প মাত্রার দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহের সাথে তুলনা করেছেন।
হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়া ও জীবন্ত স্বপ্ন দেখাঃ
নিদ্রাহীনতায় ভোগা রোগীদের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়।যারা ড্রাইভিং করেন বা মেশিন চালান তাদের জন্য এ অবস্থা মারাত্মক দূর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণ হতে পারে।তাছাড়া এ ধরণের ঘুম মূলতঃ রেম টাইপের (Rapid Eye Movement sleep) হওয়ায় এসময় অনেকে এমন স্বপ্ন দেখেন যে মনে হয় তা তিনি জেগে থেকে অবলোকন করছেন (vivid dream)।
ডার্ক সার্কেল ও ব্যাগী আইঃ
যারা ক্রমাগত রাত জাগেন তাদের চোখের চারপাশে কালো দাগ বা ডার্ক সার্কেল তৈরী হতে পারে।কারো কারো চোখের নীচ ফুলে উঠতে পারে(Baggy eye)।
এ ছাড়াও রয়েছে আরও নানাবিধ সমস্যা।
নিদ্রাহীনতার চিকিৎসাঃ
নিদ্রাহীনতা তথা ইনসোমনিয়ার চিকিৎসার প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো এর কারণ চিহ্নিত করা।কেননা কারণ চিহ্নিত করা গেলে এবং তার চিকিৎসা হলে নিদ্রাহীনতা এমনিতেই দূর হয়ে যায়।যেহেতু ইনসোমনিয়ার কারণ বিবিধ এবং অনেক সময় কোন কারণও খুঁজে পাওয়া যায় না;তাছাড়া এখন পর্যন্ত এ রোগ নিরাময়ের জন্য কোন কার্যকরী ঔষধও বের হয়নি তাই অনেক মানসিক রোগের মত ইনসোমনিয়াতেও সাইকোথেরাপি মুখ্য ভূমিকা পালন করে।এছাড়াও আরও কিছু চিকিৎসা সহায়ক পদ্ধতি রয়েছে।সুতরাং ইনসোমনিয়া চিকিৎসায় তিনটি বিষয় বিবেচনা করতে হবেঃ
১)নিদ্রাহীনতার কারণ নির্ণয় ও তার চিকিৎসা করতে হবে।কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে।
২)সাইকোথেরাপি তথা Cognitive Behavioral Therapy for Insomnia (CBT-I) প্রয়োগ করতে হবে।
৩)ঘুমের ঔষধের ব্যবহার সীমিত রাখতে হবে।কারণ ঔষধ নিদ্রাহীনতা নিরাময় করতে পারে না।এটা সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
কোথায় চিকিৎসা পাবেনঃ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শ্যামলী, ঢাকা;বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউ. হাসপাতাল(পিজি হাসপাতাল)-এর মানসিক রোগ বিভাগে।এছাড়াও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আপনি এ চিকিৎসা পাবেন।
নিদ্রহীনতায় সাইকোথেরাপির ভূমিকাঃ
এক বিশেষ ধরণের সাইকোথেরাপি হলো Cognitive Behavioral Therapy for Insomnia (CBT-I)। নিদ্রাহীনতায় CBT-Iএটি এখন পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে বেশী কার্যকরী নিদ্রাহীনতার চিকিৎসা পদ্ধতি।এটার কার্যকারিতা ও অন্যন্য সুবিধা Benzodiazipines (diazepam, midazolam, bromazepam etc) এর চেয়েও বেশী।তাছাড়া এ থেরাপি বন্ধ করার পরও প্রায় ১বছর পর্যন্ত এর কার্যকারিতা দেখা গেছে।এটি প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি উভয় প্রকার ইসোমনিয়ায় কার্যকরী হতে দেখা গেছে।এ ধরণের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন মূলত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা।Cognitive Behavioral Therapy for Insomnia (CBT-I) এর ৫টি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ রয়েছে-
১)উত্তেজক নিয়ন্ত্রণ (Stimulus control)-যেসব বিষয় ব্রেনকে উত্তেজিত করে ও ঘুম আসতে বাঁধা দেয় সে সব বিষয়ে রোগীকে শিক্ষা দেওয়া।
২)ঘুম সীমিতকরণ(Sleep restriction therapy)-নিদ্রাহীনতার রোগীদের হঠাৎ এক রাতের মধ্যেই পরিপূর্ণ ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা মোটেও উপকারি ও কার্যকরী নয়।বরং রোগী ঘুম আসলেই কেবল ঘুমাতে যাবেন এবং থেরাপিস্ট বিবেচিত নির্দিষ্ট সময় পর ঘুম থেকে উঠবেন।এভাবে নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রতি রাতে ১৫-৩০মি করে ঘুমের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হয়।
৩)শিথিলায়ন(Relaxation techniques)-অস্
থিরতা ও দুচিন্তাজনিত মাংসপেশীর সংকোচন শিথিল করা গেলে অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা দূর হওয়ার পাশাপাশি তা ঘুম আনতেও বেশ সাহায্য করে।মেডিটেশন, হিপনোসিস, আলফা ওয়েভ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নানা নামে বিভিন্ন শিথিলায়ন কৌশল আছে।এগুলো নিয়মিত করলে ইনসোমনিয়ার বেশ উন্নতি হয়।
৪)উপলব্ধিকরণ(Cognitive therapy)-এ ধাপে মূলতঃ ঘুম নিয়ে রোগীর নানা বিশ্বাস ও অবিশ্বাস যা তার নিদ্রাহীনতাকে প্রভাবিত করছে সে বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা প্রদানপূর্বক রোগীকে এ বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলা হয়।
৫)ঘুমের পরিচ্ছন্নতা(Sleep hygiene education)-“ভাল ঘুমের জন্য ভাল পরিবেশ দরকার” এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে কী কী করলে এবং কী কী না করলে ঘুমের ভাল পরিবেশ তৈরী করা সম্ভব সে বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়।
এ স্বল্প পরিসরে Cognitive Behavioral Therapy for Insomnia (CBT-I) পুরোটা বর্ণনা করা সম্ভব নয় তবুও এর কিছু উপাদান আলাদা শিরোনামে নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
ব্রেন ওয়েভ নিয়ন্ত্রণঃ
এ অংশটি বোঝার জন্য আমার “অশান্তি,অস্থিরতা ও উত্তেজনা কমাতে ব্রেন ওয়েভ টিউন করুন” পোস্টটি পড়ার অনুরোধ করছি।আমরা যখন জেগে থাকি ও কাজে সক্রিয় থাকি তখন ব্রেন বিটা বা তারচেয়ে বেশী ওয়েভে সক্রিয় থাকে।বিটা থেকে ব্রেন ওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি যত কমতে থাকে (বিটা- আলফা- থিটা- ডেল্টা) ততই আমরা আরাম পেতে থাকি এবং খুব কমে গেলে ঘুমিয়ে পড়ি।আমরা ব্রেন ওয়েভ নিম্নগামী করার জন্য কিছু কাজ করতে পারি যা ঘুম আনয়নে দারুণ সাহায্য করতে পারে।পদ্ধতিটি নিম্নরূপ-
১)ঢিলা জামাকাপড় পরে ঠিক মরা মানুষের মত পুরো শরীরটাকে শিথিল করে শুয়ে পড়ুন।
২)ঘর অন্ধকার রাখুন এবং চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।সম্ভব হলে ঘরে ল্যাভেন্ডার ফুল রাখুন বা ল্যাভেন্ডার এসেনশিয়াল ওয়েল স্প্রে করে দিন।ল্যাভেন্ডার মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে।
৩)মনের বিক্ষিপ্ততা কমাতে কোন একটি বিষয় নিয়ে ভাবুন বা উল্টো দিক থেকে সংখ্যা গুণতে থাকুন মনে মনে।
৪)কানে হেডফোন লাগিয়ে শিথিলায়ন সুর শনতে থাকুন।এরকম কয়েকটা মিউজিক উদাহরণ হিসাবে নীচে যুক্ত করলাম-
৫)এবার Slow Breathing Exercise শুরু করুন।মুখ দিয়ে শ্বাস ছেড়ে কেবলমাত্র নাক দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিন পেট ফুলিয়ে ধীরে ধীরে।দমটা অল্পক্ষণ আটকে রাখুন।তারপর শিস বাজানোর মত মুখের ছিদ্র সংকুচিত করে সে পথে ধীরে ধীরে (শ্বাস গ্রহণের চেয়েও অর্ধেক ধীরগতিতে) শ্বাস ত্যাগ করুন।এভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকুন। প্রথম প্রথম প্রতি রাতে ৫-১০মিনিটের জন্য এভাবে শ্বাসের ব্যায়াম করবেন এবং আস্তে আস্তে তা বাড়িয়ে ৩০-৪৫মিনিট পর্যন্ত করতে পারেন।সময়ের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কতটুকু সময়ব্যাপী এই প্র্যাকটিসটা করলে আপনি শান্ত ও স্থির হতে পারছেন সেটা বিবেচনা করা।তবে অপ্রয়োজনীয় বা অতি উৎসাহে একটানা বেশীক্ষণ ধরে এরূপ প্র্যাকটিস করলে আপনি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। Slow Breathing Exercise ব্রেন ওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সিকে নিম্নগামী হতে সাহায্য করে।
ঘুমের পরিচ্ছন্ন অবস্থা (SLEEP HYGIENE) কী?আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় ইচ্ছা করলেই ঘুমাতে পারি না।ঘুমের বিষয়টা পুরোপুরি ব্রেন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।কিন্তু আমরা আদর্শ অবস্থা তৈরীর মাধ্যমে ঘুমকে কার্যকর হওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে ব্রেন এ কাজটি খুব সহজেই করতে পারে।যে সব নিয়ম-কানুন মেনে ঘুমের আদর্শ অবস্থা তৈরী করা সম্ভব তাদেরকেই সামষ্টিকভাবে SLEEP HYGIENE বলে।এগুলো হলো-
১)ঘুম না আসা পর্যন্ত বিছানায় না যাওয়া।
২)বেডরুমকে কেবলমাত্র ঘুম ও সঙ্গমের জন্যই ব্যবহার করা।কোন অবস্থাতেই বেড রুমকে আড্ডা দেওয়া,অবসর সময় কাটানো,পড়াশোনাসহ অন্যন্য কাজে ব্যবহার না করা।বেডরুম ও বেডকে কেবলমাত্র ঘুমের সাথে সম্পর্কিত করতে পারলে বেডে যাওয়ার সাথে সাথে ব্রেনে ঘুম কার্যকর হওয়ার প্রক্রিয়া (sleep induction) সহজতর হয়।এটাকে ব্রেনের কন্ডিশনিং বলে।এ ব্যাপারটা আরও ভাল বোঝা যায় অন্যের বাসায় বেড়াতে গিয়ে রাত্রি যাপনের সময়।যেহেতু ঘুম নিজ বেডরুমের বিছানার সাথে কন্ডিশনড ছিল তাই নতুন পরিবেশে গিয়ে ব্রেন সেটার সাথে তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোজন করতে না পারায় অনেকেরই ভাল ঘুম হয় না;এমনকি কেউ কেউ ঘুমাতেই পারেন না।গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যারা যত কম সময় বেড ব্যবহার করেন (ঘুমানোর সময় ছাড়া অন্য সময়) তাদের ঘুমের গভীরতা ও নিরবচ্ছিন্নতা তত বেশী হয়।
৩)রাতের বেলা ঘুমানোর সময় ছাড়া যখন তখন যেখানে সেখানে শুয়ে বিশ্রাম নেওয়ার অভ্যাস যথাসম্ভব ত্যাগ করা।
৪)বিছানায় যাওয়ার পর ২০ মিনিটের মধ্যে ঘুম না আসলে জোর করে শুয়ে না থেকে বরং বিছানা ও বেডরুম ত্যাগ করে পুনরায় ঘুম না আসা পর্যন্ত বেডরুমে না ঢোকা।যারা জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করেন তাদের পরবর্তীতে ঘুমানোর সময় সমস্যা আরও তীব্রতা লাভ করে।
৫)প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে উঠা তাতে রাতে যে পরিমাণই ঘুম হয়ে থাকুক না কেন।
৬)সন্ধ্যার পর স্নায়ু উত্তেজক খাবার বা পানীয় যেমন চা.কফি,কোলা,চকো
লেট,এনার্জি ড্রিংকস,ধূমপান সেবন না করা এবং মদ্যপান (এলকোহল একটানা ঘুমকে বাঁধাগ্রস্থ করে) পরিহার করা।
৭)সকালে বা দিনের অন্য সময় নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা।দিনের বেলার হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম রাতে ঘুম আনতে সহায়তা করে।তবে সন্ধ্যার পর ব্যায়াম করা যাবে না কারণ তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
৮)টিভি দেখার সময় সোফায় গা না এলিয়ে বরং চেয়ার বা মেঝেতে পিঠ সোজা করে বসে দেখা।
৯)ঘুমানোর সময় ঘরের সকল লাইট বন্ধ রাখা।আলো ব্রেনে ঘুম উদ্দীপক মেলাটোনিনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়।এমনকি ডিম লাইটও স্বাস্থ্যকর নয়।এ বিষয়ে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ঘুম গবেষক Stephen Lockley বলেন “Even dim light can interfere with a person’s circadian rhythm & melatonin secretion…..Light at night is part of the reason so many people don’t get enough sleep.” । আরেকটি বিষয় অনেকেই বেডরুমে রোমান্টিক আবহ তৈরী করতে নীল আলো ব্যবহার করেন।গবেষণায় দেখা গেছে অন্য যে কোন রঙের তুলনায় নীল আলো ব্রেনে ঘুম উদ্দীপক মেলটোনিনের নিঃসরণ প্রায় ২গুণ কমিয়ে দেয়।
১০)ঘুমানোর আগে অতিরিক্ত পানি পান না করা।এক্ষেত্রে বার বার মুত্র ত্যাগের কারণে ঘুমের নিরবচ্ছিন্নতা বিঘ্নিত হয়।
১১)বেডরুমের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যথাসম্ভব স্বস্থিকর অবস্থায় রাখা।
১২)সন্ধ্যার পর থেকে বিশেষতঃ ঘুমানোর পূর্বে কোর কারণে উত্তেজিত না হওয়া বা জটিল কোন কিছু চিন্তা না করা।বিছানায় শুয়ে টিভি দেখা,ফেসবুক চালানো বা চ্যাট করা,মোবাইলে কথা বলা,জীবনের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা,ভবিষ্যত পরিকল্পনা করা ইত্যাদি বিষয় ত্যাগ করা।
ঔষধের ভূমিকাঃবিশ্বে এখন পর্যন্ত ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতা নিরাময়ে কোন ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি।দেশে দেশে নিদ্রাহীনতায় যে Benzodiazipines (diazepam, midazolam, clonazepam, bromazepam etc), বিষন্নতাবিরোধী ঔষধ (amitriptyline,
mirtazapine etc), এন্টি-সাইকোটিক ঔষধ (যেমন Quetiapine) এবং এন্টি-হিসটামিনিক (যেমন Diphenhydramine) জাতীয় ঔষধ ব্যবহৃত হয় তা কেবল স্বল্প সময়ের জন্য দেওয়া হয় মূলত অস্থিরতা কমাতে।ইনসোমনিয়া বা নিদ্রাহীনতার নানাবিধ কারণ রয়েছে।অস্থিরতা,অন্যন্য মানসিক রোগ,হরমোনের তারতম্য,জীবনের নানা প্রভাবক ঘটনা ইত্যাদি।তবে ইনসোমনিয়ার প্রায় সব রোগীর ক্ষেত্রেই সন্ধ্যা পরবর্তী সময়ে রক্তে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসোলের আধিক্য লক্ষ্য করা গেছে।ঘুমের ঔষধ কেবলমাত্র কিছুটা অস্থিরতা কমাতে পারলেও অন্যন্য কারণগুলো দূর করতে সমর্থ নয়।তাই নিদ্রাহীনতা নিরাময়ে এসব ঔষধের কোন ভূমিকা না থাকায় এগুলো দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করা হয় না।এ বিষয়ে মেডিসিনের টেক্সট বুক Davidson’s Principles and Practice of Medicine [18th ed, page-1093] খানিকটা অংশ তুলে ধরছি “Hypnotic drugs (ঘুমের ঔষধ) are useful for short-term treatment of insomnia due to acute stress;for example,bereavement or separation.They should not be taken for longer than 3 weeks.” আর দীর্ঘমেয়াদী নিদ্রাহীনতার ক্ষেত্রে যে কোন ধরণের ঔষধ ব্যবহারের ব্যাপারে বলা হয়েছে “Drugs are not appropriate when insomnia is a chronic condition.” আবার একই কথা বলা হয়েছে The Medical Journal of Australia (2013,199-8;36-40) তে “Chronic insomnia is best managed using non-drug strategies such as Cognitive Behavioral Therapy”। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদী নিদ্রাহীনতায় ঔষধের ব্যবহার উপযুক্ত নয়। এ কারণেই ঘুমের ঔষধের উপর নির্ভরশীল ইনসোমনিয়ার রোগীদের প্রায়ই বলতে শোনা যায় “ঘুমের ঔষধ খাওয়ার পরও ঘুম হয় না”,“অনেক ডাক্তার দেখালাম,অনেক ধরণের ঔষধ দিল,কিন্তু কোনটাতেই কাজ হয় না”।
ইনসোমনিয়া চিকিৎসায় ঘুমের ঔষধ ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকঃ
আশা করি উপরের আলোচনা থেকে ধারণা পেয়েছেন নিদ্রাহীনতা নিরাময়ে ঘুমের ঔষধের কোন নিরাময়ী ভূমিকা (curative) নেই;বরং তা দীর্ঘমেয়াদে সেবন করলে নানাবিধ ক্ষতিকর পরিণতি ভোগ করতে হয়।যেহেতু আমাদের দেশে নিদ্রাহীনতায় ব্যাপকভাবে ঘুমের ঔষধের ব্যবহার হয় তাই আপনাদের জ্ঞাতার্থে সেসব ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরলাম-
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ
ঢুলুনি বা ঝিমুনি লাগা, মাথা ঘোরা, দূর্বলতা, মাথার ভিতর শূন্য লাগা, ঘোর লাগা, মুখ শুকিয়ে আসা, বমি বমি ভাব লাগা বা বমি করা, অ্যালার্জি, চোখ ঝাপসা লাগা ইত্যাদি।এসবের কারণে রোগী নিদ্রাহীনতার জন্য যতটা না দেখতে অসুস্থ দেখায় তারচেয়েও বেশী অসুস্থ লাগে ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায়।
টলারেন্সঃ
সময়ের সাথে সাথে এসব ঔষধের কার্যকারিতা হ্রাস পেতে থাকে।তখন ডোজ না বাড়ালে ভাল ফল পাওয়া যায় না।একই মাত্রার সুফল পেতে ক্রমাগত ঔষধের ডোজ বাড়ানোর বিষয়টিকেই টলারেন্স বলে।এত ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াজনিত ক্ষতির প্রভাব আরও বাড়তে থাকে।
ঔষধ বন্ধে নিদ্রাহীনতার পুনরাবৃত্তিঃ
ঘুমের ঔষধ সেবন হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে নিদ্রাহীনতা তীব্রভাবে ফিরে আসার পাশাপাশি অস্থিরতা,বিরক্তি,বিষন্নতা বা মন খারাপ করে থাকা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে যা রোগীকে পুনরায় এসব ঔষধ সেবনে বাধ্য করে।
নেশা বা আসক্তিঃ
ঘুমের ঔষধ একটানা ৩ সপ্তাহের বেশী ব্যবহার করা উচিৎ নয়।দীর্ঘদিন সেবনে এসব ঔষধের প্রতি আসক্তি তৈরী হয় যা অন্যন্য নেশাদ্রব্যের মতই ভয়ংকর।
ইনসোমনিয়া চিকিৎসায় ইন্টারনেটের ভূমিকাঃপূর্বেই উল্লেখ করেছি নিদ্রাহীনতা চিকিৎসায় সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো Cognitive Behavioral Therapy for Insomnia (CBT-I)।কিন্তু এ ধরণের সাইকোথেরাপি নিতে উপযুক্ত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের শরনাপন্ন হতে হয় যা অনেক সময় সহজলভ্য নয় অথবা ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে আপনি বিনামূল্য বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে এ ধরণের সাইকোথেরাপী পেতে পারেন। তাছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ইনসোমনিয়া গ্রুপ যাদের সাথে আপনি তথ্য বিনিময় করে উপকৃত হতে পারেন।‘ONLINE CBT-I’ লিখে গুগলে সার্চ দিলেই এরকম বেশকিছু সেবা প্রদানকারীর সাইট পেয়ে যাবেন।
সঠিক চিকিৎসায় সকল নিদ্রাহীনতায় ভোগা রোগী সুস্থতা লাভ করুক।
অসংখ্য ধন্যবাদ যারা কষ্ট করে এ আর্টিকেলটি পড়লেন।