"Illusion"
"Hallucination"
"Delusion"
"Paranoia"
এই শব্দগুলোর সাথে মোটামুটি আমরা সবাই পরিচিত । বিভিন্ন উপন্যাস, গল্পে আমরা প্রায় পেয়েছি এই ধরনের শব্দ।চলুন এই শব্দগুলোর সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
Illusion (ভ্রান্ত অনুভূতি):
অভিধানে Illusion ও Delusion শব্দের অর্থ দেয়া আছে "মোহ" , "ভ্রান্তি" । কিন্তু মনোবিজ্ঞানের ভাষায় প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে । মনোবিজ্ঞানে Illusion হচ্ছে কোনও বস্তু প্রকৃতপক্ষে যা , তাকে সেইভাবে উপলব্ধি না করা।
যেমন : একটা সোজা হাতলের চামচের কিছু অংশ পানিতে ডুবিয়ে রাখলে সোজা চামচটা আর সোজা দেখায় না । দেখলে মনে হয় চামচটা বেঁকে আছে । কিন্তু আসলেই কি পানিতে ডুবালে সোজা চামচ বাকা হয়ে যায় ? না তা কখনই হয় না । এখানে আমাদের দর্শনানুভুতির ভুল হয়েছে ।
এইরকম অনেক উদাহরন রয়েছে । Wikipedia তে "Optical Illusion" নামে খুজলেই পেয়ে যাবেন ।
Illusion আরও নানা ধরনের রয়েছে । আপনি হয়তো সকালবেলার চায়ের কাপটা নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে আয়েস করে খবরের কাগজটা পড়ছেন । এমন সময় আপনার স্ত্রী বাজারের ব্যাগটা নিয়ে হাজির হলেন । বললেন , "আজ কিন্তু চা আনতে হবে , দুশো গ্রামের একটা হলুদের গুড়ো আনবে " আপনার পড়ায় মন দিতে অসুবিধে হচ্ছে আপনি বললেন," আর কিছু লাগবে না তো ? ঠিক আছে ব্যাগ এখানেই........." কথা শেষ করতে পারলেন না । লাফিয় উঠলেন শিরশির একটা আতঙ্কে । খোলা কাধের উপর কি যেন একটা ? বিছে নয় তো ? চায়ের কাপটা ইজিচেয়ারের সামনে রাখা টুলটায় রেখে লাফাতে লাফাতে ডান হাত দিয়ে কাধটা ঝেরে ফেলতেই মেঝেতে পড়ল একটুকরো সুতা । স্ত্রীর হাত থেকে বা ব্যাগ থেকে কাধে পড়েছে । আপনি সুতোকেই ভাবছিলেন বুঝি বিছে । এটিই হল স্পর্শানুভূতির বিভ্রম । এই ধরনের বিভ্রম (Illusion) স্বাদগ্রহনের অনুভূতি , ঘ্রাণানুভূতি ও শ্রবণাভূতির ক্ষেত্রেও হতে পারে।
পঞ্চইন্দ্রিয়কে ভিত্তি করে ভ্রান্তিকে (Illusion) কে মনোবিজ্ঞানে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে ।
১. দর্শনানুভুতির ভ্রম ( Optical Illusion )
২. শ্রবণাভুতির ভ্রম ( Auditory Illusion )
৩. স্পর্শানুভুতির ভ্রম ( Talctile Illusion )
৪. ঘ্রাণানুভুতির ভ্রম ( Offactory Illusion )
৫. স্বাদগ্রহনের বা জিহ্বানুভুতির ভ্রম ( Taste Illusion )
Hallucination:
অভিধানে Hallucination শব্দটির বাংলা অর্থ দেয়া আছে "অলীক কিছুর অস্তিত্তে বিশ্বাস"।অলীক বা অস্তিত্বহীন কোনও কিছু সম্পর্কে অনুভূতি লাভ করাকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Hallucination ।
ধরুন , অরণ্য একদিন রাতে কাজ শেষে অফিস থেকে বাসায় ফিরছে । ফেরার পথে বাস না পাওয়াই তাকে হেঁটেই বাসায় ফিরতে হচ্ছে । রাত অনেক হয়েছে । রাস্তাও ফাকা । রাস্তার ধারে রয়েছে এক বিশাল বটগাছ। আরও রয়েছে ঝিঝি পোকাদের শব্দ । যেন এক ভুতুরে পরিবেশ তৈরি হয়েছে । হঠাৎ তার কাছে মনে হল কে যেন তার পেছনে রয়েছে ।তাকে দেখছে। অরণ্য পেছনে তাকানোর সাহস পেল না । কিন্তু পেছনে না তাকিয়ে থাকতেও পারল না । অবশেষে কৌতূহলের কাছে হেরে গিয়ে সে পেছনে তাকিয়ে দেখল । যা দেখল তাতে তার শিরদ্বারা দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল । সে দেখল এক ভয়ংকর প্রাণী যেটার কুকুরের মত মুখ, দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ছে । প্রাণীটি মানুষের মত হাত তবে শুধু মুখটা কুকুরের। প্রাণীটার পায়ের কাছে একটা লাশ পড়ে আছে।আর প্রাণীটা সেই লাশ খাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে অরণ্য ভয়ে দৌড় দিল এবং কিছু দূরে গিয়ে এক লোকের দেখা পেল ।সে লোকটিকে গিয়ে সব খুলে বলল ।এবং দুইজন মিলে সেই স্থানে গেল কিন্তু সেখানে কিছুই দেখতে পেল না ।
এই ধরনের ঘটনা অনেকের সাথেই ঘটে থাকে । আসলে ওই ধরনের প্রাণীর কোনও অস্তিত্তই নেই । অরণ্য যা দেখেছে তা হল "Optical Hallucination" বা "Visual Hallucination" । অস্তিত্বহীন কোনও কিছুর উপরে কারোর দৃঢ় বিশ্বাস থাকলে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সে এই ধরনের ঘটনার স্বীকার হয়ে থাকে ।
সুন্দরী তরুনি রুপা বিয়ের এক বছরের মধ্যে তার স্বামীকে হারিয়েছে । তার স্বামীর নাম ছিল রাহুল ।ব্যাঙ্কে কাজ করত । অফিসে যাবার পথে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন । রাহুল যে ব্যাঙ্কে কাজ করত সেই ব্যাঙ্কেই রুপা চাকরী পেয়েছে । সহকর্মী শুভ্রকে ভালই লাগে তার । শুভ্রও ওকে পছন্দ করে । সেটুকু বুঝতে তার অসুবিধে হয়না । একদিন শুভ্র বিয়ের প্রস্তাব দিল রুপাকে । আর সেই রাতেই শুতে যাবার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল বাধতে বাধতে রুপা তাকাল রাহুলের ছবির দিকে , আর অমনি স্পষ্ট শুনতে পেল রাহুলের গলা "তুমি আমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে রুপা? " সে এর পর রাহুলের কথা প্রায় শুনতে পেত । কিন্তু সে ছাড়া আর কেও তা শুনতে পেত না । এই হল Auditory Hallucination এর উদাহরন ।
রুপার মনে পাপবোধ থেকে সে এই ধরনের Hallucination এর স্বীকার হয়েছে ।
আমার এক বন্ধু ঢাকায় থাকে । তার বাবা হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করলো , তার বাড়িতে কর্পোরেশনের যে পানি আসে তাতে প্রস্রাবের গন্ধ । তার দৃঢ় ধারণা হল এর পেছনে আছে তারই এক আত্মীয় । বাড়ির লোকজন বোঝালেন এটা অলীক চিন্তা । কিন্তু তিনি বুঝলেন না । তিনি সন্দেহ প্রকাশ করলেন, দুষ্টু লোকটি কর্পোরেশনের লোকদের হাত করে পানিতে প্রস্রাব মেশাচ্ছে । দীর্ঘদিন তিনি সেই পানিতে গোসল করেননি ,এমনকি তিনি বাইরে থেকে পানি কিনে খেতেন । কিন্তু তাঁর বাড়ির কেও পানিতে কোনও গন্ধ পেত না । এটা ঘ্রানভিত্তিক ভ্রান্তির(Olfactory Hallucination) একটি উদাহরন ।
মনে করুন , অনিম নামে এক লোকের এক মেয়ে আছে তাঁর নাম নুপুর । একদিন নুপুর রসগোল্লা খেতে গিয়ে গলায় আটকে মারা যায় । তারপর থেকে অনিম কোনও মিষ্টি খেতে পারেন না । মুখে দিলেই মনে হয় বিষ তেতো । এটা স্বাদভিত্তিক বা Taste Hallucination অসুস্থ মস্তিস্কের ফল।
বিভিন্ন ধরনের রাসয়নিক পদার্থের (Chemical Stimulus) এর সাহায্যেও Hallucination সৃষ্টি করা সম্ভব । গাজা , আফিম , L.S.D , ভাঙ , কোকেন , চরস ইত্যাদি সেবনকারীরাও বিভিন্ন Hallucination এর স্বীকার হয় ।
এক টিভিশো তে দেখেছিলাম , এক তরুন L.S.D খাওয়ার পর অনুভব করেছিল, তাঁর দেহটা খাটে শুয়ে আছে এবং আত্মা সিলিং-এ ঝুলে আছে ।
Illusion এর মত Hallucination কেও পঞ্চইন্দ্রিয়ের উপর ভিত্তি করে ৫ ভাগে ভাগ করা হয় :
১. দর্শনানুভুতির ভ্রম ( Optical Hallucination )
২. শ্রবণাভুতির ভ্রম ( Auditory Hallucination )
৩. স্পর্শানুভুতির ভ্রম ( Talctile Hallucination )
৪. ঘ্রাণানুভুতির ভ্রম ( Olfactory Hallucination)
৫. স্বাদগ্রহনের বা জিহ্বানুভুতির ভ্রম ( Taste Hallucination )
পৃথিবীর সকল ভুতের ছবি এই নিতির উপর গড়ে তুলা হয়...
Delusion (মোহ, অন্ধ, ভ্রান্ত ধারনা):
Delusion শব্দটির অর্থ যে মোহ তা আগেই আলোচনা করেছি । Illusion ও Hallucination এর সঙ্গে Delusion এর অনুভূতির পার্থক্য রয়েছে । Delusion রুগীর মধ্যে বদ্ধমূল কিছু ধারণা থাকে ।এই যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা অসুস্থ মস্তিষ্কেরই ফল ।
মনে করুন, হাসান সাহেব বাঙ্কে চাকরী করেন । তার দৃঢ় ধারণা সহকর্মীরা তার প্রতি সহানুভূতিহীন , হীনচরিত্র ও দুষ্টপ্রকৃতির । সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে কথা বললে হাসান সাহেব ধরে নেন ওরা তার সন্মন্ধেই কথা বলছে । কোনও দুই সহকর্মী নিজেদের দিকে তাকালেই সে ধরে নেন তাকে উদ্দেশ্য করেই ওরা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলো । "ও কেন আমার কাছ থেকে যাবার সময় সিগারেটের প্যাকেট বের করল ? আমার টেবিলের সামনে দাড়িয়ে কেন ওরা গল্প করলো ? আমি কি ভিলেন ? অফিসের আমজাদ সাহেব কেন আমাকে মাধুরী দিক্সিত এর ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার দিল ? আমি কি লম্পট ? আমি অফিসে ঢুকতেই কেন ওরা হাসাহাসি শুরু করলো ? আমি কি ওদের হাসির রসদ ? এই ধরনের নানা আত্নপ্রাসঙ্গিক ভ্রান্তি নিজের সাথে জুড়ে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন রুগী । নির্যাতনমুলক এই Delusion রুগী কিন্তু নিজের প্রতিটি ধারণা ও ব্যাখ্যাকে অভ্রান্ত মনে করেন। আমরা প্রায় সকলেই এই Delusion এর স্বীকার । আমরা অনেকে কারোকে কারোকে কোনও কারন ছাড়াই অপছন্দ করি । আবার কেও কেও যাকে অপছন্দ করি তার সম্পর্কে নানা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করি । যেমন মনে করি সে খারাপ , সে আমার ক্ষতি করতে চাই । এই গুলও Delusion এর কারনেই হয় ।
মনোবিজ্ঞানী পালভবের মতে, Delusion এর উৎপত্তির মুলে রয়েছে প্রথমত মস্তিস্ক স্নায়ুকোষের বিকারগত অনড়ত্ব, আর দ্বিতীয় কারন হল , স্ববিরোধী মানসিক অবস্থা ।
Paranoia:
Paranoia শব্দটির অভিধানিক অর্থ " বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিস্ক বিকৃতি " ।
Paranoia রোগী Delusion এর রোগীর মতই অন্ধ ভ্রান্ত বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত হয় বটে, কিন্তু পারানইয়া রোগী তার এই বিশ্বাসের পেছনে এমন সব সুন্দর যুক্তি হাজির করতে থাকেন যে , একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেও বিচার করা কঠিন হয়ে পড়ে - "উনি কি আসলেই মানসিক রোগী ? , উনার যুক্তিগুলো কি আসলেই সত্যি ? "
মনে করুন , জাভির হাসান একজন চাকুরীজীবী ।সে আপনাকে বলল যে তার স্ত্রী নুপুরের অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক আছে । এবং নুপুর তাকে মেরে ফেলতে চায় । সে এই কথার পেছনে এমন সব যুক্তি উপস্থাপন করলো যে আপনি তার কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন । জাভির হাসানের আপনার খুব কাছের বব্ধু হওয়ায় আপনি আপনার পরিচিত লোক লাগালেন এবং নিজেই খোজ খবর নিতে লেগে পড়লেন । শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করলেন আপনার বন্ধুর সব সন্দেহ ভিত্তিহীন ।
নিজের ভুল বিশ্বাসকে যুক্তিসহ হাজির করার প্রচেষ্টায় পারানইয়া রোগীর বৈশিষ্ট নিজের ওই বদ্ধমূল ভ্রান্ত বিশ্বাসের বাইরে পারানইয়া রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ , স্বাভাবিক মনে হয় ।
প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ম্যাকডুগালের মতে, পারানইয়া রোগীর গোপন মনে হীনমন্যতা বা পাপবোধ লুকিয়ে থাকার দরুন ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে এক ধরনের শান্তি পাই । নিজের অন্যায় কাজকে জাস্টিফায় করে প্রশান্তি পায় ।
Shemanto Reza