নিউটন শেষ বয়সে পাগলা হয়ে মারা গিয়েছিলেন একটা গোপন বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে...
সেই গোপনীয় জিনিস হল "আলকেমি"।
লোহা বা রুপাকে সোনায় পরিণত করার গোপন জ্ঞানকে আলকেমি বলা হয়। কেমিস্ট্রি ও আলকেমি কিন্তু দুটো আলাদা জিনিস।শুধু নিউটন না, মধ্যযুগের যেসব বিজ্ঞানী যারা পাগল হয়ে মারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগই এই গোপন বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মারা যান।
আলকেমি গবেষণা প্রথম শুরু করে মুসলিম বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান।এই আলকেমির দুইটা দিক... একটি হল ফিলোসফার’স স্টোন বা পরশ পাথর তৈরি করে তার সাহায্যে যেকোনো ধাতুকে সোনায় রুপান্তর করা...আরেকটি হল অমৃত সুধা বা এলিক্সর অভ লাইফ, যা পান করলে অনেক দীর্ঘায়ু লাভ করা সম্ভব।অনেকেই এটা নিয়ে গবেষণা করলেও ধারনা করা হয় কয়েকজন বিজ্ঞানী এই ফিলোসফার’স স্টোন আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তবে তারা কখনো সেগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি। এদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান, রজার বেকন, নিউটন ও ফ্লামেল উল্লেখযোগ্য।ফ্লামেল যে এই গোপন বিদ্যা আয়ত্বে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা নিয়ে অনেক বিশাল কাহিনী আছে।
আলকেমি এক রহস্যময় অধ্যায়। আলকেমির অর্থ হলো অপরসায়ন। অর্থাৎ যে বিদ্যা দিয়ে অন্য কোনো ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করা যায়। আলকেমি শব্দটি আরবি ‘আল-কিমিয়া’ থেকে এসেছে। আলকেমি নিয়ে যারা গবেষণা করতেন তাদের বলা হয় আল কেমিস্ট। এদের গবেষণার মূলত দুটি ধারা আছে, এক পরমায়ু লাভ করা। দ্বিতীয়ত সস্তা ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করা। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলকেমি (আরবি: ﺍﻟﻜﻴﻤﻴﺎﺀ, আল-কিমিয়া) দ্বারা একটি প্রাচীনকালে প্রকৃতির এক ধরনের অনুসন্ধান এবং জ্ঞানের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক একটি শাখাকে বোঝায় যাতে জ্ঞানের সকল শাখার সকল উপাদানের সম্মিলনের মাধ্যমে একটিমাত্র উচ্চতর মহান শক্তির অস্তিত্বের ধারণা করা হতো। অর্থাৎ রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতিষ শাস্ত্র, সেমিওটিক্স, মরমিবাদ, আধ্যাত্মবাদ এবং শিল্পকলা এই সকল শাখার সকল উপাদান যে একক উচ্চতর শক্তির অংশ হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে তার বিজ্ঞানই হল আলকেমি। মেসোপটেমিয়া, প্রাচীন মিশর, পারস্য, ভারত, চীন, প্রাচীন গ্রীস, রোম, মুসলিম সভ্যতা এবং সবশেষে ইউরোপে এই আলকেমির চর্চা হয়েছে। এ হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ বছর ধরে আলকেমির চর্চা অব্যাহত ছিল। এর জন্য গঠিত হয়েছিল জটিল সব স্কুল ও দার্শনিক ধারা।
অলিয়াস বারকিয়াসের মতে টুবাল কেইনের সময় থেকে আলকেমির চর্চা শুরু হয়। বাইজান্টেনিয়াম পুরোহিতদের আলকেমির পিতৃপুরুষ ধরা হয়। তাদের মতে মিসরে সর্বপ্রথম আলকেমির চর্চা শুরু করে পুরোহিতরা। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে ট্রিস ম্যাগিস্টাস নামে এক পুরোহিতের কথা জানা যায়, যিনি বিভিন্ন বিদ্যার আবিষ্কারক হিসেবে নানা খ্যাতি অর্জন করেন। এই খ্যাতি তাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায় যা তাকে ঈশ্বরের সমকক্ষ তুল্য করে। তার নাম অনুসারেই পরবর্তীতে আলকেমি একটি ‘হামেটিক আর্ট’ বা গোপন বিদ্যা রূপে পরিচিতি লাভ করে।
আলকেমি নিয়ে রচিত বইপত্র গোপন সাংকেতিক ভাষায় লিখিত হতো বলে এর রহস্যের ছায়া আরো বিস্তার লাভ করে। আলকেমির ইতিহাস থেকে জানা যায় চাইনিজ, ইন্ডিয়ান আর গ্রেকো-রোমান জাতি আলাদাভাবে এই পরশ পাথরের খোঁজে আত্মনিয়োগ করে। আরবীয়রা আলকেমি নিয়ে এত গবেষণা করে যে আলকেমি আর আরব জাতি প্রায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে পরে। অষ্টম শতাব্দীতে আরব রসায়নবিদ জাবের বিন হাইয়াম আলকেমিকে আবার পাদ প্রদীপের নিচে নিয়ে আসেন এ ব্যাপারে তিনি প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান তার ল্যাবরেটরিতে।
এই আলকেমি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আরব রসায়নবিদরা কিন্তু আবিষ্কার করে ফেলে সালফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড আর অ্যাকোয়া রেজিয়ার মতো প্রয়োজনীয় পদার্থ। এই আবিষ্কার সে সময় আলকেমিদের সম্মানের চূড়ায় নিয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে আলকেমির সঙ্গে অ্যান্তনীয় ল্যাভয়সিয়ে আর চার্লস বয়েলের মতো নামি রসায়নবিদের নামও জড়িত। তারা নাকি গোপনে আলকেমির চর্চা করত। আলকেমির ইতিহাস থেকে জানা যায় দু’ধরনের আলকেমি ছিল একদল অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সারাজীবন নিরলসভাবে লোহাকে সোনায় রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছে, আর একদল ছিল এটাকে পুঁজি করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আলকেমির প্রসার শুরু হয়। এখান থেকেই আলকেমি রোমান সাম্রাজ্য ও ইউরোপে প্রবেশ লাভ করে।
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় আলকেমি কনস্ট্যান্টিপোলে ছড়িয়ে পরে। নিষ্ঠার সঙ্গে অনেক আলকেমিস্ট আলকেমির চর্চা করলেও অনেক প্রতারণা ও ঠগবাজির উদাহরণ বিরল নয়। প্রতারণার পরিমাণ এত বেশি হয়ে গেছিল যে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সম্রাট ডাইওক্লোটিন আলকেমির গোটা মিসরীয় গ্রন্থাবলি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন।
এদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান, রজার বেকন, নিউটন ও ফ্লামেল উল্লেখযোগ্য… ফ্লামেল যে এই গোপন বিদ্যা আয়ত্বে নিয়ে এসেছিলেন, সেটা নিয়ে অনেক বিশাল কাহিনী আছে।
এই আলকেমিদের ভয়ে ইংল্যান্ডে একসময় কৃত্রিম সোনা বানানোর বিরুদ্ধে অগ্রিমভাবে আইনও তৈরি করা হয়। তবে এই পর্যন্ত আলকেমির মাধ্যমে কোন কৃত্রিম স্বর্ণ তৈরির প্রমাণ কখনোই পাওয়া যায় নি।
বিজ্ঞানী রজার বেকন ছিলেন সবচেয়ে রহস্যময় এক বিজ্ঞানী, যার পদচারনা বিজ্ঞানের এমন কোন শাখায় বাদ ছিল না। তিনি তখনকার সময়ে আলকেমিতেও জগৎ বিখ্যাত ছিলেন।
ভয়ানিখের পান্ডুলিপির নাম হয়তো অনেকে শুনে থাকতে পারেন। পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় যে পনেরটি পান্ডুলিপি আছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম।
২৪০ পৃষ্ঠার এই পান্ডুলিপিটি একশ বছর আগে উদ্ধার হলেও এতে কি লেখা আছে তা এখন পর্যন্ত কেউ বের করতে পারেনি… এটি রজার বেকনের লেখা।
এই পান্ডুলিপিতে যেসব গাছের ছবি দেওয়া আছে, সেগুলো এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে কেউ খুঁজে পায় নি। কিছু কিছু জটিল কেমিক্যাল বিক্রিয়ার ছবি দেয়া আছে, যা থেকে ধারনা করা হয় এই বইয়ে আলকেমির মাধ্যমে সোনা বানানোর গোপন রহস্য দেওয়া আছে।
Tags:
জানা-অজানা