ভূত বিশ্বাস করেন? জানি অনেকেই বাঁকা হাসি হাসবেন। বলবেন, ভূত বলে কিছু আছে নাকি? এদের মাঝে অনেকেই আবার স্রেফ পার্ট নেয়ার জন্য বলবেন, কিন্তু রাতের বেলা ভূতের মুভি দেখতে বসে চোখে হাত চেপে ধরে আস্তে আস্তে আঙুল সরিয়ে ফুটো বানিয়ে চোখ রাখবেন মনিটরে সে যাকগে, ভূত আছে কি নাই সে তর্কে নাই বা গেলাম চলুন জেনে নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর হন্টেড জায়গা সম্পর্কে।
পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক হন্টেড জায়গা হিসেবে "পোভেগ্লিয়া আইল্যান্ড" কে মানা হয়ে থাকে। নাম শুনেছেন আগে? না শুনলে সমস্যা নেই। নর্দান ইটালির ভেনেশিয়ান ল্যাগুনের ভেনিস এবং লিডো'র (৭ মাইল বিশিষ্ট বালুকাবেলা, পর্যটনের জন্য বিখ্যাত) মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত পোভেগ্লিয়া দ্বীপটি। মধ্যবর্তী স্থানে না বলে লিডোর কাছাকাছি বললেই ভালো হয়। কারণ লিডো থেকে বোটে মাত্র মিনিটপাঁচেকের পথ এই পোভেগলিয়া আইল্যান্ড। আয়তনে বেশ ছোট দ্বীপটি। দ্বীপের মাঝ বরাবর একটি খাল দ্বীপটিকে দু'ভাগে ভাগ করে ফেলেছে একটি কাঠের ব্রিজ দু'ভাগে ভাগ করা দ্বীপটির মাঝে সংযোগ স্থাপন করেছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে পোভেগলিয়া আইল্যান্ডের নাম সর্বপ্রথম উঠে আসে ৪২১ খ্রিস্টাব্দে। ঐ সময়টা ছিলো রোমান সাম্রাজ্যের পতনকাল। ভয়ানক আক্রমণের শিকার হয়ে পাদুয়া এবং এস্তে নগরীর অনেক উচ্চবংশীয় লোক ভেনেশিয়ান ল্যাগুনের দিকে আসতে থাকে আশ্রয়ের খোঁজে। পোভেগ্লিয়া আইল্যান্ড সহ আশপাশের দ্বীপগুলোতে কোন বসতি ছিলো না তখন। এই পাদুয়া এবং এস্তে নগরীর লোকজনই সর্বপ্রথম পোভেগ্লিয়া দ্বীপে মানুষের পায়ের ছাপ রাখে বলে জানা যায়। পোভেগলিয়া আইল্যান্ড ও আশপাশের দ্বীপগুলো আয়তনে বেশ ছোট বলে আক্রমণকারীরা এর দিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি।
ধীরে ধীরে পোভেগলিয়ার জনসংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ১২০০ সালের পরের দিকে ইতালির একজন প্রতিনিধি দ্বীপটির গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন, যাকে তৎকালীন ইতালিয় ভাষায় বলা হতো Podestà (যার অর্থ মেয়র)। ১৩৭৯ সালে ভেনিসকে যখন আক্রমণ করা হয় তখন পোভেগ্লিয়ার জনগণ পোভেগ্লিয়া ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তী প্রায় ৪০০ বছর এই দ্বীপে কোন মনুষ্যবসতি ছিলো না। যদিও ১৫২৭ সালে তৎকালীন ভেনেশিয়ান সরকার ধর্মযাজকদের দ্বীপটি দিতে চেয়েছিলেন তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কিন্তু তারা সরকারের সে প্রস্তাব প্রত্যাখান করে। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ভেনেশিয়ান সরকার ভেনেশিয়ান ল্যাগুনে পাঁচটি অষ্টভুজাকৃতির দূর্গ তৈরী করে। ভেনেশিয়ান ল্যাগুনের নিরাপত্তা ও অবাধ প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণই এইসব দূর্গ তৈরী করার উদ্দেশ্য ছিলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ভেনিস ব্যবসার জন্য বিখ্যাত হতে লাগলো। এরই প্রেক্ষিতে ১৭৭৬ সাল থেকে ভেনিস হতে ছেড়ে আসা এবং ভেনিসমুখী জাহাজে বয়ে আনা মালামাল এবং নাবিকদের শারীরিক অবস্থা যাচাই করার জন্য পোভেগলিয়াকে চেকপয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করা হয়।
১৭৯৩ সালে দুটি জাহাজে বেশ কিছু প্লেগ রোগী পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে দ্বীপের একাংশকে প্রাথমিকভাবে রোগীদের জন্য আইসোলেটেড কারাগারের মত বানানো হয়। কিন্তু ১৮০৫ সালে যখন প্লেগ রোগ মহমারীর আকার ধারণ করলো তখন ইতালির ক্ষমতায় ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি পোভেগ্লিয়াকে পার্মানেন্টভাবে প্লেগ রোগীর নির্বাসনস্থান বলে ঘোষণা দেন। শুধু প্লেগ রোগীই না, যাদের মধ্যে প্লেগ রোগের বিন্দুমাত্র সিম্পটম দেখা দিতো তাদেরকে পোভেগলিয়ায় যেতে বাধ্য করা হত। আর পোভেগলিয়ায় যাওয়া মানেই ছিলো নিশ্চিত মৃত্যু। এতটুকু একটা দ্বীপে মহামারী রোগ প্লেগের বিপুল রোগীর জায়গা কিভাবে হতো সেটা ভাবছেন তো? মাথা খাটান। হুম, আপনার ধারণাই ঠিক। যারা মরতো তারা তো মরতোই, তাদের কবর দেয়া হতো (কবর না বলে পুঁতে ফেলা বলাই ভালো), আর যারা বেশী অসুস্থ তাদেরকে জীবিত অবস্থায়ই পুড়িয়ে মারা হতো। শেষদিকে এমন হলো যে, কাউকেই আর কবর দেয়া হতো না, স্রেফ পুড়িয়ে মারা হতো। বলা হয়ে থাকে, প্রায় ১৬০০০০ প্লেগ রোগীকে পুড়িয়ে মারা হয় নিরীহদর্শন ঐ দ্বীপটিতে। আর এই ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন শেষ হয় অর্থাৎ দ্বীপটি বন্ধ করে দেয়া হয় ১৮১৪ সালে। আর এখান থেকেই ভূতের উপদ্রব শুরু হয় বলে শোনা যায়।
স্থানীয় জেলেরা সবজায়গায় মাছ ধরলেও পোভেগ্লিয়ার আশপাশ এড়িয়েই চলতো তারা। তাদের মতে ওখানে জাল ফেললে যতোটা না মাছ পাওয়া যায় তারচেয়ে বেশী পাওয়া নানা সাইজের মানুষের হাড়। তবে ১৯২২ সালে এটি আবার খুলে দেয়া হয়। দ্বীপের মূল বিল্ডিংগুলোকে এটিকে ব্যবহার করা হয় মানসিক রোগীদের হাসপাতাল হিসেবে। তবে মানসিক রোগীদের হাসপাতাল হলেও এখান থেকে কোন রোগীর সুস্থ হয়ে ফেরত হয়ে আসার কোন সংবাদ শোনা যায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন ঐ দ্বীপে এমন একজন ডাক্তার ছিলেন যিনি কিনা রোগীদের ওপর নানা ধরণের শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। তিনি তার ডাক্তারি সরঞ্জাম হিসেবে হাতুড়ি, বাটাল, ড্রিল মেশিন ব্যবহার করতেন। আর তার পরীক্ষার কাজে যেসব রোগী সাহায্য করতো না তাদের তিনি পুরনো বেল টাওয়ারে নিয়ে যেতেন এবং নির্মমভাবে শাস্তি দিতেন। তার কিছু বছর পরেই বেল টাওয়ারের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করার চেষ্টা করে ঐ সাইকো ডাক্তার। বলা হয়ে থাকে, তিনি ঐ দ্বীপের মৃত রোগীদের আত্মাদের দ্বারা নির্যাতিত ছিলেন এবং শেষদিকে তিনি নিজেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে তার মৃত্যু নিয়ে একটা রহস্য আছে। বেল টাওয়ার এর ওপর থেকে লাফিয়ে পড়লেও তিনি বেঁচে যান। কিছুক্ষণ পরেই একটা রহস্যময় কুয়াশা এসে তাকে ঘিরে ফেলে এবং তার কিছুক্ষণ পরেই তার লাশটা গায়েব হয়ে যায়। এই ঘটনাটা কত সালের সেটা এক্সাক্টলি জানা যায় নি, তবে তার কয়েক বছর পরেই ১৯৬৮ সালে ঐ রহস্যময় ভূতুড়ে হসপিটাল বন্ধ হয়ে যায়। পোভেগলিয়া এরপর মনুষ্যবিহীন একটা নিঃসঙ্গ ভূতুড়ে দ্বীপে পরিণত হয়।
এরপরেও বিভিন্ন সময় পোভেগলিয়ায় ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটনার কথা শোনা যায়। অনেকেই দাবী করেছে যে পোভেগলিয়ার পাশ দিয়ে গেলে প্লেগ রোগীর কাশির শব্দ শোনা যায়। যন্ত্রণায় চীৎকার এবং কান্নার শব্দও শোনা যায় বলেও অনেকে জানান। দ্বীপে গিয়েছেন এমন অনেকে বলেন, ওখানে এখনও আত্মারা ঘোরাফেরা করে। দ্বীপে যারা ভিজিট করতে গেছেন প্রায় তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, কোন অশরীরী তাদের স্পর্শ থেকে শুরু করে ধাক্কা এমনকি মারাত্মক ভাবে আঘাত পর্যন্ত করেছে এবং ভয়ে তারা সে স্থানে সে স্থান ত্যাগ করেছেন। তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে, ওখানে আসলেই অশরীরী কোন কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে। স্থানীয়রা এমনভাবে এড়িয়ে চলে দ্বীপটিকে চলে যেন, ওখানে কিং সলোমনের গুপ্তধন থাকলেও তা নিয়ে বিন্দুমাত্র লোভ নেই তাদের। সারাবিশ্বের কাছে এই দ্বীপটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভূতুড়ে জায়গা হিসেবে পরিচিত।
শেষমেশ দুটো রোমহর্ষক পয়েন্ট বলি, ৮০'র দশকে পোভেগলিয়ার সকল ঘটনাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়ে একটা ফ্যামিলি সেখানে হলিডের এক সপ্তাহ কাটানোর জন্য যায়। কিন্তু একরাত থাকার পরেই তারা ফিরে আসেন। কেন ফিরে আসেন, ওখানে তারা কি দেখেছেন সে বিষয়ে কখনোই মুখ খোলেন না। তবে তাদের একমাত্র মেয়ের মুখে সুগভীর বিশাল একটা কাটা দাগ দেখা যায়, যেটাতে ১৪ টা সেলাই পড়েছিল। এবং ঐ আঘাতটা একদিন আগেও ছিলো না বলে প্রতিবেশীরা জানান।
আরেকটা বিষয় পাঠকদের কতটা ভয়ের লাগবে জানি না, তবে চিন্তা করতেই আমার লোম দাঁড়িয়ে গেছে বারবার। পোভেগলিয়া আইল্যান্ডের মাটির প্রায় ৬০% ভাগই মানুষের দেহপোড়ার ছাই। দ্বীপে নেমে মাটিতে হাত দিলে বালুর মত উঠে আসে সেই ছাই। দ্বীপের মূল অংশটা বাদে অন্য যে অংশটা আছে ওখানে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের হাড়। চারিদিকে হালকা একটা কটু গন্ধ জালের মত বিছিয়ে আছে।
অশরীরী কোন জিনিসে বিশ্বাস করেন না, ব্যাপক সাহসী এমন কেউ কি আছেন যে ওখানে যাবেন?
তানজীম আহমেদ