লুসিড ড্রিমঃ স্বপ্ন যেখানে সত্যি!

Lucid dream


স্বপ্ন নিয়ে মানুষের আগ্রহ সেই প্রাচীনকাল থেকে।প্রাচীনকালের লোকজনের না উপকথা, মিথ এ ছড়িয়ে আছে এই স্বপ্ন। অনেকে মনে করত, স্বপ্নে আত্মা দেহ ত্যাগ করে নাকি ঘুরতে বের হয়! আবার অনেকে ভাবেন,স্বপ্ন ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্দেশ করে। আমাদের দাদী নানীদের ও তাই স্বপ্ন নিয়ে নানান ব্যাখ্যা দিতে দেখা যায়। খোয়াবনামা বইটি এখনো হয়ত আমাদের অনেকের ঘরেই পাওয়া যাবে। সেই স্বপ্নেরই এক অত্যাশ্চর্য বিষয় হচ্ছে লুসিড ড্রিমিং। আসুন ঘুরে আসি লুসিড ড্রিমিং এর জগৎ থেকে-

লুসিড ড্রিমিং কি?

ইংরেজি Lucid এর বাংলা অর্থ হচ্ছে পরিস্কার বা খুব স্পষ্ট। সাধারন স্বপ্নতে যেমন ঘটনার উপর ব্যাক্তির কোন নিয়ন্ত্রন থাকে না,লুসিড ড্রিমিং এ ঘটে ঠিক এর উল্টোটা। লুসিড ড্রিমিং এ একজন ব্যাক্তি তার স্বপ্ন দেখা নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকেন। এমনকি তিনি নিজে স্বপ্নের মাঝে সিদ্ধান্তও নিতে পারেন! এটাই লুসিড ড্রিমিং আর সাধারন স্বপ্ন এর মাঝে পার্থক্য। লুসিড ড্রিমিং এর অন্যতম প্রধান গবেষক Stephen LaBerg খুব সুন্দর উক্তি দিয়েছেন-
“Lucid dreaming lets you make use of the dream state that comes to you every night to have a stimulating reality”

লুসিড ড্রিমিং এর ইতিহাস:

লুসিড ড্রিমিং নিয়ে আধুনিক গবেষনা সাম্প্রতিক হলেও, এটি নিয়ে ধারনা প্রকাশ করা হয় অনেক আগে। সর্বপ্রথম গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল এটি নিয়ে ধারনা দেন। তার ভাষায়,
“often when one is asleep, there is something in consciousness which declares that what then presents itself is but a dream”
ইতিহাসে সর্বপ্রথম লুসিড ড্রিমিং এর অভিজ্ঞতা নেন বলে লিপিবদ্ধ হন Marquis d’Hervey de Saint-Denys’s একজন ফরাসি নাগরিক। তিনি” Dreams and the ways to direct them: practical observations” বইটিতে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কিন্ত মজার ব্যাপার হল,তারা লুসিড ড্রিমিং সম্পর্কে জানলেও এই টার্মটির ব্যবহার তারা করেন নি। ডাচ সাইক্রিয়াস্টিক ও লেখক Frederik (Willem) van Eeden সর্বপ্রথম লুসিড ড্রিমিং ব্যবহার করেন।

বৈজ্ঞানিক ভাবে যিনি লুসিড ড্রিমিং কে প্রতিষ্টা করেন, তিনি হলেন Stephen LaBerge। উনি সর্বপ্রথম লুসিড ড্রিমিং এর বৈজ্ঞানিক প্রমান তুলে ধরেন ১৯৮০ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এ তার পিএইচডি থিসিসের অংশ হিসেবে। তাছাড়া তিনি “The lucidity Institute” এর প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে লুসিড ড্রিমিং এর উপর কিছু কোর্স চালু আছে। তাছাড়া আরো কিছু বিজ্ঞানি লুসিড ড্রিমিং এর উপর গবেষনা করেন।

লুসিড ড্রিমিং এর বিজ্ঞান:

লুসিড ড্রিমং এর বিজ্ঞানটি বেশ জটিল। মূলত ব্রেনের প্যারাইটাল লোব থেকে এটির সৃষ্টি। এর সাথে REM(Rapid eyeeye movement) sleep এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মূলত REM sleep শুরু হবার সাথে সাথে কারো যদি macro consciousness তৈরী হয়, তখন কেউ লুসিড ড্রিমিং অনুভব করে।বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এসময় ব্রেনে Beta-1 ফ্রিকুয়েন্সির তরঙ্গ বেশি ধরা পড়ে।
মূল বৈজ্ঞানিক আলোচনা টি বেশ জটিল তাই এখানে তুলে ধরা হল না। আগ্রহী পাঠকেরা নিচের লিংক থেকে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন,
Lucid Dreaming: Psychophysiological Studies of Consciousness during REM Sleep by Stephen LaBerge, Ph.D.

তবে লুসিড ড্রিমিং হতে হলে কিছু ফ্যাক্টর পূরন করতে হয়। LaBerge এইরকম সাতটি ফ্যাক্টরের কথা বলেন। ফ্যাক্টরগুলো হচ্ছে-
1. Awareness of the dream state (orientation);
2. Awareness of the capacity to make decisions;
3. Awareness of memory functions;
4. Awareness of self;
5. Awareness of the dream environment;
6. Awareness of the meaning of the dream;
7. Awareness of concentration and focus (the subjective clarity of that state)
অর্থাৎ কোন ড্রিম লুসিড ড্রিম হতে হলে তাকে অবশ্যই এই ফ্যাক্টরগুলো পূরন করতে হবে।

কিভাবে করব “লুসিড ড্রিমিং”:

লুসিড ড্রিমিং প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে এটি আর্টিফিশিয়ালি ও করা যায়। Dr.LaBerge এর The Lucidity Institution সাধারনের জন্য লুসিড ড্রিমিং দেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। Mnemonic Induction of Lucid Dreams (MILD) হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি। যারা স্বপ্ন দেখে মনে রাখতে পারে তাদের জন্য এটি সহজ হয়। মূলত REM sleeping er সময় বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে লুসিড ড্রিমিং ঘটানো যায়।এজন্য তারা The Nova Dreamer নামে লুসিড ড্রিমিং ইন্ডাকশন ডিভাইস আবিষ্কার করেন। তাছাড়া কিছু ড্রাগ (যেমন,Galantamine) লুসিড ড্রিমিংয়ে সহায়তা করে বলে জানা যায়।তবে এসব কিছু ছাড়াও কেউ লুসিড ড্রিমিং অনুভব করতে পারেন একটি বিশেষ পদ্ধতিতে। নিচে তা দেয়া হল:

প্রথমেই বিছানায় শুয়ে পড়তে হবে। এটি সবচেয়ে ভাল কাজ করে যখন কেউ খুব ক্লান্ত থাকে। এমনভাবে শুতে হবে যেন হাত শরীরের পাশে থাকে এবং মুখ উপরের দিকে থাকে। চোখ বন্ধ থাকবে এবং সম্পূর্ন শান্ত অবস্থায় থাকতে হবে।এসময় ব্রেইন ঘুমানোর জন্য দেহকে কিছু সিগনাল দিতে থাকবে। যেমন,অস্বস্তি, চোখ কুটকুট করা,পাশ চেঞ্জ করার ইচ্ছা ইত্যাদি। কিন্ত এই সব সিগনাল ই অমান্য করতে হবে। এভাবে বিশ পচিশ মিনিট থাকার পর বুকের উপর থেকে কিছু ওজন সরে যাবার অনুভুতি হবে। এইসময় অনেকে অদ্ভুত শব্দও শুনতে পায়। এই অবস্থাকে বলে” sleep paralysis”। এই মুহুর্তে চোখ খুললে ব্যক্তি হ্যলুসিলেশানে ভুগবে। অর্থাৎ চোখ খুলে স্বপ্ন দেখার মত। এই মুহুর্তে ব্যক্তির পুরো শরীর ঘুমে থাকলেও ব্যক্তি অবগত থাকেন উনি স্বপ্ন দেখছেন এবং নিজের ইচ্ছামত তার স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন।
এই পদ্ধতিটি কার্যকর হলেও প্রথম দফায় কেউ সফল নাও হতে পারেন। এর জন্য দরকার অনেকদিনের প্রাকটিস।

লুসিড ড্রিমিং ভাল ও মন্দ: লুসিড ড্রিমিং নি:সন্দেহে একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। সব ধরনের ফ্যান্টাসি অনুভবের সুযোগ রয়েছে এখানে! যেমন পাখির মত উড়ার অনুভুতি বাস্তবে আমাদের পক্ষে না নেয়া সম্ভব হলেও লুসিড ড্রিমিং এ সম্ভব। আপনার কোন শত্রুকে ইচ্ছা করলে আপনি বেধরক পিটুনি দিতে পারেন! যেহেতু স্বপ্ন আপনার নিয়ন্ত্রনে থাকে। মনোবিদেরা দু:স্বপ্ন কিংবা Nightmare এর চিকিৎসায় লুসিড ড্রিমিং এর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেকে নানাধরনের ফোবিয়া বা ভীতি থেকে মুক্তি পেতে,সামাজিক ও মানসিক উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে,কিংবা সেলফ কনফিডেন্স বাড়াতে লুসিড ড্রিমিং করে থাকে। গবেষনায় এটিও প্রমানিত হয়েছে,লুসিড ড্রিমিং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে।
লুসিড ড্রিমিং এর কিছু অপকারিতাও আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় তাদের যারা ঘন ঘন লুসিড ড্রিমিং করেন।তারা একসময় রিয়েলিটি নিয়ে সমস্যায় পড়ে যায়। অর্থাৎ তারা স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তবে আছে সেটি গুলিয়ে ফেলে! ফলে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এর সমাধান ও আছেএজন্য একটি কাগজে কিছু লিখে ফেলুন,সংখ্যা নাহয় কবিতার লাইন। এবার কিছুসময় অন্যদিকে তাকিয়ে আবার লেখা দেখুন। যদি দেখেন সাবজেক্ট চেঞ্জ হয়ে গেছে,তবে বুঝবেন আপনি স্বপ্নে আছেন। কারন স্বপ্নে সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হয়। অনেকে ধারনা করেন,লুসিড ড্রিমিং এ কারো মৃত্যু হলে বাস্তবেও তার মৃত্যু ঘটতে পারে। যদিও এর স্বপক্ষে কোন প্রমান মেলে নি। তবু বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন থাকাই জরুরী।
ভাল মন্দ সব কিছু মিলিয়েই এই লুসিড ড্রিমিং।
ঘুরে আসবেন নাকি লুসিড ড্রিমিং এর জগতে??

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম