বড় একটা ক্লাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিয়ে শেষ হতে রাত অর্ধেক পেরিয়ে গেল। ভেবেছিলাম মজা তেমন একটা করতে পারব না। কিন্তু নিঃসঙ্কোচে আনন্দ যা চেয়েছিলাম লুটিয়ে নিয়েছি। তাতে ফুফি বা মিহির ভাইয়ার ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তাঁরা তাদের মতোই বিয়েতে মশগুল ছিলেন। বিয়ে শেষে বর আর কনে চলে আসার অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমরা ক্লাবে ছিলাম, ফুর্তি করেছিলাম। আমি, আমার আপু, মায়া আপু, মুক্তা এবং তাদের বন্ধুবাধবরা সকলেই।
রাত এগারোটা নাগাদ সবাই বেরিয়ে এলাম। যে যার মতো গাড়িতে উঠছিল। অনেকাংশই আমার অপরিচিত হওয়ায় আমি গর্দভ বেশে দাঁড়িয়ে রইলাম। দু'একটা ছেলে জায়গা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের আশেপাশে। মিহির ভাইয়ারা সবাই যে যার-যার বাইকে। আমার পাশে এসে আচমকা দাঁড়াল মুক্তা। আমার পাশ থেকেই চিল্লিয়ে বলল, "ঐ, ওখানে আর কয়জনের জায়গা অবশিষ্ট আছে?"
দুলাভাই প্রায় চেঁচিয়ে বলল, "ওগো জানপাখি, জায়গা তো তেমন নেই। অনেক কষ্টে একটু করেছি। তুমি চলে এসো।"
বউয়ের প্রতি বলা ভাইয়ার আদুরে কথাগুলো শুনে আমরা সবাই হো হো করে হেসে দিলাম। পেছন থেকে মিহির ভাইয়া মুক্তাকে ডেকে বলছেন, তাঁর বাইকের পেছনেই বসতে।
দুলাভাইয়ের কাছে যেতে যেতে মুক্তা বলল, "উনি আমাকে ছাড়া বসবে না। তুমি বরং সাবিহাকে তোমার বাইকে নাও। ও বেচারি, আগেভাগে কোনোদিকে বসেনি।"
আমি বোকার মতো হা করে ছিলাম, জায়গাই পাচ্ছিলাম না। মুক্তা যাওয়ার সময় এক চোখ টিপে দিয়ে চলে গেল। এ কী করল সে? সে কি আমার পক্ষে? আমাকে আর মিহির ভাইয়াকে এক করার কথা ভাবছে না তো? তা হলে বরং সে তো আমায় বড় অসুবিধায় ফেলে গেছে। ভাইয়া আমাকে মোটেও পছন্দ করেন না। নেবেন আমাকে? আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
অল্পক্ষণের মধ্যে সবাই যে যার মতো করে বেরিয়ে পড়েছে। একা রয়ে গেলাম আমি। পেছনে ফিরে যেই দেখি, একি! ভাইয়া এখনও আছে। কীভাবে রাগে ফুঁসছে আমায় দেখে দেখে। এরচেয়ে বরং আমি কোনো একটা গাড়ি খুঁজে চলে যাই। শতগুণে রেহাই পাব। না, ভাইয়া তো আমার অপেক্ষায় আছেন। আমি বরং তার দিকে এগিয়ে গেলাম।
"আমি আগেই তোমাকে সঠিকভাবে চিনেছি, চালবাজ হিসেবে। মুক্তাকেও নিজ পক্ষে করে নিয়েছ। তাই না? দেখেছিলাম আমি, কীভাবে সে ভাইয়াকে প্ল্যান বুঝাচ্ছিল, 'আপনাকে জায়গার কথা জিজ্ঞেস করলে চিল্লিয়ে বলবেন শুধু আমার জন্যই জায়গা আছে।' আর কতটুকু নিচে নামবে যদি বলে দিতে তবে উপকৃত হতাম।"
সেদিনের মতো আবারও আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমাকে নিয়ে তিনি যে হারে ঘৃণাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, আমার সাফাই কি কানে নেবেন?
"দাঁড়িয়ে কেন আছ? আমি তোমাকে নিতে চাই না। গাড়ি খুঁজে নাও নিজের জন্য।"
আমি মুখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে চলে এলাম। সেদিনের মতো শব্দ করে কাঁদলাম না। তবে লক্ষ্য করলাম, নিষ্ঠুর চোখগুলো বাধা মানল না। চোখের আশপাশ ভিজিয়ে দিলো। আমি নিরুপায় হয়ে নির্জন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ি পাওয়ার আশায় এদিক-ওদিক চোখকে ঘুরাচ্ছিলাম। কতদূর হবে এখান থেকে ফুফার বাসা? এক মাইল তো হবেই না। হেঁটে তো যাওয়া যাবে। গাড়ি আসে না যখন হাঁটা ধরাটাই শ্রেয়। তাছাড়া চেনা পথ। নির্বিঘ্নে চলতে লাগলাম।
একটু পর হঠাৎ পাশে মিহির ভাইয়া বাইক নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। আমি লুকিয়ে চোখ মুছে আমার মতো করে হাঁটতে লাগলাম। এতক্ষণেও কেন তিনি যাননি? যাইহোক, তিনি অপমানের ওপর অপমান করবেন আর আমি কেবল শ্রোতা হয়ে থাকব? আমারও আত্মসম্মান বোধ বলতে কিছু আছে কি না?
ভাইয়া এবার বাইক নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, "উঠে পড়ো। এতো রাতে এখানে গাড়ি সহজেই পাওয়া যায় না।"
আমি আমার মতোই হাঁটতে লাগলাম।
"কী বলছি শুনছ না? তোমার তো আবার বাবাকে সবকিছু বলে দেওয়ার অভ্যাস। তোমায় নিয়ে না যাওয়ার খবরটা বাবার কাছে পৌঁছতে মুহূর্ত খানেকও লাগবে? এভাবে হেঁটে যেও না। উঠে পড়ো বাইকে।"
আমি হাঁটতেই আছি দেখে ভাইয়া বাইক থেকে নেমে আমাকে টেনে বাইকের পাশে নিয়ে গেলেন। আবার কোনোকিছু হলে আমাকে দোষারোপ করবেন। তাই অগত্যা উঠে পড়লাম। তারপর তিনি বাইক চালাতে লাগলেন। বিগত সময়গুলোতে তার ব্যবহারে আমার মনটা আবার প্রবল ঘৃণায় ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। একটা মানুষকে যাচ্ছেতা বলার স্বভাব এখনও তার গেল না। তিনি হঠাৎ বাইক থামিয়ে আমায় রুমাল দিলেন, "চোখ মুছে নাও।"
একি! তিনি কি আমায় কাঁদতে দেখে ফেলেছেন? লুকিং গ্লাসের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম, আমার মুখের প্রতিবিম্ব ওখানে সরাসরি ভাসছে।
"সামান্য বিষয়েও কান্নাকাটি করার স্বভাব এখনও গেল না তোমার?"
"সিরিয়াসলি! সামান্য বিষয়?"
"সামান্য কেন হবে না? সবকিছুতে দোষ তো তোমারই।"
আমি কোনো প্রতিশব্দ করলাম না। করলেও বা লাভ কী তাতে? দোষীই থাকব। তিনি আবার আগের মতো করে বাইক চালাতে লাগলেন।
তিনি অর্ধেক যেতেই আমি বলতে লাগলাম, "ফুফার কাছে নিশ্চয় শুনেছেন, রাতে আমি বেশি উত্তেজিত হয়ে ঘুমালে অর্ধরাতে বেড থেকে নিচের ফ্লোরে পড়ে যাই। আমি ফুফাকে এসব কথা অনেক আগেই শেয়ার করেছিলাম। তিনি অনেককেই বলে বেড়িয়েছিলেন।
ওইদিনটা ঠিক অমনই হয়েছিল। আমি ঘুমের ঘোরে পড়ে যাওয়ার সময় পাশে টেবিল থাকায় হাতসহ কিছু কিছু জায়গায় আঁচড় লেগেছিল। পরদিন ফুফার মাথায় তেল মালিশ করার সময় ফুফা ওই আঁচড়গুলো দেখলেন। আর এর একটু আগেই যখন তিনি জানতে পেরেছিলেন, ফুফির আমাকে রেখে বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা, তখনই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সেরাত আমি আর আপনি বাসায় একাই ছিলাম কিনা। আমি হ্যাঁ-বোধক উত্তর দিয়েছিলাম। এরপর ফুফা আমাকে আর কোনো কথা না বলে উঠে চলে গেলেন। এসব শোনার পরও যদি আপনার মনে হয় যে, আপনার সাথে ঘটা ঘটনার জন্য আমি দায়ী, তবে আপনি ভুল করছেন। আর পরশু আমরা একে অপরের সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর কুশল বিনিময় করিনি দেখে মুক্তা ভেবেছে আমাদের মাঝে কোনো ঝগড়া বেধেছে প্রতিবারের মতো। ওইজন্যই হয়তো এভাবে আমাকে আর আপনাকে একসাথে সময় কাটানোর জন্য প্ল্যান করেছে। অথচ আমি জানতাম না ওর প্ল্যানের কথা।
আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। সবসময়ই ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যায়। আর আপনারও এভাবে পুরো ঘটনা না জেনে আমাকে অহেতুক অপমান করাটা, সেদিনের তুই-তোকারি করে কথা বলাটা সাঝেনি।"
এ পর্যন্ত বলে নিশ্চুপ রইলাম। শেষের সামান্য মিথ্যেটা বলার দায়ে নিজেকেই ধিক্কার জানাতে লাগলাম। সত্য বলে দিলে তো রক্ষা নেই। তিনি নিজের মতো করে বাইক চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিছুদূরে বাইকটা আবার থামালেন। জিজ্ঞেস করলেন, "আইসক্রিম খাবে?"
আমি এবারও সায় দিইনি। তা দেখে তিনি আমায় জোর করে নামিয়ে নিয়ে গেলেন। আমার প্রিয় ফ্লেভারের আইসক্রিমটা নিয়ে দিলেন।
ভেবেছিলাম বিগত সময়ে বলা কথাগুলো নিয়ে তিনি আমাকে অনেক ঝাড়বেন। অহেতুক বকবেন, যেমনটা প্রতিবার করেন। কিন্তু এবার মৌন রইলেন। আমার বলা কথাগুলোর কোনো প্রতিক্রিয়া পেলাম না। কিন্তু তবু আশঙ্কা রয়ে গেল, এখন যে বকাটা পাইনি তা নিশ্চয় পরে পাওনা হিসেবে আদায় করে দেবেন। সে আশঙ্কা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
এসেই মুক্তার কাছে ওই কাণ্ডের জন্য প্রতিবাদ করলাম। সে বলল, "সরি, আসলে আমি তোদের মাঝের ভুল বোঝাবুঝিটা ঠিক করার জন্যই ওইরূপ বোকামো প্ল্যান করেছিলাম। ভাবা উচিত ছিল, হিতে বিপরীত হয়ে গেলে তোর রক্ষা নেই। স্যরি রে।
আমি চেয়েছিলাম কী জানিস? আমার ভাইদুটোর স্ত্রীগুলো যেন আমার বান্ধবীসরূপ হয়। কিন্তু দেখা গেল, বড় ভাইয়া নিজের জন্য মেয়ে নিজেই পছন্দ করে রেখেছেন। ওখানে আমার পছন্দের বিষয়টা আর উঠল না। আর বড় ভাবীকে দেখে মনে হয় না, তিনি তাঁর ননদকে নিজের বান্ধবীর মতো করে দেখবেন। তবে দেখ, ছোট ভাইয়ারটা আমার হাতের মুঠোয় আছে। মানে ভাইয়া তো জানিস, মেয়েদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন। আর তাঁর কোনো পছন্দের মেয়ে নেই। সেই হিসেবে ছোট ভাবীর সিলেকশন'টা আমার নিজের হাতের মুঠোয়। তো ভাবলাম, পর কোনো মেয়েকে ছোট ভাবী হিসেবে আনলে তাঁর সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ার সম্ভাবনাটুকু তো দিতে পারব না। তোর ডায়েরি পড়ে ভাবলাম, তার চেয়ে বরং আপন বান্ধবীকেই আরও আপন করে নিই। কিন্তু যার সাথে তোর সেটিং করতে চেয়েছিলাম, সেই উল্টো তোর উপর নারাজ হয়ে গেল। ধুর!"
মুক্তা নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। আমি তখন মুচকি হাসছিলাম।
"কিরে, হাসছিস কেন?"
"হিতে বিপরীত হয়েছে কিনা তা জানি না, তবে বিপরীত না হওয়ার সম্ভাবনাও অনেকটুকু।"
"মানে? মানে? কী হয়েছে আমায় বল না।" উত্তেজিত হয়ে উঠল মুক্তা।
"তোর বোকামোর কারণে তার সাথে কথা একটু বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। সে সুযোগে মনের সব অভিমান উজাড় করে দিয়েছিলাম। কথাগুলো এমন করুণভাবে বলেছিলাম যে, তিনি কোনো উল্টো প্রতিক্রিয়া দেননি। সাধারণত আমাদের মাঝে যতবারই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, ততবারই তিনি আমার সাফাইয়ের কোনো গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এবার গুরুত্ব দেননি, এমনটা বলতে পারব না। কারণ ওসব কথা শোনেও তিনি চুপচাপ ছিলেন। তার মানে একটু আন্দাজ করা যায়, হিতে বিপরীত হয়নি।"
"সর্বেসর্বা।" মুক্তার কণ্ঠ উত্তেজিত শুনাল, "কিন্তু তোদের বিয়ের ব্যাপারে কারও সাথে কী কথা বলব? জানিস তো, মা তোকে ওই ঘটনার পর থেকে তেমন একটা পছন্দ করেন না। আর বাবার সাথে আমার তেমন ভালো হাবভাব নেই, যতটা না তোর সাথে আছে। আর মায়া আপুকে তো চিনিসই, একঘেয়েমিপনা ভরে আছে। ও তো কেবল সর্বক্ষণ নিজ স্বার্থের কথাই ভাবে। সে বড় মেয়ে বিধায় সে না হয় কথাটা পেড়ে দেখতে পারত। কিন্তু কারও জীবন নিয়ে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। তাই তার কাছ থেকে কিছুই আশা করা যায় না। এমনও হতে পারে, এই বিষয়টা জেনে ও আমাদের বিপক্ষতা করতে পারে। অন্য কিছু করার জন্য ভাবতে হবে।"
"তুই টেনশন করিস না। আমার ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবে।"
ডায়েরিতে লিখতে লিখতে রাত অর্ধেক যে পেরিয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। এখন আর ডায়েরি লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বরং ঘুমিয়েই পড়ি।
.
.
কলিং বেলটা বেজে উঠল। বুয়া গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। বাসায় এসময় মিহিরের আসার কথা নয়। নিশ্চয় মুক্তা। রুমের দিকে কেউ একজনের হেঁটে আসার শব্দ পেয়ে সামিরা তড়িঘড়ি করে ডায়েরিটা বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলল। বসে থাকার ভান করে রইল।
মুক্তা এসে পাশে বসতেই জিজ্ঞেস করল, "কিরে, কেমন আছিস?"
"ভালো।"
"শুধুই ভালো? আর আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবি না?"
"কেমন আছ?"
"জিজ্ঞেস করার পরই? আমিও ভালো আছি। আচ্ছা, বল, তোর কি কোনো বন্ধুবান্ধব নেই?"
সামিরা মাথা এপাশ-ওপাশ করে ঝাঁকাল।
"বন্ধুবান্ধব থাকলে মানুষ হাসতে খেলতে শেখে। তুই তো সারাক্ষণ একঘেয়েমিভাবে বসে থাকিস। তোর মনে কী চলে রে সামিরা? কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাতে পারিস।"
"কোনো সমস্যা নেই।" ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলো সামিরা, "মুক্তা, তুমি যাও এখান থেকে। আমি পড়ব এখন। গল্প পড়ব।"
"আহা...এই মেয়েকে নিয়ে আমি আর পারলাম না। বড়দের নাম ধরে ডাকতে নেই। তোর বয়স বারো চলে এখন। তবুও তুই শিখলি না? আর কখনও আমায় নাম ধরে ডাকবি না। ফুফি ডাকবি আমাকে।"
"ফুফিরা ভালো না।"
"কে বলেছে তোকে?" কিঞ্চিত বিস্মিত হয় মুক্তা, "কে বলেছে তোকে এ কথা?"
"কেউই বলেনি। ধারণা করেছি। তুমি এখন যাও। আমার কথা বলার মোড নেই।"
মুক্তা জানে সামিরা তার মায়ের মতোই হয়েছে। সহজে অন্তর্নিহিত কোনো কথা বের করানো যায় না। আগে সামিরাকে যাও ঠিক লাগত। এখন অতিরিক্ত মৌনতায় ডুবে গিয়েছে সে। কী নিয়ে ভাবে সারাক্ষণ? কার কথা ভাবে? ভাইয়াই হয়তো জবাব দিতে পারবে।
মুক্তা প্রতিবার এলে মিহিরের সাথে তেমন একটা দেখা হয় না। মিহির সাধারণত নিজেকে ব্যস্ত রাখতে সকাল অফিসে চলে গেলে আর ফিরে আসে না। গভীর রাত অবধি বাসায়ই ফেরে না। তাই মুক্তা রয়ে গেল। সাথে পনেরো বছর বয়সী বড় মেয়ে রাফাকে নিয়ে এসেছে। হুজুগে মুক্তা বেশ কয়েকবার রাফাকে সামিরার রুমে পাঠাতে চেয়েছিল বন্ধুত্ব করানোর জন্য, যেমনটা প্রতিবার চেষ্টা করে। কিন্তু সামিরা দরজা ভেতর থেকে ভেজিয়ে রেখেছে। নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে তাই কথাও বলছে না। রাত অবধি মিহিরের জন্য অপেক্ষা করল মুক্তা।
মিহির ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার টেবিলে চলে গেল। মুক্তাও এসে বসল।
"ভাইয়া, কেমন আছ?"
"ভালো।"
"তোমাকেও দেখি সামিরার রোগে পেয়েছে।"
"ও কিছু না।" কিঞ্চিত হাসার চেষ্টা করে মিহির বলল, "দুজনেই যে একই ছাদের নিচে থাকি। অভ্যাস একটু-আধটু বিনিময় হওয়ারই কথা।"
"তাহলে অন্য কারো স্বভাব সামিরার কাছে বিনিময় হয় না কেন?"
"তা জানি না।"
"আচ্ছা, ও তোমাকেও কি নাম ধরে ডাকে?"
"ও তো আমাকে ডাকেই না।" খেতে খেতে বলল মিহির, "ওর কাছে কখনও আমার প্রয়োজন হয়নি। তবে বুয়া কখনও আমার কথা বললে সে আমাকে মিহির বলেই সম্বোধন করতে শুনেছি।"
"ও কি কখনও তোমাকে বাবা বলে ডাকবে না?"
"জানি না।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহির বলল, "অতিরিক্ত প্রত্যাশা খুব ভয়ংকরী। ওসবের প্রত্যাশা করি না। যেমনটা চলছে, তেমনই চলুক।"
"মেয়েটা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আমার খুব চিন্তা হয় ওর জন্য। রাফাকে যতবার নিয়ে আসি, ততবারই বলে রাখি ওর সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে। কিন্তু সে অতিরিক্ত বন্ধুত্ব ভালো না বলে উড়িয়ে দেয়।"
"ও একা থাকতে চাইলে কিছু করার নেই।"
মিহির যদিও বা কথাগুলো সরলভাবে বলে দিয়েছে, সে জানে তার মন আজও সামিরার মুখে বাবা ডাক শোনার প্রত্যাশায় জেগে আছে।
.
সামিরা আজ ডায়েরি না পড়েই বিরক্তির সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে যে নিষ্ক্রিয় থাকতে চায়, তা কেউ বুঝে না। দিন কয়েক মুক্তা বাসায় থাকায় সে ডায়েরি পড়েনি। মুক্তা যাওয়ার পর একদিন ডায়েরি নিয়ে বসল। বেশ কয়েক পৃষ্ঠা ঘেঁটে সামিরা সাবিহার বিষণ্ণ মনের নানান কথার মালা দেখে। লেখা আছে, কীভাবে সে বিয়ের পর বাসায় ফিরে আসার পর থেকে মিহিরের খেয়ালে সবটে সময় দগ্ধ ছিল। বেশ কয়েক পৃষ্ঠা পর সামিরা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
বাসায় আজ ফুফা এসেছে। সাথে মিহির ভাইয়াও। আজ অনেক বছর পর মিহির ভাইয়া আমাদের বাসায় এসেছেন। এভাবে হঠাৎই আজ কোন কারণে আসা হলো তাঁদের? আমি গিয়ে দরজার কোণ ঘেঁষে লুকিয়ে তাঁদের একটু-আধটু দেখছিলাম। বাবারা কী কথাবার্তা বলছেন তা কিছুই বুঝছি না। আর বাবাই বলে রেখেছেন, বড়রা কথাবার্তা বললে ওখানে যেন না যাই, আমি যত বড় হই না কেন। লুকিয়ে বিশেষ কিছু দেখতে পারছিলাম না। খানিকটা বেরুতেই মিহির ভাইয়ার নজরে পড়ে গেলাম। সাথে সাথেই দরজার কোণে লুকিয়ে পড়ি। খানিক পর আরেকটু উঁকি দিয়ে দেখি ভাইয়া রাগে কটমট করছেন। আমাকে দেখেই রাগছেন। একি! আমি কি আবার তার সাথে কোনো গণ্ডগোল করে ফেলেছি? তড়িঘড়ি করে চলে এলাম। মাথায় হাত ঠেকিয়ে ডায়েরিতে লিখছি। বাহিরে সকলের সমাগম। কী হচ্ছে কিছুই বুঝছি না।
ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেলে বাহিরের নিস্তব্ধতার আভাস পেলাম। সবাই চলে গিয়েছে ভেবে আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হই। এহেন সময় আমার আর বাইরে যেতে হয়নি। বাবা নিজেই আমার রুমে প্রবেশ করলেন। বাবাকে নিয়ে আমার একটা সমস্যা, তাঁর অন্তরে কী চলে তা সহজেই বুঝি না। তাঁর অনুভূতির ভাবমূর্তি তাঁর চেহারায় সহজেই প্রকাশ পায় না। রেগে আছেন নাকি খুশিতে মেতে উঠেছেন কিছুই বুঝছি না। তিনি আমার টেবিলের সামনে এসে একটা চেয়ার বসার জন্য টেনে নিলেন। তাঁর সাথে সাথে আমিও বসে পড়লাম। বুকটা কেবল দুরুদুরু করছিল। এই যেন ফুফার নালিশ না শোনায়। করেছিও বা কী? আমার তো এমন কিছু মনে নেই যে, আমি আবারও কোনো গোলমাল পাকিয়েছি মিহির ভাইয়ার সাথে।
বাবা বললেন, "মা, তোর বিয়ের বয়স আগেই হয়েছে। তোর ভাগ্য খারাপ হওয়ায় তোর সম্বন্ধটা খারাপ পড়েছিল। ওই কারণে তোর মনের অবস্থা বুঝে আমি মাস খানেক তোর সাথে বিয়ের সম্বন্ধে কিছুই বলিনি।"
এমা, খাইছে! আবার বিয়ে? গত বিয়েটি থেকে রেহাই পেয়ে কত ফুর্তিতেই না ছিলাম। এখন আবার বিয়ের কথা তুলছেন? এইবার নিশ্চিত আমার রেহাই নেই।
"তুই তো জানিস, তোর জন্য আমি এমন বর চাই, যে তোকে খুব সুখে রাখবে।" বাবা বলছিলেন, "ধনীর কোনো ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা। আল্লাহ্ আমার মনোবাসনা পূরণ করেছেন। তোর জন্য পেয়েছি এমন একজন।"
মুহূর্তেই হৃদস্পন্দন আমার হুট করে বেড়ে গেল। একটু আগে ফুফারা এসেছিলেন। সম্ভবত কোনো একটা সম্বন্ধ নিয়ে। তার মানে..
"তোর ফুফা তোর জন্য মিহিরের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলেন।" তিনি বললেন, "তোর সাথে মিহিরের বিয়ে দিতে চান।"
আমার হৃদস্পন্দন কমে গেল। আমি শীতল হয়ে গেলাম। মন-দেমাক আমার হয়তো সবই অসার হয়ে পড়ে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এ কী শুনলাম?
"তোর আর মিহিরের মাঝের ঝগড়া-ঝাঁটিগুলোর সম্বন্ধে আমি আগে মুক্তার কাছে অনেকবার শুনেছি।" বাবা বললেন, "হয়তো তোরা একে অপরকে পছন্দ করিস না। এডজাস্ট করে নিবি! একবার বিয়ে হয়ে গেলে সবই ঠিক হয়ে যাবে। তোর আর মিহিরের মাঝের ভুল বোঝাবুঝিগুলোও ঠিক হয়ে যাবে। মিহির ভালো একটা ছেলে। একটু কম কথা বলে এই যা। স্বভাবে যে অনেক নম্র, এ কারণে ছেলেটিকে আমার খুব ভালো লাগে। আর আমার পছন্দ মানে তোর পছন্দ। তবু তোর মত বল।"
কোনোকিছুতে আমার দ্বিধাবোধ করলে কানের সামনের চুলগুলো হাত দিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেওয়া আমার স্বভাব। তখনও আপনা থেকে এমনটা করেছিলাম। বাবা মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমি বিস্মিত রয়ে গেলাম। গালে হাত ঠেকিয়ে কী সব হয়ে গেল তার চিন্তায় মশগুল। তখনই কে যেন আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। ভ্রমের দেশ থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম মুক্তা আমাকে জড়িয়ে ধরে মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। বলছে, "কিরে, কেমন খেলেছিরে? এখন তোকে আমার ভাবী হতে কেউ বাধা দিতে পারবে না।"
"এসব তুই করেছিস?"
"হ্যাঁ, তাই নয় কি?" মুক্তা আমার চেয়ারের পেছনের ক্ষুদ্রাংশে বসে বলল, "সে কতগুলোই না রুটি বেলেছি।"
"কয়টা? আর কীভাবে?" জবুথবু হয়ে বসে পেছনের দিকে তাকিয়ে বললাম, "মিহির ভাইয়াকে রাগে ফুঁসতে দেখেছি আমি। কী এমন করেছিস? আমার গলায় ফান্দা দেওয়ার পরিকল্পনা করছিস না তো?"
"আরে না, তেমন কিছু হবে না। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ছোট ভাইয়া হয়তো এখন কিঞ্চিত রেগে আছেন। রেগে হয়তো অগ্নিশর্মাও হয়েছেন। তবে চিন্তা করিস না। বিয়েটা হওয়ার পর বলে দিস যে, সব হট্টগোল আমিই করেছি।"
"কী করেছিস তা তো বল?"
"শোন, আমি পরশু বাসায় আমার জানপাখিটাকে নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছি, অনেক হয়েছে অপেক্ষা। এখন কিছু একটা করার সময় চলে এসেছে। ছোট ভাইয়ার বিয়ে দেখার পালা এসেছে। আমি একটা প্ল্যান করলাম। কাল ভাইয়া তোর দুলাভাইয়ের সাথে কাজে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় ওঁকে একটা লিপস্টিক দিয়ে রেখেছিলাম এবং পুরো প্ল্যানিংটা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। সেই মোতাবেক তিনি ভাইয়াকে জোর করে একটা টেইলরের দোকানে নিয়ে গেলেন, ভাইয়ার জন্য একটি জামা বানাতে দিয়েছেন জানিয়ে। আর তাঁর পাগলামোর সম্বন্ধে ভাইয়া অনেক আগে থেকেই অবগত আছে। ভাইয়া তাঁকে বোঝালো, 'পাঞ্জাবি কেনে দেওয়ার এতই যখন ইচ্ছা, একটা রেডিমেড কিনে দিন। এতোগুলো মাপজোখ করে পাঞ্জাবি সেলানোর কী দরকার? আমার অন্য কোনো পাঞ্জাবির সাইজও তো নিতে পারতেন।' তিনি ভাইয়ার একটা কথাও না শোনে টেইলরকে মাপ নিতে বললেন। আমার কথামতো তিনি ভাইয়ার অজ্ঞাতসারে টেইলরের এক হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির নিচের ভাগে পাশের খাঁজের সাথে মিশিয়ে লিপস্টিক লাগিয়ে দিলেন এবং বললেন, সুযোগে ভাইয়ার গলার আশেপাশে লিপস্টিকের ছাপটি বসিয়ে দিতে। তারপর টেইলরকে দিয়ে তোর ভাইয়া ইশারা করে ছাপটি বসিয়ে নিলেন। প্ল্যান এভাবেই অর্ধেক সফল হয়েছে। প্ল্যান মোতাবেক তিনি আসার সময় ভাইয়াকে একাই বাসায় ফিরতে বলে নিজ কাজে চলে গেলেন। ভাইয়া একা ফিরে এলো। হলরুমের সোফায় আমি আর বাবা বসেছিলাম। ভাইয়ার মুখের সঠিক জায়গায় ছাপটা বসিয়েছে দেখে আমি আমার জানপাখিকে শত শাবাশি দিতে লাগলাম।"
"রাখ, তুই আর তোর জানপাখি। এতো অবিচার তাঁর সাথে? তারপর কী শয়তানি করেছিস বল।"
"আমি ওটা দেখেও না দেখার ভান করে রইলাম। বাবা হঠাৎ নিউজপেপার ফেলে ভাইয়ার পেছনে তার রুমে চলে গেলেন। আমি সোফা থেকেই দেখছিলাম, ভাইয়া হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবা বললেন, 'তোর সাথে কথা আছে।' এরপর দরজা বেঁধে দিলেন। আমি গিয়ে দরজার সাথে কান লাগালাম। শুনতে পাচ্ছিলাম, বাবা বলছিলেন, 'তোর গলার পাশে লালরঙের এসব কিসের দাগ?'
'কোথায়?'
'এই যে তোর গলায় লিপস্টিকের মতো?'
'লিপস্টিক?', ভাইয়া প্রায় চিৎকার করে উঠল।
'বাইরে কী করে এসেছিস?'
'আমি আবার কী করে আসব?'
'তোকে কি আমি চিনি না? তুই বাহিরে গিয়ে ইটিস-পিটিস করবি আর বাসায় এসে মিথ্যা বলবি, এই যে তোর স্বভাব।'
এভাবে বাবা আর ভাইয়ার মধ্যে কথোপকথন হচ্ছিল। শেষের দিকে বললেন, 'তোর এসব কাণ্ডসাজীর কারণে লজ্জায় সবার সামনে আমার মাথা নিচু হবে। এখন তোকে বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।'
ভাইয়াও বেশ তর্ক করলেন। তবে বাবা নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন। আমি ভেবেছিলাম, সুযোগের দুর্ব্যবহার করে বাবার দেমাকে ভাইয়ার বিয়ে দেওয়ার খেয়ালটা ঢুকাব। কিন্তু আমার কিছুই করতে হয়নি। বাবা যখন রুম থেকে বেরুচ্ছিলেন, তখন আমাকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, 'কী শুনছিস?'
ভাইয়া তখন ওয়াশরুমে যাচ্ছিল দেখে সময় থাকতে বাবাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে বললাম, 'আপনিও কি ওদের কথা জেনে ফেলেছেন?'
'মানে? কাদের কথা?'
'এই যে ছোট ভাইয়া আর সাবিহার কথা?'
'বুঝিনি আমি..'
'বাবা, আমি যখন ওদের একসাথে দেখা করার কথা শুনেছিলাম তখনই ভেবে ফেলেছি, ভাইয়া যা করছে না আপনার চোখকেও বেশিদিন এড়াবে না।"
'কী বলছিস? ক্লিয়ারলি বল।'
'তিনি একটু আগে আমাকে কল করে বলেছিলেন, আজও ভাইয়াকে সাবিহার সাথে রেস্টুরেন্টে দেখেছিলেন। দুজন কেমন স্বাভাবিকভাবে প্রেমালাপ করছিল। এই শোনে আমার কেবল সন্দেহ হয়েছে। এখন বাস্তবেই দেখি সাবিহার সাথে ভাইয়ার..'
'চুপ, আরেকটা কথা বলবি না। যা সামনে থেকে।' ফিসফিসিয়ে ধমকের সুরে বললেন।
ভাইয়া ওয়াশরুম থেকে বেরুচ্ছে দেখে আমি বেরিয়ে পড়লাম। তারপর বাবার মাথায় ঢোকালাম, তোদের এসব কাণ্ড বেশিদিন চললে সমাজে আমাদের দুর্নাম হবে। তার চেয়ে বরং তোদেরকে যেন এক করে দেয়। বাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে রুমে চলে গেলেন। রাতের খাবার শেষে ভাইয়াকে হুকুম দিয়ে এলেন, ভাইয়াকে তোর সাথে শিগগিরই বিয়ে করতে হবে। অতঃপর আজ মামাদের সাথে কথা বলে গেলেন। কিন্তু তিনি তোদের ওইসব কাণ্ডকারখানার কথা বলেননি মামাকে। হি হি হি।"
আমি উঠে মুক্তাকে এলোপাথাড়ি পেটাতে লাগলাম। ফুফা এখন কী ভাববেন আমার সম্বন্ধে? আমাকে কত ভালই না বাসতেন তিনি! এখন মিহির ভাইয়াকেও বা কীভাবে শাসিয়েছেন। তাকে পিঠিয়ে ক্ষান্ত হলাম। ও হেসে বলল, "বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে বাবা। সত্য কথাগুলো বেরুতে দেরি লাগবে না। তুই কেবল বিয়ের প্রস্তুতি নে।"
"আচ্ছা, ওই পাগলাটে ট্রিক'টা কোত্থেকে পেয়েছিস?"
"একবার একটা টিভি শো'তে দেখেছিলাম লিপস্টিক ঠোঁটের আকারে লাগানোর ধরনটা।"
"আমার না খুব ভয় করছে। সবকিছুর জন্য তিনি আমাকেই যে ঝাড়বেন।"
"আরে এতো টেনশন নিস না তো। ঠিক হয়ে যাবে।"
আজরাত মুক্তা এখানেই থেকে গেল। ফুফারা পুনরায় এসে বিয়ের কথা পাক্কা করে যাবেন।
সবশেষে ডায়েরি নামের একমাত্র বন্ধুটির কাছে সব কথা শেয়ার করতে বসলাম। এতদিনের প্রত্যাশা আমার পূরণ হতে চলেছে। তবে কোথাও যেন ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। তাঁকে এভাবে জোরপূর্বক আপন করার তো মানে হয় না।
দরজার ওপাশে কোনো পুরুষালি গলার আওয়াজ পেয়ে সামিরা ডায়েরি লুকিয়ে ফেলল। নিশ্চয় মিহির কথা বলছে। একটু পর রুমে সামিরার জন্য খাবার হাতে বুয়া এসে ঢুকলেন। সামিরা জিজ্ঞেস করল, "কী বলছিল মিহির?"
"আপনের বাবা আইজ রাইত আফিস থেইক্যা আয়তে পারবেন না। আমারে সবসময় তোমাগো আশেপাশে থাকতে কইতেছিলেন।"
"আপনাকে বারবার বলি তাঁকে আমার বাবা বলবেন না।"
"অমন বলতি নাই। ওঁ তোমার জন্মদাতা। তুমি নিজ সন্তান বইল্যা দেশের বাড়িঘর ছাইড়া তোমারে নিয়া এখানে চলি আয়ছেন। তোমাগো দেখভাল করবার জন্য আমারেও নিয়া আয়ছেন। তোমার লালনপালনে কোনো কমতি রাখতেছে নি? ডাকবে না কেন বাবা?"
"তিনি যদি সত্যিই আমার চিন্তা করতেন, তবে মা'কে দেশে ফেলে চলে আসতেন না। সর্বদা আমার সাথে রাখতেন।"
বুয়া তাঁর চোখগুলো বড় বড় করলেন, "তুমি ওরে মা ডাকলে?"
"কেন? কোনো সমস্যা?"
"না," জয়ের হাসি হেসে বুয়া বললেন, "এই প্রথম দেখলাম, তুমি কেউ একজনের নাম না ধইরা তারে মা বলি ডাকছ।"
"আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?" একদিকে চেয়ে থেকে সামিরা প্রশ্ন করল, "তিনি কোথায় আছেন? কেমন আছেন?"
বুয়ার চোখ ছলছল করে উঠল। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন তার দিকে। এরপর মাথায় তাঁর হাত বুলিয়ে বললেন, "আমি চিনি সামিরা মা'কে। তোমার বাবাগো কইছিলাম, সামিরা মায়ের একটা মন আছে। তার ভেতর সুখ-দুঃখও আছে। কিন্তু তোমাগো ফুফিরা কয়, তুমি অন্য সবার কাছ থিকা আলাদা। তোমার মইধ্যে মন নেই।"
সামিরা কথাগুলো শুনল না। বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বসে রইল।
"আছে, তোমাগো মা ভালা আছে।"
"থাকেন কোথায়?"
"নিজ বাড়িতে।"
"আমার খোঁজ-খবর নেন না?"
"কেন নিবে না? তোমাগো ফুফির সাথে তো যোগাযোগ রাখছেন। তুমি তো ফুফির সাথে কথাও কও না। তাই ফুফি তোমারে কিছু কয় না।"
সামিরা দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল। বুয়া মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ালেন। এখনও তিনি হতভম্ব। এতবছর যাবৎ তিনি সামিরার সাথে আছেন, সামিরা কখনও কারও কথা জিজ্ঞেস করেনি। এই প্রথম তার মায়ের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছে, তাও হুট করেই। সামিরা ঘুমে তলিয়ে গেলে তিনি লাইট বন্ধ করে দিলেন।
ডায়েরি থেকে।
এখন আমাকে বউ সাজে তাঁর রুমে বসিয়ে গেছে মুক্তা ও মায়া আপুরা। এই কয়েকদিন বিয়ের চাপে বলতে গেলে ডায়েরিটা ধরাই হয়নি। এইমাত্র বসলাম। ভয়ে কাঁপছি আমি। কী হতে চলেছে? নিশ্চয় তিনি আজ খুব বকা দেবেন আমায়। কারও হেঁটে আসার শব্দ হচ্ছে। নিশ্চয় তিনি আসছেন।
কালরাত তিনি আসার সাথে সাথে ডায়েরি লুকিয়ে ফেলেছিলাম। তাঁর চোখের সাথে আমার চোখ একবারও মিলেনি। এসে তিনি কাপড় বদলিয়ে আস্ত পাশে শুয়ে পড়লেন। আমার না বকা শোনার কথা? নাকি এসব তুফানের আগের নীরবতা?
দিন কয়েকটা কেটে গিয়েছে আমার বিয়ের। এখনও আমরা অপরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করি। তিনি আমার সাথে সেই থেকে নিয়ে একটুও কথা বলেননি। এমনকি বকাও দেননি। আমি বোকা বনে বসে। তাঁর মনে কী চলছে কিছুরই আভাস পাচ্ছি না।
তাঁর এই নীরবতাকে কিসের ইঙ্গিত ভেবে নেবো? আদৌ তিনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন? হ্যাঁ, নেহাতই হয়তো আমি অতিরিক্ত ভাবছি। সবই আমার ক্লান্ত মনের ভুল। যেখানে আমার কোনো দোষ নেই, বকা শোনার কোনো কারণ বেঁচে নেই ওখানে। তবু আমার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যেতে হবে তাঁর মৌনতা ভাঙানোর।
কী ভাবেন তিনি? কাউকে নিয়ে ঘৃণা পোষেন? কেউ কি তাকে ধোঁকা দিয়েছে? এতো মৌন কেন থাকেন তিনি? কিসের এতো দ্বিধা? সবের উত্তর আমায় জানতে হবে।
বেশ কয়েক পৃষ্টা পর।
মাস দুয়েক অতিবাহিত হয়েছে আমার বিয়ের। এখনও সেই জায়গায় আটকে আছি আমি। মুক্তা যতবারই এসেছে, ততবারই জিজ্ঞেস করেছে আমাদের মাঝে সবই ঠিক হয়েছে কিনা। আমি মুচকি হেসে নিজেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার ন্যায় বলতাম, হ্যাঁ, ঠিক আছে সবকিছু। কিন্তু আড়ালের কথা কেউ আদৌ জানে না। জানে না, আজ পর্যন্ত যে আমরা কখনও দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলিনি, জানে না কেউ আমরা পাশে থেকেও কাছে থাকি না। পাশে থেকেও দূরত্ব যেন বহু ক্রোশ। এও জানে না, একই জায়গায় থেকেও আমরা দুজন দুই ধরনের জীবের ন্যায় আচরণ করি। মাঝে-মধ্যে ভাবনার মাঝে উদ্যত হয়, কেন বিয়েটা করলাম একজনের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে? তারচেয়ে বরং যেভাবে চলছিল সেভাবেই সব থাকত। আজ দুটো জীবন অকারণে নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি আমাকে যতটা অপছন্দ করেন, অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে হয়তো ততটা করতেন না। হয়তো তখন তাঁর সংসারটা বেশিদূর অগোছালো থাকত না। সাংসারিক জীবনে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়তেন। তাঁকে বিয়ে করে এখনও আগের পথে থমকে আছি। তাঁর কোনো ভাবান্তর ঘটেনি বিয়ের মাধ্যমেও। বরং নির্জীবতা যেন ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। কাজ, কাজ, কাজ শেষে বাড়ি ফেরা, বাসার লোকের সাথে কুশল একটু-আধটু বিনিময় করা, আবারও কাজ, ঘরে কাজ, বাহিরে কাজ। বিয়ে যেন আমাকে করেননি, এই কাজকেই করেছেন। আবার অনেক সময় বোধ হয়, এই বুঝি কাজ করার বাহানা করছেন, নয়তো নিজেকে ব্যস্ত রাখার ফন্দি এঁটেছেন।
দিন-দিন তিক্ততা আমার মাঝে ভরে উঠছে। এই যেন গর্জে উঠে না বলে দিই, কী হয়েছে আপনার? এতো ভাব কেন দেখান? আমি কোনো ভুল করেছি? করলে আমায় মারুন, পিটুন। কিন্তু এভাবে আমি আপনার এই মৌনতাকে মোটেও সহ্য করতে পারছি না। দোহাই লাগি আপনার, এই মৌনতাকে ভাঙুন। কিন্তু সহসা সামান্য বুলিও উনার সামনে বের করতে পারি না।
আমার ভাগ্যের চালবাজি, মুক্তা আমার অনুপস্থিতিতে আমার ডায়েরিটি সকালে আবার দেখে ফেলেছে। গতবার দেখেছে বলে সে নানা ফন্দি করে আমার জীবনকে অজান্তেই নরকের দিকে ধাবিত করেছে, মিহিরের সাথে বিয়ে দিয়েছে। এবারও দেখেছে আর পড়েছে অনেক কিছুই। না জানি আবার কী করে বসবে সে। এতক্ষণে হয়তো জেনে ফেলেছে এতদিন তাকে আমি মিথ্যে বলে এসেছি। একবার যেই ঢুকেছে তার মাথায়, আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কিছুই ঠিক নেই, তবে কিছু একটা করেই ছাড়বে। আসলে ওর মনোভাবনাও খারাপ নয়। শতবার বলেছে, আমার কারণে আজ সে এতো ভালো একটা স্বামী আর সংসার পেয়েছে। বলতে গেলে তখন থেকেই সে আমাকে আরও বেশি ভালোবাসতে শুরু করেছে। এবং সেই ভালোবাসার খাতিরে আমার চাওয়া-পাওয়াকেও অত্যধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।
আজ সকাল উনি বাসায় না থাকায় বসে ডায়েরিতে একটু লিখছিলাম। কোন খেয়ালের মোহে পড়ে খামখেয়ালি হয়ে ডায়েরিটি ওখানেই রেখে কাজ করতে চলে যাই। ব্যস, মুক্তা আমার সাথে কথা বলতে এসে ডায়েরির বর্তমান অংশ পড়ে ফেলল। মিথ্যা বলার দায়ে সে এখনও অবধি আমার সাথে কথা বলেনি। বরং আমি কথা বলতে গেলেও আমাকে ইগনোর করেছে।
আরও বেশ কয়েক পৃষ্টা পর।
কত চেষ্টা, কত প্রতীক্ষার প্রহর গুণেও কিছুই হয়নি। চোখের পলকেই যেন বিয়ের একটা বছর কেটে গিয়েছে। ফুফা বিয়ের শুরুতে আমার সঙ্গে আগের ন্যায় কথাবার্তা বলতেন না। কিছু মাস গত হলে তিনি আমাকে বুঝতে পেরে আবার আগের মতো করে তিনি মাথায় তেল মালিশ করতে আমায় ডাকেন। প্রথমবারের মতো তাঁর মুখে বৌমা ডাক শুনলাম তখনই। কেননা মুক্তা সব উগলে দিয়েছে। কীভাবে, কী ফন্দি রটিয়ে সে যে আমার আর মিহিরের বিয়ে করিয়েছে তার সবেরই স্বীকারোক্তি করেছে। নিষেধ করেছিলাম এমনটা করতে। এখন সে এক মেয়ের জননী, ওই বিষয়গুলো তুললে ফুফার প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে ওর ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কারণ ফুফার প্রতিক্রিয়া দু'ধরনের হতে পারত। এক. তিনি সবকিছু মেনে নেবেন, হেসে উড়িয়ে দেবেন নয়তো দুই. মুক্তার সাথে এই নিয়ে নারাজ হবেন। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই হয়েছে। কেননা তিনি মুক্তার এসব কাজে আমাকে আর মিহিরকে খুব ভুল বুঝেছিলেন। মুক্তাকে অপ্রকাশ্যে অনেক বকা দিয়েছেন। ফুটফুটে কচি রাফাকে নিয়ে সেই যে সে চলে গিয়েছে, আর একটিবারও আমাদের দেখতে মুক্তা আসেনি। সব অভিমানেরই যে খেলা। ফুফাকে বাবা বলে ডাকার অধিকার পাওয়ার পর তাঁকে বুঝাই, ওসবের আড়ালে থাকা আমার প্রতি মুক্তার ভালোবাসার কথা। সব জেনে বাবা নিজেই মুক্তার কাছে গেলেন। তবু তার অভিমান স্বল্প পরিমাণও গলেনি। আমিও যে কম বুঝিয়েছি তা নয়। তবে এই অভিমান বেশিদিন স্থায়ী থাকবে না তার। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসি তাকে, পিচ্চি রাফাকেও। তাকে দেখলেই যেন বুকটা খাঁ খাঁ করে। এই যেন কলিজাটি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে-আসবে অবস্থা। যে বাচ্চাদের এতোটা পছন্দ করে আজ তারই কিনা কোল শূন্য। যখনই তার বাসা থেকে ফিরতাম এই নিয়ে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে যেত। এসে তাঁকেই ঝাড়তাম। যেগুলো বলার ভয় করি সেগুলোই মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। কী হয়েছে আপনার? এতো কেন ভাব দেখান? কাজ তো আমিও করি। কী করেছি আমি? কী ভুল হয়েছে আমার দ্বারা? কেন আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন?
কাপড় গুছানোর সময় কিংবা অন্য কোনো কাজ করার সময় অনর্গল বকে যেতাম তিনি বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসলে, "আমার না.. ভালো লাগে না এসব। হয়তো আপনার মৌনতাকে ভাঙুন নয়তো আমাকেই পর করে দিন।" তিনি কিছু না বলে ল্যাপটপটা বন্ধ করে ধীরে ধীরে কোনো আওয়াজ ছাড়াই বেরিয়ে যেতেন, যেন আমি এযাবৎ এতো কথা কোনো পুতুলকে শুনিয়েছি। রাগ বেড়ে গেলে যখন তাঁকে একটু বেশিই শুনাই, তখন আমার গলা যেন কাটা পড়ে। কারণ তিনি চেঁচিয়ে উঠে নানা বকাবকি করতে থাকেন। একসময় কথা উঠে যেত তালাকের। কাজেই সেসময় আমার মুখ দিয়ে ভয়ে আর কোনো কথা বেরুত না এবং নিজ ভুল বুঝতে পেরে চুপসে যেতাম। কারণ ফুফা এখন আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে অনেকটা কৌতূহলজনক ধারণা রাখেন। আমাদের জুটি যেন সেরা জুটি। আগে কেন ভাবেনি আমাদের দুজনকে একসাথে কত ভালো মানাবে? ওই বাবাই যদি জানতে পারেন, আমাদের সম্পর্কটা যে এমন, একে অপরকে তালাক দিলেই রক্ষা, তবে রঙ করা জানালায় যেন অকালেই জঙ ধরবে।
আমার সংসারে যেন মরিচা ধরেছে। চাকচিক্য বলতে কিছু নেই-ই। দুজন যেন দুই জগতের লোক। একে অপরের সাথে নিঃসঙ্কোচে কথা বলতে যেন সহস্র দ্বিধা। কবে এক হব? কবে মিটবে সকল ব্যবধান? নাকি অচিরেই দূরত্ব হুট করেই বেড়ে যাবে?
মুক্তার মেয়ে রাফার জন্মের দেড় মাস গড়ালে আজ আমরা দুজন তাকে দেখতে গেলাম। মুক্তা অনেক মাস পর মিহিরকে নিজ বাসায় দেখে আহ্লাদে গদগদ করছিল। অন্তর্নিহিত কথা বলতে, তিনি যেতেই চাননি। অনেক জোর করাতেই রাজি হয়েছেন মুক্তার শ্বশুরবাড়ি যেতে। তাঁকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার পর মনে হলো, যেন মুক্তাকে নিয়ে তাঁর মনে চাপা একটা অভিমান কাজ করছে। কেবল আমিই না, মুক্তাও স্বয়ং খেয়াল করেছে। সারাদিন দুজনই লক্ষ করলাম, যে ভাই বয়সে ছয়-সাত বছর বড় হয়েও বোনকে সবসময় সমবয়সী বন্ধুর ন্যায় দেখেছে, আচরণ করেছে, আজ সে-ই মুক্তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। আমরা নিশ্চিত জানি বাবা আমাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবার পাত্র নন। আমরা যে কাণ্ডখানা করেছি তা বাবা না বললে মিহিরের জানার কথা নয়।
একসময় এ বিষয়ের খোলাসার জন্য মুক্তা মিহিরকে নির্জনে নিজ রুমে নিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তাঁর মনের অবস্থার কথা। তিনি তেমন কিছুই বলেননি। আমিও পাশে রাফাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মুক্তা জানতে চাইল, "ভাইয়া, কী চলছে তোমার মনে? আমি কি তোমার সাথে ভুল কিছু করেছি? তুমি আমার খোঁজখবর নাও না কেন? আসার পর থেকে একটুও ভালোভাবে কথা বলোনি। কী হয়েছে তোমার?"
"কই? কী আবার হবে? কখন তোর সাথে কথা বলিনি?"
"আমি বলেছি ভালোভাবে কথা বলোনি। একদম কথা বলোনি তা তো বলছি না। কিছু হয়েছে কি? বিয়ের পর থেকে আজ অবধি এই একবার এলে। নাকি কাজের চাপই বেড়ে গিয়েছে?"
"এমনিই আসা হয়নি।"
"ভাইয়া, তুমি আর সাবিহা, আমার অত্যন্ত খুব আপন দুজন। সহজেই বুঝে ফেলি তোমাদের মনের কথা। কিছু একটা নিয়ে বড্ড অভিমান করেছ। নচেৎ এরূপ অনীহা দেখাতে না।"
"আমার অনীহা করা বা না করা নিয়ে তোদের কী আসে যায়? আমি কি তোদের আপন কেউ হতে পারলাম কখনও?"
"বলছ কী?"
"হজম হয়নি নাকি?"
"তুমি কী বলবে পরিষ্কার করে বলো ভাইয়া।"
"পরিষ্কার সবকিছু উভয়ের সামনেই আছে। অপরিষ্কার কিছুই নেই। তুই যেটা জানিস, সেটা আমিও জানি। আমি যা জানি, তা আবার তুইও জানিস।"
"ভাইয়া, বলো তো কী নিয়ে অভিমান করেছ?"
"আমার মতো পর কেউ অভিমান করতে পারে নাকি? ও তো আপনেরাই করে। অধিকার আছে বলে কথা। এতো বড় ঘটনা ঘটে গেলেও আমাদের মতো পরদের কিছুই করার থাকে না।"
"কিসের ঘটনা?"
"তুই জানিস না? তুই না জানলে কী করে হয়? তুই আপন হয়েও এমনটা করলি, সাবিহার মতো পরকে তো সাইডেই রাখলাম।"
আমার নিশ্বাস ভারী হয়ে গেল। আমি জানতাম, তিনি আমাকে ঘৃণা করেন, এটা জানার ব্যথা তাও সওয়া যায়। কিন্তু স্বয়ং তাঁর মুখ থেকে শুনলে মনটাই পাংশুটে হয়ে যায়, ব্যথা দ্বিগুণে বেড়ে যায়।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
Tags:
Novel