সাফিও-১ মাইকেল এল্ট্রো (পর্ব ১)


চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক জায়গায় তার জন্ম। ফারাবী ছিল বাবার তিন সন্তানের মাঝে দ্বিতীয়। বেশ চঞ্চল ও সাহসী। ছোট থেকেই ভ্রমণ ও এ্যাডভেঞ্চার নিয়ে তার মন জুড়ে স্বপ্ন। জীবনে বেশ দুর্ধর্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের মুকাবেলা করে আসছে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় মা বাবাকে হারাতে হয়, তারপর থেকে বড় হয়েছে মামার কাছে। এসএসসির পর ফারাবী চট্টগ্রাম ফিরে গিয়ে চিটাগাং কলেজে ভর্তি হয়। ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার করে এ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্নে এইচএসসির পর অফিসার পদে যোগ দিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে। তবে ভাগ্যটা এতই খারাপ যে, সাব-লেফটেন্যান্ট থাকা অবস্থায় কোনো এক কারণে চাকরিটা চলে যায়। শখের চাকরিটা ছেড়ে আসতে চোখ ভিজে গেলেও ফারাবী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। মাথায় শুধু একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর জাহাজে সময় কাটানো হয়ে উঠবে না। তবে অভিযানের শখ তার পিছু ছাড়েনি। পুনরায় সব বাদ দিয়ে শুরু করলো অনার্সে লেখাপড়া। ভার্সিটিতে তার বন্ধু হয় কয়েকজন। সাবিহা, সানজু, সজীব ও আবিদ। সবাই মেধাবী হলেও এদের মাঝে মূলত ফারাবীই সবচেয়ে মেধাবী। তবে তাদের প্রত্যেকের জীবনের পেছনে লুকিয়ে আছে এক একটা আধারে ঘেরা উপন্যাস। সবাই হোস্টেলেই থাকতো। একসময় ফারাবীর মাথায় আসলো, তার বন্ধুদের দিয়ে একটি গোয়েন্দা দল বানালে মন্দ হয়না। কতসময় কত কেস হয়, সবকিছুর তদন্ত কি পুলিশ করে? তার উপর ফারাবী নৌবাহিনীতে ছিল, এসব বিষয়ে তার চেয়ে আগে ভার্সিটির কেউ নেই। বন্ধুদের বলতেই তারা রাজি হয়ে গেল। এসব বিষয়ে তাদেরও আগ্রহ অনেক। তাই এত সহজেই রাজি হয়ে যাওয়া। তারপর ফারাবীর দেওয়া নামে তৈরি হয়, সাফিও!
সেদিন আকাশ বেশ মেঘলা ছিল, যদিও বৃষ্টি পড়ছিল না। মুখ ভার করে করে কফির মগে চুমুক দিল ফারাবী। অসহায় কন্ঠে বলল, দেখুন এটা কিভাবে সম্ভব? একটা বন্ধ রুম যেখানে দরজা জানালা সব ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, কেউ ঢোকার পথ নেই। আর সেখান থেকেই বলছেন আপনার স্বর্ণের মূর্তি চুরি হয়েছে! অসম্ভব।
ফারাবীর এমন কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটি চিঠির মতো ছোট কাগজ এগিয়ে দিলেন মি. উইল। ফারাবী তা নিয়ে দেখলো,
- কি লেখা রে এতে? আবিদ বলল
- আজ ঠিক রাত বারোটায় আপনার স্বর্ণের মূর্তি চুরি করবো, যদি থামাতে পারেন তাহলে থামিয়ে দেখান। ইতি মাইকেল এল্ট্রো এটা আবার কি? ফারাবী বলল
- সে চুরির আগে চ্যালেঞ্জ করে, তারপর চুরি। জানি আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, আসলেই তা অসম্ভব। পুলিশও আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে। মি. উইল বলল
- কেন? ফিরিয়ে দিল কেন? আবিদ বলল
- থানায় গিয়েছিলাম মামলা করতে, তবে ওসি সরাসরি বলে দিলেন দশ লাখ টাকার কথা। টাকা দেওয়ার পর তারা রুমটি ঘুরে ফিরে দেখে বলল এই তদন্ত সম্ভব নয়। মি. উইল বলল
- আবিদ কিছু বুঝেছিস? ফারাবী বলল
- হুম টাকা খাওয়ার ধানদা ছিল। আবিদ বলল
- তোমাদের সাফিও টিমের কথা অনেক শুনেছি, প্রচুর মেধাবী তোমরা। আমার বিশ্বাস তোমরা একটু চেষ্টা করলেই কেসটা সল্ভ করতে পারবে। মি. উইল বলল
- আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করবো আঙ্কেল। আপনি আমাদের সেই রুমটি দেখান যে রুম থেকে চুরি হয়েছিল। ফারাবী বলল
- এসো আমার সাথে।
গতকালের ঘটনা, প্রায় রাত আট'টার দিকে হুমকি দিয়ে কেউ একজন পত্র লিখে রেখে যায় মি. উইলের বসার ঘরে। তবে মি. উইল সেটাকে কারো দুষ্টুমি ভেবে এড়িয়ে যান। সেদিন রাতেই হয় চুরিটি। সকালে উঠে স্বর্ণের মূর্তিটিকে গায়েব দেখে পুলিশে মামলা করে। তবে সেটাও কাজে আসে না। তারপর সাফিও'র কাছে আসতে বাধ্য হয়। এখন তার একমাত্র ভরসা, সাফিও!
ফারাবী ও আবিদকে একটি বড় ঘরে নিয়ে গেল মি. উইল। ঘরটি হরেক রকম ছবি ও দামি সোপিস দ্বারা সজ্জিত। ঘরটির দক্ষিণে একটিই জানালা, সে জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে সমস্ত বাগান। জানালার পাশে এসে দাঁড়ায় ফারাবী, বাড়ির কাজের লোক বাগানে পানি দিচ্ছে।
- এত বড় বাড়িতে আপনি একা থাকেন? ফারাবী বলল
- একা কোথায়? সারাদিন কাজের লোকটা থাকে, দিন শেষে চলে যায়। তাছাড়া আমার কুকুর ড্যাসি তো আছেই!
মি. উইলের এই কথা শুনে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করলো ফারাবী। একটা লোক কিনা একটি কুকুর নিয়েই একাকীত্বকে দূর করছে। তবে তার মনে একটাই প্রশ্ন। ঘরের দরজা বন্ধ, একটাই জানালা, চুরি হলো তো হলো কিভাবে!
- এখানে চুরি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। ফারাবী বলল
- আপনার মূর্তিটা কোথায় ছিল? আবিদ বলল
- এইত এখানে! মি. উইল একটি সেন্টার টেবিল দেখিয়ে বলল
- সেটা দেখতে ঠিক কেমন? ফারাবী বলল
- লম্বায় বারো ইঞ্চি, এক রমণীর মূর্তি। এইযে ছবি।
একটি ছবি এগিয়ে দিলেন মি. উইল, ফারাবী তা নিয়ে দেখে বলল,
- কেসটির কিছুই আমি বুঝতে পারছি, হয়তো সল্ভ করতে বেশ সময় লাগবে।
- সমস্যা নেই, যতদিন পারো সময় নাও। মি. উইল বলল
- ধন্যবাদ আপনাকে, আমরা তাহলে আসি।
এই বলে ফারাবী ও আবিদ চলে যাচ্ছিল, এমন সময় মি. উইল বাধা দিয়ে বলেন,
- টাকার ব্যাপারে কিছু বললে না?
- কিসের টাকা? পেছন ফিরে ফারাবী বলল
- তোমরা যে তদন্ত করবে... ..
- হাহাহা! আঙ্কেল আমরা কারো উপকার করতে টাকা নেইনা, বরং নিজ ইচ্ছায় তদন্ত করি। আসি। ফারাবী বলল
এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ফারাবী ও আবিদ। বর্ষাকাল চলছে, মাঠ ঘাট পানিতে ডুবে আছে। গাছগাছালির পাতাগুলোতে শিশির বিন্দুর মতো জমে আছে বৃষ্টির ফোটা। কথা বলতে বলতে বাস স্টপে গিয়েই একটি বাস পেয়ে উঠে পড়লো ফারাবী ও আবিদ। ভাগ্যক্রমে বৃষ্টি নেই, নয়তো তাদের বাড়ি ফিরতে বারোটা থেকে তেরোটা বাজতে সময় লাগতো না।
পথে আবিদকে বিদায় দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে আসে ফারাবী। হাত ঘড়ি দেখতে দেখতে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। তার এক বদঅভ্যাস, সে ঘরে থাকা অবস্থায় কখনোই তার ঘরের দরজা খোলা রাখে না। বিভিন্ন সব আসবাপত্র দিয়ে ঘরটি গুছিয়েছে ফারাবী। বিছানার পাশেই ছোট টেবিল। তার উপর একটি টেবিল ল্যাম্প। জানালার ধারের টেবিলে এক গাদা বই, দেওয়ালেও বুকসেল্ফ। বিছানার ঠিক উপরে ঝুঁলছে ফারাবীরই আঁকা একটি ছবি। ছবিটিতে চারপাশে ঘন জঙ্গল, তার মধ্যকার পথ ধরে অভার কোট, হ্যাট পড়া ও লাঠি হাতে একলোক হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য। হাত ঘড়িটা খুলে টেবিলের উপর রাখে ফারাবী। মি. উইলের বাসায় এখন শুধু ফারাবী ও আবিদই গিয়েছিল, আজ রাতে সবাইকে কেসটির ব্যাপারে জানাতে হবে।
সেদিন রাতে ছাদে কেসটির ব্যাপারে কথা বলছে ফারাবী, সাবিহা, সানজু, সজীব ও আবিদ। সাবিহা দূরের নদীর উপর ব্রিজে দিয়ে ছুটে গাড়ির হ্যাডলাইটের আলো দেখে বলল, রাতের শহরটা খুব ভালো লাগে আমার।
- আমারো। ফারাবী বলল
- এই তোরা আবেগের কথাগুলো বন্ধ করে কেস সম্পর্কে কিছু বল। সজীব বলল
- সব তো বললামই। ফারাবী বলল
- আমার মাথায় কিছুই আসছে না, কিভাবে চোর ঘরে ঢুকলো! সানজু বলল
- এ যে সে চোর নয়, চুরি করার আগেই জানিয়ে দেয়। আবিদ বলল
- ওখানে গিয়ে আরেকবার দেখলে কেমন হয়? সাবিহা বলল
- হুম তাই ভাবছিলাম।
কথাটি শেষ করা মাত্র টেলিফোনের শব্দ কানে আসে ফারাবীর, নিচের ঘর থেকে আসছে।
- এই টেলিফোন বাজছে না? সজীব বলল
- বাসা থেকে আসছে, আমি দেখছি।
ফারাবী উঠে চলে গেল, বসার ঘরে এসে দেখে ঠিকই টেলিফোন বাজছে। রিসিভ করলো সে।
- হ্যালো ফারাবী বলছি।
- হ্যালো আমি উইল, কিছু ভেবেছো এর মাঝে?
- ওহ আঙ্কেল, আমরা আগামীকাল আপনার বাসায় আসছি।
- ওখান থেকে তোমাদের বারবার আসতে খুব অসুবিধা হয়, তার চেয়ে বরং তোমরা আমার বাসায় চলে এসো। যতদিন প্রয়োজন হয় থাকবে।
- ঠিক আছে ধন্যবাদ।
ফারাবী টেলিফোনটা রাখতেই দেখে সবাই ঘরে এসে ঢুকেছে। সজীব প্রায় অস্থির হয়েই বলল, কে ফোন করেছিল?
- হাপাচ্ছিস কেন? মি. উইল ছিল। ফারাবী বলল
- কি বলল মি. উইল? সাবিহা বলল
- আগামীকাল আমাদের যেতে হবে। ফারাবী বলল
- কোথায়? সানজু বলল
- মি. উইলের বাড়ি, যতদিন এই রহস্য সামনে না আসছে ততদিন ওখানেই কাটাতে হবে। ফারাবী বলল
- তাহলে তো অনেক প্রস্তুতি করতে হবে। সজীব বলল
- হুম আজ সবাই ব্যাগ গুছিয়ে নে, আগামীকাল বিকেলের বাসেই রওনা দিব। ফারাবী বলল
সেদিনের মতো বাসায় প্রস্তুতি নিতে চলে গেল সবাই।
পরদিন সকালে, বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছে ফারাবী, সাবিহা, সানজু, সজীব ও আবিদ। কিছুক্ষণ পরই বাস এসে থামলো, একে একে উঠে পড়লো সবাই। বাস ছুটে চলল ইমুলু টাউনের উদ্দেশে।
যে শহরে মি. উইলের বাড়ি তার নাম ইমুলু শহর, প্রায় দু ঘন্টা পর বাস এসে থামে ইমুলু বাস স্টপে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে, পাখিরা দল বেঁধে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের নিড়ে।
তবে বিপত্তি ঘটলো মি. উইলের পোষা কুকুর ড্যাসিকে নিয়ে, তাদের কখনো দেখেনি বলে পাগলের মতো চিৎকার করতে শুরু করে।
- এখন কি করবি? এ তো আজ কামড়েই ছাড়বে। সজীব বলল
- আরে একটু ধৈর্য ধর না, এই দারোয়ান ভাই আমাদের বাঁচাও! ফারাবী বলল
পরে অবশ্য দারোয়ান এসে কুকুরটিকে নিয়ে যায়।মি. উইলের বাড়িতে হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠলো, কাজের লোকটি দরজা খুলে বলল,
- কাকে খুজছেন মশাই?
- মি. উইল বাড়িতে আছেন? আমরা তার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। সজীব বলল
- আপনারা বসুন, আমি সাহেবকে ডেকে দিচ্ছি।
কাজের লোকটি তাদের বসতে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। সোফায় বসে আশেপাশে তাকাচ্ছে সাবিহা, এত বড় বাড়ি কেউ কখনো দেখেনি তাদের মাঝে।
- এত বড় বাড়ি! সাবিহা বলল
- বড়লোক মানুষ, এমন তো হবেই। ফারাবী বলল
- আচ্ছা চুরি হয়েছে কোন রুমে? সজীব বলল
- আরে মাথামোটা, সব আমি বলবো নাকি? ফারাবী বলল
এরই মাঝে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলেন মি. উইল। তার সাথে কথা বলার পর তিনি বললেন, তোমরা হয়তো খুব ক্লান্ত, এবার বিশ্রাম নাও। আমার কাজের লোকটি তোমাদের খাবার ব্যবস্থা করছে।
- ঠিক আছে আপনাকে ধন্যবাদ।
এই বলে ভেতরে চলে গেল সবাই।
দেখতে দেখতে রাত গভীর হতে লাগলো, এখন রাত ১১টা ৫৮মিনিট। বারোটা বাজতে আর মাত্র দু মিনিট। মিউজিয়ামের চারপাশে কড়া নজরদারি। আজই হুমকি এসেছে মিউজিয়ামে আনা দামি মুটুক চুরি করার। হঠাৎ বড় ঘড়িটি ঢং ঢং শব্দ করে উঠলো, মূহুর্তেই নিভে গেল মুটুক রাখা ঘরটির সব আলো!
আতঙ্কে মেতে উঠে পাহারারত সবাই। মুকুট রাখা ঘরটিতে ঢুকেই আলো জ্বালিয়ে দেখে, মুকুট নেই! সবার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ঠিক বারোটা বাজতেই আলো নিভে গেল, তার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই চুরি! অবাক হয়ে ফাঁকা মুকুটের স্ট্যান্ডটির দিকে তাকিয়ে রইল সবাই, বিশাল ঘড়িটি এখনো অনবরত ঢং ঢং করেই চলছে।
পরদিন সকালে, মুখের উপর সকালের মিষ্টি রোদ পড়তেই ফারাবীর ঘুম ভেঙে গেল। শীত চলে আসছে প্রায়, মৃদু বাতাসের সঙ্গে অল্প ঠান্ডায় বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায়না। হঠাৎ দরজায় কারো কড়ানাড়ার শব্দ, ঘুম ঘুম চোখে তাকায় ফারাবী। পুনরায় শব্দ হতেই উঠে বসে বলল, ভেতরে চলে এসো! দরজা খুলে কাজের লোকটি এসে ঢুকে বলল,
- সবাই উঠে পড়েছে, আপনিও ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে চলে আসুন।
- ঠিক আছে আপনি যান, আমি আসছি।
কাজের লোকটি চলে যেতেই ফারাবী উঠে ফ্রেস হতে চলে গেল। ফ্রেস হয়ে কাপড় বদলে গেল খাবার টেবিলে। সবাই সেখানে আগে থেকেই বসে গল্প করছে।
- শুভ সকাল বন্ধুরা! হাই তুলতে তুলতে ফারাবী বলল
- শুভ সকাল, এখনো ঘুম যায়নি? সাবিহা বলল
- কি করবো? লং জার্নির পর আমার আর ভালো লাগে না।
এই বলে টেবিলে মাথা রেখে চোখ বুজে রইল ফারাবী। সজীব তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
- এই ব্যাটা উঠ!
- উট? ফারাবী বলল
- উট না উঠ! সজীব বলল
- তুই উট!
- তুই গরু!
- তুই মহিশ!
- তুই... ..
- এই তোমরা থামো! কি শুরু করেছো সকাল সকাল! সানজু বলল
- সরি!
- আচ্ছা মি. উইল খাওয়া শেষে আমরা এলাকাটা ঘুরে দেখতে পারি? আবিদ বলল
- অবশ্যই, কেন পারবে না? মি. উইল বলল
- আসলে এমন জায়গা আগে কখনো দেখিনি। আবিদ বলল
- এবার দেখবে, তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়ো।
খাওয়ার পর্ব শেষ করে তারা বেরিয়ে পড়লো ইমুলু শহরটি ঘুরে দেখতে, শহরটি দেখতে অনেকটা খ্রিষ্টান দেশগুলোর মতো। হাঁটতে হাঁটতে মাইকেলকে নিয়ে বিভিন্ন কথা হচ্ছে তাদের মাঝে। তবে সাবিহা অন্যদের চেয়ে বেতিক্রম, সে শহরটি দেখা নিয়ে ব্যস্ত। শহরটি দেখতে দেখতে হঠাৎ সামনে ভীড় চোখে পড়লো তার।
- ফারাবী, সামনে এত ভীড় কেন? সাবিহা বলল
- কোথায়? ফারাবী বলল
- ওইযে মিউজিয়ামের সামনে!
সানজুর কথা শুনে সামনে তাকিয়ে ভীড় দেখতে পায় ফারাবী। বেশ ভীড় ওখানে পুলিশের লোকও আছে।
- এত ভীড় কেন! চল গিয়ে দেখি। ফারাবী বলল
ভীড়ের মাঝে এসে দাঁড়ায় তারা। ওখানের একজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায় এখানে ঠিক রাত বারোটায় চুরি হয়েছে! কথাটি শুনে একে অপরের দিকে তাকা তাকি করে তারা।
- এ নিশ্চয়ই মাইকেল এল্ট্রোর কাজ। ফারাবী বলল
- এই মিউজিয়ামটা প্রাইভেট মনে হয়। সজীব বলল
- তাহলে মালিকের সঙ্গে কথা বললে হয়না? সানজু বলল
- হুম আমিও তাই ভাবছিলাম। ফারাবী বলল
মালিকের সঙ্গে দেখা করতে মিউজিয়ামের কাছে যায় ফারাবী, সাবিহা, সানজু, সজীব ও আবিদ। ভেতরে যেতেই একলোককে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে তারা। কেমন যেন চিন্তার রেখা তার কপালে, বয়স প্রায় ৬৫ বছর। ফারাবী তার কাছে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, আমি ফারাবী, আপনি কি এই মিউজিয়ামের মালিক?
ভদ্রলোক মাথা তুলে তাকালেন, হাত মিলিয়ে বললেন,
- হুম আমি উইলিয়াম থমসন, কে তোমরা?
- আমাদের আপনি চিনবেন না, মাইকেল এল্ট্রোর চুরির বিষয়টা দেখতেই আমরা এসেছি। সানজু বলল
- বসো, কি মনে করে এলে?
- আঙ্কেল লোক মুখে শুনলাম মাইকেল নাকি এই মিউজিয়ামে চুরি করেছে? সাবিহা বলল
- হুম, অনেক টাকা খরচ করে ওটা আনিয়েছিলাম। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।
- আচ্ছা চুরির আগে কি আপনার কাছে কোনো হুমকি আসেনি? ফারাবী বলল
- হ্যাঁ, একটি ছোট কাগজে লিখে দিয়েছিল 'আজ ঠিক রাত বারোটায় মিউজিয়ামে রাখা মুকুটটি চুরি হতে চলেছে, ক্ষমতা থাকলে থামিয়ে দেখাও!'
- কি সাংঘাতিক! আবিদ বলল
- এবার তো সবচেয়ে দামি জিনিসটি চুরি হয়েছে, পরবর্তীতে অন্যান্য দামি জিনিসগুলোর দিকে নজর দিতে পারে। চলো, মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখাই।
উইলিয়াম তাদের মিউজিয়ামের ভেতর নিয়ে গেলেন। বিভিন্ন দামি ও পুরনো জিনিসে ভর্তি মিউজিয়াম। তাদের একটি ঘরে নিয়ে গেলেন উইলিয়াম, আঙুল দিয়ে একটি স্ট্যান্ড দেখিয়ে বললেন, ওইযে, ওখানেই ছিল মুকুটটি। সাবিহা সেটার কাছে গিয়ে বলল,
- চুরি যে করেছে তার কোনো ক্লু ও রেখে যায়নি!
- এ যে সে চোর নয়। চুরির আগেই জানিয়ে দেয়, কতবড় সাহস। ফারাবী বলল
- আমি ভাবছি এত সিকিউরিটির মাঝে চুরি করলো কিভাবে! সানজু বলল
- সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এসেছে আর কি। সজীব বলল
- হুম এত মানুষের মাঝে ফাঁকি দিবে কিভাবে? আবিদ বলল
- তাও কথা! মাথা নাড়লো সজীব বলল
- শুনেছি ব্যবসায়ী মি. উইলের বাড়িতে ঠিক এভাবেই চুরি হয়েছে, তাই আমি যত বেশি সম্ভব সিকিউরিটি বসিয়েছিলাম। উইলিয়াম বললেন
- উইলিয়াম সাহেব, আমরা মি. উইলের বাড়িতেই এসেছি। ফারাবী বলল
কথাটি শুনে উইলিয়াম কিছুটা অবাক হলেন, অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,
- উইলের বাড়িতে! তোমরা তো এখানের বলে মনে হয়না, কি কাজে এসেছো?
- আমরা শখের গোয়েন্দা, এই চুরির বিষয়ে তদন্ত করতে এসেছি। সাবিহা বলল
- ওহ আচ্ছা।
- দেখুন উইলিয়াম সাহেব, এই কেসটা খুব রহস্যময়। তাই কেসটা সোল্ভ করতে আপনার সাহায্যের প্রয়োজনও হতে পারে। ফারাবী বলল
- হ্যাঁ অবশ্যই, সাহায্য লাগলেই বলবে।
- আপাতত একটাই সাহায্য। আপনার মিউজিয়ামে অনেক দামি জিনিস আছে, এবং তা চুরি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক। তাই কেসটি সোল্ভ করতো এখানে আমাদের মাঝে মাঝে এখানে আসতে হতে পারে। ফারাবী বলল
- অবশ্যই আসবে, আমার সঙ্গে দেখা করলেই চলবে।
এমন সময় এক প্রাপ্ত বয়স্ক লোক এসে বলল যে মিউজিয়াম আপাতত লাগানো হবে। সেদিনের মতো মিউজিয়াম থেকে ফিরে আসে তারা। মি. উইলের বাড়ি ফিরেই বিষয়টি নিয়ে আলাপ শুরু হলো, এই চোর কোনো সাধারণ চোর নয়।
রাত ৩টা ২৪মিনিট। শহরের সবাই আলো নিভিয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন, মিউজিয়াম অন্ধকার। চাঁদের আলো জানালা দিয়ে এসে অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করছে, মৃদু বাতাসে ঢুলছে জানালার পর্দা। হঠাৎ ঘরের আবছা আলোতে একটি ছায়ামূর্তি দেখা গেল। পরনে অভার কোট, মাথায় হ্যাট। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে টেবিলের উপর একটি ছোট চিঠি রেখে দিল লোকটি, চাঁদের আলোয় তার আঙুলের আংটিটা চকচক করছে। কাগজটি একটি ছোট পাথরের নিচে চাপা দিয়ে বিদায় নিল সে।
পরদিন সকালে। গতবারের মতো আজও মিউজিয়ামে চুরির হুমকি। আজ লেখা 'আজ রাত বারোটায় পুনরায় আসছি, মিউজিয়ামে রাখা স্বর্ণের গোল্ডেন গিটারটি উধাও করতে!' চিঠিটা টেবিলের উপর রেখে অসহায়ের মতো বসে রইল উইলিয়াম। পাশে তার এসিস্টেন্ট মি. হ্যারি ওসবর্ন। তার সামনে বসে ফারাবী, সাবিহা, সানজু, সজীব ও আবিদ। কারো মুখে কথা নেই। একসময় নীরবতা ভেঙে ফারাবী বলল,
- আচ্ছা, গিটারটা পুলিশের কাছে দিয়ে দিলে কেমন হয়?
- পুলিশের কাছে কেন? মি. ওসবর্ন বলল
- থানায় থাকলে চুরি করতে পারবে না, ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক। ফারাবী বলল
- আমারো তাই মনে হয়, এখানে সহজেই চুরি করতে পারবে তবে থানায় পারবে না। সাবিহা বলল
- আচ্ছা তোমরা কথা বলো, আমি একটু বাড়ি থেকে আসছি।
এই বলে উইলিয়াম উঠে যেতে থাকলেন, ফারাবী পেছন থেকে বলল, উইলিয়াম সাহেব কি হলো?
- একটু কাজ আছে, এখনই আসছি।
উইলিয়াম চলে গেলেন। ফারাবী চেয়ে রইল তার দিকে। হঠাৎ মি. ওসবর্নের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো তার।
- তাহলে ঠিক আছে, আপাতত সময় নষ্ট করতে চাইনা। সামনেই পুলিশ স্টেশন, চলো।
মি. ওসবর্ন উঠতে যাবে এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলো ইন্সপেক্টর অর্জুন। তাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো সবাই। উইলিয়াম আমতা আমতা করে বলল,
- ইন্সপেক্টর আপনি এখানে?
- শুনেছি আবারও নাকি চুরি হবে, তাই দেখতে আসলাম।
- ভালোই করেছেন, আমরাও এখন থানায় যেতাম। সানজু বলল
- কেন?
- আসলে আমরা চাচ্ছি গোল্ডেন গিটারটা থানায় থাকুক, তাহলে চুরির সম্ভাবনা কম থাকবে। ফারাবী বলল
- ওহ, আচ্ছা কি চুরি হওয়ার কথা তা কি দেখতে পারি?
- অবশ্যই, আসুন আমার সঙ্গে।
উইলিয়াম তাদের নিয়ে গেল গোল্ডেন গিটারটির ঘরে, গিটার দেখে সবাই মুগ্ধ। পুরোপুরি স্বর্ণের তৈরি মনে হয়। গ্লাসের ভেতর লম্বা একটি স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো গিটারটি। ইন্সপেক্টর তা দেখে বলল,
- হুম চোরের নজর পড়ার মতোই।
- আপনি গিটারটি নিয়ে থানায় রাখুন, তাহলে হয়তো বাঁচা যাবে। মি. ওসবর্ন বলল
- ঠিক আছে, আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না।
গিটারটি বাক্স বন্দি করে ইন্সপেক্টর অর্জুনের হাতে তুলে দেওয়া হলো, সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাক্সটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ইন্সপেক্টর অর্জুন। পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে চলে যেতে দেখছে সবাই, যাওয়ার সময় ঠোটের কোণে এক রহস্যময় হাসি ফোটে উঠে ইন্সপেক্টর অর্জুনের! (চলবে..)
- ফারহান আহমেদ ফারাবী   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম