দ্যা হন্টেড নাইট (শেষ পর্ব)


- ফারাবী স্যার এমন করছে! সৈনিক সাদি বলল
- এর পেছনে কোনো কারণ আছে। সজীব, ফারাবী এখন কোথায়? মেজর রুমেল
- সে তো কোয়ার্টারে চলে গেছে স্যার! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- ওহ মাই গড! সজীব, সাদি চলো আমার সঙ্গে। মেজর রুমেল বলল
- ইয়েস স্যার!
কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে সাবিহা, ফারাবীকে দেখে মুচকি হাসে। রুমটিতে মিটমিট করে মিটলাইট জ্বলছে, আবছা অন্ধকার চারপাশে। আশপাশে চেয়ে ফারাবী ভেতরে ঢুকলো।
- কি ব্যাপার মিটলাইট কেন জ্বালিয়ে রেখেছো? ফারাবী বলল
- কি করবো বলো? রাত হলেই তুমি আলোতে থাকতে চাও না।
দরজা লাগালো সাবিহা, তারপর ফারাবীর কাছে এসে বলে, এমন কেন করো একটু বলবে?
- জানিনা।
- জানিনা বললে তো হবে না, এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
- তাতে কি যায় আসে?
- অনেক কিছু, তখন আমার কি হবে?
- একথা কেন বলছো?
- তা বুঝবে না, দেখি এদিকে তাকাও?
- না!
- তাকাও না।
ফারাবীর মুখ তুলে সাবিহা, চোখে চোখ পড়তেই ঘাবড়ে উঠে। চোখ লাল! এক পোলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয় ফারাবী।
- একি! তোমার চোখ এমন কেন? ঘাবড়ে গিয়ে সাবিহা বলল
- এটা কিছুই নয়, রাত হলেই এমন হয়ে যাই। ফারাবী বলল
- এটা কেমন কথা? তুমি অসুস্থ মনে হয়।
- না, আমি ঠিক আছি।
- বললেই হবে না, কাল গিয়ে ডাক্তার দেখাবে।
- বাদ দাও না।
- তুমি বুঝো না! তোমার কিছু হলে আমি কি করবো!
- কেন?
- ভালোবাসি তাই।
ফারাবীকে জড়িয়ে ধরলো সাবিহা, ফারাবীও সাবিহাকে। সাবিহা চোখ বন্ধ করে জড়িয়ে ধরে থাকে। ফারাবীর খেয়াল নেই, রাত গভীর হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। সাবিহাকে জড়িয়ে ধরে থাকা অবস্থায়ই ড্রাকুলারের দাঁত বের করে ফারাবী! সাবিহার খেয়াল নেই সেদিকে। সাবিহার ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে যেতে থাকে। এমন সময় দরজায় ঠাসঠাস শব্দ হয়! কয়েক সেকেন্ড পরই দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে মেজর রুমেল, ক্যাপ্টেন সজীব ও সৈনিক সাদি! তাদের দেখে ফারাবীকে ছেড়ে তাদের দিকে তাকায় সাবিহা।
- ফারাবী একি করছো! পিস্তল তাক করে বলল মেজর রুমেল
- ওর এমন হলো কিভাবে! সাবিহা বলল
- আমি দেখছি স্যার!
ফারাবীকে আটকাতে ক্যাপ্টেন সজীব এগিয়ে যেতেই তার উপর হাত তুলে ফারাবী। তার শরীরের শক্তি যেন আরো বেড়ে গেছে। সজীবের উপর আক্রমণ করতেই ফারাবীর উপর টর্চের আলো ফেলে সৈনিক সাদি। আলো সহ্য করতে না পেরে ফারাবী দেয়ালের উপর ছিটকে পড়ে হাত দিয়ে মুখ আড়াল করতে থাকে। এদিকে তাকে স্বাভাবিক করতে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে সবাই। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ফারাবী। সবাই করে এগিয়ে যায় তার কাছে, লাইট জ্বালানো হয়। ফারাবীকে ধরাধরি করে বিছানায় শোয়ায় ক্যাপ্টেন সজীব ও সৈনিক সাদি। ইতিমধ্যে ডাক্তার ডাকে মেজর রুমেল। রাত ১২টার উপরে, ডাক্তার আসতেও অনেক দেরি হবে। ডাক্তারের আগমন প্রায় রাত একটার দিকে। সমস্ত ঘটনা খুলে বলার পর ফারাবীর চেকআপ শুরু হয়।
- কি হয়েছে ড.? সাবিহা বলল
- তেমন কিছু নয়, শুধু অজ্ঞান হয়েছে। ড. বলল
- আচ্ছা জ্ঞান ফেরার পর উনার সব মনে থাকবে তো? সৈনিক সাদি বলল
- তুমি কি বলতে চাইছো ফারাবীর ব্রেইন আউট হয়ে যাবে? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- না না তেমন কিছু হবে না, তবে কয়েকদিন দুর্বল থাকতে পারে। আমি এই ঔষধগুলো লিখে দিচ্ছি, আপনারা ব্যবস্থা করুন। ড. বলল
- থ্যাংক ইউ ড.। মেজর রুমেল বলল
ডাক্তার চলে গেল, এখন শুধু ফারাবীর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা।
এখন রাত ২টা বাজে, সোফায় বসে ঝিমুচ্ছে সবাই। শুধু সাবিহা ফারাবীর হাত ধরে বিছানায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ সাবিহার হাতের মুঠোয় থাকা ফারাবীর আঙুল সামান্য নড়ে উঠলো! ঘুম হালকা হওয়া নড়েচড়ে ফারাবীর হাতে মাথা রাখে সাবিহা। পুনরায় হাত নড়ে উঠলো, সাবিহার গাল স্পর্শ করতেই ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেল তার। উত্তেজিত হয়ে ফারাবীকে ডাকতে শুরু করলো,
- ফারাবী? উঠো!
সাবিহার এমন ডাক শুনে সবার ঝিমুনি ভাবটাও যেন পালিয়ে গেল, ছুটে এসে বলল,
- ওর কি জ্ঞান ফিরেছে? মেজর রুমেল বলল
- এই মাত্র হাত নাড়লো। সাবিহা বলল
- ফারাবী চোখ খোল! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
সবার কথাগুলো অস্পষ্ঠ ভাবে ফারাবীর কানে আসছে, ধীরে ধীরে চোখ খোলার চেষ্টা করে সে। তবে শরীর এতটাই দুর্বল যে চোখ খোলার শক্তিটুকুও নেই।
- কিরে এখন কেমন লাগছে? ক্যাপ্টেন সজীব
- সজীব এখন কিছু জিজ্ঞেস করোনা, সে দুর্বল। মেজর রুমেল বলল
- স্যার আমাদের চিনতে পারছেন? সৈনিক সাদি বলল
- সাদি! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
ইতিমধ্যেই ফারাবী চোখ খোলে, তা দেখে তার পাশে বসে মেজর রুমেল।
- স্যার, আমার কি হয়েছিল? ফারাবী বলল
- আপনার কিছু মনে নেই স্যার! সৈনিক সাদি বলল
- সাদি ভাইয়া আপনি চুপ করবেন! সাবিহা বলল
- তোর এমন অবস্থা কিভাবে হয়েছিল? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- কি বলছিস বুঝলাম না। ফারাবী বলল
- তুমি ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছিলে, পরপর তিনজনের রক্ত খেয়েছো! মেজর রুমেল বলল
কথাগুলো শুনে মাথাব্যথা করতে শুরু করে ফারাবীর, এদিক ওদিক সবার দিকে চেয়ে বলে, মি. উইল আমায় বলেছিল, আমার ভেতর ভ্যাম্পায়ারের সত্ত্বা প্রবেশ করেছে!
- ভ্যাম্পায়ারের সত্ত্বা! অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- আমরা যে বাদুরগুলো দেখেছিলাম সেগুল ভ্যাম্পায়ার ছিল। ফারাবী বলল
- তার মানে বাদুরের কামড়ের মাধ্যমে তুই এমন হয়েছিলি? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- হ্যাঁ। আমি ভাবতেই পারছি না যে, আমি নিজে মানুষের রক্ত খেয়েছি! উফ!
দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয় ফারাবী, চুপ করে থাকে সবাই। মেজর রুমেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারাবীকে অভয় দিয়ে বলল,
- চিন্তা করো না, তুমি ইচ্ছে করে কিছু করোনি। তুমি এখন দুর্বল, যতদিন প্রয়োজন বিশ্রাম করো। আর ড. এর দেওয়া ঔষধগুলো সজীব কাল এনে দিবে।
মেজর রুমেলের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারাবী। মেজর রুমেল বসা থেকে উঠে বলে, অনেক রাত হয়েছে, তুমি বিশ্রাম নাও। আমরা আসি। সজীব, সাদি চলো।
- ইয়েস স্যার!
সেদিনের মতো এখানেই সমাপ্তি হয় দিনটির।
পরদিন সকালে।
- কিরে তুই অফিসে এলি কেন?
ফারাবীকে অফিসে ঢুকতে দেখে অবাক হয়েই কথাটি বলল ক্যাপ্টেন তুষিত। ফারাবী তার টেবিলে যেতে যেতে বলল, আমি ঠিক আছি, ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
- কিন্তু ডিউটি করলে তোর ব্রেইনে চাপ পড়বে। ক্যাপ্টেন তুষিত বলল
- না রে, আমার কিছু হয়নি।
- আরে বললেই তো হবে না, ডাক্তারই বলল যে তোর....
- বিশ্রামের প্রয়োজন, হুম ডিউটি না করলে আমি সুস্থ হবো না। আমরা দেশ রক্ষক, কোনো আরামে থাকা ব্যক্তি নই।
- তোর সাথে কথায় পারা যাবে না।
- যাই হোক বাকিরা কোথায়?
- মিটিংয়ে, ভ্যাম্পায়ার ফরেস্ট নিয়ে।
- এটা আবার কোন নতুন বিপদ?
- ইনফোরমেশন পাওয়া গেল একটা ফরেস্টে ভ্যাম্পায়ারদের আনাগনা, সেখানে অপারেশনের মিটিং চলছে।
- ওহ, কোথায়?
- ওখানে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ক্যাপ্টেন তুষিত।
- অকে থ্যাংক্স।
- আরে তুই কোথায় যাচ্ছিস!
ক্যাপ্টেন তুষিতের কথা কানে না নিয়েই এক প্রকার দৌড়ে সেদিকে যায় ফারাবী। রুমে সবাই লম্বা টেবিলে বসে মেজর জেনারেল আব্দুল হামিদের বক্তিতা শুনছে। এমন সময় দরজা খোলার শব্দ, পেছন ফিরে তাকায় সবাই। ফারাবী মেজর জেনারেল হামিদকে স্যালুট দিয়ে বলল,
- সালাম স্যার, ম্যায় আই কাম স্যার?
- ক্যাপ্টেন ফারাবী! প্লিজ কাম। সিট ডাউন।
- থ্যাংক ইউ স্যার।
- কিরে তুই এলি কেন? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- কি করবো বল? ডিউটির মানুষ ডিউটি না করলে হয়না। বসতে বসতে ফারাবী বলল
- হুম। মাথা দুলালো ক্যাপ্টেন সজীব
- স্যার ভ্যাম্পায়ার ফরেস্ট নিয়ে কি যেন বলছিলেন? ফারাবী বলল
- আগামীকাল খ্রিষ্ট পাড়ার এক ফরেস্টে অপারেশন পরিচালনা করা হবে, তার নাম মিশন ভ্যাম্পায়ার ফরেস্ট।
একটি লম্বা স্টিক হাতে নিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ম্যাপের উপর দেখিয়ে মেজর জেনারেল হামিদ বলল
- এইযে ফরেস্টটি দেখছো, এটাই ভ্যাম্পায়ার ফরেস্ট। এবং ফরেস্টটি প্রায় তিন মাইল। তোমরা অপারেশন শুরু করবে এখান থেকে (স্টিক দিয়ে একটি জায়গা দেখিয়ে), এবং তোমরা হবে আটজনের একটি দল। একটা বিষয় ভালো ভাবে খেয়াল রাখবে যে কেউ কাউকে দূরে রেখে এগিয়ে পড়বে না, এবং কেউ একা সামনে এগুবে না। মিশন ভ্যাম্পায়ার ফরেস্টের জন্য সিলেক্টেড সেনা সদস্যরা হলো, ক্যাপ্টেন সজীব, লেফট্যানেন্ট রুহুল, সৈনিক সাদি, সৈনিক সাব্বির, সৈনিক পলাশ, সৈনিক তানভির এবং সৈনিক মাহমুদ।
হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তা দেখে মেজর জেনারেল হামিদ জিজ্ঞেস করলো, ফারাবী কিছু বলবে?
উত্তেজিত কন্ঠে ফারাবী বলল, স্যার, আমিও অপারেশনে যাব!
ফারাবীর কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়, যেন তালা লেগে গেছে সবার মুখে। যে মাত্র বাঘের মুখ থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে সে কিনা আবার বাঘের মুখের সামনে যেতে চায়।
- মাথা ঠিক আছে তোর? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- তুমি যেতে পারবে না, আর আমরাও তোমাকে এই অবস্থায় নিতে চাইনা। মেজর রুমেল বলল
- ক্যাপ্টেন ফারাবী তোমার কিছু বলার আছে? মেজর জেনারেল হামিদ বলল
- স্যার, আমি ক্যাপ্টেন। দীর্ঘ দুবছর মিলিটারি একাডেমি আমায় শিখিয়েছে মৃত্যুকে কখনো ভয় না করতে। একজন সেনা সদস্য চাইলেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে পারেনা স্যার, শহীদ না হওয়া অবধি তাকে মেশিন-গান অথবা মর্টার চালিয়ে যেতে হয়। আমি এখনো মারা যাইনি, আই ওয়ান্টু গো স্যার!
ফারাবীর কথা শুনে মাথা নিচু করে বসে থাকলো সবাই, তার উত্তরের অপেক্ষায় স্থির দাঁড়িয়ে ফারাবী। মেজর জেনারেল হামিদ বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে ফারাবীকে তারা নিতে চায়না, আবার ফারাবী বলা কথাগুলোর একটি শব্দও অযুক্তিক নয়। কিছুক্ষণ ভেবে মেজর জেনারেল হামিদ বলল, ঠিক আছে, ফারাবী সহ তোমরা নয়জন যাবে এই মিশনে।
- থ্যাংক ইউ স্যার!
অনুমতি পেয়ে একগাল হেসে উঠে ফারাবী। এখন শুধু আগামী দিনের অপেক্ষা।
পরদিন বিকেলে,
অপারেশনের জন্য প্রস্তুত সবাই, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সবার সামনে দাঁড়িয়ে অপারেশনের প্রতিটি ধাপ কলম বুঝিয়ে দিচ্ছে মেজর রুমেল। বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে মিলিটারি হেলিকপ্টার। সব বুঝিয়ে দিয়ে সবাইকে হেলিকপ্টারে উঠার নির্দেশ দেওয়া হলো, এক সারিতে রুম থেকে বেরিয়ে একে একে হেলিকপ্টারে উঠলো সবাই। সবার হাতে বিডি-08 এবং মাথায় শক্ত হ্যালমেট। ধীরে ধীরে হেলিপক্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করলো, মাটির সব ধুলবালু দেখা যাচ্ছে। হেলিকপ্টারটি শূণ্যে উঠে উড়ে, একসময় আকাশের আবছা মেঘের মাঝে হারিয়ে যায়।
এখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে, হেলিকপ্টার থেকে স্পষ্ঠ দেখা যাচ্ছে লাল ডুবন্ত সূর্য। নিচে ঘন জঙ্গল, সূর্যের আলো অবধি পৌঁছে কিনা সন্দেহ। হেলিপক্টারের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অপারেশন শুরুর পথ খুঁজছে ফারাবী। সময় বুঝে দড়ি ফেলার নির্দেশ দেয়, তার দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী দড়ি ফেলা হয় জঙ্গলের মাঝে। একে একে দড়ি গেয়ে নেমে পড়ে সবাই। নিচে নেমে ফারাবী হাত নেড়ে ইশারায় হেলিকপ্টারের পাইলটকে চলে যেতে বলে, হেলিকপ্টার চলে গেল। নির্জন হয়ে আছে চারপাশ। আকাশের দিকে তাকালো ফারাবী। দিন ভালো না, ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। হঠাৎ কখনো বজ্রপাতের শব্দ কাঁপিয়ে তুলছে সবকিছু।
- সবাই এগোতে শুরু করো, ভোরের মধ্যে মিশন কমপ্লিট করতে হবে। ফারাবী বলল
- ইয়েস স্যার!
ঘন জঙ্গলের মাঝে এগোতে থাকে একদল সেনাবাহিনী। কেমন যেন ভূতুরে জঙ্গলটি। মাঝে মাঝে লতাপাতায় পা পেচিয়ে যাচ্ছে, কাদায় ভিজে আছে জঙ্গলটি। এদিকে সূর্যও ডুবে গেছে। সব পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের নিড়ে। তাদের বুটের শব্দ ছাড়া সবই নির্জন। হাতে রাইফেল নিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।
রাত প্রায় ১০টা, প্রায় তিন ঘন্টা যাবত হেঁটে চলছে দলটি। নেই কোনো বিরতি, নেই কোনো বিশ্রাম। এক নাগারে হেঁটেই চলছে। আশেপাশে দৈত্যের মতো ঘন বড় গাছগাছালি। মাঝে মাঝে পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আসছে গাছগুলো থেকে। লেফটেন্যান্ট রুহুল হাত দিয়ে গাছের ডাল সরাতে সরাতে বলল, উফ কি অসহ্য জঙ্গল! ক্যাপ্টেন সজীব উত্তর হিসেবে বলল, থামলে চলবে না, অভিযোগ না করে হাঁটতে থাকো। কয়েক কদম হেঁটেই একটি বড় পাথরের উপর বসে পড়লো সৈনিক সাব্বির, তা দেখে বিরক্তি ভাব নিয়ে ফারাবী বলল, কি ব্যাপার? এখানেই বসে পড়লে হবে?
- খুব ক্লান্ত লাগছে স্যার। সৈনিক সাব্বির বলল
- আমারো পা ব্যথা করছে। সৈনিক পলাশ বলল
- কি করা যায় স্যার? সবারই এক কথা? লেফটেন্যান্ট রুহুল বলল
- এমনটা হওয়ারই কথা, সেই বিকেল থেকে একটানা হাঁটছে। ঠিক আছে দশ মিনিট বসলে খুব একটা ক্ষতি নেই।
এই বলে রাইফেলটি একটি গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে হ্যালমেট খুলল ফারাবী, ঘামে পুরো মাথা ভিজে আছে। একে একে সবাই রাইফেল ও হ্যালমেট রেখে বসে পড়লো। ক্যাপ্টেন সজীব বোতলে এক ঢোক পানি খেয়ে বলল, সারাদিন পানি না খাওয়াতে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে!
- তোর কি মনে হয়? এই মিশনে সবাই বাঁচবে? ফারাবী বলল
- হায়াত থাকলে কে মারবে বল? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- হুম! মাথা নাড়লো ফারাবী
- স্যার আমার মনে হয়না এই জঙ্গলে সত্যিই ভ্যাম্পায়ার হবে। সৈনিক পলাশ বলল
- কেন? লেফটেন্যান্ট রুহুল বলল
- শুধু মনে হলো স্যার। সৈনিক পলাশ বলল
- শত্রুর দেশে ঢুকলেই কি শত্রু পাওয়া যায়? ফারাবী বলল
- এই ওসব কথা বাদদে তোরা, তার চেয়ে বরং.. ..
হঠাৎ পাশে কোথাও কিছুর নড়াচড়ার শব্দে ক্যাপ্টেন সজীব কথা বন্ধ করে কান পাতলো! চুপ হয়ে গেল সবাই, আবার শব্দ হতেই ক্যাপ্টেন সজীব ফিসফিস করে বলল,
- কিছু শুনতে পাচ্ছো কেউ?
- হ্যাঁ, পাশেই কোথাও। সৈনিক সাব্বির বলল
- আস্তে কথা বলো, শব্দটা কোথা থেকে আসছে? ফারাবী বলল
- ওদিক থেকে স্যার!
লেফটেন্যান্ট রুহুল আঙুল দিয়ে একটি দিক দেখালো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সবাই, গরগর শব্দ আসছে। সবাই সবার হ্যালমেট পড়ে নিয়ে রাইফেল তাক করলো, ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সেদিকে। যত কাছে যাচ্ছে তত বুক কেঁপে উঠছে তাদের। ক্যাপ্টেন সজীব লাফিয়ে ঝুঁপের সামনে এসে রাইফেল তাক করতেই একটি বাদুর ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে গেল! সস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। ক্যাপ্টেন সজীব হেসে বলল, যাক, ওটা বাদুর ছিল। আমি তো ভয়ই পেয়েছিলাম। এমন সময় হঠাৎ বাদুরটিকে লক্ষ্য করে ফায়ার করে বসে রুহুল! বাদুরটির রক্ত ছিটকে পড়ে তার মুখের উপর, ফায়ারিংয়ের আগুনে আলোকিত হয়ে উঠছিল চারপাশ। এবং বাদুরটি নিমিসেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
- একি! তুমি এটাকে মারলি কেন? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- ভুলে গেছেন স্যার? রুহুল বলল
- কি? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- ওটা ভ্যাম্পায়ারও হতে পারে স্যার। সৈনিক সাদি বলল
- যাই হোক এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক হবে না। লেফটেন্যান্ট রুহুল বলল
- আরে পলাশ আর ফারাবী স্যার কোথায়! আতকে উঠলো সৈনিক সাদি
- মানে কি? ফারাবী বলল
- এখানেই তো ছিল। পলাশ!
সৈনিক পলাশকে খুঁজতে শুরু করে সবাই। কোথাও নেই, যেন কোনো ভীন গ্রহের প্রাণী উঠিয়ে নিয়ে গেছে। হঠাৎ জঙ্গলের গভীর থেকে কারো বিকট চিৎকার ভেসে এলো!
- কার চিৎকার! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- পলাশের নয়তো! সৈনিক সাদি বলল
- চলো গিয়ে দেখি! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
দৌড়ে জঙ্গলের গহিনে যেতে থাকে তারা। পাতার মচমচ শব্দে পরিবেশ ছেয়ে যায় মূহুর্তেই। বেশ সামনে যেতেই হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বলল ফারাবী! সামনে কেউ আছে। ইতিমধ্যে ফোটা ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। নিচু জায়গায় রাইফেল তাক করে বসে পড়ে তারা। আবছা আলোতে সবাই দেখলো, সৈনিক পলাশের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে আছে একটি গাছের পাশে!
যাওয়ার জন্য পেছন ফিরতেই চিৎকার করে উঠে সৈনিক সাব্বির! একটি ভ্যাম্পায়ার দাঁত বের করে ঝাপিয়ে পড়ে তার উপর। সৈনিক সাদি এক দফা গুলি চালাতেই ভ্যাম্পায়ারটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
- সাব্বির ঠিক আছো? লেফটেন্যান্ট রুহুল বলল
- স্যার এরা সবদিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরেছে!
সৈনিক সাদির কথা শুনে আশেপাশে দেখে সবাই। চারপাশ থেকে ভ্যাম্পায়াররা ঘিরে ফেলেছে, মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে তারা।
- তোমরা গুলি করছো না কেন! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- আপনার অর্ডারের অপেক্ষায় আছি স্যার! সৈনিক সাদি বলল
- অর্ডার লাগবে না ফায়ার করো সবাই! ক্যাপ্টেন সজীবের নির্দেশে একসঙ্গে গুলি করতে শুরু করে সবাই, ভ্যাম্পায়ারের শরীরের রক্তে ভরে যাচ্ছে চার পাশ! একের পর এক লুটিয়ে পড়ছে, তবুও যেন কমছে না।
মুখের উপর বৃষ্টির ফোটা পড়তেই চোখ খোলে ফারাবী, আশেপাশে চেয়ে দেখে আবছা অন্ধকার। কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কোনোরকমে উঠে বসে ফারাবী। হঠাৎ কিছুটা দূর থেকে কেউ একজন ধরা গলায় বলল, হাও আর ইউ ক্যাপ্টেন ফারাবী! কথাটি শুনে ফারাবী চমকে উঠে, ধমকের স্বরে বলে, রে ওখানে?! আধার থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে ব্যক্তিটি।
- ড. হার্ন! অবাক হয়ে ফারাবী বলল
রজার্স হার্ন ফারাবীর পাশে ছুড়ে মারে তার রাইফেলটি, তারপর বলে,
- তোমার যেমন বিশাল সেনাদল আছে, আমারো তেমনই সেনাদলের ইচ্ছে ছিল। তাই ভ্যাম্পায়ারদের দ্বারাই দল করে নিলাম। জলদিই তোমরাও হবে আমারই দলের সৈন্য!
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠে হার্ন। ফারাবী তার রাইফেল তুলতে হাত বাড়াতেই রাইফেল পা দিয়ে চেপে ধরে সে! মাথা তুলে হার্নের দিকে তাকায় ফারাবী, হার্ন খিলখিল করে হেসে বলে, এসবের কোনো লাভ নেই ক্যাপ্টেন, আজ তোমার নামও হবে ভ্যাম্পায়ার! এই বলে তীক্ষ্ন দাঁত বের করে ঝাপিয়ে পড়ে হার্ন!
এদিকে ভ্যাম্পায়ার সব শেষ হয়ে আসে, সবদিকে শুধু ভ্যাম্পায়ারদের মৃতদেহ।
- ফারাবী কোথায়! ক্যাপ্টেন সজীব বলষ
- পলাশ তো এখানে, স্যার কোথায় হবে! সৈনিক সাদি বলল
- চিন্তা করো না, তার কিছু হবে না। চলো গিয়ে দেখতে হবে, লেট্স গো! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- ইয়েস স্যার!
হার্ন আক্রমণ করতে আসলেই কার মুখে প্রচন্ড ঘুষি বসিয়ে দেয় ফারাবী। ঘুষির আঘাতে গাছের উপর ছিটকে পড়ে হার্ন। ফারাবী কাছে আসতেই হার্ন তাকে ঘুষি মেরে নিচে ফেলে দেয়, বিল ঘুষি মেরে ফারাবীকে দুর্বল করে দেয়! একসময় একটি গাছের উপর পড়ে নিচে পড়ে যায় ফারাবী, তার সামনে এসে দাঁড়ায় রজার্স হার্ন। ফারাবীর ঠোট থেকে রক্ত পড়ছে, মুখে ক্লান্তির ছাপ।
- তুমি তোমার শেষ শক্তিটুকুও. হারিয়ে ফেলেছো, এবার তোমার কিছু করার নেই ক্যাপ্টেন। তোমার দল হয়তো এতক্ষণে ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছে, এবং এবার তোমার পালা!
কথাটি শুনে দাঁতে দাতঁ চেপে ভ্রু কুচকে হার্নের দিকে তাকায় ফারাবী, তার চোখে স্পষ্ঠ রাগ। হার্ন আকাশ পানে চেয়ে এক বিকট চিৎকার করে এবং সাথেসাথেই তীক্ষ্ন দাঁত বেরিয়ে আসে! ফারাবীর উপর ঝাপিয়ে পড়তেই তার মুখে ধরে ফেলে ফারাবী, হার্ন তাকে কামড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ফারাবী তাকে এক ধাক্কায় দূরে ফেলে দেয়। হার্ন পুনরায় উঠে দাঁড়াতেই ফারাবী তার পাশে পড়ে থাকা বড় গাছের ডাল তুলে ছুড়ে মারে হার্নের দিকে, সেটার আঘাতে দূরে ছিটকে পড়ে হার্ন। ছুটে গিয়ে হার্নের কলার ধরে ঘুষি মারতে শুরু করে ফারাবী। তুলে আবার ঘুষি মারে, একের পর এক মারতেই থাকে! গুলি করার জন্য কোমর থেকে পিস্তল বের করতেই হার্ন হাত বাড়িয়ে বলল, ফারাবী থামো, থামো! ট্রিগার চাপলো না ফারাবী, অবাক হয়ে বলল, ড. হার্ন! হার্নের কথা শুনতে চাইলো। হার্ন বলল,
আমি ড্রাকুলা ঠিক, তবে আমিও একসময় ঠিক তোমার মতোই মানুষ ছিলাম। ডোনার একা সেদিনও বলেছি। কেউ আমার বাড়ির ধারে কাছেও আশে না, তবে তুমি বিপদ জেনেও এসেছিলে। তখনই তোমায় আমার বেশ ভালো লেগেছিল, তবে রক্ত পিপাসা লাগলে পাগল হয়ে যাই। তোমার বয়সী এক ছেলে ছিল আমার, তোমার মতোই সেনাবাহিনী অফিসার ছিল এব তোমার মতোই দুঃসাহসী। বেঁচে থাকতে সে ছিল লেফটেন্যান্ট, আমার ছেলে লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম হার্ন। তবে তুমি বিশ্বাস করবে না যে, রক্ত পিপাসায় আমি নিজের ছেলেকে হত্যা করেছি। পরে বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করি। আর আজ দেখো, আমি ড্রাকুলা নামে পরিচিত। আমি চাইনা নিজের ছেলের মতো কারো হাতে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু হোক।
বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালো হার্ন, ফারাবী এখনো পিস্তল তাক করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। হার্ন কোটের ভেতর থেকে ফারাবীর মিলিটারি নাইফটি বের করে দেখিয়ে বলল, এটা তোমার ছুরি না? যেটা আমার হাতে গেথে দিয়েছিলে? কথাটি শুনেই ফারাবীর মনে পড়লো সেই ভয়ানক দৃশ্যটি, এবং মনে পড়লো লেফটেন্যান্ট উইলিয়ামের কথা। একবারের জন্য হার্নের চোখে চোখ রাখলো ফারাবী, এবং বলল,
- ড. হার্ন, উইলিয়াম আমার স্টাফ ছিল!
- স্টাফ?
- হ্যাঁ, মিলিটারি একাডেমি থেকে আমরা একসঙ্গেই প্রশিক্ষণ শেষ করেছিলাম। এবং ইউএন মিশনও। আজ যদি সে বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো ক্যাপ্টেন হতো।
হার্ন এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
- আমি আর কিছু শুনতে চাইছি না।
এই বলেই নিজের পেটে নিজে ছুরি গেথে দিল হার্ন! তা দেখে অবাক হয় চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল ফারাবী, দৃশ্যটি যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না। ঝিরঝির বৃষ্টিতে হার্ন যন্ত্রনায় ছটফট করছে। একসময় ছটফট করা বন্ধ হয়ে যায়। বুঝতে বাকি রইল না ফারাবীর, হার্ন ইজ নো মোর! পিস্তল নামিয়ে এক নজরে হার্নের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইল ফারাবী। বৃষ্টিতে ভিজে একদম ভেজা কাক হয়ে আছে সে। এমন সময় কারো কন্ঠে তার নাম শুনে ঘোর কাটলো তার, পাশ ফিরে দেখে বাকিরা ছুটে আসছে।
- ফারাবী তুই বেঁচে আছিস? ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- হ্যাঁ, বেঁচে আছি। ফারাবী বলল
- স্যার পলাশ..
- কি হয়েছে পলাশের? ফারাবী বলল
- মারা গেছে! সৈনিক সাদি বলল
- হুম, একদিন না একদিন সবাইকেই মারা যেতে হয়। ফারাবী বলল
- এবার ফিরে চল, অপারেশন শেষ। ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- হুম।
সবাই ফিরে যেতে লাগলো, যাওয়ার আগে একবার পেছন ফিরে হার্নের মৃতদেহের দিক তাকালো ফারাবী। ভাবতেই অবাক লাগে, একটু আগেই এই ড্রাকুলা এতটা ভয়ানক হয়ে উঠেছিল। আর এখন, মারা গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। পিস্তলটি সামনে এনে দেখলো ফারাবী, সামান্য মাটি লেগে আছে পিস্তলটায়।
- ফারাবী কি করছিস ওখানে! ক্যাপ্টেন সজীব বলল
- ওহ কিছু না, দাঁড়া আসছি!
পিস্তলটি কোমরে গুজে পায়ের পাশে পড়ে থাকা রাইফেলটি পিঠে ঝুলিয়ে রওনা দেয় ইষ্ট বেঙ্গলের দূর্ধর্ষ ক্যাপ্টেন ফারাবী!
_____________সমাপ্ত_____________

লিখাঃ ফারহান আহমেদ ফারাবী 

দ্যা হন্টেড নাইট (পর্ব ৬)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম