বঙ্গাব্দ, তুমি কার?



সূর্যসিদ্ধান্ত প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতকে লিখিত এই পুঁথিতে শ্লোকের ছন্দে সূর্যকে স্থির ধরে পৃথিবী সহ বিবিধ গ্রহ ও চাঁদের ব্যাস, কক্ষপথ, পরিক্রমণকাল সংক্রান্ত বিভিন্ন গণনা বিবৃত আছে। এই সমস্ত বিভিন্ন গণনার যে কার্যকরী পদ্ধতি এখানে উল্লেখিত আছে আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারী গণনার সঙ্গে তা প্রায় মিলে যায়। মনে করা হয়, পঞ্চম শতকের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির এটি রচনা করেছিলেন। আবার আলবেরুনী মনে করতেন এটি প্রথম আর্য্যভট্টের এক সুযোগ্য ছাত্র লাটদেব রচনা করেছিলেন। তবে এই পুঁথিতে তথ্যসূত্রের ব্যবহার দেখে মনে করা হয়, সূর্য-কেন্দ্রিক জ্যোতির্বিদ্যার ধারণা প্রাচীন ভারতবর্ষে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল মার্কণ্ডেয় ও শ্রীবাস্তবের হাত ধরে, যাঁরা প্রথম ধারণা করেছিলেন যে পৃথিবী গোলাকার। এটি বোধহয় অন্যতম প্রাচীন পুঁথি যেখানে সেক্সাজেসিমাল (৬০ কে একক ধরে গণনার পদ্ধতি) ও ত্রিকোণমিতিক গণনা পদ্ধতির কথা বলা আছে। এই পুঁথি দিশা দিয়েছিল সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর পরিক্রমণকালের গণনা, যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল লুনি-সোলার হিন্দু ক্যালেন্ডার। ধরা হয়েছিল, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করতে মোটামোটি ৩৬৫ দিন সময় নেয়। এই সময়কালকে একটি সম্বত বা বৎসর ধরে বারোটি মাসে বিভাজন করা হয়। এই বিভাজন আবার স্থির হয় পৃথিবীর সাপেক্ষে চাঁদের অবস্থান অনুযায়ী। মোটামোটি ভাবে চাঁদ ২৯.৫  দিন সময় নেয় কলা সম্পূর্ণ করতে, তবে পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে তার সময় লাগে ২৭ দিনের একটু বেশি। তাই প্রতিমাসের দৈর্ঘ্য ৩০ কিংবা ৩১ দিন, তবে কিছু মাস ২৯ বা ৩২ দিনেরও হয়। সব মিলিয়ে বছরে ৩৬৫ দিনই হয় (লিপ ইয়ার ছাড়া)। এই গণনার সৌন্দর্য এখানেই - বছরের একটি নির্দিষ্ট মাসে আমরা পাকা আম খেতে পাই, একটি নির্দিষ্ট মাসে মৌসুমী বায়ু পৌঁছয়, একটি নির্দিষ্ট মাসে দুর্গাপুজো হয়, একটি নির্দিষ্ট মাসে চাষিরা ধান গোলাবন্দী করে। অর্থাৎ ঋতুচক্র ও মাসভিত্তিক বৎসরের হিসাব একেবারেই সুসংগত। 


অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের কোণায় কোণায় এই হিসাবের পদ্ধতি অত্যন্ত সুপ্রচলিত ছিল। প্রায় একই সময়ে সমান্তরাল ভাবে চৈনিক দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও একই ধরণের ৩৬৫ দিন ভিত্তিক গণনা পদ্ধতির ধারণা করেন। গণনার এই হিন্দু পদ্ধতি বৌদ্ধরাও গ্রহণ করেন। বছরের বিভিন্ন মাসের নাম হিন্দু ও বৌদ্ধ দুই ক্যালেন্ডারেই এক। সম্রাট অশোক খ্রিস্টপূর্ব ২৫১ তে তাঁর পুত্র-কন্যা মহেন্দ্র ও সঙ্ঘমিত্রাকে সিংহলে পাঠান বৌদ্ধধর্মের প্রচারে। তবে তারও প্রায় আড়াইশো বছর আগে আমাদের সিঙ্গুরের সন্তান বিজয়সিংহ সাতশো অনুচর নিয়ে সিংহলে পৌঁছে ওখানকার রাজা হন। মনে করা হয় তাঁর নামেই দ্বীপরাষ্ট্রটির নাম হয় সিংহল। তবে এটি ইতিহাস না হয়ে বহু কথিত লোকগাথাও হতে পারে। যেটা বলতে চাইছি, তা হলো আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতবাসী মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের বাইরে পা রেখেছে। ব্রহ্মদেশ (অধুনা মায়ানমার), শ্যামদেশ (অধুনা থাইল্যান্ড), ইন্দোচীন (অধুনা লাওস-ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া অঞ্চল), মালয় (অধুনা মালয়েশিয়া), যবদ্বীপ-বালি-সুমাত্রা (অধুনা ইন্দোনেশিয়া) সহ বিস্তীর্ণ দূরপ্রাচ্যে বৌদ্ধ ধর্ম পৌঁছেছিল দুটি পথ ধরে - এক, জলপথে সিংহল হয়ে আর দুই স্থলপথে মধ্য এশিয়া-চীন হয়ে, খ্রিস্টাব্দের প্রথম হাজার বছরের বিভিন্ন সময়ে। দক্ষিণ ভারতের চোল সাম্রাজ্য যখন তার সমৃদ্ধির শিখরে, সেই হাজার বা একাদশ শতাব্দে তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় অধুনা কেরল, তামিলনাড়ু, শ্রীলঙ্কা, অন্ধ্র, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। বোঝার সুবিধার জন্য একটি মানচিত্র দিলাম। আর আশ্চর্যের কথা, এই সমগ্র অঞ্চলের আঞ্চলিক ক্যালেন্ডারের কাঠামো প্রায় এক। শুধু তাই নয়, অন্ধ্র বাদে বাকি সব জায়গায় নববর্ষ পালিত হয় প্রায় একই সময়ে - মাত্র একদিন আগে বা পরে। তবে স্থানভেদে মিলেনিয়াম বা সহস্রাব্দের হিসাব ভিন্ন। যেমন, কেরল বা তামিলনাড়ুতে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু বা কলিযুগের শুরু যে বছরে হয়েছিল তাকে প্রথম বছর ধরে গণনা করা হয়। শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড সহ পুরো দূরপ্রাচ্যে ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের বছরকে প্রথম বছর ধরা হয়। পরবর্তীতে শাসকের পরিবর্তনে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে কিছু পরিবর্তন আসে, তবে মোটামোটি কাঠামো একই থেকে যায়। আর ইসলামি প্রভাবে মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়াতেও হিজরি ক্যালেন্ডার চালু হয়। কিন্তু সমস্যা হলো আসাম-বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যা নিয়ে - কারণ এই অঞ্চলের সহস্রাব্দের গণনা সমাপতিত হয়, না শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর সঙ্গে, না ভগবান বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের সঙ্গে। এখানে সহস্রাব্দের গণনা আরম্ভ হয় ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে। হঠাৎ ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে কেন আরম্ভ হলো? দুটি স্কুল অফ থট বহুল প্রচলিত। একটির প্রবল সমর্থক তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা আর অন্যটির প্রবল সমর্থক তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা। আর তাই প্রতিবছর ঠিক এই সময়ে গোল বেধে যায় দুই পক্ষের। বঙ্গাব্দ কার? আকবরের না শশাঙ্কের? দুই পক্ষেই কোন জোরালো লিখিত প্রমাণ নেই। অনুমান ছাড়া। বলা মুশকিল। তবে অবস্থাগত নজির বা লক্ষণের ভিত্তিতে কোনো একটির প্রবলতর সম্ভাবনার কথা বলাই যায়। 


ভারতবর্ষে যেমন সূর্যসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার তৈরী হয়েছিল, আরবেও সেরকম তৈরী হয়েছিল সম্পূর্ণ লুনার ক্যালেন্ডার। প্রাক ইসলামিক যুগে সূর্যসিদ্ধান্তের আরবি ভাষায় অনুবাদের প্রমাণ পাওয়া গেলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে ইসলামিক আরবে চালু হয়েছিল সম্পূর্ণ লুনার ক্যালেন্ডার, যা হিজরি নামে পরিচিত। তবে মহম্মদের সময়ের আগে থেকেই আরবে একটি লুনার ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। হিজরি যখন চালু হয় তখন তাকে কোনো নম্বর দিয়ে প্রকাশ না করে সেই বছরে ঘটা কোনো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার নাম দিয়ে প্রকাশ করা হতো। যেমন, প্রথম হিজরির নাম হয় 'নিষ্ক্রমণের আজ্ঞা', ৬২২ খ্রিস্টাব্দ, যে বছরে মহম্মদ তাঁর ৭০ জন অনুগামী নিয়ে মক্কা থেকে মদিনা গমন করেন। হিজরি চালু হবার সতেরো বছর পর বছরের এই ধরণের নামকরণ প্রথা নিয়ে শুরু হলো বিস্তর ব্যবহারিক সমস্যা। খলিফা উমর তখন চালু করলেন নম্বর দিয়ে বছর প্রকাশের প্রথা। ঠিক হলো, 'নিষ্ক্রমণের আজ্ঞা'-র বছরটিকে ১ হিজরি ধরে গণনা শুরু। হিজরি যেহেতু লুনার ক্যালেন্ডার, এটির হিসাবে বছরে ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন ধরা হয়। অর্থাৎ সৌর বৎসরের থেকে ১০ বা ১১ দিন কম। মাসের সংখ্যা ভারতীয় প্রথার মতোই বারো। দিনসংখ্যা কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে ওঠানামা করবে আর তার জন্য মাসপ্রতি দিনের সংখ্যায় কী প্রভাব পড়বে সে আলোচনা এই নিবন্ধের বিচার্য বিষয় নয়। ইসলামের হাত ধরে ভারতবর্ষেও হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রবেশ ঘটলো। দিল্লির সুলতানি আমল সহ মুঘল আমলের প্রথম অংশ পর্যন্ত সমস্ত সরকারি কাজে ছিল এই হিজরি ক্যালেন্ডারের ব্যবহার। কিন্তু এর একটি সমস্যা ছিল। হিজরির কোনো একটি নির্দিষ্ট মাস ঋতুচক্রের কোনো একটি নির্দিষ্ট ঋতুতেই প্রতিবছর আবির্ভূত হয় না। অর্থাৎ, হিজরির মাস ও ঋতু সুসঙ্গত নয় মোটেই। কারণ স্পষ্ট। ঋতু নির্ভর করে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণের ওপরে। আর এদিকে হিজরির মূলভিত্তিটি দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর চারিদিকে চাঁদের প্রদক্ষিণের ওপরে। মুঘল বাদশাহ আকবরের সভাসদ টোডরমলের ওপরে দায়িত্ব ছিল ভূমিবন্টন ও রাজস্ব ব্যবস্থা সুস্থিত করার। আবুল ফজল ও টোডরমলের নজরে আসে যে হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি বছর কোনো একটি বিশেষ মাসেই চাষিরা ফসল ঘরে তোলে না। অর্থাৎ প্রতিবছর ফসল তোলার পর রাজস্ব আদায়ের মাস পরিবর্তিত হতেই থাকে। অ্যাকউন্টিংয়ে এটি একটি গুরুতর সমস্যা। উপরন্তু গণনায় দেখা গেল যে ৩০ সৌরবর্ষ ৩১ চান্দ্রবর্ষের সমান। অর্থাৎ প্রজাদের প্রতি তিরিশ বছর অন্তর এক বছর বেশি খাজনা দিতে হবে। আকবরের নির্দেশে শুরু হলো পরিমার্জনার কাজ। ১৫৮৪ সালে শুরু হলো নতুন ব্যবস্থা, যার নাম হলো তারিখ-ই-ইলাহি। এটি তৈরী হলো সেই প্রাচীন ভারতীয় লুনি-সোলার প্রথা অবলম্বন করেই।  মাসের নাম গুলি নেওয়া হলো অবশ্য পারস্যে প্রচলিত ফার্সি ভাষা থেকে। আর ইলাহির শুরুর বর্ষসংখ্যা রাখা হলো সেই বছরের হিজরির বর্ষসংখ্যার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে, ইসলামীয় ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখে। সেইজন্যে, যেহেতু হিজরি অনুযায়ী মহররম প্রথম মাস আর ভারতীয় প্রথায় বৈশাখ প্রথম মাস - পূর্ববর্তী বছরগুলির মধ্যে এমন একটি বছর বেছে নিতে হতো যখন মহররম ও বৈশাখ সমাপতিত হয়েছিল। অবাক কাণ্ড - ৯৬৩ হিজরি বা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে এমন ঘটনা ঘটেছিল। এই বছরেই দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে কিনা আকবর হিমুকে পরাস্ত করে নিজের মুঘল শাসন পুনরুদ্ধার করেন। বাদশাহের এই বিশেষ কৃতিত্বকে মহিমান্বিত করতে অতএব ৯৬৩ হিজরিকে ধরা হয় ইলাহির প্রথম বছর। তবে ওই বছরে ইলাহির বর্ষসংখ্যা ৯৬৩ ই রাখা হলো। ৯৬৩ ইলাহির পর আজ ৪৬৭ বছর কেটে গেছে। সুতরাং সেই হিসাবে আজ ১৪৩০ ইলাহি। হুবহু মিলে যায় বঙ্গাব্দের সঙ্গে। তবে আজ ১৪৪৪ হিজরি। ইলাহির সঙ্গে হিজরির আজকে তফাৎ ১৪ বছরের। এর কারণ আর কিছুই নয়, হিজরি বছর যেহেতু ইলাহি বছরের তুলনায় ১১ দিন কম, ইলাহি প্রচলনের সাড়ে চার শতকের মাথায় তফাতটা দাঁড়িয়েছে ১৪ বছরের। অর্থনীতি ও রাজস্ব নীতির প্রয়োজনে এই সংস্কার সেই সময়ের নিরিখে নিঃসন্দেহে এক পাথব্ৰেকিং কাজ। আসল কাজটি আকবরের সভাসদরা (টোডরমল তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন আর আবুল ফজলেরও যোগ্য সহায়তা ছিল) করলেও নিজস্ব ধর্মাচরণের ওপরে উঠে  হিন্দু গণনাব্যবস্থা অনুসারী ইলাহিকে স্বীকার করে নেবার জন্য আকবর যথার্থই কৃতিত্বের দাবিদার। এ সত্যিই তাঁর উদার মানসিকতা ও বাস্তববোধের পরিচয় দেয়। কিন্তু তাই বলে বঙ্গাব্দের প্রচলন আকবরের হাত ধরেই হয়েছিল - এ কতটা যুক্তিসঙ্গত? যোগ বিয়োগের অঙ্ক মিলে গেলেও প্রশ্ন থেকে

যায়। সেই প্রসঙ্গে আসছি এবারে।


তবে তার আগে অন্য একটি ন্যারেটিভের উল্লেখ করি। কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, যাঁরা ঘোষিতভাবে বর্তমান হিন্দুত্ববাদী ধারার কট্টর সমালোচক (এই তালিকায় এক অতিবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীও আছেন), বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দাবি করেন বঙ্গাব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার স্মৃতি। ক্ষুদ্রবুদ্ধির মানুষ আমি এই দাবির পেছনে কোনো যুক্তি পাইনি। কারণ, এক মুহূর্তের জন্য ইলাহির প্রবর্তক হিসাবে আকবরকেই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক ধরে নিলে তা প্রচলিত হয়েছিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে (১ হিজরি) নয়। আর ইলাহিকে ১ হিজরিতে এক্সট্রাপোলেট করলে ৩০ ইলাহি পাওয়া যায়। অর্থাৎ যদি  ইলাহি ব্যবস্থা হিজরিরও প্রাচীন হতো তাহলে ১ হিজরি সময়কালে ৩০ ইলাহি হতো। হয় বঙ্গাব্দের সঙ্গে মহম্মদের সম্পর্কের এই অধুনা দাবির সারবত্তা সাধারণ বুদ্ধিতে আমি বুঝতে পারিনি, নয় সর্বধর্মসমন্বয়ের মহৎ উদ্দেশ্যে এই অর্ধসত্য ন্যারেটিভটি প্রচারিত হয়েছে। যাক, এবারে অন্য চিন্তাধারার প্রসঙ্গে আসি।


বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা হিসাবে সর্বাগ্রে শশাঙ্কের নামই উঠে আসে। ধর্মাচরণে শৈব শশাঙ্ক ঘোষিতভাবে ছিলেন প্রবল বৌদ্ধ বিরোধী। থানেশ্বরের সম্রাট বৌদ্ধ হর্ষবর্ধনকে তিনি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ। এহেন শশাঙ্কের রাজত্বকাল ছিল ৫৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬২৫ খিস্টাব্দ পর্যন্ত। সময়ের হিসাবে ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বঙ্গাব্দের প্রচলন হয় যা শশাঙ্কের রাজত্বকালের অন্তর্গত। এখন, এমন কোনো প্রাচীন নথি পাওয়া যায়নি যা সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করে যে শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন। তবে প্রথম কথা হলো প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার ধারা অনুসরণ করলে এটা বুঝতে অসুবিধা নেই যে ভারতবর্ষে প্রায় অধুনা বিজ্ঞান অনুসারী সোলার ক্যালেন্ডার সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত মধ্যযুগীয় বাংলায় সুলতানি শাসনের আমলেও হিজরির পাশাপাশি গৌড়াব্দের প্রচলন ছিল। তৃতীয়ত আকবরের বহু আগে বাংলার সুলতান হুসেন শাহের আমলে রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে সরকারি কাজে গৌড়াব্দের পুনঃপ্রবর্তন হয়। চতুর্থত, বাঁকুড়া জেলায় হাজার বছরের পুরোনো কয়েকটি শিবমন্দিরে সেই সময়ে বঙ্গাব্দ প্রচলিত থাকার নিদর্শন পাওয়া গেছে। আর সর্বোপরি, বাঙলা ইলাহি থেকে শুধু অব্দ সংখাটিই নিলো, মাসের নাম গুলি হিন্দু মতেই রেখে দিলো, এটি সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর একটি কাউন্টার ন্যারেটিভও আছে। শশাঙ্ক যখন বাঙলা শাসন করছেন, তখন আসামের রাজা ছিলেন ভাস্করবর্মন। এঁরা দুজনে ছিলেন একে অপরের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। শশাঙ্ক আসাম আক্রমণ করেছিলেন। আবার হর্ষবর্ধনের সঙ্গে শশাঙ্কের যুদ্ধে হর্ষবর্ধনকে সেনা সহায়তা দিয়েছিলেন ভাস্করবর্মন। আসামের ক্যালেন্ডারের নাম ভাস্করাব্দ -  আর সংখ্যার হিসাবে এটি বঙ্গাব্দের সমান। অসমীয়ারা মনে করেন ভাস্করবর্মন প্রচলিত ভাস্করাব্দই বাঙলায় বঙ্গাব্দ হিসাবে গৃহীত হয়। 


স্বাধীন ভারতের এক কৃতী আইএএস অফিসার ছিলেন নীতিশ সেনগুপ্ত। চাকরিজীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সামলানোর শেষে অবসরের পর তিনি রাজনীতিতে আসেন ও লোকসভার সদস্য হন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি একটি বই লেখেন -  ল্যান্ড অফ টু রিভার্স: এ হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল ফ্রম মহাভারত টু মুজিব। দুই পক্ষেই প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে আর প্রাপ্ত অবস্থাগত প্রমাণের সাপেক্ষে এই বইয়ে বঙ্গাব্দের প্রচলক হিসাবে তিনি শশাঙ্ককেই বেশিরভাগ কৃতিত্ব দিয়েছেন আর কিছুটা দিয়েছেন হুসেন শাহকে। নিচে সেই বই থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করলাম। তবে তার আগে আমার নিজস্ব মত বলি। ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গায়ে ব্যাথা করে কোনো লাভ আছে কি? বঙ্গাব্দকে বঙ্গাব্দই বলুন। আজ থেকে হাজার বছর আগেও এর অস্তিত্ব ছিল। ভারতবাসী হিসাবে নিজেকে হীন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের সংস্কৃতি ও জ্ঞানের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তার সঙ্গে আকবরকেও যথাযথ সম্মান দিন, তাঁর উদার মনোভাবের সঙ্গে ভারতীয় ব্যবস্থা মেনে নিয়ে ইলাহি প্রচলনের জন্য। তবে প্রশ্ন করা থামাবেন না - না হলে শেখার রাস্তা রুদ্ধ হয়ে যাবে। এবারে রইলো নীতিশবাবুর বই থেকে উদ্ধৃতি।                  


Some historians have associated Allauddin Hussain Shah with the formalization of the Bengali era (Bangabda). This era actually began in AD 594, long before Hussain Shah. According to one school of thought, this was an adaptation of the Islamic Hijra lunar calendar (with 354 days)—which started in AD 622 to commemorate Prophet Muhammad’s journey from Mecca to Medina —to the solar calendar system of 365 days that was prevalent in India and under which the seasons like summer, winter, spring and monsoon occurred at fixed periods in a calendar year. The origin of the Bengali calendar is shrouded in mystery. Some historians attribute it to King Sasanka of Gaur (c. 606–37).

Chronologically, this has a high degree of probability. Whether this was started by Sasanka or whether it was a modification of the Hijra calendar, which too started around the same time and came to Bengal along with the Turkish conquest, is difficult to answer. But clearly this is the calendar starting around AD 594 which was given recognition as the standard Bengali calendar either by Hussain Shah or by Akbar (on the advice of Todar Mal) for facility of administration. In particular, the administration of land revenue could not depend on the uncertainty of a lunar calendar which had no relationship with the time of harvesting of foodgrains.

Akbar ascended the throne in AD 1556 (965 Hijra) and started a lunar calendar which he called Tarikh-e-Elahi on the model of a similar calendar in use in Persia. Interestingly, the expression Bangabda also came into use from AD 1556. The earliest reference to Bangabda occurs in two Shiva temples in Bankura district, one of them located at the village Dihargram and the other at a place called Sonatapan. Both these temples are around a thousand years old.

Clearly, the Bengali calendar was in existence at that time, well before Emperor Akbar. This supports the view that rather than Akbar, it was Ala-ud-din Hussain Shah who, on seeing the administrative difficulties the Hijra calendar created in land-revenue collection, gave his official approval to another calendar which might have been adopted around the time of Sasanka as the official calendar.

The first month was Baishakh and it ended with the month of Chaitra. It had 365 days, although months sometimes had thirty-two days and some others, twenty-nine. It is difficult to arrive at the exact truth, but surely the association of the Bengali calendar with one whom we have called the first Bengalee ruler of Bengal stands to reason and can be regarded as an additional feather in King Hussain Shah’s cap.


পার্থ মণ্ডল

বার্মিংহাম

ষোলই এপ্রিল, বিশ তেইশ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম