একজন সঙ্গীতার গল্প



আজ এক বছর পূর্ণ হলো। সঙ্গীতা নেই।

সঙ্গীতার সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৭ সালে। ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার কয়েক দিন পরেই। প্রথম পরিচয়েই আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।

আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম ছিল না। কিন্তু দুজন দুজনকে বুঝতাম।

আমি ছিলাম উড়নচন্ডী টাইপের ছেলে। কোনো কিছুই বেশি দিন ভালো লাগতো না। প্রায়ই বাড়ি থেকে পালাতাম। বান্দরবান কিংবা খাগড়াছড়িতে কিছু দিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসতাম।  

এভাবেই চলছিলো জীবন।

বন্ধু মহলে আমার নাম ছিলো ট্যুরিস্ট মাহবুব। একটা বড় সপ্ন ছিলো। কোন এক দিন মাউন্ট এভারেস্ট এর উপরে উঠবো। 

পড়ালেখা ভাল লাগতো না। বিশেষ করে আমার ডিপার্টমেন্টের পড়ালেখা। 

তখন ৩য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিলো। শেষ পরীক্ষার আগের দিন সিদ্ধান্ত নিলাম... আর পড়ালেখা করব না। 

বাসায় বললাম। মতবিরোধের এক পর্যায়ে বাসা থেকে আবার বের হয়ে গেলাম। 

সঙ্গীতাকে জানালাম। ও বললো, তোর যেটা ভাল লাগে তুই কর। কিন্তু চলবি কিভাবে?? 

আমি বললাম, জানি না।  

পরের দিন সঙ্গীতা কিছু টাকা নিয়ে আসলো। বললো, আমার টিউশনির টাকা। তুই চিন্তা করিস না। তোর হাত খরচের টাকা আমি টিউশনি করে ম্যানেজ করবো। তোর যেটা ভালো লাগে সেটাই কর।  

এভাবেই শুরু হলো ভিন্ন জীবন। চললো বেশ কিছু দিন। পড়ালেখা ছেড়ে আমি বনে বাদারে ঘুরে বেড়াতে থাকলাম। 

আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম ছিল না। আমি ছিলাম বোহেমিয়ান টাইপের ছেলে। প্রেম ট্রেম আমার মধ্যে ছিলো না।

বছর খানেক পরে আমার পরিবার বিষয়টা মেনে নিলো। ফিরে গেলাম বাসায়। সঙ্গীতার উতসাহে আবার পড়ালেখায় ফিরে এলাম। ভর্তি হলাম এমবিএতে। 

২০০৫ সাল। মাষ্টার্স শেষ করে সঙ্গীতা একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকুরী করছে। আর আমি এমবিএ করছি। এক দিন বললো, তোর সাথে জরুরী কথা আছে। ইউনিভার্সিটিতে আয়। 

আমি গেলাম। 

জানালো, ওর বাসা থেকে বিয়ে করার জন্য প্রেশার দিচ্ছে। বেশ কয়েকটা ভালো প্রস্তাবও এসেছে। এই বছরের মধ্যেই বিয়ে করতে হবে। 

আমি বললাম, সমস্যা কি? করে ফেল বিয়ে!!

সঙ্গীতা আমার দিকে অভিমান ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, না করবো না। তুই যদি রাজি থাকিস তবে তোকে বিয়ে করবো। আর না হলে, কাউকে করবো না। 

আমি জানতাম, আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম ছিল না। 

কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম, তুই কি পাগল হইছিস? আমি বিয়ে করবো?? কেমনে??? আর যদি বিয়ে করিও তুই কি ভালো থাকবি??

সঙ্গীতার উত্তর ছিলো, তুই ভালো থাকবি কি না জানি না। তবে আমি ভালো থাকবো। 

আমি বললাম, তোর মাথা ঠিক নাই। বাসায় যা। পরে আলাপ করবো। 

সঙ্গীতা বললো, আমার মাথা ঠিক আছে। আর শোন, যদি তুই বিয়ে করতে রাজি হস তবে আমার একটা শর্ত আছে। একটাই শর্ত। মাউন্ট এভারেস্ট পর্বতে উঠার প্ল্যান তোর বাদ দিতে হবে। 

অবাক হয়ে আমি বললাম, কেন???

উত্তরে সঙ্গীতা বললো, পাহাড়ে উঠতে গিয়ে তুই যদি মরে যাস তাহলে আমার কি হবে??

আমি কিছুক্ষন হাসলাম। বললাম, তোর যে মাথা ঠিক নাই এইটা আমি সিওর। বিয়েরই ঠিক নাই আর মাউন্ট এভারেস্ট.........!! যা বাসায় যা। 

বাসায় ফিরলাম। বিয়ে করার ব্যাপারে কখনোই চিন্তা করি নাই। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। খুব অস্থির কয়েকটা দিন কাটলো। একজন শুভাকাংখীর পরামর্শ ছিলো, বিয়ে তাকেই করবা যে তোমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। 

সঙ্গীতার সাথে দেখা করলাম। বললাম, বিয়ে করে সংসার চালাবো কিভাবে? 

বললো, চিন্তা করিস না। আমি তো চাকরী করছিই। 

আমি বললাম, বেকার ছেলের কাছে তোর বাপ বিয়ে দিবে? 

সঙ্গীতা বললো, তা হয়তো দিবে না। তুই সম্ভব হলে আপাতত কোনো একটা জব এর ট্রাই কর। যদি জব হয় তাহলে তো খুবই ভালো। বিয়ের পরে তুই জব ছেড়ে দিস। আর যদি জব না হয় এবং আমাদের ফ্যামিলি মেনে না নেয় তাহলে আমরা বাসা থেকে ভেগে যাবো। 

আইডিয়াটা পছন্দ হলো। 

কিভাবে যেন প্রথম ইন্টারভিউতেই চাকরী হয়ে গেলো। ২০০৫ এর জুন মাসে জয়েন করলাম। ডিসেম্বর এ বিয়ে করে ফেললাম। আর বিয়ের ১৪ দিন পরে চাকরী ছেড়ে দিলাম। 

সঙ্গীতা ছিলো আমার প্রতিটি মুহুর্তের প্রেরনা। আমার সব কিছুতেই ছিলো ওর দারুন উতসাহ। কিভাবে যেন আস্তে আস্তে আমাকে সংসারী করে তুললো। একটু একটু করে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলাম। এরই মাঝে বাবা হলাম, দুজন ভালো চাকরীতে ঢুকলাম। জীবন ছিলো কানায় কানায় পুর্ণ। সুযোগ পেলেই দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতাম। আত্নীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের কাছে একটি আদর্শ সুখী পরিবারের উদাহরন হয়ে উঠলাম আমরা। 

কিন্তু জীবন তো এত সহজ নয়!! হঠাত করেই সব এলোমেলো হওয়া শুরু হলো। ২০১৭ সালে মাত্র সাত মাস বয়সে  আমার ছেলের মৃত্যু হলো। এর এক মাস পরেই সঙ্গীতার ক্যান্সার ধরা পড়লো। স্টেজ ফোর, নন কিউরেবল ক্যান্সার। 

আবার সংগ্রাম শুরু হলো। এক মুহুর্তের জন্যও আমরা হাল ছাড়িনি। যুদ্ধটা ছিলো সময়ের সাথে। অবশ্যম্ভাবী বিষয়টাকে একটু পিছিয়ে দেয়া মাত্র। 

সঙ্গীতার একটাই টেনশন ছিলো। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি ও আমার মেয়ে কিভাবে সার্ভাইভ করবো সে বিষয়ে। লক্ষ্য ছিলো, কোনোভাবে মেয়েটাকে আর একটু বড় করা যায় কি না। 

এর মাঝেও আমরা আনন্দময় উচ্ছল জীবন কাটানোর চেষ্টা করেছি। অনেকেই অবাক হতো। কিভাবে আমরা পারি!! সঙ্গীতা ছিলো অনেকের জন্যই একটি প্রেরণা। 

এভাবেই যুদ্ধ চললো তিন বছর ধরে। গত বছরের এপ্রিল মাসে ওর শরীরটা একটু বেশি খারাপ হলো। ডাক্তার জানালো, খুব বেশি সময় নেই। আপনারা মানসিক প্রস্তুতি নিন।  

মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। কিন্তু সঙ্গীতা ছিলো স্বাভাবিক। এক দিন রাতে ঘুমাতে যাবার সময় আমাকে বললো, আমি মরে যাবার পরে তুমি যদি পারো মাউন্ট এভারেস্টে উঠার চেষ্টা করিও। আমি তো মরেই যাবো, তোমার সপ্নটাও মরে যাক এটা আমি চাই না।  

আমি কোন উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষন চুপ থেকে সঙ্গীতা আবার বললো, জানো, আমি এখন একটাই সপ্ন দেখি। 

আমি বললাম, কি?? 

খুব আস্তে আস্তে সঙ্গীতা উচ্চারণ করলো, মৃত্যুর সময় যেন আমি তোমার কাধে মাথা রেখে মরতে পারি। 

আমি এবারেও কোন উত্তর দিতে পারিনি। 

২০২০ সালের ১২ই মে আমার কাধে মাথা রেখেই সঙ্গীতা চলে গেলো। 

এবার হয়তো আমার এভারেস্টে যাবার সপ্ন পূরণ হবে......।।

(গল্পটি আমার বন্ধুরা অনেকেই জানে...তবুও দিলাম)

-Md Mahbub Alam

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম