"ফেসবুক ছাড়া জীবন অচল"
এরকম কথা আপনি নিজে বলেন বা অন্যান্যদের কাছে হয়তো শুনে থাকবেন। সোশ্যাল মিডিয়া এডিকশন যে কতটা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা বুঝার জন্য গবেষণা দরকার নেই এখন। জাস্ট চারদিকে চোখ রাখলেই বুঝা যায়।
ট্রল, সমালোচনা কিংবা ঘন্টায় ঘন্টায় নিজের ব্যাক্তিগত ব্যাপার সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ে আসা এখন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
অনেকেই বলবেন আহা! আমি ফেসবুক ব্যবহার করি বিনোদনের জন্য, কেউ বলবেন একাকীত্ব কাটানোর জন্য, কেউ বলবেন সোশ্যালি কানেক্ট থাকার জন্য। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে আমরা যে উদ্দেশ্য নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করি না কেন, আমাদের লাভ-ক্ষতির হিসেবে পিছিয়েই থাকি।
এভাবে আলাপ করলে পাত্তা দিবেন না তাই একটু এই টপিকের উপর হওয়া গবেষণার ফলাফল দেখিয়ে দিই।
১. ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যে বাচ্চাদের উপর একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা দিনে ৩ ঘন্টা কিংবা তারও বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছে অন্যদের তুলনায় তাদের মানসিক অসুস্থতার হার অনেক বেশি হয়!
২. ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকলে তা সরাসরি ডিপ্রেশন ও একাকীত্বের উপর পজিটিভ প্রভাব ফেলে! অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় না আসলেই আপনি ভালো থাকবেন।
৩. ২০২১ সালে ১৫০০ আমেরিকানদের উপর জরিপ চালানো হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৬% মানুষ মতামত দিয়েছে যে, হ্যাপিনেস এবং সেল্ফ-ইমেজের উপরে সোশ্যাল মিডিয়া সরাসরি নেগেটিভ প্রভাব ফেলে।
৭৯-৮৩% মনে করেন, ডিপ্রেশন, একাকীত্ব এবং anxiety, সোশ্যাল মিডিয়া দ্বারা নেতিবাচক প্রভাবিত হয়।
৪. এ বছরে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং নরওয়ে একটি যৌথ গবেষণা করে। গবেষণায় দেখা যায়, যারা বিনোদনের জন্য কিংবা একাকীত্ব দূর করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি এক্টিভ থাকেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা বাজে হয়ে থাকে।
৫. ২০২১ সালে ৬৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর একটি স্টাডিতে দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ব্রেক নিলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই মুড ভালো থাকে, ঘুম ভালো হয় এবং দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে।
তো, আমার প্রিয় ভাই-বোনেরা এতক্ষণের আলাপ থেকে বুঝলেন?
সোশ্যাল মিডিয়া গোপনে গোপনে আমাদের জীবনকে নরক বানিয়ে দিচ্ছে। তাহলে স্বর্গের অনুভূতি পাওয়ার জন্য অবশ্যই আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা উচিত।
চিল্লায়া বলেন কথা ঠিক না বেঠিক?
স্বভাবতই আপনার মনে এখন প্রশ্ন জাগবে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকব কীভাবে?
সকলে গোল হয়ে কাছাকাছি এসে বসুন। আজকের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশটাই এখন করব।
আপনার আসলে কি করা উচিত তা নির্ভর করে আপনি কোন উদ্দেশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্টিভ থাকেন তাঁর উপর। যে উদ্দেশ্য ব্যবহার করেন, তাঁর বিকল্প উপায় খোঁজাটাই হচ্ছে আপনার আসল কাজ!
_____________________
যদি আপনি বিনোদনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তবে :
কিছু মিমস আর শর্ট ভিডিও আপনাকে যতটুকু বিনোদন দিবে, তার চেয়ে বেশি কেড়ে নিবে।
শর্ট ভিডিও দেখতে দেখতে এক সময় আপনার মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কমে আসবে! আগের আলাপ তো পড়লেনই!
সুতরাং আপনার যদি আসলেই বিনোদনের প্রয়োজন হয় তাহলে :
১. সুযোগ থাকলে লাইভ মিউজিক প্রোগামে যান।
২. নতুন কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখুন।
৩. ফোনে ডাউনলোড করে বা ইউটিউব থেকে মুভি বা ড্রামা দেখুন।
৪. মার্শাল আর্ট বা নৃত্য শিখতে পারেন। আগে থেকে জানা থাকলে অন্য কাউকে শেখাতে পারেন। নিজের জানা জিনিস আরেকজনকে শেখানোর মধ্যে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে।
৫. কোথাও ঘুরতে যান।
৬. বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিন।
এককথায়, আপনার যা ভালো লাগে করুন কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় আসবেন না!
______
যদি রিল্যাক্স ফিল করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তবে :
রিল্যাক্স করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা একটা ফালতু কাজ। আপনার সামনে কখন কি এসে যাবে আপনি নিজেও জানেন না। যেকোনো মূহুর্তে মুড চেঞ্জ করে দিতে পারে আপনার।
সুতরাং রিল্যাক্স করতে চাইলে :
১. বাসা থেকে বের হয়ে একটু হেটে আসুন।
২. গান শুনুন। তবে বিরহের না গান না কিন্তু!
৩. রাতের বেলা হলে, বাতি নিভিয়ে মোম জ্বালিয়ে নিন। একটা এস্থেটিক ভাইব আসবে।
৪. বই পড়তে পারেন।
৫. যদি পারেন তবে কিছু একটা বানান। যে কোনো কিছু। ক্র্যাফটিং আরকি! রান্নাবান্না জানলে মজার কোনো খাবার রান্না করে ফেলুন।
আমাকে দিতে হবে না, নিজেই খান।
৬. পোষা প্রাণী থাকলে তাদের সাথে খেলা করুন। অন্যরকম শান্তি পাবেন।
৭. মেডিটেশন বা ইয়োগা করতে পারেন।
৮. চা, কফি কিংবা চকোলেট খেতে পারেন।
৯. গ্যালারির পুরনো ছবি দেখুন। তবে প্রাক্তনের ছবি না।
___________
যদি অন্যদের সাথে কানেক্টেড থাকার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তবে :
১. সোশ্যাল মিডিয়ায় টুং-টাং না করে তাদের সরাসরি কল দিয়ে কথা বলার অভ্যাস করুন।
২. যারা কাছাকাছি থাকে তাদের সাথে সরাসরি আড্ডা দিন।
৩. মজাদার কোনো আইটেম রান্না করে বন্ধুদের কিংবা প্রতিবেশীদের দাওয়াত দিতে পারেন। জমিয়ে আড্ডা হবে।
৪. সামাজিক বিভিন্ন সংগঠনে ভলান্টিয়ার হিসেবে যোগ দিতে পারেন। সোশ্যাল কানেক্টিভিটি বাড়বে আপনার।
মানে, সোশ্যালি কানেক্টেড থাকার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করে বাস্তবেই কানেক্টেড হতে হবে।
আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা একেবারেই কম। সে হিসেবে, এই লেখাটিও সিরিয়াসলি নেওয়ার লোক খুব বেশি হবে না।
কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, আপনি স্বীকার করুন আর না করুন, সোশ্যাল মিডিয়া আপনার আমার কাছ থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে।
যাই বলি না কেন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকাটা অনেক টাফ। তাই আমাদের লক্ষ্য থাকবে সোশ্যাল মিডিয়া কম ব্যবহার করা এবং করলেও যাতে নেগেটিভ প্রভাব যাতে না পড়ে সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকা।
কিভাবে সতর্ক থাকবেন?
১. যেসব প্রোফাইল আপনার মুড এবং সেল্ফ ইমেজে নেগেটিভ প্রভাব ফেলে সেগুলো আনফলো করে দিন।
২. নিজে হীনমন্যতায় ভুগেন এরকম কোনো ছবি প্রোফাইল থেকে সরিয়ে ফেলুন।
৩. অযথা ট্রল বা সমালোচনা থেকে বিরত থাকুন।
৪. ফেসবুকে বেশি বেশি শো অফ করবেন না।
৫. ফেসবুকে কারও শো অফ দেখে তার সাথে নিজেকে তুলনা করবেন না। সবাই তাঁর বেস্ট কিছু শো অফ করতে চায়, কিন্ত তাদের লাইফেও ডার্ক সাইড আছে।
আপনি নিজের প্রতি নিজে কৃতজ্ঞ থাকুন। আরেকজনের বাড়ি-গাড়ি বা গফ-বফ আপনার জীবনে আসলে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না।
তাহলে আজাইরা চিন্তা করে লাভ কী?
বাস্তব জীবনে মন দিন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকুন।
আপনার জীবন সুখী হোক।💝
ইমামুল হাসান