অর্জুন গাছের ঔষধি গুন



পরিচিতি:   ভেষজশাত্রে ঔষধি গাছ হিসাবে অৰ্জুনের ব্যবহার অগনিত। বাড়িতে একটি অর্জুন গাছ রাখা আর একজন ডাক্তার রাখা একই কথা। এটি কমব্রিটেসি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এ গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Terminalia arjuna , সংস্কৃত নাম ককুভ। বৃহদাকৃতির বহুবর্ষজীবী এই উদ্ভিদটি প্রায় ১৮-২৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। গাছটির মাথা ছড়ানো ডালগুলো নীচের দিকে ঝুলানো থাকে। পাতা দেখতে অনেকটা মানুষের জিহবাকৃতির। ছাল খুব মোটা এবং ধূসর বর্ণের। গাছ থেকে সহজেই ছাল উঠানো যায়। বলা হয়ে থাকে, অর্জুন গাছে অজস্র শক্ত ফল হয়। ফল দেখতে কামরাঙ্গার মত, পাঁচ খাঁজ বিশিষ্ট কিন্তু আকৃতিতে অনেক ছোট। শীতের শেষেই সাধারণত গাছ নিষ্পত্র হয়ে যায় এবং বসন্তে নতুন পাতায় গাছ ভরে যায়। নতুন পাতা গজানোর সময়েই গাছের শাখাগুলো পুষ্পমঞ্জরিতে ভরে ওঠে। এর ঔষধি গুন মানবসমাজের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই। শরীরের বল ফিরিয়ে আনা এবং রণাঙ্গনে মনকে উজ্জীবিত রাখতে অর্জুন ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে মহাভারত ও বেদ-সংহিতায়। তারপর যত দিন যাচ্ছে ততই অর্জুনের উপকারী দিক উদ্ভাবিত হচ্ছে।


অর্জুনের কিছু উপকারী দিক বর্ণনা করা হলোঃ

 ➢ যাদের বুক ধড়ফড় করে অথচ উচ্চ রাক্তচাপ নাই, তাদের পক্ষে অর্জুন ছাল কাঁচা হলে ১০-১২ গ্রাম, শুকনা হলে ৫-৬ গ্রাম একটু ছেঁচে ২৫০ মিলি দুধ ও ৫০০ মি লি জল এর সাথে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে আনুমানিক ১২৫ মিলি থাকতে ছেঁকে বিকেলবেলা খেলে বুক ধড়ফড়ানি কমে যায়। তবে পেটে যাতে বায়ু না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। 

 ➢ অর্জুন ছাল বেটে খেলে হৃৎপিন্ডের পেশি শক্তিশালী হয়, হৃৎপিন্ডের ক্ষমতা বাড়ে। এটি রক্তের কোলেষ্টরল কমায় এবং ফলত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে থাকে। 

 ➢ বিচুর্ণ ফল মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে এবং লিভারসিরোসিসের টনিক হিসাবে ব্যাবহৃত হয়। 

 ➢ অর্জুনের ছালে ট্যানিন রয়েছে, এই ট্যানিন মুখ,জিহ্বা ও মাড়ীর প্রদাহের চিকিৎসায় ব্যাবহার হয়। এটি রক্তপাত বন্ধ করে এবং শরীরে ক্ষত, খোস পাঁচড়া দেখা দিলে অর্জুনের ছাল বেটে লাগালে সেরে যায়। 

 ➢ এই গাছের ছাল ঋতুস্রাবজনিত, হাঁপানি, আমাশয়, ব্যথ্যা প্রদর ইত্যাদি চিকিৎসায় ব্যাবহার করা হয় । 

 ➢ এটি সংকোচ ও জ্বর নিবারক হিসাবেও কাজ করে। 

 ➢ অর্জুনে saponin নামক রাসায়নিক রয়েছে যা যৌন উদ্দীপনা বাড়ায়। তাই চর্ম ও যৌন রোগে অর্জুন ব্যাবহ্রত হয়। যৌন উদ্দীপনা বাড়াতেও অর্জুনের ছালের রস ব্যাবহার হয়। 

 ➢ অর্জুনের ছালে essential oil রয়েছে তাই অর্জুন খাদ্য হজম ক্ষমতা বাড়ায়। খাদ্যাতন্ত্রের ক্রিয়া স্বভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

 ➢ অর্জুন ক্যান্সার কোষের বর্ধন রোধকারী এ কারনে এটি ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।

 ➢ এর বাকল থেকে আহরিত ট্যানিন চামড়াতে ব্যবহৃত হয়। অর্জুনের বাকল থেকে হৃদরোগের ওষুধ , পাতার রস থেকে আমাশয় রোগের ওষুধ বানানো হয় এবং পাতা তসর রেশম পোকার খাদ্য। 

 ➢ পরিপক্ক গাছ থেকে ছাল সংগ্রহ করে ছোট ছোট টুকরো করে ৪-৫দিন রৌদ্রে শুকিয়ে চটের বস্তায় ভরে শুষ্ক স্থানে রেখে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় এবং এর কার্যকারিতা অটুট থাকে। এছাড়া পুরোপুরিভাবে পরিপক্ক বীজ গাছ থেকে সংগ্রহ করে ভালোভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে রেখে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। 

 ➢ বৈজ্ঞানিক গবেষণাতে প্রমাণিত যে দুধের সাথে অর্জুনের বাকল খেলে কোলেস্টেরলএর মাত্রা হ্রাস পায়। এটি একটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, তাই লিপিডএর পারঅক্সিডেশান প্রতিরোধ হয়, ফলে এথেরোস্ক্লেরোসিসএর ঝুঁকি কম হয়। 

 ➢ কাশির উপসর্গ হ্রাস করতে কার্যকর। কিন্তু মানব-দেহে পরীক্ষার ফলাফলের অনুপস্থিতিতে উচিৎ হবে একজন আয়ুর্বেদ চিকিৎসকের কাছে অর্জুন বাকলের কাশি নিরাময়ের প্রভাবের বিষয়ে জেনে নেওয়া। 

 ➢ অসুস্থ হূদযন্ত্রকেও ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলে৷ অর্জুন ছালের রস কো-এনজাইম কিউ-১০ সমৃদ্ধ । এই এনজাইম হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করে । বাকলের রস ব্লাড প্রেসার এবং কোলেস্টেরল লেভেল কমায় । অর্জুনের ছাল বেটে রস খেলে হৃদপিন্ডের পেশি শক্তিশালী হয় এবং হৃদযন্ত্রের ক্ষমতা বাড়ে । বাকলের ঘন রস দুধের সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেতে হবে। বাকলের রস না থাকলে শুকনো বাকলের গুঁড়া ১-২ গ্রাম দুধের সাথে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেতে হবে।

 অর্জুনের বাকল কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপ হ্রাস করে, যে দুটি হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ বলে চিহ্নিত। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ক্লটিং গুণ থাকাতে অর্জুনের বাকল স্ট্রোক, হৃদরোগ এবং বয়স সম্পর্কিত কার্ডিওভাসকুলার সমস্যাগুলি প্রতিরোধ করে। 

 ➢ অ্যাজমা: অর্জুন ছালের পাউডার ১২ গ্রাম দুধের ক্ষীর বা পায়েসের সাথে মিশিয়ে খেলে অ্যাজমা আক্রান্ত ব্যক্তির অ্যাজমা রোগের স্থায়ী সমাধান হবে।

 ➢ প্রাচীন বৈদ্যেরা অর্জুন ছালের গুঁড়া, বাসক পাতার রসে ভিজিয়ে শুকিয়ে রাখতেন। দমকা কাশি হতে থাকলে একটু ঘি ও মধু বা মিছরির গুঁড়া মিশিয়ে খেতে দিতেন। এতে কাশির উপকার হতো। 

 ➢ হাড় মচকে গেলে বা চিড় খেলে: অর্জুন ছাল ও রসুন বেটে অল্প গরম করে মচকানো জায়গায় লাগিয়ে বেঁধে রাখলে সেরে যায়। তবে সেই সাথে অর্জুন ছালের চূর্ণ ২-৩ গ্রাম মাত্রায় আধা চামচ ঘি ও সিকি কাপ দুধ মিশিয়ে অথবা শুধু দুধ মিশিয়ে খেলে আরও ভালো হয়। 

 ➢ ত্বকে ব্রণের ক্ষেত্রে অর্জুন ছালের চূর্ণ মধুর সাথে মিশিয়ে ব্রণের উপর লাগালে খুব দ্রুত উপকার হয়। এছাড়া ছালের মিহি গুঁড়া মধু মিশিয়ে লাগালে মেচতার দাগ দূর হয়।

 ➢ বুক ধড়ফড় - যাদের বুক ধড়ফড় করে অথচ উচ্চ রক্তচাপ নেই তাদের পক্ষে অর্জুন ছাল কাঁচা হলে ১০-১২ গ্রাম, শুকনা হলে ৫-৬ গ্রাম একটু ছেঁচে ২৫০ মিলি দুধ ও ৫০০ মিলি পানির সাথে মিশিয়ে জলে ফুটিয়ে ছেঁকে বিকাল বেলা খেলে বুক ধড়ফড়ানি অবশ্যই কমবে। লো-ব্লাড প্রেসারে উপযুক্ত নিয়মে তৈরি করে খেলেও অবশ্য প্রেসার বাড়বে।

 ➢ মাঝে মাঝে কারণে বা অকারণে রক্ত ওঠে বা পড়ে। সেক্ষেত্রে ৪-৫ গ্রাম ছাল রাত্রিতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেঁকে নিয়ে পানিটা খেলে উপকার পাওয়া যায়। 

 ➢ ফোঁড়া হলে পাতা দিয়ে ঢেকে রাখলে ফোঁড়া ফেটে যায়, তারপর পাতার রস দিলে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়।

 ➢ শরীরে ক্ষত বা ঘা হলে, খোস-পাঁচড়া দেখা দিলে অর্জুনের ছালের ক্বাথ দিয়ে ধুয়ে ছালের মিহি গুঁড়া পানি দিয়ে মিশিয়ে লাগালে দ্রুত ঘা সেরে যায়। 

 ➢ কানের ব্যথায় অর্জুন ব্যবহার করা হয়। কচি পাতার রস কানের ভিতরে দুই ফোঁটা করে দিলে কানের ব্যথা ভালো হয়। 

 ➢ যাদের মধ্যে যৌন অনীহা দেখা দেয় তাদের ক্ষেত্রে অর্জুনের ছাল চূর্ণ উপকারী। এই ছাল চূর্ণ দুধের সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত খেলে এই রোগ দূর হয়। এছাড়া যাদের শুক্রমেহ আছে তারা অর্জুন ছালের গুঁড়া ৪-৫ গ্রাম ৪-৫ ঘণ্টা আধা পোয়া গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে, তারপর ছেঁকে ওই পানির সাথে ১ চামচ শ্বেতচন্দন মিশিয়ে খেলে উপকার হয় । 

 ➢ ৪-৫ গ্রাম অর্জুন ছালের ক্বাথে ছাগলের দুধ মিশিয়ে খেলে রক্ত আমাশয় ভালো হয়।

 ➢ পেটের সমস্যা দেখা দিলে অর্জুনের ছাল এর রস খেলে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । 

ইদানিং অর্জুন গাছের ছাল থেকে ‘অর্জুন চা’তৈরি হচ্ছে যা হৃদরোগের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। DOS থেরাপি অনুযায়ী অর্জুন ফল দেখতে মানব দেহের হৃদপিন্ডের মতো তাই অর্জুনকে হৃদরোগের মহৌষধ বলা হয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম