আদিপিতা কুদ্দুস
গতপর্বে আমরা "কুদ্দুস গরুর খামার"এ গরু চুরি হওয়ার মাধ্যমে জেনেটিক ড্রিফটের ধারণা নিয়েছিলাম। ড্রিফট জিনিসটা খুশিতে-ঠেলায়-ঘোরতে হয়, কোনো কারণ, উদ্দেশ্য, প্রভাবের প্রভাব থাকেনা।আজকে আমরা চলে যাবো আমাদের কুদ্দুসের কাছেই।
আমাদের হাইপোথেটিকাল কুদ্দুস থাকে হাইপোথেটিকাল বছিরনগরে, সমুদ্রের পাড়ে একটা ছোট লোকালয়, যেখানে মোট জনসংখ্যা ১০০০।এই ১০০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০ জনের মধ্যে বিশেষ একটা ট্রেইট আছে, কুদ্দুস সেই ১০ জনের একজন।
তারা তাদের জিহ্বা দিয়ে নাকের আগা স্পর্শ করতে পারে।কিন্তু, তাদের কেউই নিজেদের এই অসাম বৈশিষ্ট্যটা খেয়াল করেনি কখনো।খেয়াল না করাটাই স্বাভাবিক।
চমৎকার একখান ইউনিক বৈশিষ্ট্য বলে কথা!
একদিন, বছিরনগরের ৯জন বাসিন্দা মিলে ঠিক করলো যে তারা নৌকায় করে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবে, ৯ জনের প্রধান ছিলো কুদ্দুস।কুদ্দুস নৌকা চালাবে।
তারা গেল, বিকালে সমুদ্রে ঝড় উঠলো, নৌকা ভেসে চলে গেল কতদূর!কোন জায়গায় কে জানে।রাত কাটলো, সকালে তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করলো সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায়।
কী আর করার, সেখানেই কোনোমতে খাবার-দাবার জোগাড় করে দিন কাটাতে লাগলো। ছেলে-মেয়ে ছিলো, প্রজনন করলো।
তারা ১০ থেকে ২০, ২০ থেকে ৪০,৪০ থেকে ৮০ হলো। জনসংখ্যা বাড়তে লাগলো।
কয়েকশ বছর পর সেই জায়গায়, সমুদ্রের মাঝে লোকালয় গড়ে উঠলো।
একদিন, এক লোক হঠাৎ নিজের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলো।
"সে জিহ্বা দিয়ে নিজের নাকের আগা স্পর্শ করতে পারে!"
সারা গ্রামে এই কথা রটে গেল, সবাই কৌতুহলে নিজেও চেষ্টা করে দেখলো যে তারা পারে কিনা। দেখা গেল যে, সবাইই এই অদ্ভুত জিনিসটা করতে পারে।
অনেক বড় গল্প বললাম।
এবার, বিজ্ঞান!
এখানে ব্যাপারটা ঘটেছে কী?
ওইযে ১০ জন বিশেষ ট্রেইটধারী ছিলোনা বছিরনগরে? তারাতো জানতো না যে তারা ওই বিশেষ ট্রেইটটা ধারণ করে। একদম র্যান্ডমলি,বলা যায় দুর্ভাগ্যবশত, তাদের মধ্যে ৯জনই সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলো।
আবার বলি, "র্যান্ডমলি"।
মানে মাছ ধরতে যাওয়া ৯ জনই সেই বিশেষ ট্রেইটধারী ১০ জনের ৯ জন। তারাই নতুন লোকালয়ের আদিপিতা,কুদ্দুস তাদের একজন। ফলে কুদ্দুসদের বংশধরদের মধ্যে,এক্কেবারে সবার মধ্যেই এই বিশেষ ট্রেইটটা আছে,কারণ তাদের আদিপিতাদের সবার মধ্যেই একই ট্রেইট ছিলো। মানে, একটা নতুন জনসংখ্যার উৎপত্তি হয়েছে ও একটা ট্রেইট বিস্তার লাভ করেছে, নাটকীয় ভাবে।
আমরা প্রত্যক্ষ করলাম "ফাউন্ডার ইফেক্ট", জেনেটিক ড্রিফটের বিশেষ প্রকার।যখন একটা জনসংখ্যা থেকে একদল লোক,যাদের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি ওই টোটাল জনসংখ্যার এলিল ফ্রিকোয়েন্সিকে রিপ্রেজেন্ট করেনা, তারা যখন মাইগ্রেট করে অন্য স্থানে চলে যায় ও সম্পূর্ণ নতুন জনসংখ্যার উৎপত্তি ঘটায়, তখন নতুন জনসংখ্যার এলিল ফ্রিকোয়েন্সি আগেরটা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে,আর উভয় জনসংখ্যারই জেনেটিক ভ্যারিয়েশন বা জিন-বৈচিত্র কমে যায়, একেই বলে ফাউন্ডার ইফেক্ট।
আমাদের নতুন লোকালয়ের আদিপিতারাতো বছিরনগরেরই অধিবাসী। বছিরনগরের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি আর এই ৯ জন থেকে উৎপন্ন লোকালয়ের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি কী এক? কখনোই না।কারণ এই ৯ জনই বিশেষ ট্রেইটটা ধারণ করে, আর বাকি থেকে যাওয়া ৯৯১ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন এই ট্রেইটধারী।তাই, তাদের এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে আকাশ-পাতাল তফাৎ, ওই ৯ জনের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি দেখে সমগ্র বছিরনগরকে বিচার করা যাবেনা। আবার, যখন ৯ জন বছিরনগরে ছিলো, তখন বছিরনগরের জিনপুলে অদ্ভুত এই ট্রেইটটাও ছিলো,বৈচিত্র ছিলো। কিন্তু যখনই ৯ জন চলে গিয়ে নতুন জনসংখ্যার উৎপত্তি ঘটালো, বড় একটা বৈচিত্র কমে গেল।আর নতুন লোকালয়ে বৈচিত্র নেই বললেই চলে, কারণ সবার মধ্যেই একই ট্রেইট।সুতরাং, ওভারঅল, জিন ভ্যারিয়েশন কমেছে।(জিনপুল তেমন কিছু না,একটা জনসংখ্যার সব জিনের সেট)
ক্লিয়ার?
ফাউন্ডার ইফেক্টের ফলে জিনোটাইপ ও ফিনোটাইপে বিপুল পরিবর্তন আসতে পারে।আমরা বছিরনগরের উদাহরণের মাধ্যমে শুধু জিনোটাইপ নিয়েই কথা বলেছি।ফিনোটাইপ বললে হোমোজাইগাস-হেটেরোজাইগাস অনেক কিছু চলে আসতো, ঝামেলা বাড়তো, কিন্তু ফলাফল একই হবে।
আচ্ছা,আমাদের গ্যালাপ্যাগোসের ফিঞ্চ আর কচ্ছপদের কথা মনে আছে? যারা দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্যালাপ্যাগোসে চলে গিয়েছিলো? বিখ্যাত একটা হাইপোথিসিস হলো, ওখানেও এই জেনেটিক ড্রিফট ঘটেছিলো, ফাউন্ডার ইফেক্ট। আর এই ফাউন্ডার ইফেক্ট হয়ে যাওয়ার পর ন্যাচারাল সিলেকশন সবকিছু নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেয়, তারপর ভিন্ন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে।
বিপর্যয়ে বিবর্তন
বছিরনগরে এবার মাত্র ১০০ জন লোক থাকে। সরকারের টাকা বেশি হয়ে গেছিলো, তাই কয়েক কোটি টাকার বাজেট ধরে সরকার সেখানে লোক পাঠালো বছিরনগরের লোকজনদের চুলের রঙ দেখার জন্য।তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখল আর জানতে পারলো, ২৫ জন কালচে খয়রি আর ৭৫ জন কালো।
এর কয়েকদিন পরেই, লোকসংখ্যা তখনো বাড়েনি,
একদিন ক্যাটাগরি পাঁচ এর ঘূর্ণিঝড় হলো,৩৫ জন মারা গেল।
১ মিনিটের নীরবতা।
শেষ।
ত্রাণ সহায়তা দিতে সরকারি লোকজন আসলো। বাকি ৬৫ জনকে ত্রাণ দেয়ার সময় দেখা গেল কোনো লোকের চুলই কালচে খয়রি না।
মানে, সেই ২৫ জনই মারা গেছে। র্যান্ডমলি।
এবার, সেখানে যত শিশু জন্ম দেবে, সবার চুলই কালো হবে, কারণ কালচে খয়রি এলিলওয়ালা কেউ বেঁচে নেই।
সুতরাং, এলাকার জিন পুলে আর এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে বিপুল পরিবর্তন আসছে, জিন ভ্যারিয়েশন কমে গেছে। কীভাবে? কোনো একটা আকস্মিক বিপর্যয়ের কারণে, এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়। একে বলে "Bottleneck effect"
একটা বোতলে লাল,নীল,হলুদ,কমলা, এই চার রঙের মারবেল ভরলাম, তারপর মুখ খুলে বোতলটাকে ঝারা দিলাম। কতটুকু সম্ভাবনা আছে যে প্রত্যেক রঙের সমান সংখ্যক মারবেল বের হবে?
একেবারেই কম। সম্ভাবনা বেশি হলো, কোনো নির্দিষ্ট রঙের মারবেল বেশি বের হবে।
বোতলের ভেতরের মারবেলের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি আর বের হওয়া মারবেলের এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে আকাশ-পাতাল তফাৎ।
মানে, উৎপন্ন হওয়া ডটার পপুলেশন এর প্যারেন্ট পপুলেশনকে রিপ্রেজেন্ট করেনা। আর উৎপন্ন হবে কীভাবে? যেকোনো দুর্যোগ,বিপর্যয় বা আকস্মিক জনসংখ্যা হ্রাসকারী কোনো ঘটনার মাধ্যমে।
এইটাই বটলনেক ইফেক্ট, আরেকপ্রকার জেনেটিক ড্রিফট। বুঝছেন?
আসলে এখানে যত সহজে ব্যাখ্যা করলাম তত সহজ না। কারণ, কালো চুল যদি হোমোজাইগাস না হয়ে হেটেরোজাইগাস হয়, তাহলে প্রজননের সময় ডমিনেন্ট-রিসেসিভ রিকম্বাইন হয়ে কালচে খয়রির জন্য প্রয়োজনীয় জিনোটাইপ আবার তৈরি হতে পারে। আবার এখানে হেটেরোজাইগাস আর হোমোজাইগাসের দুইপ্রকার, এই তিনটা ফিনোটাইপ থাকার কথা, কিন্তু বোঝার সুবিধার্থে আমরা দুইটা, কালো আর কালচে খয়রি ধরে নিয়েছি।
এই গেল একটা ঝামেলা, আরেকটা হলো, শুধু বটলনেক বা শুধু ফাউন্ডার ইফেক্ট হয়ে আলাদা প্রজাতি তৈরির মতো জিনপুলে হঠাৎ আমূল পরিবর্তন আসা একটু কঠিন।
কারণ র্যান্ডমলি একটা নির্দিষ্ট ট্রেইটেধারী সবাই মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও কম, ২-১ জন থেকেই যাবে,তাই ওই ট্রেইটটাকে টোটালি নির্মূল করতে ফাউন্ডার আর বটলনেক পরপর হওয়া লাগবে। মানে দুইটা ছাকনির মতো।
আর তা না হলে ট্রেইটটা টোটালি ধ্বংস হওয়ার একমাত্র উপায় প্রজননের সময় র্যান্ডম রিকম্বিনেশন।মানে, প্রজননের সময় একেবারে র্যান্ডমলি সেই ফিনোটাইপের জন্য প্রয়োজনীয় জিনোটাইপটা তৈরি হবে না।
মনে করেন, যেই ট্রেইটটা ধ্বংস হবে, সেটার জিনোটাইপ dd আর টিকে যাবে Dd. রিকম্বিনেশনের সময় dd,DD,Dd, তিনটাই তৈরি হতে পারে। কিন্তু, র্যান্ডমলি যদি কারোর মধ্যেই dd তৈরি না হয়, তাহলেই বহু প্রজন্ম পর ট্রেইটটা নির্মূল হবে।কিন্তু এটা একবারে হবেনা, হবে কয়েক মিলিয়ন বছরে, কয়েক হাজার প্রজন্মে।
এভাবে বহু প্রজন্মের পর সেই ফিনোটাইপ, সেই ট্রেইট টোটালি ধ্বংস হয়ে যাবে, আর জনসংখ্যাটা একটা নতুন প্রজাতি হওয়ার দিকে আরেকধাপ এগিয়ে যাবে।
আজ এতটুকুই।
জানি, ভাষাটা একটু কঠিন আর জটিল হয়ে গেছে, বুঝতে অসুবিধা হলে বলেন, পিডিএফ করার সময় আরো ব্যাখ্যা করবো তাহলে।
স্থির নাকি চলমান?
আমরা বিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তিগুলোর একটা, জেনেটিক ড্রিফট নিয়ে আলোচনা করে ফেলেছি। এখন, জেনেটিক ড্রিফট বা ন্যাচারাল সিলেকশন হওয়ার পর একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে, সেটা নিয়ে আলোচনা করবো।
আমরা আগের পর্বগুলোতে বিষয়বস্তুগুলো বোঝার সুবিধার্থে যত উদাহরণ দিয়েছি, সবক্ষেত্রে কী হয়েছে?
ডারউইনগর,কুদ্দুস গরুর খামার,বছিরনগর ইত্যাদি ইত্যাদি, কী হয়েছে সবশেষে?
সবক্ষেত্রেই শেষমেষ একটা ট্রেইট জনসংখ্যার সবার মধ্যে চলে এসেছে, মানে একটা এলিল প্রত্যেকের জিনে স্থান করে নিয়েছে। মানে? একটা এলিলের ফ্রিকোয়েন্সি ১০০% হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ প্রত্যেকের মধ্যেই ওই এলিলটা আছে।এলিলটা ওই জনসংখ্যার জিন পুলে fixed হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনাকে বলে Fixation. স্থায়ীকরণ বা স্থিরীকরণ।
একটা জনসংখ্যার জিন পুলে একই জিনের দুইটা এলিল থাকার অবস্থা থেকে একটা এলিল টিকে যাওয়া ও আরেকটি বিলুপ্ত হওয়ার ঘটনাকে ফিক্সেশন বলে। এটা প্রধানত ন্যাচারাল সিলেকশন আর জেনেটিক ড্রিফটের মাধ্যমে হয়। নতুন কোনো মিউটেশন হওয়া আর "হেটেরোজাইগোট এডভান্টেজ", এই দুইটার অনুপস্থিতিতে এই ফিক্সেশন অবস্থা বিরাজ করে।
মিউটেশন হলে নির্দিষ্ট এলিলের ফ্রিকোয়েন্সি ১০০% থাকলোনা, ফিক্সেশন ভঙ্গ হলো, বুঝলাম। কিন্তু এই হেটেরোজাইগোট এডভান্টেজ টা কী? এটা হলো এমন একটা অবস্থা, যেখানে হেটেরোজাইগোট জিনোটাইপটা হোমোজাইগোট থেকে বেশি সুবিধাজনক। তাই, হেটেরোজাইগোট এডভান্টেজ থাকলে সেটাই সিলেক্টেড হবে, ফলে প্রজননকালে ডমিনেন্ট-রিসেসিভ রিকম্বাইন হয়ে হোমোজাইগাস রিসেসিভ বা ডমিনেন্ট, দুইটাই তৈরি হতে পারে, এতে আবার ফিক্সেশন ভঙ্গ হবে। হেটেরোজাইগোট এডভান্টেজ নিয়ে পিডিএফে আরো লিখবো।
এই ফিক্সেশনে মূলত বায়োলজির থেকে গণিত বেশি, কতক্ষণ লাগবে ফিক্সড হতে, সম্ভাবনা কত, ব্লা ব্লা। আমরা আর ওদিকে গেলাম না।
মূল ব্যাপার হচ্ছে, অনেক স্বঘোষিত বিজ্ঞানী, ধরে নেন যে একটা মিউট্যান্ট জিন এর ফিক্সেশন হওয়ার সময় আর বাকি কোনো জিন এর কোনো কার্যকলাপ হবে না, সব ফ্রিজ হয়ে থাকবে।তারপর তারা হিসাব করেন, "অস্ট্রেলোপ্যাথিকাস থেকে মানুষ আসতে গেলে মাত্র ৮ টা উপকারী মিউটেশন হতে গেলে ১৮ বিলিয়ন বছর লাগবে!"
তারা ধরে নেন যে, একটা মিউটেশন হয়, হওয়ার সময় অন্য কোনো জিন কাজ করেনা। চুপ করে থাকে। সেটা মিউটেশন হয়, ফিক্সেশন হয়, তারপর কয়দিক ছুটি কাটায়, তারপর গিয়ে আরেকটা শুরু হয়।
এইরকম জ্ঞান নিয়ে যারা বিবর্তনের ওপর বই লিখে ফেলেন দেখে আমার বিখ্যাত গায়ক মাহফুজুর রহমানের কথা মনে আসে।
আসলে, মানুষের মধ্যে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে মিউটেশনের সঠিক সংখ্যা কত, তা এখনো নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। কোনো গবেষণায় উঠে এসেছে ৩-১০ টা, আবার কেউ বলেছে ৪২-৬৪ টা। সে যাই হোক, কিন্তু সংখ্যাটা ২০ এর কম হবে বলে আমার মনে হয়না।
সাধারণ যুক্তি খাটান, মানুষের জিন আছে প্রায় ২৫-৩০ হাজার। এতগুলো জিন, চিন্তা করুন,একপ্রজন্মে কতগুলো মিউটেশন হওয়া সম্ভব? আর মিউটেশনের ফলে প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যের ওপর সিলেকশনতো সর্বদাই চলে। আবার আছে জেনেটিক ড্রিফট, যেখানে কখন কোন ট্রেইট সিলেক্ট হয়ে যাবে, কেউ জানেনা!
তাই,এখনো কোনো মূর্খই বলবে যে একটামাত্র মিউটেশন ফিক্স হয় এট এ টাইম, তারপর আবার আরেকটা শুরু হয়। আমরা বিবর্তনক সহজভাবে উপস্থাপন করার জন্য একটা-একটা করে উদাহরণ দেই। কিন্তু আসলে কী বিবর্তন এত সহজ? জনসংখ্যা আছে কয়েকলক্ষ, ট্রেইট আছে হাজার হাজার,মিউটেশন হচ্ছে ডজন ডজন, সময় আছে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর, এর ওপর ক্রিয়া করে সিলেকশন, ড্রিফট, ফ্লো আরো কত কী!
একটা অতি সহজ উদাহরণ দেই শেষে, কুদ্দুস চাকরি পায়নি ওর অদ্ভুত স্বভাবের জন্য, মনে আছে?
সেখানে কী ওর একটা মাত্র ট্রেইটের বিপক্ষে সিলেকশন হয়েছিলো? না। কুদ্দুস যেহেতু চাকরি পায়নি, বিয়ে হয়নি, প্রজনন হয়নি, মানে ওর কাছে যত ট্রেইট ছিলো, একটাও পরবর্তী প্রজন্মে পাস হয়নি। শুধুমাত্র একটা খারাপ বৈশিষ্ট্য, অদ্ভুত স্বভাবের জন্য ওর একটা ট্রেইটও পাস হলোনা, মানে ওর দেহে যত মিউটেশন ছিলো, একটাও পাস হলোনা।
ওদিকে, হোসুইন, শুধুমাত্র ওর বাপ বড়লোক্স বলে ওর দেহের অর্ধেক মিউটেশন পাস হয়ে গেল!
এখানে কী একটামাত্র ট্রেইটের সিলেকশন হয়েছে? মাত্র একটা মিউটেশন ফিক্স হয়েছে? না অনেকগুলো একসাথে হয়েছে বা হচ্ছে।
সুতরাং, একইসাথে অনেকগুলো ফিক্সেশন হতে পারে।আবার একটা মিউট্যান্ট জিন যখন ফিক্স হয়ে গেছে, একই সময়ে আরেকটা হয়তো শুরু হয়েছে, আরেকটা হয়তো মাঝপথে আছে। ফিক্সেশন কোনো স্থায়ী জিনিস না, একটা মাত্র মিউটেশন হলেই তা ভেঙে যাবে, আর যেহেতু মিউটেশন হলো বিবর্তনের নাটকের পরিচালক, সেটা হবেই। বিবর্তন নদীর স্রোতের মতো চিরবহমান।
জিন প্রবহণ
ঘটনা-১:
একটা প্রজাতি আছে, A.
A এর বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে প্রজনন ঘটায়। মানে,তাদের নিজেদের মধ্যেই জিন আদান-প্রদান হচ্ছে, সন্তান উৎপাদনের সময় তাদের নিজেদের জিনই জগা-খিচুড়ি হয়ে মিলে-মিশে নতুন একপিস উৎপাদন হচ্ছে। মানে, তাদের প্রজাতির স্বকীয়তা রক্ষাকারী জিনগুলো টিকে আছে, তারা একই প্রজাতির।
এইযে একই প্রজাতির প্রাণীরা সঙ্গম করছে, এখানে জিন প্রবাহিত হচ্ছে। নিজেদের জিন নিজেদের মধ্যেই প্রবাহিত হচ্ছে। একই প্রজাতির এক প্রাণীর জিন আরেক প্রাণীর মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে?
তাদের জিন পুল বিশুদ্ধ থাকছে, বাইরের কারো দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেনা। মিউটেশন হলেও তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
নিজেদের মধ্যে জিনের প্রবহণ প্রজাতির মৌলিকত্ব এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে।
ঘটনা-২:
A প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে দ্বন্দ দেখা দিলো। ফলে তারা দুইভাগ হয়ে গেল, A1 & A2.
একদল আরেকদলের ছায়াও পা দেয়না।সঙ্গমতো বহু দূরের ব্যাপার। ফলে কী হলো?
A1 এর প্রাণীদের মধ্যে মিউটেশন হয়ে যেসব বৈশিষ্ট্যের সিলেকশন হলো, তা A2 থেকে আলাদা। কারণ, তারা নিজেদের মধ্যে সঙ্গম করছে না, জিন আদান-প্রদান করছে না। ফলে একদলের মিউটেশন আরেকদলে পাস হচ্ছেনা। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে দুইদলের মধ্যে আলাদা নতুন নতুন মিউটেশন হবে, দুইদলের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ট্রেইট টিকতে থাকবে। আর ভাগ্যক্রমে র্যান্ডমলি দুইদলে একই ধরনের মিউটেশন হয়ে তা সিলেক্ট হওয়ার সম্ভাবনা মোটেই নেই বললে দোষ হবেনা।
অনেকদিন পর দেখা যাবে, A1 আর A2 আলাদা দুইটা প্রজাতি হয়ে গেছে।মানে, তারা নিজেদের মধ্যে প্রজনন করে উর্বর সন্তান উৎপাদন করতে পারছেনা।
জিনের আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে দুইটা আলাদা প্রজাতির সৃষ্টি হলো। A এর জিন পুলে ফাটল দেখা দিয়ে ধীরে ধীরে তা A1 আর A2 তে ভাগ হতে থাকলো। A1 আর A2 তে ভিন্ন ভিন্ন মিউটেশনের ফলে দুই দলের মধ্যে জিন ভ্যারিয়েশন বাড়তে থাকলো।
ঘটনা-৩:
কয়েক হাজার বছর পরে, A1 আর A2 তখন ভিন্ন দুইটা প্রজাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।
উল্লেখ্য যে প্রজাতির শুরু শেষ নির্ণয় করা যায়না। কেন? পড়ে আসুন-https://www.facebook.com/groups/bcb.science/permalink/3378864452197200/
এইটা বলা সম্ভব না যে ঠিক কোন প্রাণী থেকে বা ঠিক কোন মুহূর্তে নতুন প্রজাতির শুরু। তাই, আমরা এমন একটা সময় কল্পনা করতে পারি, A1 আর A2 যখন এমন একটা পর্যায়ে যে প্রায় অনেকটাই আলাদা প্রজাতি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের মিল আছে এখনো।
ফলে, তারা নিজেদের মধ্যে এখনো উর্বর সন্তান উৎপাদন করতে পারছে। আর কয়েকটা মিউটেশন হলেই আর পারবেনা।
এমন সময়ে, A1 এর এক ছেলে(x), A2 এর এক মেয়ের(y) প্রেমে পড়লো।
দীর্ঘদিনের প্রজাতিগত দ্বন্দ প্রেমের সামনে হেরে গেল।
x আর y বিয়ে করলো, y চলে গেল x এর বাড়িতে থাকতে। y, A1 এ মাইগ্রেট (migrate) করলো।ফলে কী হলো?
A2 এর মধ্যে যত মিউটেশন ছিলো, তার অর্ধেক(বাবা,x থেকে বাকি অর্ধেক আসবে) y এর মাধ্যমে A1 এ চলে আসলো x এর সাথে প্রজনন করার মাধ্যমে। সন্তানের মধ্যে এবার x আর y উভয়ের বৈশিষ্ট্য আছে। সে যখন A1 এর কারো সাথে মিলে প্রজনন করবে, তার মধ্যে আবার A2 এর বৈশিষ্ট্যের অংশ চলে যাবে।
x আর y এর বৈপ্লবিক প্রেম কাহিনী মিডিয়া, সোশাল নেটওয়ার্ক কে কাপিয়ে দিলো। বহু তরুণ-তরুণী উদ্বুদ্ধ হলো। ধীরে ধীরে A1 আর A2 এর মধ্যে সম্পর্ক বাড়তে থাকলো। migration বা স্থানান্তর বাড়তে থাকলো।জিন আদান-প্রদান হতে শুরু করলো। ফলে, এতদিন যাবৎ তাদের মধ্যে ভিন্ন যেসব মিউটেশন হয়েছিলো, সেগুলো মিক্স হতে থাকলো।
এক পর্যায়ে, তাদের ভিন্ন দুইটি জিন পুল এর মধ্যে মিল্কিওয়ে-এন্ড্রোমিডার জিন ভ্যারিয়েশন কমে গিয়ে পৃথিবী-মঙ্গলের পর্যায়ে চলে আসলো।
আরো সময় এগোতে থাকলে তারা এতটাই মিক্স হয়ে গেল, জিনের প্রবাহ নিজেদের মধ্যে এতটাই বেড়ে গেল যে তারা আবার মিলে প্রজাতি A হয়ে গেল। তাদের জিনপুল এক হয়ে গেল, আলাদা হিসেবে জিন ভ্যারিয়েশন রইলো না।
এই নতুন A কিন্তু আবার ঘটনা-২ এর আগের A এর মতো হয়ে যাবেনা। হওয়ার সম্ভাবনা এক্কেবারেই ০ বলা যায়।কারণ আগেই বলেছি, একই মিউটেশন হুবহু আরেকবার হয়ে সিলেক্ট হবেনা বললেই চলে, সম্ভাবনা এত কম।তাছাড়া নতুন অনেক মিউটেশন হওয়ার পর দুইদল এক হয়েছে।
এইযে বারবার জিনের প্রবাহ, জিনের প্রবাহ বলে চিল্লাচ্ছি, একে বলে Gene flow. একজনের জিন অন্যজনে যাওয়া বা প্রবাহিত হওয়া, অথবা একটি দলের জিনপুলের মধ্যে অন্য দলের জিনপুল ধীরে ধীরে ঢুকে বা প্রবাহিত হয়ে মিলেমিশে একাকার হওয়া, এইটাই জিন ফ্লো।
ঘটনা-১ এ বোঝা যায়, একই প্রজাতির মধ্যে এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে জিন ফ্লো প্রজাতির স্বতন্ত্রতাকে টিকিয়ে রাখে।
ঘটনা-২ এ বোঝা যায়, একই প্রজাতির মধ্যে কোনো কারণে (কারণগুলো নিয়ে পরে আলোচনা করবো বিস্তারিত) জিন ফ্লো বন্ধ হয়ে গেলে আলাদা দুইটা প্রজাতির সূচনা হতে পারে। উল্লেখ্য যে, অনেকসময় একেবারে আলাদা প্রজাতির উদ্ভব হয়না।একই প্রজাতি থাকে, কিন্তু একটা বৈশিষ্ট্যের ওপর তাদেরকে দুইদলে ভাগ করা যায়। মানে প্রজাতি একই, কিন্তু নির্দিষ্ট কয়েকটা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দল দুইটা। আলাদা প্রজাতি হবে, নাকি শুধু কয়েকটা বৈশিষ্ট্যের কারণে একই প্রজাতির আলাদা দল গঠন হবে, সেটা ওই জিন ফ্লো বন্ধের কারণের ওপর নির্ভর করে অনেকখানি।
ঘটনা-৩ এ বোঝা যায়, দুইটা "প্রায় আলাদা প্রজাতি", একেবারে আলাদা হয়ে পারেনি এমন, তবে দেখে আলাদা করা যায়। এমন দুই প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে কোনোভাবে জিন ফ্লো শুরু হলে দুইটা প্রজাতি মিলেমিশে একটা প্রজাতি হয়ে যাবে। তাদের জিনপুল এক হয়ে যাবে, তাদের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি এক হয়ে যাবে। মানে, তারা একটা নতুন প্রজাতি গঠন করবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রজাতির সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ আছে। তাই দুইটা আলাদা প্রজাতি মিলেও একটা প্রজাতি গঠন করতে পারে। তবে তাদের গণ একই হওয়া লাগবে। গাছের একটা প্রজাতি আর বানরের একটা প্রজাতির মধ্যে নিশ্চই জিন ফ্লো হবেনা।
দুইটি প্রজাতির মধ্যে জিন ফ্লো আসলে ওভারঅল জিন ভ্যারিয়েশন কমিয়ে দেয়। বিবর্তনের ফলে নতুন ও বেশি প্রজাতি সৃষ্টি হয়, জেনেটিক ডাইভার্সিটি আসে। কিন্তু এই জিন ফ্লো এর ফলে দুইটা প্রজাতি একটা হয়ে যায়, প্রজাতি কমে যায়। জিন ভ্যারিয়েশন বা ডাইভার্সিটি কমে যায়। কিন্তু, নতুন প্রজাতি ঠিকই গঠিত হয়।
শুধু একটা প্রজাতি হতে গিয়ে দুইটা প্রজাতির আত্ম-বলিদান দিতে হয়।
একসাথে পথ চলা
অনেএএ-এএকদিন পর লিখতে বসলাম। আশা করি ভুলে যাননি!ভুলে গেলে সমস্যা নেই, পড়ে আসেন আগের পর্বগুলো।
তো, শুরু করা যাক!
কুদ্দুস আর হোসুইনের কথা মনে আছে না? ওইযে, দুইজন একই মেয়ের প্রেমে পড়েছিলো? হ্যা, ওরাই।
এইবার আর বউ নিয়ে না, এইবার ওরা জমি-জমা নিয়ে কিলাকিলি করছে। বছিরনগরে ৪ বিঘা জমি, কুদ্দুস দাবি করে যে এইটা ওর পিতৃপুরুষের জমি, হোসুইন দাবি করে যে ওর! কিন্তু কেউই কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে না।
গ্রামের মুরুব্বিরা সালিশ করে বললো যে ১ মাস কুদ্দুস ওই জমি ব্যবহার করবে, আর ১ মাস হোসুইন। এভাবে বছরে ছয়মাস করে দুইজন ব্যবহার করবে।
কিন্তু ওরা তাতেও সন্তুষ্ট না।
মুরুব্বিদের ইয়া লম্বা লম্বা লেকচার শুনে যখন ওদের মানসিক ভারসাম্য টলমল করছে, তখন শেষমেষ ওরা টিকতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলো যে ওরা দুইভাগ করে জমি নিয়ে যাবে।
নিলো, দুইজন সেখানে বাড়ি বানালো, শান্তিতে বসবাস করতে থাকলো।
এখানে কী ঘটেছে?
একজন যদি জমি নিতো, আরেকজন না খেয়ে মরতো।কুদ্দুস আর হোসুইন আধা আধা করে নিলো, কেউই না খেয়ে থাকবেনা, আবার কেউ বেশিও খাবেনা। মানে একটা ভালোই অবস্থা। দুইজন একে অন্যের সাথে মানিয়ে নিয়েছে।সব সমস্যায় একে অন্যকে সাহায্য করে, একজনের বিপদে অন্যজন এগিয়ে আসে। কয়েকছর পর এভাবে একসাথে থাকার পর দেখা গেল যে তারা আর একা থাকতে পারছে না, একজনকে ছাড়া আরেকজনের মন লাগে না!
এই ঘটনা যদি বিবর্তনে ঘটে, তাকে বলে সিম্বায়োসিস।
উপরের উদাহরণটা আসলে খুবই দুর্বল সিম্বায়োসিসের মতো একটা জিনিসকে ব্যাখ্যা করার জন্য। সিম্বায়োসিসের অনেক প্রকারভেদ আছে, অসংখ্য উদাহরণ আছে। প্রত্যেকটা নিয়ে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো। দু-একটা ঘটনা বলে সিম্বায়োসিস ব্যাখ্যা করা যায় না।আপাতত কিছু সাধারণ জ্ঞান দিয়ে যাই।
সিম্বায়োসিস শব্দের উৎপত্তি গ্রীক দুটি শব্দ থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় "একসাথে থাকা"।
এটা হলো দুইটা ভিন্ন প্রজাতি বা একই প্রজাতির দুইটি জীবের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ আর লং-টার্ম বায়োলজিকাল ইন্টার্যাকশন।
সিম্বায়োসিসে অংশগ্রহণকারী জীবদ্বয়কে বলে সিম্বায়োন্ট। অনেক ক্ষেত্রে সিম্বায়োন্টরা একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একসাথে বিবর্তিত হয়, এটাকে বলে কো-ইভোলুশন।
সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপ কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হয়ে যায়, অর্থাৎ জীবদ্বয় তখন একে-অন্যকে ছাড়া বাঁচতেই পারে না। Relationship Goals
আবার কিছুক্ষেত্রে এই রিলেশনশিপ ঐচ্ছিক, মানে একে-অন্যকে ছাড়াও বাঁচতে পারে, কিন্তু আলাদা হয়ে বাঁচতে চায়না, একসাথেই থাকতে চায়। এটাও একপ্রকার Relationship Goals
এই সিম্বায়োসিসের সংজ্ঞা নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে ১৩০ বছর ধরে মারামারি ছিলো, শেষমেষ ২১ শতকে এসে তারা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, উপরে যেটা বলেছি।
একসাথে পথ চলা(২)
গতপর্বে সিম্বায়োসিস নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। আজ আমরা তার শ্রেণিবিভাগ নিয়ে জানবো।
দেহের ওপর ভিত্তি করে সিম্বায়োসিস দুই রকমের হয়। যখন দুইটা সিম্বায়োন্ট এর দেহ এক হয়ে যায়, মানে একই দেহের মধ্যে দুইটা ভিন্ন প্রাণী বাস করে, তখন তাকে বলা হয় কনজাঙ্কটিভ(সংযোজক) সিম্বায়োসিস। আর বাকি সব রকমের সিম্বায়োসিস হলো ডিসজাঙ্কটিভ বা বিয়োজক, মানে সিম্বায়োন্টদের দেহ আলাদা থাকে।
যখন একটা সিম্বায়োন্ট আরেকটার দেহের ওপরে মানে দেহের বাইরে বসবাস করে, তাকে বলে এক্টোসিম্বায়োসিস।যেমন-মানুষের মাথার উঁকুন। আর যখন একটা সিম্বায়োন্ট আরেকটার দেহের ভেতরে বা টিস্যু আবরণীর ভেতরে বসবাস করে, তখন তাকে বলে এন্ডোসিম্বায়োসিস। যেমন-শিমের মূলজ অর্বুদে বসবাসকারী rhizobia নামক ব্যাকটেরিয়া। উদ্ভিদের মূলের মধ্যে গোল গোল যে ফোলা অংশগুলো থাকে, তাদের বলে Root nodule বা মূলজ অর্বুদ। এসব ব্যাকটেরয়া শিম গাছকে নাইট্রোজেনের জোগাড় করে দেয়। এ নিয়ে পরে আরো বিস্তারিত লিখবো।
আচ্ছা, এন্ডোসিম্বায়োসিস আর কনজাঙ্কটিভ সিম্বায়োসিস, দুইটা অনেকটা একই রকম না? এন্ডোসিম্বায়োসিসে একজন আরেকজনের দেহে ঢুকে যায়,আর কনজাঙ্কটিভে দুইজনের এক দেহ হয়ে যায়। এদের মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে।
কনজাঙ্কটিভে দুইজনের দেহ এক হয়ে যাওয়া মানে একই দেহ দিয়ে দুইজন কাজ চালায়, দুইজনের দেহ আলাদা করা যায়না। আর এন্ডোসিম্বায়োসিসে দেহ আলাদা করা যায়, আলাদাভাবে দুইজনের দেহ শনাক্ত করা যায়। দুইজন ভিন্ন দুইটা দেহ দিয়ে কাজ করে,শুধু একটা দেহ আরেকটার ভিতর ঢুকে থাকে।একজনের দেহ থেকে আরেকজনকে বের করে আনা যায়।
বুঝলেন?
এবার প্রধান ভাগগুলো, দুইজন সিম্বায়োন্ট এর লাভ-ক্ষতির ওপর নির্ভর করে সিম্বায়োসিসকে বেশ কয়েকটা ভাগ করা হয়।
"কম্পিটিশন" বা প্রতিযোগিতাও একরকমের সিম্বায়োসিস। টিকে থাকার প্রতিযোগিতা,অনেকটা নেগেটিভ সিম্বায়োসিসের মতো। এতে শেষমেষ দুইজনেরই কিছু না কিছু ক্ষতি হয়।একজনের ফিটনেস বা "সামর্থ্য" আরেকজনের উপস্থিতিতে কমে যায়। মনে করেন কুদ্দুস আর হোসুইন জমির জন্য মারামারি করলো। হোসুইনের বাপ বিশাল বড় নেতা, ওর পাওয়ার বেশি। তাই হোসুইনের সামনে কুদ্দুসের হাওয়া টাইট হয়ে যাবে। এরকম।
কম্পিটিশন হতে পারে যৌন সঙ্গীর জন্য, খাদ্যের জন্য, এলাকার জন্য বা অন্য যেকোনো কিছুর জন্য। কম্পিটিশন নানা ভাবে হতে পারে, প্রধানত প্রত্যক্ষ মারামারির করেই হয়। এইটাও একপ্রকার সহাবস্থান বা সিম্বায়োসিস, কিন্তু উলটো দিক দিয়ে। যেভাবে বিপরীত ভেক্টর যোগ করার নামই ভেক্টরের বিয়োগ, সেরকম অনেকটা।
এরপর আছে মিউচুয়ালিজম। বাংলায় "পারস্পরিক মঙ্গলজনক সহাবস্থান"। বুঝতেই পারছেন, এতে দুই সিম্বায়োন্ট এরই উপকার হয়। একে Interspecies reciprocal alturism ও বলা হয়। এ নিয়ে অনেক কথা, আগামী পর্বগুলোতে বিস্তারিত লিখবো।
মিউচুয়ালিজম এর একটা উদাহরণ হলো- Goby & Shrimp. "গবি"র বাংলা নেই মনে হয়, একধরনের ছোট মাছ। এরা চিংড়ির সাথে মিউচুয়ালিস্টিক সিম্বায়োসিস ঘটায়।
চিংড়ি সমুদ্রের তলে বালিতে গর্ত করে, সেই গর্তে গবি আর চিংড়ি একসাথে বাস করে। চিংড়ির কী লাভ?
চিংড়ি চোখে কিছুই দেখে না বলা যায়, তাই গর্তের বাইরে শিকারীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া অনেক কঠিন ওর একার জন্য।
এখানেই গবি কাজে আসে। গবি যখনই দেখে যে কোনো শিকারী আছে আশেপাশে, তখন নিজের লেজ দিয়ে চিংড়িকে ধাক্কা দেয়। চিংড়ি বুঝে যায় যে শিকারী আছে, দুইজন দ্রুত দৌড় দিয়ে গর্তে ফিরে যায়।
সাঁতার দিয়ে আরকি!
এরপর আছে কমেনসালিজম। এখানে একজনের উপকার হয়, আরেকজনের উপকার-অপকার কিছুই হয়না। যেই প্রাণী উপকৃত হয়, তাকে বলে কমেনসাল। এই কমেনসাল নানাভাবে উপকৃত হতে পারে। যেমন- বিভিন্ন পাখি, যারা গাছের কাণ্ডের গর্তে থাকে। এতে গাছের তেমন কোনো উপকার হয়না, তবে পাখির ঠিকই উপকার হয়।
প্যারাসাইটিজম, পরাশ্রয়িতা। এখানে প্যারাসাইট বা পরজীবীটা উপকৃত হলেও হোস্ট, বা যার দেহে প্যারাসাইটটি বাস করে, সে অপকৃত হয়। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো আমাদের অন্ত্রের কৃমি।
মিমিক্রি বা অনুকরণ।এক্ষেত্রে একটা প্রজাতি অন্য একটা প্রজাতির কিছু বৈশিষ্ট্য নকল করে, যাতে অন্য প্রজাতিটি সেই বৈশিষ্ট্যের ফলে যেসব সুবিধা পেতো, সেগুলো যেন তারাও পায়।যেমন- কোকিল পাখি কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, যাতে বাচ্চা বড় করে তুলতে কোয়েলের অতিরিক্ত শ্রম না দেয়া লাগে! এজন্য কোকিল পাখির কাকের ডিমের মতো ডিম পাড়া, যাতে কাক সেই ডিমকে আলাদা করে চিনে রিজেক্ট করতে না পারে, এইটাই মিমিক্রি।
এমেনসালিজম, এই ক্ষেত্রে একটা সিম্বায়োন্ট আরেকটা সিম্বায়োন্টের দ্বারা প্রভাবিত হয়না। কিন্তু আরেকজনের ক্ষতি হয়, অনেক ক্ষেত্রে মারা যায়। যেমন-যদি কোনো বড় গাছের ছায়ার নিচে একটা অন্য গাছের ছোট চারা বোনা হয়, তাহলে বড় গাছটার কারণে ছোট গাছ রোদ-বৃষ্টি পাবে না, বড় গাছটা মাটি থেকে সব খণিজও টেনে নিয়ে যাবে। বড় গাছ কিন্তু এখানে চারার দ্বারা প্রভাবিত না, কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে একদিন ছোট চারা গাছটা মারা যাবে।
একতাই বল
গতপর্বে সিম্বায়োসিসের শ্রেণিবিভাগ নিয়ে সাধারণ কিছু আলোচনা করেছিলাম। আজ থেকে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
সবার আগে, মিউচুয়ালিজম, পারস্পরিক মঙ্গলজনক সহাবস্থান।
আবার মনে করিয়ে দেই, মিউচুয়ালিজমে উভয় পক্ষই উপকৃত হয়।
Mycorrhiza নামে একটা জিনিস আছে। সবুজ উদ্ভিদের মূল অঞ্চল আর ছত্রাকের মধ্যকার সিম্বায়োটিক রিলেশনশিপকে বলে মাইকোরাইযা। এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিচুয়ালিজম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্যারাসাইটিজম হতে পারে।
তো, মাইকোরাইযাতে ছত্রাক নিজের হোস্ট উদ্ভিদের মূলের টিস্যুকে কলোনাইয করে ফেলে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন শর্করা ছত্রাককে দেয় আর ছত্রাক উদ্ভিদকে মাটি থেকে বিভিন্ন পুষ্টিদ্রব্য সংগ্রহ করে দেয়।ফলে উভয় সিম্বায়োন্ট সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকে।
বিভিন্ন ফসিল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে প্রাচীন কালে যেসব উদ্ভিদের মূল সুগঠিত থাকতো না, তাদের মূল অঞ্চলে Mycorrhizal association গড়ে উঠতো।মানে ইয়া বড় দলবল বেঁধে ছত্রাক বাসা বানাতো। ফলে মূলের অভাবে যেইটুকু পুষ্টি শোষণে সমস্যা হতো, ছত্রাক তা জোগান দিয়ে ক্ষতিপূরণ করে দিতো।রিটার্ন হিসেবে উদ্ভিদ থেকে টেনে নিতো খাদ্য উপাদান।
বর্তমানে মাটির ওপরে বসবাসকারী প্রায় ৪৮ শতাংশ গাছ-পালা এই মাইকোরাইযার ওপর নির্ভর করে অজৈব পুষ্টি উপাদানের জন্য।
অন্যদিকে, আমরা জানি যে অসংখ্য উদ্ভিদ বংশবৃদ্ধি করে বীজের মাধ্যমে। এই বীজ ছড়িয়ে দিতে অধিকাংশ সময় কিন্তু বিভিন্ন প্রাণীরা উদ্ভিদকে সাহায্য করে।
যেমন- অনেক পশু-পাখি উদ্ভিদের ফল খায়, কিন্তু ফলের বীজ হজম করতে পারে না। ফলে মলের সাথে সেই বীজ বের হয়ে যায়। তো প্রাণীটাতো আর এক জায়গায় দাড়ায়ে থাকে না, ঘুরতে-ফিরতে-চলতে কিংবা উড়তে এই বীজ ছড়িয়ে যায় দূর-দূরান্তে।ফলে সেখানে আবার নতুন করে গাছ হয়। এটাও মিউচুয়ালিজম।
এখানে উদ্ভিদ প্রাণীটাকে ফল দিয়ে সাহায্য করছে, আবার প্রাণীটা উদ্ভিদের বংশবিস্তারে সাহায্য করছে।
দেখা গেছে যে, গ্রীষ্মপ্রধান দেশের ৭০-৯০ শতাংশ উদ্ভিদ নিজেদের বীজ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রাণীদের ওপর নির্ভর করে।
এখন,উপরের উদাহরণ দুইটা পড়েছেন তো? এইটুকুতো বুঝেছেনই যে দুইটাই মিউচুয়ালিজম, মানে উভয় সিম্বায়োন্ট একে অন্যের উপকার করছে। কিন্তু এই উপকার বেসিকালি কয়ভাবে হয়েছে ?
দুই ভাবে।
service & resource, সেবা এবং সামগ্রী।
উপরে যে দুইটা উদাহরণ দিলাম সেখানে মাইকোরাইযা তে কী হচ্ছে?
উদ্ভিদ ছত্রাককে শর্করা দিচ্ছে। এই শর্করা কী? একপ্রকার সামগ্রী, যা ছত্রাকের প্রয়োজন।
আবার ছত্রাক উদ্ভিদকে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান দিচ্ছে। এই পুষ্টি উপাদান কী?
এটাও একপ্রকার সামগ্রী, যা উদ্ভিদের প্রয়োজন।
আবার দ্বিতীয় উদাহরণ, বীজ ছড়িয়ে দেয়া। এখানে কী হচ্ছে? উদ্ভিদ প্রাণী কে ফল দিচ্ছে। ফলটা হলো সামগ্রী, যা প্রাণীর প্রয়োজন ক্ষুধা মিটানোর জন্য। কিন্তু রিটার্নে প্রাণীটা কী উদ্ভিদকে কোনো "সামগ্রী" দিচ্ছে?
না।
তাহলে প্রাণীটা কী দিচ্ছে?
Service বা সেবা। প্রাণীটা উদ্ভিদের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধির কাজ করে দিচ্ছে।
এই সার্ভিস আর রিসোর্স বা সেবা আর সামগ্রীর ওপর নির্ভর করে মিউচুয়ালিজম তিন প্রকার। এই তিন প্রকার নিয়ে আলোচনা করবো আগামী পর্বগুলোতে।
পড়তে থাকুন.......
পর্ব-২৪:মৌমাছির গল্প
আমরা জেনেছি যে সেবা আর সামগ্রী, এই দুইটির আদান-প্রদানের মাধ্যমে মিউচুয়ালিস্টিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
সেবা-সামগ্রী, এই দুইটা জিনিস কয়ভাবে নেয়া-দেয়া করা যায়?
তিনভাবে।
সেবা দেয়া,সামগ্রী নেয়া; Service-resource relationship
সেবা দেয়া,সেবা নেয়া; Service-service relationship
সামগ্রী দেয়া,সামগ্রী নেয়া;Resource-resource relationship.
সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপে একজন সেবা করে, একজন সামগ্রী দেয়। এর বেশি কিছু বোঝার নেই আসলে। এই সম্পর্কটা আবার তিন রকমের হয়।
১. Pollination/পরাগযোগ/পরাগমিলন: পাখি, কীট, পতঙ্গ, পোকা-মাকড়, এমনকি অনেক পশুও ফুলের মধু খেতে আসে, তখন পুরুষ ফুলের ওপর থেকে পরাগরেণু জীবটার দেহে লেগে যায়। জীবটা যখন আবার আরেক ফুলে যায়, তখন সেই পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে নিষেক ঘটায়। ফলে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি হয়। এভাবে পরাগায়ণ ঘটানোর মাধ্যমে জীবটা উদ্ভিদকে সেবা দেয়, আর উদ্ভিদ জীবকে খাদ্য সামগ্রী দেয়।
বিশেষ উদাহরণ হলো মৌমাছি। এরা ফুল থেকে প্রধানত nectar(মধু) আর pollen(পরাগরেণু) সংগ্রহ করে, যা যথাক্রমে শর্করা আর প্রোটিনের ভালো উৎস। কিন্তু মাঝে মাঝে এরা তৈল,সুগন্ধী,রেজিন বা ওয়্যাক্স এর জন্যও ফুলে-ফুলে ঘুরে বেড়ায়। এই ঘোরা-ফেরার মধ্যে নিজের অজান্তেই এরা ফুলের পরাগায়ণ ঘটিয়ে ফেলে।
আরো মজার ঘটনা হলো, মৌমাছি আর ফুলের কো-ইভোলুশনতো ঘটেছেই, খোদ মৌমাছির উৎপত্তিই ঘটেছে এই পলিনেশনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে।
মৌমাছিদের আদিপিতা ছিলো wasp, বাংলায় যাকে আমরা বোলতা বা ভীমরুল বলি(যারা কামড় খাইছেন তাদের জন্য আমার সমবেদনা)। এই বোলতারা মূলত অন্যান্য পোকা-মাকড় খেয়ে থাকতো। এখন পোকা-মাকড় তো নানা জায়গায়, ফুল-লতা-পাতায় ঘুরে বেড়ায়। যখন পোকা-মাকড়রা ফুলের ওপর দিয়ে চলাচল করতো, ফুলের মধু বা পরাগরেণু তাদের দেহে লেগে যেত।আর বোলতারা এই ধরনের পোকা-মাকড়ও খেতো। যখন বোলতারা নিজের লার্ভাদের সেই নেক্টার আর পলেন লাগানো পোকা-মাকড় খাওয়ালো, সেসব লার্ভারা প্রোটিন-শর্করা বেশি পরিমাণে পেলো, তাদের ফিটনেস বাড়লো। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নেক্টার-পলেন ভক্ষণকারী বোলতাদের ফিটনেস বাড়তে থাকলো। ফলে ছোটকালে নেক্টার-পলেনযুক্ত পোকা-মাকড় খাওয়া বোলতারা বড় হয়েও "সেই স্বাদ ভুলতে পারলোনা"। এখন নেক্টার-পলেন সংগ্রহ করতে গেলে নিশ্চই ফুলের কাছে যেতে হবে!
ওদিকে, গুবরে পোকার মতো পোকা-মাকড় আগে থেকেই ফুলের পরাগায়ণ বা পলিনেশন ঘটানোর কাজ করতো। তাই তাদের সাথে ফুলের একটা কো-ইভোলুশন আগে থেকেই হয়েছিলো। পোকারা যাতে পলেন সংগ্রহ করতে পারে, এজন্য ফুলগুলোর আকৃতি কাপের মতো আর অগভীর হয়ে বিবর্তিত হয়েছিলো।
আসলে ব্যাপার কী? ফুল স্বাভাবিকই ছিলো। কিন্তু মিউটেশন হয়ে যাদের আকৃতি একটু কাপের মতো হয়েছে আর যারা অগভীর, উঁচু-উঁচু হয়েছে, তাদের পরাগরেণু পোকার গায়ে সহজে লেগেছে, তাদের ভেতরেই পরাগরেণু প্রবেশ করেছে সহজে। ফলে তাদের মিউটেশনটা পরের প্রজন্মে পাস হতে পেরেছে বেশি, তাই একসময় সব ফুলই ওরকম অগভীর কাপের মতো
হয়ে গিয়েছিলো।
এবার এখানে আসলো পলেন-খাদক বোলতারা। এখন এই বোলতাদের সাথে ফুলের কো-ইভোলুশনের মাত্রা মারাত্মক বেড়ে গেল। যেসব বোলতার জিহ্বা একটু লম্বা ছিলো, তারা গভীর থেকে পলেন আর নেক্টার সংগ্রহ করতে পারলো ভালো। আবার যেসব ফুলের টিউব আকৃতির অংশ লম্বা ছিলো বেশি, সেখানে পলেন-নেক্টার ধরতো বেশি। তাই বোলতারা ওখানেই যেত। এভাবে যেসব বোলতার জিহ্বা লম্বা, আর যেসব ফুলের টিউব লম্বা, তাদের একসাথে কো-ইভোলুশন ঘটলো। উদাহরণ হলো Amegilla cingulata প্রজাতির মৌমাছি আর Acanthus ilicifolius প্রজাতির ফুল।
আবার অনেক মৌমাছির প্রজাতি scopal hair, পায়ে বা পেটে পশমের মতো অংশ ডেভেলপ করলো, এতে তারা পলেন আর নেক্টার সংগ্রহ করতে পারলো বেশি।কেউ কেউ আবার পলেন বাস্কেট, পিছনের পায়ে বাস্কেটের মতো অংশ ডেভেলপ করলো, এতেও তারা নেক্টার-পলেন সংগ্রহ করতে পারলো বেশি। এতে সেসব ফুলের প্রজনন বাড়লো যাদের পলেন-নেক্টার ছিলো বেশি, আর যারা মিউটেশনের ফলে অভিনব পদ্ধতিতে নেক্টার আর পলেন দান করতে পারতো।
এভাবে বোলতা থেকে মৌমাছির বিবর্তন ফুলের সাথে কো-ইভোলুশনের মাধ্যমে ঘটলো। সবই সম্ভব হলো পলিনেশনের কারণে, যা একটা সার্ভিস-রিসোর্স রিলেশনশিপ। যা মিউচুয়ালিস্টিক সিম্বায়োসিস!
মৌমাছির বিবর্তনের সুন্দর সুন্দর ফসিল রেকর্ড দেখতে চলে যান এই লিংকে এ-
https://www.museumoftheearth.org/bees/evolution-fossil-record#gsc.tab=0
Writer: Tahsin Ahmed Omi