সেক্সুয়াল সিলেকশনের খুঁটি-নাটি

আমরা গতপর্বে যৌন নির্বাচন বা সেক্সুয়াল সিলেকশন নিয়ে জেনেছিলাম। আজকে এই নিয়েই আরেকটু বিস্তারিতভাবে জানবো।

সেক্সুয়াল সিলেকশনের ফলে সবচেয়ে লক্ষণীয় প্রভাবটা হলো সেক্সুয়াল ডায়মর্ফিজম। অর্থাৎ, একই প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রীদের মধ্যে জননাঙ্গের পাশাপাশি নানাবিধ পার্থক্য। গতপর্বেই মোরগ-মুরগি, সিংহ-সিংহীর কথা বলেছিলাম। এদের জননাঙ্গের পার্থক্যের পাশাপাশি দেহের রঙ,আচরণ,আকার,গঠন ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়। কারণ, স্ত্রীরা এক্ষেত্রে পুরুষদের ব্রিডিং করে তাদের মধ্যে অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিজেরা অত নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হতে পারেনি। ফলে লিঙ্গভেদে এত পার্থক্যের আবির্ভাব হয়েছে। প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় মানুষদের মধ্যে সেক্সুয়াল ডায়মর্ফিজম বহুগুণ কম।

সেক্সুয়াল সিলেকশন দুই রকমের।আজ একটা প্রকার নিয়ে জানবো।

কুদ্দুসের love life তখন সবেমাত্র শুরু। চৌধুরী সাহেবের মেয়ের ওপর ক্রাশিত। তখনই ও জানতে পারলো যে পাশের বাড়ির হোসুইনও একই মেয়ের ওপর ক্রাশিত।ফলে কী হলো? দুইজনের মধ্যে একপ্রকার রেশারেশি শুরু হলো, "কে হবে চৌধুরী সাহেবের মেয়ের জামাই"।
হোসুইনের আব্বা বড়লোক্স। বাপের পাওয়ার দেখায় সে চাকরিটা নিজের করে নিলো, কুদ্দুস বেকারই রয়ে গেল।পরবর্তীর দুঃখের ঘটনা আমরা সবাই জানি। আর বললাম না।

এইযে কুদ্দুস আর হোসুইন, চৌধুরী সাহেবের মেয়েকে পাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে কিলা-কিলি করছে, এইটাকে বলে ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন। Selection "within" a sex. মানে, একই লিঙ্গের ভেতর নির্বাচন।এখানে কী চৌধুরী সাহেবের মেয়ে কোনোকিছু করছে? না, সে বাড়িতে আরামছে বসে মেকাপ করছে আর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে "Natural beauty is the best, No makeup"।
আর ওদিকে হোসুইন দল-বল টাকা-পয়সা দিয়ে কুদ্দুসকে প্রতিযোগিতা থেকেই বের করে দিয়েছে। মানে, পুরুষে-পুরুষে লড়াই হয়েছে। একে বলে ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন। বাংলায় আন্তঃলৈঙ্গিক নির্বাচন।

প্রাণী জগতে প্রায় প্রত্যেক প্রজাতিতেই অহরহ ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন দেখা যায়।সব প্রজাতিতেই পুরুষরা মারামারি করে একটা স্ত্রী পাওয়ার জন্য, যার শক্তি বেশি, সে ই টিকে যায়। এভাবে, পুরুষদের দৈহিক শক্তি হলো ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশনের কমন উদাহরণ। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গ, যেগুলো মারামারির সময় তাদের শক্তি প্রদর্শন করে, যেমন-হরিণের শিং, Elephant Seal দের bulk বা বপু,Horned beetle নামের পোকাদের মুখের সামনে শিং এর মতো অংশ, এগুলোও ইন্ট্রাসেক্সুয়ালের উদাহরণ।তবে, এগুলো সঙ্গমের জন্য সিলেকশন, মানে মিলনের আগে কাজে দেয়, সঙ্গমের আগেই এই সিলেকশন হয়ে যায়।

অনেকক্ষেত্রে সঙ্গম করার পরেও প্রতিযোগিতা হয়।ড্রাগনফ্লাই, বাংলায় যাকে গঙ্গা-ফড়িং বা গয়াল-পোকাও বলে, তাদের পুরুষরা স্ত্রীদের সাথে মিলনের পর স্ত্রীকে পাহাড়া দেয়। যাতে ডিম পাড়ার আগে সে অন্য কোনো পুরুষের সাথে সঙ্গম না করে। এখানেও একজন পুরুষ অন্য পুরুষদের সাথেই প্রতিযোগিতা করছে, ফলে এটাও ইন্ট্রাসেক্সুয়াল। কিন্তু এটা হচ্ছে সঙ্গমের পরে, post-mating competition.

আবার, dunnock নামের একটা ইউরোপিয়ান পাখি। এদের পুরুষরা সঙ্গমের আগে স্ত্রীদের cloaca (পরিপাকতন্ত্রের শেষের একটা বিশেষ ছিদ্র যেটা একইসাথে মলত্যাগ ও জনন-সম্বন্ধীয় নিঃসরণের কাজ করে) তে চঞ্চু দ্বারা খোচাতে থাকে, যতক্ষননা স্ত্রীটা নিজের cloaca কে প্রসারিত করছে,ততক্ষণ।প্রসারিত করার ফলে পূর্ববর্তী যে পুরুষ তার সাথে সঙ্গম করেছিলো, তার বীর্য সেখান থেকে বের হয়ে যায়, তারপর বর্তমান পুরুষটা সঙ্গম শুরু করে।
আবার এক ধরনের প্যারাসাইট আছে, যাদের পুরুষরা সঙ্গমের পর স্ত্রীদের জননেন্দ্রিয়কে(genitalia) বিশেষভাবে বন্ধ করে দেয়,একটা প্লাগের মতো করে। যেটা শুধু সে ই খুলতে পারে।ফলে অন্য পুরুষের প্রজনন করার সম্ভাবনা কমে যায়।
আবার, এই পুরুষরা ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশনকে এক্কেবারে গড-লেভেলে নিয়ে যায়! কীভাবে? এরা প্রায়ই প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, তারপর তাদের জননাঙ্গ বন্ধ করে দেয়,যাতে তারা সঙ্গমে লিপ্ত হতে না পারে।ফলে, তার নিজের সঙ্গমের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
ভাবা যায়!!

এভাবে, ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির পুরুষদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে দেয়া হয়।কে টিকায়? পুরুষরা নিজেই।
পুরুষরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে নিজেদের অজান্তেই এমনসব বৈশিষ্ট্যকে টিকিয়ে দেয়, যেগুলো তাদের দৈহিক শক্তি বৃদ্ধি করে। প্রজাতিভেদে এই বৈশিষ্ট্য ভিন্ন।যেমন- দেহের আকার, শিং, বপু, ইত্যাদি অনেক কিছু।তবে এগুলো সঙ্গমের আগে।
আবার, অনেকসময় সঙ্গমের পর ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন হয়, এখানে পুরুষরা সঙ্গমের পর জোড় করে নিজেদের বৈশিষ্ট্যের টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, অন্য পুরুষরা যাতে সেই স্ত্রীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত না হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে।

আমাদের ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন নিয়ে পড়ালেখা শেষ



সেক্সুয়াল সিলেকশনের খুঁটি-নাটি(২)

গতপর্বে আমরা কুদ্দুস ও হোসুইনের কিলা-কিলির মাধ্যমে ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশনের জ্ঞানার্জন করেছিলাম।তবে,এইবার আমাদের হাইপোথেটিকাল কুদ্দুসের সাথে একটু অন্যরকমের ঘটনা ঘটবে।

চৌধুরী সাহেবের মেয়ে জেনে গেল যে কুদ্দুস আর হোসুইন, উভয়েই তার ওপর ক্রাশিত।কিন্তু দুইজনের সাথেতো বিয়ে করা যাবেনা। কী করা যায়? সে বললো,
"বাজারে এখন ট্রেন্ড চলে, সরীসৃপ ড্রেস। পাখিড্রেস মান্ধাতের আমলের। ওইটা যে আগে কিনে এনে দেবে আর যারটা আমার পছন্দ হবে, তারেই আমি বিয়ে করবো।"
বেচারা কুদ্দুস, টাকা নাই।ওইদিকে বড়লোক্স বাপের ছেলে হোসুইন ৯৯,৯৯৯ টাকা দিয়ে দেশের সবচেয়ে দামী সরীসৃপ ড্রেস কিনে এনে চৌধুরী সাহেবের মেয়ের জামাই হয়ে গেল।আর ওইদিকে কুদ্দুস, সিংগেল ফর এভার।

এইবার, বিজ্ঞান।

এখানে কুদ্দুস আর হোসুইন নিজেদের মধ্যে কিলা-কিলি করছে? না। সক্রিয় ভূমিকা কে পালন করছে? চৌধুরী সাহেবের মেয়ে। সে ই টাকাওয়ালা ছেলে সিলেক্ট করছে বা সিলেক্টেড হওয়ার জন্য শর্ত দিয়ে দিয়ে দিছে, যে, অমুক জিনিসটা করতে হবে বা অমুক বৈশিষ্ট্যটা থাকতে হবে।
এই যে স্ত্রীদের মধ্যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত পুরুষদের সিলেক্ট করার প্রবণতা, এর ফলে হয় ইন্টারসেক্সুয়াল সিলেকশন, বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে নির্বাচন। বাংলায় সঠিক অর্থ খুঁজে পেলাম না।
যাই হোক। সহজ কথায়, মেয়েরা ছেলেদের নির্বাচন করবে, এইটাই ইন্টারসেক্সুয়াল।

ডারউইন সেক্সুয়াল সিলেকশনের ধারণা দেয়ার পরপর বিজ্ঞানীরা ইন্টারসেক্সুয়াল সিলেকশনকে তেমন দাম দেয়নি নানা কারণে। পরে ১৯৫০ এর দিকে কয়েকজন বিজ্ঞানী এই নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে, ১৯৮০তে স্পটলাইটটা ইন্টারসেক্সুয়ালের ওপরেই চলে আসে।

পুরুষদের অসংখ্য টিকে যাওয়া বৈশিষ্ট্যই এই স্ত্রীদের নির্বাচনের ফল। স্ত্রীদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও এর অরিজিন এক্সপ্লেইন করার জন্য কতগুলো হাইপোথিসিস আছে। আমরা সেগুলো নিয়ে একটু-আধটু জানার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই, "runaway sexual selection". এখানে বলা হয়, নারীরা ধীরে ধীরে পুরুষদের একটা বৈশিষ্ট্যের প্রতি আকর্ষণ ডেভেলপ করেছে। যেমন- উইডোবার্ডের লম্বা লেজ, ময়ুরের রঙিন পেখম, সিংহের কেশর। তারপর, যখন তারা সঙ্গম করেছে, পুরুষের বৈশিষ্ট্যটা(সেই বৈশিষ্ট্য, যেটার কারণে যে সিলেক্টেড হয়েছে) যেমন পরবর্তী প্রজন্মে পাস হয়েছে, একইভাবে স্ত্রীর এই নির্দিষ্ট গুণ নির্বাচন করার বৈশিষ্ট্যও পরবর্তী প্রজন্মে পাস হয়েছে। ফলে, উভয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক সম্পর্ক আর নির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে। পুরুষের বৈশিষ্ট্যটা এজন্যই টিকে যায় কারণ স্ত্রীরা সেই বৈশিষ্ট্যওয়ালার সাথেই প্রজনন করে, আবার স্ত্রীর এই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করার বৈশিষ্ট্যও এজন্যই টিকে যায় কারণ পুরুষের সেই বৈশিষ্ট্যটা আছে। অর্থাৎ, একটা নির্দিষ্ট সময় পর ট্রেইট দুইটা পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে গড়ে ওঠে। এইটাই runaway sexual selection. এটাকে বলা হয় "self reinfoecing choice".মানে ট্রেইটটা আত্মনির্ভরশীলের মতো আচরণ করে।

এরপর "handicap hypothesis".এখানে বলা হয়, পুরুষদের মধ্যে যেসব ক্ষতিকারক বৈশিষ্ট্য আছে,(আগে ব্যাখ্যা করেছি) সেগুলো স্ত্রীদেরকে নিশ্চয়তা দেয়, যে এই পুরুষটাই আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে, দায়িত্ব নিতে পারবে। এই বৈশিষ্টগুলো পুরুষদের কাছে handicap হলেও নারীদের কাছে ভালো লক্ষণ। এজন্য একে good genes hypothesis ও বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায়, পুরুষদের মধ্যে প্রতিকূল বৈশিষ্ট্যগুলো টিকে যেতে পারে, নারীদের প্রভাবিত না করেই।

আরেকটা আছে sensory bias. মানে, ইন্দ্রিয়-সম্বন্ধিত পক্ষপাত। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। স্ত্রী ব্যাঙরা সেইসব পুরুষ ব্যাঙের সাথেই সঙ্গম করে যাদের কণ্ঠ ভারী, মানে শব্দের কম্পাঙ্ক কম। কেন? কারণ এইরকম শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়।ফলে, স্ত্রীটা শুধুমাত্র তারই সন্ধান পায়। মানে, স্ত্রীটা মাত্র নিজের শ্রবণেন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করে সঙ্গী নির্বাচন করেছে।এখানে সুবিধা-পছন্দ কাজ করেনি। যার খোঁজ পেয়েছে, তাকেই সিলেক্ট করেছে। এইযে ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করে সিলেক্ট করার প্রবণতা, এটাই sesnsory bias. এজন্য পুরুষদের মাঝে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো সিলেক্ট হয়, যেগুলো ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সহজে আইডেন্টিফাই করা যায়।যেমন-উজ্জ্বল রঙ, ভারী কণ্ঠ, সামাজিকতা ইত্যাদি।

এভাবে, ইন্টারসেক্সুয়াল সিলেকশন হয়। আমাদের সেক্সুয়াল সিলেকশনের অধ্যায় শেষ।



খুশিতে-ঠ্যালায়-ঘোরতে বিবর্তন

আমরা, যারা বিবর্তন নিয়ে মোটামুটি জ্ঞান রাখি, যখনই বিবর্তন নিয়ে কথা বলি, তখন বিবর্তনের সাথে ন্যাচারাল সিলেকশন ফ্রি চলে আসে। মানে এদের নাম একসাথে নিতেই হয়। নাহলে পেটে কেমন জানি গুড়-গুড় করে। অনেকেতো আবার মনে করেন যে বিবর্তন মিউটেশন দিয়ে শুরু, ন্যাচারাল সিলেকশন দিয়ে শেষ। মানে, তারা ন্যাচারাল সিলেকশনকেই বিবর্তনের ওয়ান এন্ড ওনলি মেকানিজম মনে করেন।

কিন্তু, না।

রিসেন্ট পর্বগুলোতে আমরা সেক্সুয়াল সিলেকশন নিয়ে জেনেছি। এটা কী তাহলে বিবর্তনের আরেকটা "স্বতন্ত্র" চালিকা শক্তি? অনেকে বলেন হ্যা, তবে প্রায় সবাই বলেন না। সর্বাধিক সমাদৃত মত হচ্ছে, সেক্সুয়াল সিলেকশন হলো ন্যাচারাল সিলেকশনের বিশেষ মোড, বিশেষ প্রকার।আপনি ভালো করে সেক্সুয়াল সিলেকশন জিনিসটা বুঝলে এখানেও ন্যাচারাল সিলেকশনের হালকা গন্ধ পাবেন।কারণ, সঙ্গী নির্বাচন আর প্রজনন অত্যন্ত প্রাকৃতিক একটা প্রক্রিয়া।সেক্সুয়াল সিলেকশনের ফলাফলগুলোর পেছনে প্রাকৃতিক কারণ কাজ করে। জীবরা প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সঙ্গী নির্বাচন করে। তাহলে,সেক্সুয়াল সিলেকশন আসলে বিবর্তনের তেমন "স্বতন্ত্র" চালক না।এটা ক্লিয়ার করা প্রয়োজন ছিলো।

আর কোনো মেকানিজম আছে? সেটা বোঝার জন্য আমরা চলে যাচ্ছি "কুদ্দুস গরুর খামার" এ।

১০ টা গরু, ৮ টা খয়রি, ২ টা সাদা।
ধরলাম,রঙের ক্ষেত্রে G ডমিনেন্ট এলিল, খয়রি।আর g রিসেসিভ এলিল,সাদা।৮ টা খয়রির মধ্যে ৫ টার আছে GG, ৩ টার আছে Gg। ২ টা সাদার থাকবে gg. এই ১০ টা।মানে, মোট G আছে ১৩ টা,মোট g আছে ৭ টা।
(হিসাবের সুবিধার্থে ঘি রঙের গরুগুলোকেও খয়রি ধরলাম,মানে শুধু এলিল ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে কাজ করবো, জিনোটাইপ অতটা লাগবেনা।না বুঝলে আগের পর্বগুলো পড়ে আসেন)

রাত ২ টা।
চারিদিকে অন্ধকার, লোকজন নাক ডাকায়ে ঘুমাচ্ছে।আস্তে আস্তে আসলো চোর, গরু-চোর।সে দেখলো, গরু আছে ১০ টা।কিন্তু,ও যেই ট্রাকে গরু নিয়ে যাবে, সেখানে গরু ধরবে দুইটা।রাতের অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যায় না। একপ্রকার কানা হয়েই সে ঢুকে দুই হাতে দুইটা গরু টের পেলো, দড়ি খুলে আস্তে করে কেটে পড়লো।
চুরি শেষ।
সকালে কুদ্দুস উঠে দেখলো, সাদা গরু দুইটা নাই। কুদ্দুস কাঁদতে থাকুক, আমরা বিজ্ঞানটা বুঝে আসি।

এইখানে ব্যাপারটা কী হলো? আসলে তেমন কিছুই হয়নি। চোর এক্কেবারে র‍্যান্ডমলি, কোনো কারণ ছাড়াই, নিজের অজান্তেই, কারো বা কিছু দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই, বলা যায় "ভুল করে" সাদা রঙেরই দুইটা গরু নিয়ে গেছে। ফলে? এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে ড্রামাটিক চেঞ্জ আসছে। একসাথে ৪ টা g চলে গেল, রয়ে গেল মাত্র ৩ টা, ওদিকে G আছে ১৩ টাই।ফলে, নেক্সট জেনারশনে gg আসার সম্ভাবনা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এভাবে, বড় একটা সম্ভাবনা তৈরি হলো, কয়েক জেনারেশন পরে আর g পাওয়া যাবেনা।জি বাংলাএ সিরিয়ালের কাহিনীর মতো একদম,মাত্র একটা চুরি কুদ্দুসের গরুর খামারের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি কাপিয়ে দিলো।আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, "জেনেটিক ড্রিফট"!

এখানে আমি যে বিষয়টার ওপর জোড় দিয়েছি, সেটা হলো "র‍্যান্ডমনেস"।বাংলায় "যদৃচ্ছতা"। জেনেটিক ড্রিফট সম্পূর্ণভাবে র‍্যান্ডমনেস দ্বারা চালিত।(এজন্যই পর্বের নাম এমন দিয়েছি) এখানে কোনো রকমের কারণ, উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য কাজ করবেনা।সাদা গরু দুইটাই চুরি হবে, এর সম্ভাবনা শুণ্য ছিলোনা,ফলে তা "হতেই পারতো", আর একদম র‍্যান্ডমলি সেটাই হয়েছে। না হলে অন্য কিছু হতো, একটা সাদা, একটা খয়রি বা দুইটা খয়রিই চুরি হতে পারতো, যা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো বেশি। কিন্তু, হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হলেই যে হবে, তা না।র‍্যান্ডমনেস জিনিসটাই এমন।

একটা ঘটনা বলি।
রিচার্ড ফাইনম্যান নাকি প্রায়ই তার কলিগদের কাছে যেতেন, আর মুখভরা উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, "জানো আজকে আমার সাথে কী হইছে? জানো?" তারা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করতো, "কী?" তিনি উত্তর দিতেন,
"কিছুই না!"
ঘটনাটা সত্য কিনা জানিনা, লরেন্স ক্রাউস তার অনেক বক্তৃতায় এই ঘটনাটা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটা সত্য-মিথ্যা যাই হোক, এর সারমর্মটা চমকপ্রদক।

আমরা ভাবি যে আমাদের সাথে যা হয়, সেটাই স্পেশাল বা কোনো কারণে হয়, আমরা ভালো ঘটনাকে আমাদের ভালো কাজের ফল বা কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর শুভকামনার ফল হিসেবে চিন্তা করতে ভালোবাসি। কিন্তু, আসলে এইটাযে এক্কেবারে র‍্যান্ডমলি হচ্ছে, তা বুঝতে চাইনা। আমরা ঘটনাকে কারণযুক্ত বা উদ্দেশ্যযুক্ত করতে পছন্দ করি।
যেকোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, একটা না একটা ঘটনা হতেই হতো, আর র‍্যান্ডমলি একটা হয়ে গেছে। এতে স্পেশাল কী? যা হয়েছে সেটা যদি স্পেশাল হয়, তবে যা হয়নি, সেটাও সমানভাবে স্পেশাল।আর কিছু না হওয়ারও একটা সম্ভাবনা ছিলো বলে সেটাও সমানভাবে স্পেশাল, ফাইনম্যান এটাই বোঝাতেন। আর যদি স্পেশাল না হয়, তবে কোনোটাই স্পেশাল না।

এত কথা বলার কারণ কী? জেনেটিক ড্রিফটে একটা জনসংখ্যা থেকে র‍্যান্ডমলি নির্দিষ্ট ধরনের এলিল কোনো ঘটনার ফলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া অসম্ভব না। "স্পেশাল" বা "উদ্দেশ্যপ্রণোদিত" না। র‍্যান্ডমনেসের ফলে দুইটাই সাদা গরু চুরি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এভাবে,একদম র‍্যান্ডমলি, কোনো জনসংখ্যায় যখন একটা নির্দিষ্ট এলিলের ফ্রিকোয়েন্সি হঠাৎ করে অত্যন্ত কমে যায়, বা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়; অর্থাৎ, পপুলেশনের এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে ড্রামাটিক চেঞ্জ আসে, তখন তাকে বলি জেনেটিক ড্রিফট।

ন্যাচারাল সিলেকশন কাজ করে অনুকূল ট্রেইটের নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু জেনেটিক ড্রিফটে অনুকূল-প্রতিকূল বিষয় না। র‍্যান্ডমলি চেঞ্জ আসবে, ফলে অনেক সময় প্রতিকূল বৈশিষ্ট্যও টিকে যায়।
যেই দুইটা গরু চুরি হলো, হতে পারে সেগুলোই সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়।তাতে কী? র‍্যান্ডমলি চুরি হয়ে গেছে!হতে পারে খয়রি গরুগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম,তাতে কী?র‍্যান্ডমলি টিকে গেছে!

আচ্ছা, এবার বলেন, গরু যদি ১০০০টা থাকতো, খয়রি থাকতো ৮০০ টা, সাদা থাকতো ২০০ টা। তখন যদি চোর শ'খানেক ট্রাকও নিয়ে আসতো, তাহলেও সব সাদা গরু নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আগের তুলনায় কমে যেত। আমি বলছিনা যে সম্ভাবনা শূণ্য হয়ে যেত,বরং সম্ভাবনা "কম হতো"। তাই, জেনেটিক ড্রিফটের প্রভাব বড় জনসংখ্যার চেয়ে ছোট জনসংখ্যায় বেশি দেখা যায়। ব্যাপারটা এভাবে ভাবতে পারেন, একটা কয়েনকে ১০ বার টস করলে হেড-টেল এর সংখ্যায় পার্থক্য বেশি হবে। কিন্তু কয়েক হাজার বার করলে পার্থক্যটা কমে যাবে, হেড-টেল উভয়ে ৫০% এর অনেকটা আশেপাশে চলে আসবে। র‍্যান্ডমনেসের প্রভাব বড় সংখ্যায় তুলনামূলক কম বোঝা যায়, ছোট জনসংখ্যায় বেশি।আর জেনেটিক ড্রিফট যেহেতু সম্পূর্ণ র‍্যান্ডম, তাই ছোট জনসংখ্যায় এটা নাটকীয় প্রভাব ফেলে।

অনেক কথা বললাম, আজ এই পর্যন্তই।


Writer: Tahsin Ahmed Omi

Show