প্রকৃতিতে আরেকটু ব্রিডিং
গতপর্বে আমরা সাক্ষ্য হয়েছি গ্যালাপ্যাগোসের ফিঞ্চদের জীবন্ত বিবর্তনের। আজও আমরা গ্যালাপ্যাগোসেই যাবো, দেখবো কচ্ছপদের বিবর্তন।তাই আর কোনো নাম খুঁজে পেলাম না এই পর্বের।
গ্যালাপ্যাগোসের দুই ধরনের কচ্ছপের কথা আগেই বলেছি, ন্যাচারাল সিলেকশনের কনসেপ্টটায় আরো ক্লিয়ার হওয়ার জন্য কচ্ছপদেরকেই টেনে আনলাম।
আবারো ঝড়ের রাত,বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,প্রচণ্ড বাতাস,মুষলধারে বৃষ্টি, ওইসব। এমন সময়ে কয়েকটা কচ্ছপ সমুদ্রে ছিলো। হঠাৎ প্রচণ্ড ঢেউ এল, তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল গ্যালাপ্যাগোসে, হয়তো কোনো ভাঙা গাছের কাণ্ড বা তেমন কিছুতে। এরাও সকালে ঘুম থেকে উঠলো, নিজেদেরকে আবিষ্কার করলো সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায়।সেখানেই এরা থাকা শুরু করলো।
এই কচ্ছপদের মধ্যে ছিলো স্ত্রী-পুরুষ। তারা বংশবিস্তার করলো, অনেক সন্তান উৎপাদন করলো। ধীরে ধীরে এরা গ্যালাপ্যাগোসের প্রায় প্রত্যেকটা দ্বীপেই ছড়িয়ে গেল। প্রকৃতির খেলা শুরু হবে এখন।
বড় দ্বীপগুলোতে ঘাস বেশি হয়, ফলে কচ্ছপদের খাওয়ার কোনো অসুবিধা নেই। হাঁটে আর খায়, বসে আর খায়, ঘোরে আর খায়, এর চেয়ে সুখের জীবন আছে? কিন্তু, ছোট দ্বীপগুলোতে, যেখানে ঘাস কম হয়, সেখানে কচ্ছপরা সমস্যায় পড়ে গেল। সেখানে দেখা দিল খাদ্যের অভাব। এখন, এক্কেবারে র্যান্ডমলি, র্যান্ডমলি মানে একদম র্যান্ডমলি, মিউটেশনের ফলে সেই ছোট দ্বীপের কয়েকটা কচ্ছপের গলা সামান্য লম্বা ছিলো। ফলে? এরা মুখ উঁচুতে নিয়ে গাছের ভালো ক্যাক্টাসগুলো খেতে পারতো। তাই, এরা জীবনযাপনের জন্য বা টিকে থাকার জন্য সামান্য সুবিধা পেয়ে গেল।তবে, এই সামান্য সুবিধাই অনেক কিছু পরিবর্তন করতে পারে।
ছোট দ্বীপে যাদের গলা নর্মাল আকারের, তারা একটু কম খেতে পেল, ধীরে ধীরে তাদের খাদ্য কমতে থাকলো, তাদের পুষ্টির জোগান কমতে থাকলো, ফলে তাদের সমগ্র জীবনব্যাবস্থাটাই এক প্রকার খারাপভাবে প্রভাবিত হয়ে গেল। যে খাবারই জোগাড় করতে পারে না, সে সন্তান উৎপাদন করতে কীভাবে?
আমি একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, এমন না যে সবকয়টা ছোটগলার কচ্ছপ খাবারের অভাব দেখা দেয়ার সাথে সাথে মারা যাবে,তা সম্ভব না। এটা হবে খুব ধীরে ধীরে।বিবর্তন একটা ধীর-স্থির প্রক্রিয়া, তাই বড় প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিবর্তনের প্রত্যক্ষ চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব।
যা বলছিলাম, লম্বা গলাদের সন্তান উৎপাদনের হার ছোট গলাদের থেকে বেশি হবে।এই হারের পার্থক্য বাড়তে থাকবে, কয়েকশ প্রজন্ম পর দেখা যাবে ছোট গলার কচ্ছপ সহজে পাওয়া যাচ্ছেনা।আর কয়েক হাজার প্রজন্ম পরে? সবাই লম্বা গলার কচ্ছপ। এখনো কিন্তু প্রজাতি আলাদা হয়নি।
সবার গলা যখন লম্বা, তখন লম্বাগলা একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সবাইই ভালো ক্যাক্টাস খেতে পারে। কিন্তু, এদের মধ্যে আবার কারো কারো পা একটু লম্বা। কেন?
কারণ, বিবর্তনের নাট্যমঞ্চের পর্দার পিছনে প্রতিমুহূর্তে কাজ করে যাচ্ছে মিউটেশন। এটা হবেই,হতে থাকবেই,আর হবে একদম র্যান্ডমলি, কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া।
আচ্ছা, যাদের পা লম্বা, তারা আরেকটু ওপরে উঠে খেতে পারলো। অন্যান্যদের থেকে লম্বা দেখে মেয়ে কচ্ছপরা এদের প্রতি বেশি আকর্ষিত হলো। ফলে,খাদ্যের পাশাপাশি প্রজননের দিক দিয়েও এরা সামান্য বেশি সুবিধা পেয়ে গেল। আগের মতোই ঘটনা ঘটবে, প্রজনের হার বেশি, টিকে থাকার সুবিধা বেশি ইত্যাদি।তাই বারবার লিখলাম না।
বহু বছর পর, সবার গলা লম্বা, সবার পা লম্বা।এবার? মিউটেশন চলমান, কয়েকজনের shell এর সামনের দিকটা একটু খোলা, ফলে এরা গলা আরো একটু লম্বা করতে পারলো। আবারো একই ঘটনা, কালের আবর্তনে, সাধারণ shell এর কচ্ছপদের সংখ্যা কমতে কমতে শুণ্য হয়ে যাবে। এবার, সবার গলা লম্বা, পা লম্বা, shell এর সামনের দিকটা একটু খোলা।
এখন যদি কেউ ওই ঢেউয়ের ঠেলায় ভেসে আসা কচ্ছপদের সাথে এদের তুলনা করে, চোখে পড়ার মতো পার্থক্য দেখতে পাবে।
এভাবে, কয়েক হাজার প্রজন্ম পার হবে, আমি শুধু "লম্বা" হওয়া নিয়ে আলোচনা করলেও পাশাপাশি আরো অনেক বিষয়, শিকারি, রোগ-ব্যাধি,আবহাওয়া ইত্যাদি কাজ করবে।বিভিন্ন ট্রেইটের নির্বাচন হবে, একসময় প্রজাতিই আলাদা হয়ে যাবে!
আবার, পাশের বড় দ্বীপগুলোর কচ্ছপদের ক্ষেত্রেও একইরকমের সিলেকশন ঘটবে, ফলে তারাও তাদের ভেসে আসা আদিপিতাদের থেকে একদম আলাদা হয়ে যাবে, আর দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রজাতির উদ্ভব ঘটবে, ঘটালো কে? ন্যাচারাল সিলেকশন।
গ্যালাপ্যাগোসে ১৫ প্রজাতির কচ্ছপ ছিলো, এখন টিকে আছে ১১ টা।
এখানে আরো কয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন, আমরা কখনো বিবর্তন হতে দেখিনা কেন?উত্তরের জন্য রিচার্ড ডকিন্স এর একটা ব্যাখ্যাকে আমার মতো করে তুলে ধরলাম।
আচ্ছা, আপনি কী কোনো একটা মুহূর্তে ঘড়ির ঘণ্টার কাটাকে নড়তে দেখেন?না। হঠাৎ করে আবিষ্কার করেন কাটাটা ১ থেকে ২ এ বা ৩ থেকে ৪ এ চলে এসেছে। একই ঘটনা ঘটে আমাদের সাথেও। বিবর্তনের ক্ষেত্রে সময়ের স্কেলটা হাজার-হাজার বছরের থেকে শুরু করে মিলিয়ন-মিলিয়ন বছরের পর্যন্ত হতে পারে।
আর আপনি ৬০ বছর বাঁঁচবেন কিনা তা ই সন্দেহ, মাত্র ৬০ বছরে কোনো প্রাণীর সন্তান উৎপাদনে মিউটেশনের বৈচিত্র কতটুকু হতে পারে?যতটুকুও হয়, তা একেবারে ধরার বাইরে। কিন্তু, যখন আপনি কয়েক মিলিয়ন বছর সময় দিচ্ছেন, অনেক ছোট ছোট মিউটেশনের টিকে যাওয়া ও বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে।
যেভাবে, ১X১০০০=১ ই, কিন্তু ১.০১X১০০০=১০১০।প্রতি প্রজন্মের মাত্র ১ % পরিবর্তন হলেও ১০০০ প্রজন্ম পর সংখ্যাটা ১.০১ থেকে বিবর্তিত হয়ে ১০১০ হয়ে যায়।
অঙ্কের মাধ্যমে আসলে এখানে বিষয়টাকে অনেক অবাস্তব আর ড্রামাটিকভাবে দেখানো হয়েছে।১০১০ লাগবে না, ১ থেকে ৫ হওয়াই যথেষ্ট। আর ১০০০ প্রজন্ম অনেক কম সময়, বিবর্তনের স্তরে সময় থাকে আরো অন্নেএএএক বেশি।
সারাংশে, মিউটেশনের ফলে নতুন ট্রেইটের আবির্ভাব হয়,পরিবেশের জন্য উপযুক্ত ট্রেইটগুলো টিকতে থাকে, একসময় এই র্যান্ডম মিউটেশন হতে পাওয়া টিকে যাওয়া ভিন্ন ট্রেইটের সংখ্যা এত বেশি হয়ে যায় যে, আলাদা প্রজাতি তৈরি হয়।
সিলেকশনের খুঁটি-নাটি(১)
গত কয়েক পর্বে ন্যাচারাল সিলেকশন আমরা বেশ ভালো একটা ধারণা পেয়েছি। এখন,জানা প্রয়োজন এর প্রকারভেদ নিয়ে। ন্যাচারাল সিলেকশনকে সাধারণত তিনটা প্রকারে ভাগ করা হয়।
নাহ্, স্কুলের স্যারদের মতো একটা একটা পয়েন্ট পড়ায়ে মুখস্ত করাবো না, আগে বুঝাবো, পরে জানাবো।
১৯ শতক, ইংরেজরা তখন এক তুঙ্গে উঠে বসে আছে। এই সময়টাতে নাকি ইংরেজ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য ডুবতো না। ১৭৬০ সালে শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে ১৮৪০ পর্যন্ত এক বিশাল সময়ে সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দিলো ইংরেজরা।কিন্তু, এর ফলে শুধু সভ্যতারই মোড়ই ঘোরেনি, বিবর্তনের ছোট একটা গলিও ঘুরে গিয়েছিলো।
পেপার্ড মথ (peppered moth) নামে এক প্রকার পোকা আছে। বাংলায় কী বলে জানিনা। নিচে ছবি দেখে নিয়েন।বারবার এর নাম নেয়া লাগবে বলে একে "মইত্থা" ডাকনাম দিলাম।(কারণ-গ্রামের মানুষরা অ+ব্যাঞ্জন ধ্বনি থাকলে সেখানে অই+ব্যাঞ্জন ধ্বনির দিত্ব+আ লাগায় ডাকে)
তো, ১৮১১ সালের আগে সব সাদা রঙের মইত্থা দেখা যেতো,ধলা মইত্থা। কালা মইত্থা ছিলোই না, মানে ধরা পড়েনি, কেউ জীবনে দেখেওনি। হঠাৎ, ১৮৪৮ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে প্রথমবারের মতো কালা মইত্থা ধরা পড়ে।ব্যাপার না,এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো। কারণ আমরা জানি যে জিন-এলিলরা মাঝে মাঝে ভুল-ভাল পথে চলে গিয়ে মিউটেশন ঘটায় ফেলে, তাই দুই-একটা কালা মইত্থা পাওয়া তেমন আহামরি কিছু না।
কিন্তু, ঘটনা ঘটলো ১৯ শতকের শেষের দিকে। ১৮৯৫ সালে এসে কালো মইত্থার সংখ্যা আচমকা ৯৮% বেড়ে গেল। মানে, ধলা মইত্থা দেখা তখন সৌভাগ্যের ব্যাপার, এমন একটা অবস্থা। এইবার বিজ্ঞানীদের টনক নড়লো।
বাংলাদেশে হলে সবার আগে তদন্ত কমিটি গঠন হতো, যার প্রধান থাকতো কোনো এক্সট্রা-ডাইমেনশনাল মাল্টিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নেয়া সাধক তান্ত্রিক বাবা।যাই হোক!
হঠাৎ করে কালা মইত্থা কেন বাড়লো?নানা মুনী নানা মত দিলেন। তবে, সঠিক ধারণার উত্থান করেছিলেন J.W. Tutt নামের এক ভদ্রলোক।১৮৯৬ সালে,ডারউইনের মৃত্যুর ১৪ বছর পর, তিনি বললেন,
" ইহা ন্যাচারাল সিলেকশনের কেরামতি!"
তখন থেকে এই "মিরাকল অফ মইত্থা" নিয়ে ছোট-খাট গবেষণা শুরু হয়, সম্ভবত ২০১২ সালে এ নিয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশ হয়। আমরা সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করবো।
ম্যানচেস্টার ছিলো ইংল্যান্ডের সবচেয়ে শিল্পোন্নত শহরগুলোর একটা। শিল্পবিপ্লবের ফলে সারা বিশ্বে কয়লার ব্যাবহার বেড়ে যায়, কয়লা মানেই কার্বন, আর কার্বন মানেই কালা।মুক্ত পরিবেশে যখন কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গেল, গাছ-পালা আর বিভিন্ন স্থাপনার গায়ে কার্বন লেগে তাদের রঙ অনুজ্জ্বল হয়ে গেল। ব্যাপারটা অসম্ভব মনে হলেও সত্য, আপনার চারপাশে তাকালেই বুঝতে পারবেন। তো, সবকিছু যখন কালা হয়ে গেল, কী হলো? ধলা জিনিসগুলো ফুটে উঠলো, চোখে পড়লো, বেশি দৃষ্টিগোচর হলো। এর আগে সবকিছু যখন পরিষ্কার ছিলো, সাদা-কালো তেমন ম্যাটার করতো না। কিন্তু, এখন করে।
শিল্পবিপ্লবের আগে সব ছিলো ধলা মইত্থা।দুই-একখান কালা মইত্থা যদিও বায়-চান্স জন্ম নিতো, নিজের মিউটেশনকে পরবর্তী প্রজন্মে তেমন আকারে পাস করতে পারতোনা। ফলে কালা মইত্থাদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম, প্রজননের হার ছিলো ধ্রুব। কিন্তু, যখনই শিলবিপ্লব হলো, পরিবেশে কার্বন বাড়লো, সবকিছু কালো কালো হয়ে গেল। তখন, সাদা মইত্থারা একদম ফুটে রইলো, সহজেই চোখে পড়ার মতো। ফলে, শিকারীদের সুবিধা হয়ে গেল। আগে ধলা মইত্থা চোখে পড়বে, আগে তাকেই ধরবে।
অন্যদিকে, কালা মইত্থা নিজের কালা ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে মিশে গেলে, সহজে চোখে পড়লো না, সহজে শিকার হলোনা।ফলে, ধীরে ধীরে সাদা মইত্থার সংখ্যা কমতে লাগলো। মানে? কালা মইত্থার সংখ্যা বাড়তে লাগলো। এভাবে, একসময় এতটাই বেড়ে গেল যে, মইত্থা মানেই কালা মইত্থা। এই ঘটনাকে বলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেলানিজম। মানে, শিল্পোন্নয়নের কারণে কোনো প্রজাতিতে গাঢ় পিগমেন্টের আধিক্য হওয়া। এটা হয় ন্যাচারাল সিলেকশনের কারণে।
১৯৭৮ সালে সিওয়াল রাইট বলেন," এটা (মিরাকল অফ মইত্থা) প্রথম ঘটনা, যেখানে বিবর্তন সুস্পষ্টভাবে অবজার্ভ করা হয়েছে।"
আচ্ছা, এই মিরাকল অফ মইত্থায় কোন ধরনের ফিনোটাইপটা সিলেক্টেড হয়েছে? শুধু গাঢ় ধরনের। মানে, একটা নির্দিষ্ট ফিনোটাইপ এর সংখ্যা ভীষণভাবে বেড়ে গিয়েছে। এই ধরনের ন্যাচারাল সিলেকশনকে বলে "ডায়রেকশনাল"।
মানে, কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের চরম বা ভীষণ ধরনের ফিনোটাইপের সিলেকশন। এক্ষেত্রে, মইত্থাদের রঙের ক্ষেত্রে গাঢ় রঙের সিলেকশন হয়েছে।
এই জিনিসটার গ্রাফ আকালে কেমন হবে? x অক্ষে ট্রেইট, বাম দিক থেকে হালকা শুরু করে ডানদিকে গাঢ় বা চরম বা ভীষণ ধরনের ফিনোটাইপ। আর y অক্ষে জনসংখ্যা। নিচে ছবি দেয়া আছে, ঢেউটা গাঢ় ট্রেইটের দিকে সড়ে যাবে।এই ধরনের সিলেকশনে এলিল ফ্রিকোয়েন্সি নির্দিষ্ট ফিনোটাইপের দিকে শিফট হয়।
তো, আমরা ন্যাচারাল সিলেকশনের প্রমাণ পাওয়ার পাশাপাশি এর একটা প্রকারভেদও জেনে নিলাম, পড়তে থাকুন..........
আরেকটা খুশির খবর, পরবর্তীতে দূষণ কমালে ধলা মইত্থার সংখ্যা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো।
সিলেকশনের খুঁটি-নাটি(২)
গত পর্বে আমরা ডায়রেকশনাল সিলেকশন নিয়ে ধারণা পেয়েছিলাম। আজ আরেক প্রকার নিয়ে আলোচনা করবো।
বাকি দুই প্রকার নিয়ে আসলে "মিরাকল অফ মইত্থা"র মতো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই, তবে আমরা প্রতিদিন এর অনেক উদাহরণই দেখতে পাই, কিন্তু কখনো অত খেয়াল করিনা।
শুরু করা যাক।
জন্মের সময় শিশুর ওজন। খুব কম হলে? বাঁচার সম্ভাবনা কম। খুব বেশি হলে? বাঁচার সম্ভাবনা কম। তাহলে সবচেয়ে বেশি বাঁচার সম্ভাবনা কাদের? স্বাভাবিক বা মাঝারি ওজনের শিশুদের। যদিও বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে ওজনের কারণে শিশুমৃত্যুর হার অতি নগণ্য। তাও এক সময় এমনটাই হতো।
গাছ, বেশি খাট হলে? সূর্যের আলো কম পাবে। বেশি লম্বা হলে ঝড়ের সময় হেলে পড়বে।দুইদিক দিয়েই ঠিক থাকার জন্য উপযুক্ত মাঝারি উচ্চতার গাছ।উল্লেখ্য যে, একেক প্রজাতির গাছের জন্য এই উচ্চতা একেকরকম হবে,এটা না বললেও বোঝার কথা।
প্রাণীদের ত্বকের রঙ। একটা প্রাণী শিকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য তার চারপাশের পরিবেশের সাথে মিশে যেতে চাইবে, যাতে রঙে তাকে আলাদা না করা যায়। যদি পরিবেশের সাপেক্ষে রঙ বেশি গাঢ় হয়? ধরা পড়বে।যদি রঙ বেশি হালকা হয়? তাও ধরা পড়বে।তাহলে বাঁচবে কারা? মাঝামাঝি রঙের প্রাণীরা।
ক্যাক্টাসের কাঁটা। কম হলে? অন্য প্রাণীরা সহজে খেয়ে ফেলবে। বেশি হলে? পরজীবী পোকাদের জন্য সেই ক্যাক্টাস উপযুক্ত স্থান, কারণে একবার ভেতরে ঢুকতে পারলে খাবারও পাবে, আর বেশি কাঁটা শিকারীর থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু,ক্যাক্টাসটা মারাই যাবে পোকার আক্রমণে। তাহলে বাঁচবে কারা? স্বাভাবিক সংখ্যার কাঁটাসমৃদ্ধ ক্যাক্টাসরা।
প্রাণীদের সন্তানের সংখ্যা। অনেক প্রাণী একবারে একাধিন সন্তানের জন্ম দেয়। একবারে অনেক বেশি জন্ম দিলে? সবার খাদ্যের চাহিদা পূরণ হবেনা, পুষ্টিহীনতায় মারা যাবে। আর অনেক কম হলে সবার সার্ভাইভ করার সম্ভাবনা কম। তাহলে সবচেয়ে ভালো? মাঝামাঝি সংখ্যা।
মানুষের ক্ষেত্রে কিন্তু এইটা খাটেনা, মানুষ জিনিসটাই আলাদা।
আচ্ছা, এতক্ষণ বকবক করে আমরা "মাঝামাঝি" জিনিসটার অনেক গুণগাণ করলাম। সবক্ষেত্রে সিলেক্টেড হয়েছে "এভারেজ" বা স্বাভাবিকরা। আর এই ধরনের সিলেকশনকে বলে "স্ট্যাবিলাইজিং সিলেকশন" বা "প্রশমনকারী নির্বাচন"। এর গ্রাফ আঁকালে কেমন হবে?
x অক্ষে ফিনোটাইপ, বাম দিকে হালকা বা কম থেকে শুরু করে ডানদিকে ভারী বা বেশি বা গাঢ়, যা ই বলেন। আর y অক্ষে জনসংখ্যা।
ঢেউটা উঠবে মাঝখানে।মানে, মাঝারি বৈশিষ্ট্যধারীরা টিকবে, বাকিরা মরবে।মাঝারি ফিনোটাইপের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি পাবে, সেইটা পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তর হওয়ার সুযোগ বেশি পাবে, বাকিরা হস্তান্তরের আগেই খেল খতম।
সবশেষে, স্ট্যাবিলাইজিং সিলেকশনের সারাংশ- "সিম্পল হলে মানাবেনা, গর্জিয়াস হলে দাম বেশি, দরকার সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস।"
সিলেকশনের খুঁটি-নাটি(৩)
আমরা ন্যাচারাল সিলেকশনের দুইটা প্রকারভেদ নিয়ে জেনেছি, আজ জানবো তৃতীয়টা নিয়ে।সেজন্য আমরা আবার চলে যাবো কুদ্দুসের কাছে।
বেচারা চাকরি পেলোনা, কোনো হত্তা-কর্তার গাড়ির ড্রাইভারও হতে পারলোনা। কুদ্দুসের চোখের সামনে চৌধুরী সাহেব তার মেয়েকে এক বিসিএস ক্যাডারের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন। কুদ্দুসের জীবন এখন তামা-তামা। কুদ্দুস একদিন ইউটিউবে মোটিভেশনাল ভিডিও দেখলো, কীভাবে ৫ টাকা ইনভেস্ট করে ২ মাসে বিলিয়নার হওয়া যায়। কুদ্দুস এখন মোটিভেটেড, ও গরুর খামার দিলো।
আমরা চলে এলাম কুদ্দুসের গরুর খামারে। গেটের সামনে সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা "কুদ্দুস গরুর খামার"।
খামারে ঢুকেই দেখবো অনেকগুলো গরু-বলদ। এদের রঙের জিনের জন্য ডমিনেন্ট এলিল খয়রি- S, রিসেসিভ এলিল সাদা-s।আমরা আগে জেনেছিলাম যে ss= সাদা আর Ss, SS= খয়রি।
কিন্তু, এখানে একটু ঝটকা দিতে চাই, আসলে ডমিনেন্ট আর রিসেসিভ একসাথে থাকলে ডমিনেন্টটা প্রকাশিত হয়, রিসেসিভটা দমে যায়। কিন্তু, দমে যাওয়া মানে হাওয়া হয়ে যাওয়া না। দুধের সাথে পানি মিশালে স্বাদ কমে যায়,রঙ হালকা হয়ে যায়, পানি হাওয়া হয়ে যায়না। একইভাবে, ডমিনেন্টের সাথে রিসেসিভ মিলে ডমিনেন্টকে একটুখানি প্রশমিত করে দেয়। মানে, খয়রি আর সাদা মিলে ঘি রঙ হবে। আমরা আগের পর্বগুলোতে হিসাবের সুবিধার জন্য এই জিনিসটাকে একটুখানি ইগনোর করেছিলাম।
যাই হোক, আমরা ছিলাম "কুদ্দুস গরুর খামারে"।তাহলে, গরুর খামারে গরু থাকবে তিনটা রঙের, SS= খয়রি, Ss=ঘি, ss=সাদা। বেশ ভালো ব্যবসা চলে কুদ্দুসের।সে ঠিক করলো যে আর কয়দিন পরেই আয়-ইনকাম ভালো হলে চৌধুরী সাহেবের বাড়ির সামনে বাড়ি বানাবে।
কিন্তু,এইবার, সমস্যা হলো তখন, যখন এমন এক রোগ আসলো, যা শুধু Ss জিনোটাইপের গরুকেই আক্রমণ করে।এতে মৃত্যুহার ৬০%। ফলে, কুদ্দুসের খামারেও ঘি রঙের গরুর ৬০% মারা গেল, প্রত্যেক জেনারেশনের ঘি রঙের গরুদের ৬০% মারা যায়। এভাবে করতে করতে একসময় আর ঘি রঙের গরু থাকবেনা। বেচারার বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল!
কিন্তু, এখানে আসলে সিলেকশন হয়েছে।কাদের? দুইটি চরম বা এক্সট্রিম ফিনোটাইপের,সাদা আর খয়রির। ফিনোটাইপে কমের দিক দিয়েও চরমটার, বেশির দিক দিয়েও চরমটার,এদের মাঝামাঝিটার হয়নি। এই ধরনের সিলেকশনকে বলে "ডিসরাপ্টিভ" বা "ডাইভার্সিফাইং"। বাংলায় "সংহতিনাশক", "ঐক্যনাশক" বা "বহুমুখীকরণ" নির্বাচন।
গ্রাফ আকালে কেমন হবে?আগের মতোই, x অক্ষে বামে হালকা থেকে শুরু করে মাঝে মাঝারি, ডানে গাঢ় ফিনোটাইপ।মানে বামে হোমোজাইগাস রিসেসিভ,মাঝে হেটেরোজাইগাস, ডানে হোমোজাইগাস ডমিনেন্ট। ডানে আর বামে ঢেউ উঠবে, মাঝখানে নিচু।
কিন্তু, একটু সমস্যা আছে।
একটা SS এলিল আর ss এলিল মিলদ প্রজনন করলে Ss আসা অনেকটা অবশ্যম্ভাবী।তাহলে তো ঘি রঙের গরু আর কম থাকবেনা, অনেকটা সমান হয়ে যাবে। এজন্য, ডিসরাপ্টিভ সিলেকশনে শর্ত হলো, SS কখনো ss এর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হবে না, মানে খয়রিরা কখনো সাদাদের প্রতি আকর্ষিত হবে না। না হতেই পারে, সাদারা খয়রি পছন্দ করেনা, খয়রিরা সাদা পছন্দ করেনা। অস্বাভাবিক কিছু না।
এই শর্ত পূরণ হওয়ার পর যদি হেটেরোজাইগাস জিনোটাইপের বিরুদ্ধে সিলেকশন হয়,তাহলে আমরা পাবো ডিসরাপ্টিভ সিলেকশন।মানে, এখানে মাঝারিদের কোনো স্থান নেই। হয় গর্জিয়াস, নাহলে সিম্পল। সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস চলবেনা।
এটা ছিলো আমাদের হাইপোথেটিকাল কুদ্দুস-কথন। এবার বাস্তব উদাহরণও দেয়া উচিত।
ডারউইনের ফিঞ্চদের কথা মনে আছে?ওখানেও এই সিলেকশনই হয়েছিলো। লম্বা চঞ্চুরা পোকা খাবে, চ্যাপ্টা চঞ্চুরা শস্য খাবে।যাদের মাঝারি সাইজের চঞ্চু, তারা ঠিক মতো পোকাও খেতে পারবেনা, ঠিকমতো শস্যও খেতে পারবেনা। ফলে তাদের পুষ্টি গ্রহণের হার কম হবে, ধীরে ধীরে প্রজনন কমবে, তারপর বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আবার ওই মইত্থার কথা মনে আছে? শহরাঞ্চলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কালা মইত্থারা লুকাতে পারতো ভালো, ফলে শিকার হতোনা।ধলারা সহজে ধরা পড়তো, মারা যেতো। কিন্তু, এর ঠিক উল্টোটা ঘটলো গ্রামে, যেখানে শিল্পোন্নয়ন কম। সেখানে ধলারা পরিবেশের সাথে মিশে যেত। কালারা ফুটে থাকতো, ধরা পড়তো, মারা যেত।
কিন্তু, যারা ছাই রঙের, মানে হেটেরোজাইগাস, তারা দুই জায়গায়ই ফাটা বাঁশের মাঝে পড়ে মরলো।কারণ, এরা কোনো জায়গায়ই ভালো করে লুকাতে পারলো না। সুতরাং, মইত্থার ঘটনাটাকে যদি শহরাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে ধরি, তাহলে ঘটেছে ডাইরেকশনাল সিলেকশন। আর যদি দেশের প্রেক্ষাপটে ধরি, মানে শহর-গ্রাম মিলে, তাহলে ঘটেছে ডিসরাপ্টিভ সিলেকশন।
এর মাধ্যমে আমার ন্যাচারাল সিলেকশন নিয়ে বকবক এখানেই শেষ।
অন্য রকম সিলেকশন
ন্যাচারাল সিলেকশনের অধ্যায় শেষ, কিন্তু একটু অন্য ধরনের সিলেকশন নিয়ে আমাদের পড়ালেখা করতে হবে।কারণ বিবর্তনকে সচল রাখতে ন্যাচারাল সিলেকশনের পরেই এর স্থান, তাই এটা নিয়ে জানা প্রয়োজন।
ডারউইন বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে সুন্দর করে অসংখ্য প্রজাতির আবির্ভাব ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হলেন, চারিদিকে তখন ডারউইনের জয়-জয়কার। কিন্তু, একটুখানি সমস্যা ছিলো। তিনি নিজেই খেয়াল করলেন যে, প্রাণীজগতে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে আজও এমন কিছু বৈশিষ্ট্য টিকে আছে, যেগুলো তাদের সার্ভাইভালের জন্য বা টিকে থাকার জন্য অপ্রয়োজনীয়, আর অনেক ক্ষেত্রে প্রতিকূল। যেমন?
পুরুষ ময়ুরের পেখম, ইয়া বড় বড়, কত সুন্দর রং-বেরঙের অনেকগুলো চোখের মতো নকশা, দেখেই মনটা ভালো হয়ে যায়।কিন্তু, ময়ুরের জন্য জিনিসটা খুব-একটা সুবিধার না। প্রথমত, উজ্জ্বল রঙের হওয়ার কারণে অনেক দূর থেকেই শিকারীদের চোখে ধরা পড়ে যাবে।দ্বিতীয়ত, অনেক বড় হওয়ায় সারাক্ষণ তা বয়ে বেড়ানো ময়ুরের জন্য কষ্টকর, যদিও তারা অভ্যস্ত। কিন্তু, এর ফলেতো কোনো উপকার হচ্ছেনা, এরতো Evolutionary Value চোখে পড়ে না। তাহলে ব্যাপারটা কী?
সিংহের আর ঘোড়ার কেশর(Mane)। দেখতে একটু রাজকীয় ভাব আসে, পুরুষত্ব ফুটে ওঠে, হ্যান্ডসাম লাগে।কিন্তু দরকার কী? প্রকৃতি এদের হ্যান্ডসাম ধুয়ে পানি খাবে? তাহলে এখনো এগুলো টিকে আছে কেন?
Widow bird নামের একধরনের পাখি, এদের পুরুষ পাখিদের লেজের দৈর্ঘ্য আপন দেহের প্রায় দ্বিগুণ! ওড়ার সময় বেচারাদের এত বড় একটা লেজ নিয়ে উড়তে হয়।নিশ্চই তা এদের জন্য অনুকূল না। তাহলে এই বড় লেজ আছে কেন?
এইসবগুলোর কারণ হলো, সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌন নির্বাচন।
প্রাণীজগতে একটা দর্শনীয় সত্য হলো, স্ত্রী তাদের সঙ্গী নির্বাচনে বেশি সক্রিয়, পুরুষরা একজন নারী সঙ্গী পাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে।স্ত্রী সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য পুরুষরা প্রাণ-পন চেষ্টা করে। মানে, প্রজননের ক্ষেত্রে পশু-পাখিদের মধ্যে নারীদের ভূমিকা অগ্রণী।নারী যাকে নির্বাচন করবে, সে ই প্রজনন করতে পারবে। স্ত্রী জাতির এই নির্বাচনই বিবর্তনকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছে।
স্ত্রীরা চায় দেখতে ভালো, শক্তিশালী, দায়িত্ববান সঙ্গী।যেসব পুরুষদের মধ্যে স্ত্রীদের মনের মতো বৈশিষ্ট্য নেই,তাদেরকে স্ত্রীরা রিজেক্ট করে দেয়।তারা সঙ্গমে লিপ্ত হতে পারেনা।ফলে প্রজনন করতে পারেনা, মানে? তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। অপরদিকে, যাদেরকে নারীরা নির্বাচন করেছে, তারা নিজেদের ট্রেইটগুলো পরবর্তী প্রজন্মে পাস করে। মানে সেই ট্রেইটগুলোই, যেগুলোর কারণে তারা নির্বাচিত হয়েছে।প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকে আর এভাবে, নারীদের মনের মতো বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ পুরুষজাতি গড়ে ওঠে। ফলে, একটা প্রজাতিতে অনেক বৈশিষ্ট্য ফালতু আর প্রতিকূল হলেও টিকে যায়, কেন?শুধুমাত্র স্ত্রীদের পছন্দ বলে।
একারণে দেখবেন যে যেকোনো প্রজাতিতে স্ত্রীদের চেয়ে পুরুষদের দেহ বেশি রঙিন, বেশি সুন্দর, বেশি বৈচিত্র্যময়। (It is a natural truth and fact, I am not a sexist, don't judge me) কারণ প্রতিযোগিতা করেছে পুরুষরাই, প্রতিযোগিতায় তাদেরই বৈশিষ্ট্যের নির্বাচন হয়েছে, ফলে মিউটেশন হতে হতে আর বারংবার সিলেকশন হতে হতে তাদের মধ্যেই নতুন নতুন ট্রেইট আবির্ভাবের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে স্ত্রীরা আজীবন নির্বাচকই থেকে গেছে, তাদের তেমন কোনো নির্বাচন হয়নি। এজন্য তাদের মধ্যে চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য টেকেনি।যেমন- মুরগি আর মোরগ কে না দেখেছেন! সিংহ আর সিংহী, সিংহের কেশর থাকে, যা দেখতে নিশ্চই সুন্দর! ময়ুরের পেখম ময়ূরীর চেয়ে অনেক বড় আর রঙিন। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। এভাবেই, বিবর্তনে সেক্সুয়াল সিলেকশন ক্রিয়া করে পুরুষদের মধ্যে কিছু অপ্রয়োজনীয় আর কিছু প্রতিকূল বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে রেখেছে।
ওপরে যে তিনটা উদাহরণ দিলাম, সিংহীরা ঘন কেশরযুক্ত সিংহের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।ময়ুরীরা সেসব ময়ুরদের নির্বাচন করে যাদের পেখম দেখতে সুন্দর , প্রজননের মৌসুমে ময়ুর এজন্য পেখম তুলে নারীদের আকৃষ্ট করতে চায়। তারপর স্ত্রী উইডো বার্ডরা লম্বা লেজযুক্ত পুরুষদের বেশি পছন্দ করে।
অনেকক্ষেত্রে সেক্সুয়াল সিলেকশনের ফলে ভালো জিনিসটাও নির্বাচিত হয়।তবে এসব ক্ষেত্রে সেক্সুয়ালের পাশাপাশি ন্যাচারাল সিলেকশনও সাধারণত ক্রিয়া করে। যেমন-হরিণের শিং।হরিণীরা বড় আর শাখা-প্রশাখা যুক্ত শিং ওয়ালা পুরুষদের প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়। আবার, বড় শিং আত্মরক্ষার জন্য উপকারী।
তাছাড়া,প্রত্যেক প্রজাতিতে পুরুষদের দৈহিক আকৃতি। পুরুষের ওজন আর শক্তি নারীদের চেয়ে বেশিই হয়। এখানেও সেক্সুয়াল আর ন্যাচারাল সিলেকশন। কারণ, একটা স্ত্রী সঙ্গী পাওয়ার জন্য পুরুষরা ঝগড়া-মারামারি করেছে, যে শক্তিশালী,সে ই নির্বাচিত হয়েছে, ফলে তার ট্রেইটগুলোই প্রজন্মে পাস হয়েছে। ফলে, পুরুষরা ধীরে ধীরে আরো শক্তিশালী আর বড় হয়ে বিবর্তিত হয়েছে।আবার, শক্তিশালী হলে শিকারীর থেকে আত্মরক্ষাও হয়। এভাবে দেখা যায় যে অনেক প্রজাতিতে পুরুষদের আকার নারীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণও হয়।(ব্যতিক্রম আছে অনেক ক্ষেত্রেই)।
আমরা সেক্সুয়াল সিলেকশনের মূল ধারণাটা পেলাম। ডারউইন আর ওয়ালেস মিলে সেক্সুয়াল সিলেকশন দ্বারা উত্থিত সমস্যার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, যে কেন অপ্রয়োজনীয় আর প্রতিকূল বৈশিষ্ট্য এখনো টিকে আছে। তবে তাদের ব্যাখ্যায় সামান্য কিছু ভুল ছিলো, যা পরবর্তীতে সংশোধন করা হয়।
সেক্সুয়াল সিলেকশনের খুঁটি-নাটি
আমরা গতপর্বে যৌন নির্বাচন বা সেক্সুয়াল সিলেকশন নিয়ে জেনেছিলাম। আজকে এই নিয়েই আরেকটু বিস্তারিতভাবে জানবো।
সেক্সুয়াল সিলেকশনের ফলে সবচেয়ে লক্ষণীয় প্রভাবটা হলো সেক্সুয়াল ডায়মর্ফিজম। অর্থাৎ, একই প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রীদের মধ্যে জননাঙ্গের পাশাপাশি নানাবিধ পার্থক্য। গতপর্বেই মোরগ-মুরগি, সিংহ-সিংহীর কথা বলেছিলাম। এদের জননাঙ্গের পার্থক্যের পাশাপাশি দেহের রঙ,আচরণ,আকার,গঠন ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা যায়। কারণ, স্ত্রীরা এক্ষেত্রে পুরুষদের ব্রিডিং করে তাদের মধ্যে অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিজেরা অত নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হতে পারেনি। ফলে লিঙ্গভেদে এত পার্থক্যের আবির্ভাব হয়েছে। প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় মানুষদের মধ্যে সেক্সুয়াল ডায়মর্ফিজম বহুগুণ কম।
সেক্সুয়াল সিলেকশন দুই রকমের।আজ একটা প্রকার নিয়ে জানবো।
কুদ্দুসের love life তখন সবেমাত্র শুরু। চৌধুরী সাহেবের মেয়ের ওপর ক্রাশিত। তখনই ও জানতে পারলো যে পাশের বাড়ির হোসুইনও একই মেয়ের ওপর ক্রাশিত।ফলে কী হলো? দুইজনের মধ্যে একপ্রকার রেশারেশি শুরু হলো, "কে হবে চৌধুরী সাহেবের মেয়ের জামাই"।
হোসুইনের আব্বা বড়লোক্স। বাপের পাওয়ার দেখায় সে চাকরিটা নিজের করে নিলো, কুদ্দুস বেকারই রয়ে গেল।পরবর্তীর দুঃখের ঘটনা আমরা সবাই জানি। আর বললাম না।
এইযে কুদ্দুস আর হোসুইন, চৌধুরী সাহেবের মেয়েকে পাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে কিলা-কিলি করছে, এইটাকে বলে ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন। Selection "within" a sex. মানে, একই লিঙ্গের ভেতর নির্বাচন।এখানে কী চৌধুরী সাহেবের মেয়ে কোনোকিছু করছে? না, সে বাড়িতে আরামছে বসে মেকাপ করছে আর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে "Natural beauty is the best, No makeup"।
আর ওদিকে হোসুইন দল-বল টাকা-পয়সা দিয়ে কুদ্দুসকে প্রতিযোগিতা থেকেই বের করে দিয়েছে। মানে, পুরুষে-পুরুষে লড়াই হয়েছে। একে বলে ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন। বাংলায় আন্তঃলৈঙ্গিক নির্বাচন।
প্রাণী জগতে প্রায় প্রত্যেক প্রজাতিতেই অহরহ ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন দেখা যায়।সব প্রজাতিতেই পুরুষরা মারামারি করে একটা স্ত্রী পাওয়ার জন্য, যার শক্তি বেশি, সে ই টিকে যায়। এভাবে, পুরুষদের দৈহিক শক্তি হলো ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশনের কমন উদাহরণ। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাণীদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গ, যেগুলো মারামারির সময় তাদের শক্তি প্রদর্শন করে, যেমন-হরিণের শিং, Elephant Seal দের bulk বা বপু,Horned beetle নামের পোকাদের মুখের সামনে শিং এর মতো অংশ, এগুলোও ইন্ট্রাসেক্সুয়ালের উদাহরণ।তবে, এগুলো সঙ্গমের জন্য সিলেকশন, মানে মিলনের আগে কাজে দেয়, সঙ্গমের আগেই এই সিলেকশন হয়ে যায়।
অনেকক্ষেত্রে সঙ্গম করার পরেও প্রতিযোগিতা হয়।ড্রাগনফ্লাই, বাংলায় যাকে গঙ্গা-ফড়িং বা গয়াল-পোকাও বলে, তাদের পুরুষরা স্ত্রীদের সাথে মিলনের পর স্ত্রীকে পাহাড়া দেয়। যাতে ডিম পাড়ার আগে সে অন্য কোনো পুরুষের সাথে সঙ্গম না করে। এখানেও একজন পুরুষ অন্য পুরুষদের সাথেই প্রতিযোগিতা করছে, ফলে এটাও ইন্ট্রাসেক্সুয়াল। কিন্তু এটা হচ্ছে সঙ্গমের পরে, post-mating competition.
আবার, dunnock নামের একটা ইউরোপিয়ান পাখি। এদের পুরুষরা সঙ্গমের আগে স্ত্রীদের cloaca (পরিপাকতন্ত্রের শেষের একটা বিশেষ ছিদ্র যেটা একইসাথে মলত্যাগ ও জনন-সম্বন্ধীয় নিঃসরণের কাজ করে) তে চঞ্চু দ্বারা খোচাতে থাকে, যতক্ষননা স্ত্রীটা নিজের cloaca কে প্রসারিত করছে,ততক্ষণ।প্রসারিত করার ফলে পূর্ববর্তী যে পুরুষ তার সাথে সঙ্গম করেছিলো, তার বীর্য সেখান থেকে বের হয়ে যায়, তারপর বর্তমান পুরুষটা সঙ্গম শুরু করে।
আবার এক ধরনের প্যারাসাইট আছে, যাদের পুরুষরা সঙ্গমের পর স্ত্রীদের জননেন্দ্রিয়কে(genitalia) বিশেষভাবে বন্ধ করে দেয়,একটা প্লাগের মতো করে। যেটা শুধু সে ই খুলতে পারে।ফলে অন্য পুরুষের প্রজনন করার সম্ভাবনা কমে যায়।
আবার, এই পুরুষরা ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশনকে এক্কেবারে গড-লেভেলে নিয়ে যায়! কীভাবে? এরা প্রায়ই প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, তারপর তাদের জননাঙ্গ বন্ধ করে দেয়,যাতে তারা সঙ্গমে লিপ্ত হতে না পারে।ফলে, তার নিজের সঙ্গমের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়।
ভাবা যায়!!
এভাবে, ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশনের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির পুরুষদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য টিকিয়ে দেয়া হয়।কে টিকায়? পুরুষরা নিজেই।
পুরুষরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে নিজেদের অজান্তেই এমনসব বৈশিষ্ট্যকে টিকিয়ে দেয়, যেগুলো তাদের দৈহিক শক্তি বৃদ্ধি করে। প্রজাতিভেদে এই বৈশিষ্ট্য ভিন্ন।যেমন- দেহের আকার, শিং, বপু, ইত্যাদি অনেক কিছু।তবে এগুলো সঙ্গমের আগে।
আবার, অনেকসময় সঙ্গমের পর ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন হয়, এখানে পুরুষরা সঙ্গমের পর জোড় করে নিজেদের বৈশিষ্ট্যের টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, অন্য পুরুষরা যাতে সেই স্ত্রীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত না হতে পারে, সেই ব্যবস্থা করে।
আমাদের ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশন নিয়ে পড়ালেখা শেষ
সেক্সুয়াল সিলেকশনের খুঁটি-নাটি(২)
গতপর্বে আমরা কুদ্দুস ও হোসুইনের কিলা-কিলির মাধ্যমে ইন্ট্রাসেক্সুয়াল সিলেকশনের জ্ঞানার্জন করেছিলাম।তবে,এইবার আমাদের হাইপোথেটিকাল কুদ্দুসের সাথে একটু অন্যরকমের ঘটনা ঘটবে।
চৌধুরী সাহেবের মেয়ে জেনে গেল যে কুদ্দুস আর হোসুইন, উভয়েই তার ওপর ক্রাশিত।কিন্তু দুইজনের সাথেতো বিয়ে করা যাবেনা। কী করা যায়? সে বললো,
"বাজারে এখন ট্রেন্ড চলে, সরীসৃপ ড্রেস। পাখিড্রেস মান্ধাতের আমলের। ওইটা যে আগে কিনে এনে দেবে আর যারটা আমার পছন্দ হবে, তারেই আমি বিয়ে করবো।"
বেচারা কুদ্দুস, টাকা নাই।ওইদিকে বড়লোক্স বাপের ছেলে হোসুইন ৯৯,৯৯৯ টাকা দিয়ে দেশের সবচেয়ে দামী সরীসৃপ ড্রেস কিনে এনে চৌধুরী সাহেবের মেয়ের জামাই হয়ে গেল।আর ওইদিকে কুদ্দুস, সিংগেল ফর এভার।
এইবার, বিজ্ঞান।
এখানে কুদ্দুস আর হোসুইন নিজেদের মধ্যে কিলা-কিলি করছে? না। সক্রিয় ভূমিকা কে পালন করছে? চৌধুরী সাহেবের মেয়ে। সে ই টাকাওয়ালা ছেলে সিলেক্ট করছে বা সিলেক্টেড হওয়ার জন্য শর্ত দিয়ে দিয়ে দিছে, যে, অমুক জিনিসটা করতে হবে বা অমুক বৈশিষ্ট্যটা থাকতে হবে।
এই যে স্ত্রীদের মধ্যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত পুরুষদের সিলেক্ট করার প্রবণতা, এর ফলে হয় ইন্টারসেক্সুয়াল সিলেকশন, বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে নির্বাচন। বাংলায় সঠিক অর্থ খুঁজে পেলাম না।
যাই হোক। সহজ কথায়, মেয়েরা ছেলেদের নির্বাচন করবে, এইটাই ইন্টারসেক্সুয়াল।
ডারউইন সেক্সুয়াল সিলেকশনের ধারণা দেয়ার পরপর বিজ্ঞানীরা ইন্টারসেক্সুয়াল সিলেকশনকে তেমন দাম দেয়নি নানা কারণে। পরে ১৯৫০ এর দিকে কয়েকজন বিজ্ঞানী এই নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে, ১৯৮০তে স্পটলাইটটা ইন্টারসেক্সুয়ালের ওপরেই চলে আসে।
পুরুষদের অসংখ্য টিকে যাওয়া বৈশিষ্ট্যই এই স্ত্রীদের নির্বাচনের ফল। স্ত্রীদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও এর অরিজিন এক্সপ্লেইন করার জন্য কতগুলো হাইপোথিসিস আছে। আমরা সেগুলো নিয়ে একটু-আধটু জানার চেষ্টা করবো।
প্রথমেই, "runaway sexual selection". এখানে বলা হয়, নারীরা ধীরে ধীরে পুরুষদের একটা বৈশিষ্ট্যের প্রতি আকর্ষণ ডেভেলপ করেছে। যেমন- উইডোবার্ডের লম্বা লেজ, ময়ুরের রঙিন পেখম, সিংহের কেশর। তারপর, যখন তারা সঙ্গম করেছে, পুরুষের বৈশিষ্ট্যটা(সেই বৈশিষ্ট্য, যেটার কারণে যে সিলেক্টেড হয়েছে) যেমন পরবর্তী প্রজন্মে পাস হয়েছে, একইভাবে স্ত্রীর এই নির্দিষ্ট গুণ নির্বাচন করার বৈশিষ্ট্যও পরবর্তী প্রজন্মে পাস হয়েছে। ফলে, উভয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক সম্পর্ক আর নির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে। পুরুষের বৈশিষ্ট্যটা এজন্যই টিকে যায় কারণ স্ত্রীরা সেই বৈশিষ্ট্যওয়ালার সাথেই প্রজনন করে, আবার স্ত্রীর এই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্বাচন করার বৈশিষ্ট্যও এজন্যই টিকে যায় কারণ পুরুষের সেই বৈশিষ্ট্যটা আছে। অর্থাৎ, একটা নির্দিষ্ট সময় পর ট্রেইট দুইটা পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে গড়ে ওঠে। এইটাই runaway sexual selection. এটাকে বলা হয় "self reinfoecing choice".মানে ট্রেইটটা আত্মনির্ভরশীলের মতো আচরণ করে।
এরপর "handicap hypothesis".এখানে বলা হয়, পুরুষদের মধ্যে যেসব ক্ষতিকারক বৈশিষ্ট্য আছে,(আগে ব্যাখ্যা করেছি) সেগুলো স্ত্রীদেরকে নিশ্চয়তা দেয়, যে এই পুরুষটাই আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে, দায়িত্ব নিতে পারবে। এই বৈশিষ্টগুলো পুরুষদের কাছে handicap হলেও নারীদের কাছে ভালো লক্ষণ। এজন্য একে good genes hypothesis ও বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায়, পুরুষদের মধ্যে প্রতিকূল বৈশিষ্ট্যগুলো টিকে যেতে পারে, নারীদের প্রভাবিত না করেই।
আরেকটা আছে sensory bias. মানে, ইন্দ্রিয়-সম্বন্ধিত পক্ষপাত। উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। স্ত্রী ব্যাঙরা সেইসব পুরুষ ব্যাঙের সাথেই সঙ্গম করে যাদের কণ্ঠ ভারী, মানে শব্দের কম্পাঙ্ক কম। কেন? কারণ এইরকম শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যায়।ফলে, স্ত্রীটা শুধুমাত্র তারই সন্ধান পায়। মানে, স্ত্রীটা মাত্র নিজের শ্রবণেন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করে সঙ্গী নির্বাচন করেছে।এখানে সুবিধা-পছন্দ কাজ করেনি। যার খোঁজ পেয়েছে, তাকেই সিলেক্ট করেছে। এইযে ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করে সিলেক্ট করার প্রবণতা, এটাই sesnsory bias. এজন্য পুরুষদের মাঝে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো সিলেক্ট হয়, যেগুলো ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সহজে আইডেন্টিফাই করা যায়।যেমন-উজ্জ্বল রঙ, ভারী কণ্ঠ, সামাজিকতা ইত্যাদি।
এভাবে, ইন্টারসেক্সুয়াল সিলেকশন হয়। আমাদের সেক্সুয়াল সিলেকশনের অধ্যায় শেষ।
খুশিতে-ঠ্যালায়-ঘোরতে বিবর্তন
আমরা, যারা বিবর্তন নিয়ে মোটামুটি জ্ঞান রাখি, যখনই বিবর্তন নিয়ে কথা বলি, তখন বিবর্তনের সাথে ন্যাচারাল সিলেকশন ফ্রি চলে আসে। মানে এদের নাম একসাথে নিতেই হয়। নাহলে পেটে কেমন জানি গুড়-গুড় করে। অনেকেতো আবার মনে করেন যে বিবর্তন মিউটেশন দিয়ে শুরু, ন্যাচারাল সিলেকশন দিয়ে শেষ। মানে, তারা ন্যাচারাল সিলেকশনকেই বিবর্তনের ওয়ান এন্ড ওনলি মেকানিজম মনে করেন।
কিন্তু, না।
রিসেন্ট পর্বগুলোতে আমরা সেক্সুয়াল সিলেকশন নিয়ে জেনেছি। এটা কী তাহলে বিবর্তনের আরেকটা "স্বতন্ত্র" চালিকা শক্তি? অনেকে বলেন হ্যা, তবে প্রায় সবাই বলেন না। সর্বাধিক সমাদৃত মত হচ্ছে, সেক্সুয়াল সিলেকশন হলো ন্যাচারাল সিলেকশনের বিশেষ মোড, বিশেষ প্রকার।আপনি ভালো করে সেক্সুয়াল সিলেকশন জিনিসটা বুঝলে এখানেও ন্যাচারাল সিলেকশনের হালকা গন্ধ পাবেন।কারণ, সঙ্গী নির্বাচন আর প্রজনন অত্যন্ত প্রাকৃতিক একটা প্রক্রিয়া।সেক্সুয়াল সিলেকশনের ফলাফলগুলোর পেছনে প্রাকৃতিক কারণ কাজ করে। জীবরা প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সঙ্গী নির্বাচন করে। তাহলে,সেক্সুয়াল সিলেকশন আসলে বিবর্তনের তেমন "স্বতন্ত্র" চালক না।এটা ক্লিয়ার করা প্রয়োজন ছিলো।
আর কোনো মেকানিজম আছে? সেটা বোঝার জন্য আমরা চলে যাচ্ছি "কুদ্দুস গরুর খামার" এ।
১০ টা গরু, ৮ টা খয়রি, ২ টা সাদা।
ধরলাম,রঙের ক্ষেত্রে G ডমিনেন্ট এলিল, খয়রি।আর g রিসেসিভ এলিল,সাদা।৮ টা খয়রির মধ্যে ৫ টার আছে GG, ৩ টার আছে Gg। ২ টা সাদার থাকবে gg. এই ১০ টা।মানে, মোট G আছে ১৩ টা,মোট g আছে ৭ টা।
(হিসাবের সুবিধার্থে ঘি রঙের গরুগুলোকেও খয়রি ধরলাম,মানে শুধু এলিল ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে কাজ করবো, জিনোটাইপ অতটা লাগবেনা।না বুঝলে আগের পর্বগুলো পড়ে আসেন)
রাত ২ টা।
চারিদিকে অন্ধকার, লোকজন নাক ডাকায়ে ঘুমাচ্ছে।আস্তে আস্তে আসলো চোর, গরু-চোর।সে দেখলো, গরু আছে ১০ টা।কিন্তু,ও যেই ট্রাকে গরু নিয়ে যাবে, সেখানে গরু ধরবে দুইটা।রাতের অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যায় না। একপ্রকার কানা হয়েই সে ঢুকে দুই হাতে দুইটা গরু টের পেলো, দড়ি খুলে আস্তে করে কেটে পড়লো।
চুরি শেষ।
সকালে কুদ্দুস উঠে দেখলো, সাদা গরু দুইটা নাই। কুদ্দুস কাঁদতে থাকুক, আমরা বিজ্ঞানটা বুঝে আসি।
এইখানে ব্যাপারটা কী হলো? আসলে তেমন কিছুই হয়নি। চোর এক্কেবারে র্যান্ডমলি, কোনো কারণ ছাড়াই, নিজের অজান্তেই, কারো বা কিছু দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই, বলা যায় "ভুল করে" সাদা রঙেরই দুইটা গরু নিয়ে গেছে। ফলে? এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে ড্রামাটিক চেঞ্জ আসছে। একসাথে ৪ টা g চলে গেল, রয়ে গেল মাত্র ৩ টা, ওদিকে G আছে ১৩ টাই।ফলে, নেক্সট জেনারশনে gg আসার সম্ভাবনা আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এভাবে, বড় একটা সম্ভাবনা তৈরি হলো, কয়েক জেনারেশন পরে আর g পাওয়া যাবেনা।জি বাংলাএ সিরিয়ালের কাহিনীর মতো একদম,মাত্র একটা চুরি কুদ্দুসের গরুর খামারের এলিল ফ্রিকোয়েন্সি কাপিয়ে দিলো।আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, "জেনেটিক ড্রিফট"!
এখানে আমি যে বিষয়টার ওপর জোড় দিয়েছি, সেটা হলো "র্যান্ডমনেস"।বাংলায় "যদৃচ্ছতা"। জেনেটিক ড্রিফট সম্পূর্ণভাবে র্যান্ডমনেস দ্বারা চালিত।(এজন্যই পর্বের নাম এমন দিয়েছি) এখানে কোনো রকমের কারণ, উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য কাজ করবেনা।সাদা গরু দুইটাই চুরি হবে, এর সম্ভাবনা শুণ্য ছিলোনা,ফলে তা "হতেই পারতো", আর একদম র্যান্ডমলি সেটাই হয়েছে। না হলে অন্য কিছু হতো, একটা সাদা, একটা খয়রি বা দুইটা খয়রিই চুরি হতে পারতো, যা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো বেশি। কিন্তু, হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হলেই যে হবে, তা না।র্যান্ডমনেস জিনিসটাই এমন।
একটা ঘটনা বলি।
রিচার্ড ফাইনম্যান নাকি প্রায়ই তার কলিগদের কাছে যেতেন, আর মুখভরা উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, "জানো আজকে আমার সাথে কী হইছে? জানো?" তারা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করতো, "কী?" তিনি উত্তর দিতেন,
"কিছুই না!"
ঘটনাটা সত্য কিনা জানিনা, লরেন্স ক্রাউস তার অনেক বক্তৃতায় এই ঘটনাটা উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটা সত্য-মিথ্যা যাই হোক, এর সারমর্মটা চমকপ্রদক।
আমরা ভাবি যে আমাদের সাথে যা হয়, সেটাই স্পেশাল বা কোনো কারণে হয়, আমরা ভালো ঘটনাকে আমাদের ভালো কাজের ফল বা কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীর শুভকামনার ফল হিসেবে চিন্তা করতে ভালোবাসি। কিন্তু, আসলে এইটাযে এক্কেবারে র্যান্ডমলি হচ্ছে, তা বুঝতে চাইনা। আমরা ঘটনাকে কারণযুক্ত বা উদ্দেশ্যযুক্ত করতে পছন্দ করি।
যেকোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, একটা না একটা ঘটনা হতেই হতো, আর র্যান্ডমলি একটা হয়ে গেছে। এতে স্পেশাল কী? যা হয়েছে সেটা যদি স্পেশাল হয়, তবে যা হয়নি, সেটাও সমানভাবে স্পেশাল।আর কিছু না হওয়ারও একটা সম্ভাবনা ছিলো বলে সেটাও সমানভাবে স্পেশাল, ফাইনম্যান এটাই বোঝাতেন। আর যদি স্পেশাল না হয়, তবে কোনোটাই স্পেশাল না।
এত কথা বলার কারণ কী? জেনেটিক ড্রিফটে একটা জনসংখ্যা থেকে র্যান্ডমলি নির্দিষ্ট ধরনের এলিল কোনো ঘটনার ফলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া অসম্ভব না। "স্পেশাল" বা "উদ্দেশ্যপ্রণোদিত" না। র্যান্ডমনেসের ফলে দুইটাই সাদা গরু চুরি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এভাবে,একদম র্যান্ডমলি, কোনো জনসংখ্যায় যখন একটা নির্দিষ্ট এলিলের ফ্রিকোয়েন্সি হঠাৎ করে অত্যন্ত কমে যায়, বা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়; অর্থাৎ, পপুলেশনের এলিল ফ্রিকোয়েন্সিতে ড্রামাটিক চেঞ্জ আসে, তখন তাকে বলি জেনেটিক ড্রিফট।
ন্যাচারাল সিলেকশন কাজ করে অনুকূল ট্রেইটের নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু জেনেটিক ড্রিফটে অনুকূল-প্রতিকূল বিষয় না। র্যান্ডমলি চেঞ্জ আসবে, ফলে অনেক সময় প্রতিকূল বৈশিষ্ট্যও টিকে যায়।
যেই দুইটা গরু চুরি হলো, হতে পারে সেগুলোই সবচেয়ে বেশি দুধ দেয়।তাতে কী? র্যান্ডমলি চুরি হয়ে গেছে!হতে পারে খয়রি গরুগুলোর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম,তাতে কী?র্যান্ডমলি টিকে গেছে!
আচ্ছা, এবার বলেন, গরু যদি ১০০০টা থাকতো, খয়রি থাকতো ৮০০ টা, সাদা থাকতো ২০০ টা। তখন যদি চোর শ'খানেক ট্রাকও নিয়ে আসতো, তাহলেও সব সাদা গরু নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আগের তুলনায় কমে যেত। আমি বলছিনা যে সম্ভাবনা শূণ্য হয়ে যেত,বরং সম্ভাবনা "কম হতো"। তাই, জেনেটিক ড্রিফটের প্রভাব বড় জনসংখ্যার চেয়ে ছোট জনসংখ্যায় বেশি দেখা যায়। ব্যাপারটা এভাবে ভাবতে পারেন, একটা কয়েনকে ১০ বার টস করলে হেড-টেল এর সংখ্যায় পার্থক্য বেশি হবে। কিন্তু কয়েক হাজার বার করলে পার্থক্যটা কমে যাবে, হেড-টেল উভয়ে ৫০% এর অনেকটা আশেপাশে চলে আসবে। র্যান্ডমনেসের প্রভাব বড় সংখ্যায় তুলনামূলক কম বোঝা যায়, ছোট জনসংখ্যায় বেশি।আর জেনেটিক ড্রিফট যেহেতু সম্পূর্ণ র্যান্ডম, তাই ছোট জনসংখ্যায় এটা নাটকীয় প্রভাব ফেলে।
অনেক কথা বললাম, আজ এই পর্যন্তই।
Writer: Tahsin Ahmed Omi