আজকে কথা বলব এক ভয়ানক, খালি চোখে অদৃশ্য আতঙ্ক নিয়ে যে আপনার শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে। আক্ষরিক অর্থেই অশরীরীকে কেউ চেনে দেও এর অভিশাপ হিসেবে আর কেউ চেনে র্যাবিস ভাইরাস নামে।
সম্প্রতি র্যাবিস নিয়ে একটা চমৎকার লেখা চোখে পড়েছিল। সেটা পড়ায় মাথায় খেয়াল এল- আচ্ছা জলাতঙ্কে জল আতঙ্ক কেন?
কেন?
প্রশ্নটা যৌক্তিক। বিবর্তনের ধারায় সব র্যাবিস ভাইরাস ঠিক কীভাবে এই ক্ষমতা অর্জন করল যে তারা তাদের হোস্টদের পানির প্রতি আতঙ্কিত করে তোলে? আর এর প্রয়োজনীয়তাই বা কী?
উত্তরটা দেবো দু'টি অংশে। প্রথমে এই জলের প্রতি আতঙ্ক তৈরী হওয়ার মেকানিজম নিয়ে বলি।
যখন এই ভাইরাসটি শরীরে সংক্রমণ করে এটি রক্তে না ছড়িয়ে পেশীর কোষকে আক্রমণ করে। কারণটা সহজেই অনুমেয়,- রক্তে ছড়াতে চাইলে ইম্যুনো সিস্টেম সহজেই সেটাকে শনাক্ত করে ফেলবে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু করবে। কিন্তু পেশীর কোষে প্রবেশ করলে সে শঙ্কা নেই।
এরপর, পেশীতে থাকা neuromuscular junction, অর্থাৎ এমন জায়গা যেখানে একটা মোটর নিউরন আর একটা পেশীর ফাইবারের মাঝে একটা কেমিক্যাল সাইন্যাপ্স রয়েছে,- সেখানে মোটর নিউরনের সাথে নিজেকে bind বা সংযুক্ত করে। যেহেতু এই ভাইরাসটি neurotropic তাই খুব সহজেই নিউরনের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারে, বিশেষভাবে নিউরনের acetylcholine receptor এ। ওই রিসেপ্টরগুলো acetylcholine নামের গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটার রিসিভ করার জন্য পারদর্শী যেসব পেশী নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োজনীয়।
এরপর, সে retrograde transport ব্যবহার করে মোটর নিউরনের axon এ চলে যায়। এই retrograde transport হচ্ছে এমন মেকানিজম যার মাধ্যমে সাধারণত সাইন্যাপ্স থেকে কোষের মেইন বডিতে সিগন্যাল বা তথ্য আসে। এই সুবিধাটুকু ব্যবহার করে শুধু র্যাবিস ছাড়াও আরো অনেক অনুজীব আমাদের কোষে প্রবেশ করে।
এরপরে, ভাইরাসটি তার P protein গুলো মোটর নিউরনের ভেতরে থাকা dynein দের সাথে bind করায়। আবারো কঠিন টার্ম? আমারও পছন্দ নয়। P protein কে সহজভাষায় বললে বলা যায় ভাইরাসের nucleocapsids মানে যেটার ভেতর তার DNA বা RNA থাকে সেটার সাথে থাকা প্রোটিন যেটা ভাইরাসের mRNA তৈরীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর dynein হল আমাদের কোষে থাকা একধরণের cytoskeletal motor proteins যাদের কাজ হল ছোটখাট জিনিসপত্র, কেমিক্যালস কোষের ভেতর একজায়গা থেকে আরেকজায়গায় নিয়ে যাওয়া।
তো! বুঝতে পারছেন ঝামেলাটা? ভাইরাস ট্যাক্সিতে করে আমাদের কোষের mRNA সিনথেসিস করার জায়গায় যেতে চাচ্ছে যাতে নিজের অসংখ্য রেপ্লিকা তৈরী হয়।
তো একবার এক কাজ করতে পারলে খুব দ্রুত তার রেপ্লিকা তৈরী হতে থাকে এবং মোটর নিউরন থেকে মোটর নিউরনে যেতে যেতে মস্তিষ্কে পৌছে যায়। সেখান থেকে peripheral আর autonomic নার্ভাস সিস্টেমে পৌছে মুখে থাকা salivary glands বা লালাগ্রন্থিতে পৌছায়। Some journey, I'd say!
তো, যেহেতু peripheral আর autonomic নার্ভাস সিস্টেমের মধ্যে খাবার গেলার সময় গলার খাদ্যনালীর পেশীর কাজকর্মও অন্তর্ভুক্ত তাই ভাইরাসের সেই পেশী, circular ও longitudinal পেশীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে কোনো সমস্যাই হয় না। পানি খেতে বা গিলতে গেলেই এই পেশীগুলোতে যন্ত্রণাদায়ক খিঁচুনি সৃষ্টি করে যার ফলে পানি গেলা যায় না।
কীভাবে তারা এই কাজটি করে সেটা আমরা দেখলাম, এবার দেখার পালা কেন-র। কী লাভ পানি খেতে না দিয়ে?
র্যাবিসের ভাইরাস লালাগ্রন্থিতে চলে আসে যাতে রোগী কাউকে কামড় দিলে তার লালা থেকে অন্য মানুষের শরীরে ভাইরাসটি প্রবেশ করতে পারে। আর তাই, যদি রোগী নিজে লালা গিলে ফেলে তাহলে তো কামড় দেয়ার সময় অন্য মানুষের শরীরে ভাইরাস সংক্রামণের সম্ভাবনা কমে যায়। তাই ভাইরাসের জন্য এটাই বেশি সুবিধার যে রোগীর মুখে সবসময় লালা বা থুতু দিয়ে ভর্তি থাকে। তাই লালা, বা পানি গিলে ফেলার সময় গলার পেশীতে তীব্র ব্যাথা আর খিঁচুনি শুরু হয় যার ফলে গিলে ফেলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবস্থা বেশী খারাপ হলে লালা নিঃসরণও বেড়ে যায় আর শুধুমাত্র পানি খাওয়ার কথা চিন্তা করা মাত্র খিঁচুনি উঠে যায়।
রোগের নাম একেবারে জুতসই! রোগের আতঙ্ক একেবারেই ন্যায্য।
(সমাপ্ত)
লিখাঃ মনিফ শাহ চৌধুরী