গল্পটা তিনটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে।একটা ১৮০ ন্যানো-মিটার লম্বা বুলেট আকৃতির RNA ভাইরাস,একটা কুকুর এবং একজন হতভাগ্য মানুষ।
গল্পের ভাইরাসটির নাম হলো রেবিজ ( Rabis)। উষ্ণ রক্তের স্তন্যপায়ী প্রাণীরা হলো ভাইরাসটির প্রাকৃতিক পোষক।তবে প্রাধানত কুকুর,বিড়াল,শিয়াল,বেঁজির,বাদুড় ইত্যাদির কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটা মানুষের দেহে ছড়ায়।
আক্রান্ত প্রাণীর লালা থেকে কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে থাকে। ভাইরাসটি নিউরোট্রপিক (neurotropic) অর্থাৎ স্নায়ুতন্ত্রকে অাক্রমণ করে।
ভাইরাসটা যথেষ্ট চলাক কারণ বেশির ভাগ ভাইরাসের মতো এটা রক্তের মাধ্যমে তার গ্যন্তবে(এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক) পৌঁছায় না।কারণ রক্তের মাধ্যমে তাড়াতাড়ি গ্যন্তবে পৌঁছানো গেলেও রক্তে রয়েছে শ্বেতরক্তকণিকা (Leucocytes) দ্বারা পরিচালিত দেহের সবচেয়ে শক্তিশালী রোগপ্রতিরোধ ব্যাবস্থা। তারবদলে ভাইরাসটা অতি অাস্তে আস্তে বিভাজিত হয় যাতে দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে(Immune system) ফাঁকি দিয়ে প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রে (peripheral nervous system) চলে যাতে পারে।তারপর ভাইরাসটি প্রতিদিন গড়ে ১-২ সে.মি. গতিতে উপরদিকে হামাগুড়ি দিতে থাকে যতক্ষণ না প্রণির মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে।
এজন্যই রোগটার সুপ্তিকাল আক্রান্ত প্রাণীর কামড়ের অবস্থানের উপর নির্ভর করে।কামড়ের অবস্থান মস্তিষ্ক থেকে যত কাছে হবে রোগের সুপ্তিকালও ততো কম হবে। মানুষের ক্ষত্রে রোগটার সুপ্তিকাল সাধারণত ২-৮ সপ্তাহ।কিন্তু কিছু ক্ষত্রে রোগটা বেশ কয়েক বছর সুপ্তবস্থায় থাকতে পারে।
একবার মস্তিষ্কে পৌঁছুতে পারলে আপনি মানুষ হোন বা কুকুর-বিড়াল আপনার কেল্লা ফতে। এই দুনিয়াতে আপনার আর বেশি দিন বাকি নেই এবং আপনি কুকুর-বিড়াল হলে এই অল্প কিছুদনই আপনি পাগল হয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বেড়াবেন ভাইরাসটার পরবর্তী পোষকের খোঁজে।
মস্তিষ্কে পৌঁছে রেবিজ অতি দ্রুত বংশ বিস্তার করে। তারপর মস্তিষ্ক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রতঙ্গে বিশেষ করে লালা গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ে।রোগটিতে লালাক্ষরণ বেড়ে যায় কারণ ভাইরাসটা লালার ম্যধ্যমে ছড়ায়।
মানুষের ক্ষত্রে প্রথমে লক্ষণ গুলো সাধারণ সর্দির মতো লক্ষণ প্রকাশ পায়। তারপর জ্বর, মাথাব্যাথা,বমি,অস্বস্তি, কনফিউশান, হ্যালুসিনেশন এবং অবশ্যই জলাতঙ্ক (Hydrophobia)। শেষমেষ কোমা এবং তারপর মৃত্যু।
রেবিজে ঢোক গিলার সময় ডায়াফ্রাম,শ্বাসতন্ত্রের মাংসপেশি ও কণ্ঠনালির তীব্র ব্যথাযুক্ত সংকোচন হয় যা বিশেষ করে পানি পান করার প্রকাশ পায়। যা রোগটার প্রধান লক্ষণ।
বিজ্ঞানীদের মতে পানি পান না করতে পারা বা ঢোক না গিলতে পারার ফলে লালা ক্ষরণ বেড়ে যায়।যা ভাইরাসটার পরবর্তী পোষক খুঁজে পাওয়ার জন্য অবশ্যক কারণ ভাইরাসটা লালার মাধ্যমে ছড়ায়।
অনেকের মতে মানুষ রেবিজের accidental host.কারণ মানুষের দাঁত ও লালা গ্রন্থির গঠন এবং মানুষের আচরণ রেবিজের নতুন পোষাকের ভিতর ছড়িয়ে দেবার জন্য একদমই অনুপযুক্ত।
প্রাচীন কাল থেকেই জলাতঙ্ক রোগটা আমাদের সাথে আছে। যদিও লক্ষণ প্রকাশে মৃত্যু নিশ্চিত তবুও বিভিন্ন সভ্যতায় এর প্রতিকারের বিভিন্ন অদ্ভুত বর্ণনা পাওয়া যায়।
যেমন প্রচীন চাইনিজদের মতে পাগলা কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা হিসাবে যে কুকুর কামড় দিয়েছে সেটাকে মেরে, মাথা কেটে ব্রেইন বের করে ক্ষত স্থানে ঘষে দেওয়া।
যা হোক প্রথম রেবিজ চিকিৎসার পথপ্রদর্শক হলেন লুইস পাস্তুর। তিনিই প্রথম ১৯৮৫ সালে ৬ জুলাই জোসেফ মেইস্টার নামক ৯ বছরের বাচ্চার দেহে রেবিজের ভ্যাকসিন প্রদান করেন।
প্রথম রেবিজ ভ্যাকসিন তৈরি করা হয় রেবিজ আক্রান্ত কুকুরের স্পাইনাল কর্ড থেকে। যা আজো অনেক দেশে ব্যাবহার করা হয়।
বর্তমানে রেবিজের চিকিৎসায় প্রথমে রেবিজের ইমিউনোগ্লোবিউলিন ব্যাবহার করা হয় এবং পরে রেবিজ ভ্যাকসিনের ৪ টা ডোজ ১৪ দিনের ভিতর ব্যাবহার করা হয়। সাধারণত কামড়েরের স্থানের আশেপাশেই ভ্যাকসিন ব্যাবহার করা হয়।
বর্তমানে রেবিজের ভ্যাকসিন পৃথিবীর বহুদেশের মতো বাংলাদেশেও সহজলভ্য।
তবুও দেশে সচেতনতার অভাবে প্রতিবছর ২০০০ মানুষ মারা যান।
" প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম "। সুতরাং সবার উচিত পোষা প্রাণীদের রেবিজের ভ্যাকসিন দিয়ে রাখা এবং কুকুর,বিড়াল, শিয়াল বিষয় করে বাদুড়ের কামড় থেকে সাবধান থাকা।
বাদুড়ের কামড়ের দিকে বিশেষ সর্তকতার প্রয়োজন কারণ বাদুড় সাধারণত মাথার কাছাকাছি কামড়ে থাকে ফলে ভাইরাসটি দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো বাদুড় প্রাকৃতিক ভাবেই ভাইরাসটার ভয়াবহ স্ট্রেইন বহন করে।তারউপর বাদুড়ের কামড় ছোট বলে অনেকেই খেয়াল করতে পারে না।
উইকিপিডিয়ার মতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মাত্র ১৪ জন মানুষ রোবিজের লক্ষণ দেখা দেবার পর সেরে উঠেছে। সুতরাং আমাদের এই প্রাণঘাতী রোগটার থেকে সাবধান থাকা প্রয়োজন।
Source
Book -Rabid by Bill Wasik, Monica Murphy
Wikipedia
https://www.wikipedia.org/
ছবি- Pinterest
Writer: Sabrina Shamme