প্রজাতির সংজ্ঞা

প্রজাতি

একজন প্রশ্ন করেছেন- প্রজাতি জিনিসটার সংজ্ঞাটা যেন কীরকম। স্কুল-কলেজের জীববিজ্ঞান বইতে বলা থাকে, নিজেদের মধ্যে প্রজনন করে উর্বর সন্তান তৈরি করতে পারলে তারা এক প্রজাতি। না পারলে নয়। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ জীবই বংশবিস্তার করে অযৌন জনন প্রক্রিয়ায়। তাদের তো একজন আরেকজনের সাথে মিলিত হয়ে সন্তান তৈরির ব্যাপারই নেই। তাদের ক্ষেত্রে তাহলে প্রজাতির সংজ্ঞা কীভাবে দেওয়া হবে?

প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

স্কুল কলেজের পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য থাকে, কোন একটা বিষয়ের গোড়ার ধারণাগুলোর সাথে ছাত্রছাত্রীর পরিচয় করিয়ে দেওয়া। যেহেতু এটা একদম সূচনা পর্যায়ের বই, কাজেই এখানে অনেক কিছু সহজ করে বলা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এরকম অতি সহজ করে বলতে গিয়ে বাস্তবতা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা দেওয়া হয়ে যায়। এজন্যই "উচ্চশিক্ষা" বলে একটা ব্যাপার আছে। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে যখন আমরা কোন বিষয়ের আরেকটু গভীরে ঢুকি, তখন একটা বিশাল সময় যায় ছোটবেলায় শেখা বিদ্যের মুণ্ডুপাত করে।

আমার মনে পড়ে, অনার্সের প্রথম বর্ষে আমাদের এক শিক্ষক বলেছিলেন- দেখো, জীবাণু কেন স্পোর তৈরি করে সেটার একটা ব্যাখ্যা তোমাদেরকে শেখাচ্ছি। আপাতত এটা চুপচাপ পড়ে নাও। যখন চতুর্থ বর্ষে উঠবে, আরেকটু জ্ঞানবুদ্ধি হবে, তখন জানবে এই ব্যাখ্যাটা ভুল। এর চেয়ে ভাল আরেকটা ব্যাখ্যা আছে।

প্রক্রিয়াটা এরকমই। জটিল জিনিস বুঝতে হলে আগে জিনিসটা সহজভাবে বুঝতে হয়।

যাইহোক, প্রজাতির প্রশ্নে আসি। প্রজাতির যে সংজ্ঞাটা স্কুল-কলেজের বইতে দেওয়া থাকে, সেটার বেশ কিছু সমস্যা আছে। প্রশ্নকর্তা যেমন বললেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীর অগণিত জীবের ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞা প্রযোজ্য নয়। কারণ তারা যৌন জনন করেই না, উর্বর সন্তান দূরের কথা।

বিজ্ঞানীরা মোটামুটি এই সমস্যাকে তিনভাবে সামাল দিয়েছেন।

প্রথম সমাধানটা একটু গা-বাঁচানো। আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক কি তারও আগে যারা জীবাণু নিয়ে কাজ করতেন, তারা আসলে প্রজাতির "বাস্তব" সংজ্ঞা নিয়ে অতটা চিন্তিত ছিলেন না। তাদের মতে, বিভিন্ন জীবকে আলাদা প্রজাতিতে ভাগ করা হয় কাজের সুবিধের জন্য। এজন্য দু'টো জীবাণু যদি পরীক্ষাগারে দু'রকম বিক্রিয়া দিত, অনেক ক্ষেত্রে সেই ভিন্ন বিক্রিয়ার ভিত্তিতে তারা বলে দিতেন- এরা দুই প্রজাতি। এদের বৈশিষ্ট্যে যে হেরফের দেখা যাচ্ছে, সেটাই মূল কথা। গবেষণাগারে আলাদা করে চেনা গেলেই হল, এর চেয়ে ভেতরে চিন্তা করার আপাতত অত দরকার নেই। তাদের দেওয়া প্রজাতির সংজ্ঞা অনেক ক্ষেত্রেই আমরা আজ পর্যন্ত মেনে চলি। এবং এতে সেরকম অসুবিধেও হচ্ছে না- পরীক্ষাগারের গবেষণা তো চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে ঠিকই। সেটাই যথেষ্ট।

এই একই সমাধান কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ফসিল বা জীবাশ্মবিদ্যার ক্ষেত্রেও দেখা যেত- দু'টো জীবাশ্ম নমুনার মধ্যে ভিন্নতা দেখলেই বিজ্ঞানীরা এদের আলাদা প্রজাতি বলে দিতেন। আজকের গবেষণা বলছে, ইউরোপের নিয়ান্ডার্টাল মানব আর আফ্রিকার হোমো সেপিয়েন্সদের মধ্যে কিন্তু ঘরসংসার হয়েছে। তার প্রমাণ আজকের পৃথিবীর মানুষেরা দেহে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ফসিলগুলোর চেহারা ভিন্ন বলে আবিষ্কারের পর এদের আলাদা প্রজাতি ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এই সমাধানে গবেষণাগারে কাজের সুবিধে হয়ত হবে, কিন্তু অনেকেই আবার সন্তুষ্ট হবেন না। তারা প্রজাতি জিনিসটার আরেকটু কড়াকড়ি সংজ্ঞা চাইবেন- এমন একটা মাপকাঠি, যেটার ভিত্তিতে বাস্তবসম্মতভাবেই দু'টো জীবকে এক বা আলাদা প্রজাতি আখ্যা দেওয়া যায়।

এরকম কড়াকড়ি সংজ্ঞার সুযোগ করে দিল হাল আমলের ডিএনএ প্রযুক্তি।

পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং এর ব্যাপার শুনেছেন তো? কোন একটা জীবের ডিএনএ (বা আরএনএতে) যতগুলো অক্ষর থাকে, সব একপাশ থেকে মেশিন দিয়ে পড়ে ফেলাকে বলে সিকোয়েন্সিং। করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা মানে এর আরএনএর ত্রিশহাজার অক্ষর পড়ে ফেলা। এর ফলে আমরা জীবের কলকব্জা সম্পর্কে যত গভীরভাবে জানতে পেরেছি, এতটা আর কোন প্রযুক্তিতেই সম্ভব হয় নি।

তো এই জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি আসার পর বিজ্ঞানীরা প্রজাতির সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে আরেকটু আশার আলো দেখলেন। তারা ভাবলেন- ডিএনএ যেহেতু জীবনের নকশা, কাজেই দু'টো জীবের নকশার মধ্যে কত শতাংশ মিল পাওয়া যাচ্ছে- তার ভিত্তিতে এদেরকে প্রজাতির খোপে ভরে ফেলা যেতে পারে।

এর একটা বাস্তব উদাহরণ চিন্তা করুন। নতুন করোনাভাইরাসের সন্ধান পাওয়ার পর বিজ্ঞানীরা প্রথমেই যেটা করলেন- তারা অন্য সব করোনাভাইরাসের আরএনএর সাথে এটাকে মিলিয়ে দেখলেন। কিন্তু কোন ভাইরাসের সাথেই এর পুরোপুরি মিল পেলেন না। এক বাদুড়ের ভাইরাসের সাথে এর ছিয়ানব্বই শতাংশ মিল পেলেন- কিন্তু ঐ চার শতাংশ অমিল বিশাল ব্যাপার। এজন্যই তারা একে একটা নতুন উপপ্রজাতি ঘোষণা দিয়ে দিলেন, যেহেতু আরএনএর দিক থেকে এটা আর সবকিছু থেকে আলাদা।

কিন্তু এভাবে ডিএনএ-আরএনএর অমুক শতাংশ মিলের ভিত্তিতে প্রজাতি (বা করোনার ক্ষেত্রে উপপ্রজাতি) আখ্যা দেওয়া- এখানেও সমস্যা আছে। সেটা হল, ঐ "অমুক" শতাংশটা আসলে কত শতাংশ? একেক জীবের মধ্যে পরিবর্তনের হার একেকরকম। এইচআইভি ভাইরাসের মধ্যে যত দ্রুত পরিবর্তন আসে, করোনাভাইরাসে কিন্তু তত দ্রুত আসে না। তাই যদি হয়, তাহলে তো একেকরকম জীবের ক্ষেত্রে প্রজাতির হিসেবটা একেকরকমভাবে করতে হবে।

তার মানে, প্রজাতির "সার্বজনীন" সংজ্ঞা বলে কিছু থাকছে না। কেমন যেন হয়ে গেল ব্যাপারটা।

এই ভজঘট থেকে মুক্তির পথ আছে। এবং সেই মুক্তির পথ হচ্ছে আমাদের সেই পুরোনো ছোটবেলার প্রজাতির সংজ্ঞাটাই।

একটু চিন্তা করুন- প্রজাতির সংজ্ঞার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা যৌন প্রজনন জিনিসটাকে আদৌ হিসেবে এনেছিলেন কেন? এমনিতে তো তারা সেই অ্যারিস্টটলের মত একেকজাতের প্রাণীকে একেক প্রজাতি তকমা দিয়ে দিতে পারতেন। তারা সেটা করেননি, তারা প্রজনন এবং উর্বর সন্তানের প্রসঙ্গ এনেছেন। এটা তারা কেন করতে গেলেন?

এর মধ্যেই আমাদের সমস্যার সমাধান আছে।

জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, যৌন প্রজনন জিনিসটা হল জিন আদান প্রদানের একটা উপায়। যদি একদল জীব নিজেদের মধ্যে এই প্রক্রিয়ায় বংশবিস্তার করে, তার মানে তারা অহরহই একে অপরের সাথে জিন আদান প্রদান করবে। ফলে পুরো দলের জিনগুলো একটার সাথে আরেকটা মিশে মোটামুটি কাছাকাছি হবে। তরকারির হাড়িতে সবজির মত। এজন্যই এই একেকটা জিন-শেয়ারিং নেটওয়ার্ককে আমরা একেক প্রজাতি বলি।

এজন্যই কিন্তু উর্বর সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে। ঘোড়া আর গাধা যদি খচ্চর বানিয়ে পৃথিবী বোঝাই করে ফেলে, তারপরেও তাদের জিন ঠিক মিশছে না। দুই জাতের জিন খচ্চরের মধ্যে জমা হচ্ছে, খচ্চর বেচারি বিয়েশাদী না করেই দুনিয়া থেকে বিদেয় নিচ্ছে। কাজেই ঘোড়ার মধ্যে গাধার জিন ঢুকে সে গাধার বৈশিষ্ট্য পাচ্ছে না, আবার গাধাও ঘোড়ার বৈশিষ্ট্য পাচ্ছে না। তাই এরা আলাদা প্রজাতি। মিশতে পারছে না বলেই।

তো এই জিন আদান প্রদানই যদি প্রজাতির সংজ্ঞা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। একগোছা জীব কি একই প্রজাতি কিনা, সেটা বের করার জন্য এরা যৌন জনন করে কিনা সেটা জানার দরকার নেই। আসল প্রশ্ন হল, এরা কি একে অপরের সাথে জিন শেয়ার করতে পারে কিনা। যদি পারে, তাহলে এরা এক প্রজাতি। না পারলে ভিন্ন প্রজাতি।

এবার আসল কথা। যৌন জনন না পারলেও, জিন আদান প্রদানের বিশেষ কিছু কায়দা জীবজগতের সব সদস্যেরই জানা আছে। গবেষণাপত্রের খটোমটো ভাষায় একে বলে হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার। তার মানে, যদি জীবাণুদের মধ্যে আমরা এই জিন ট্রান্সফারের কিছু সীমানা বের করতে পারি, যার মধ্যেকার সব জীবাণু জিন দেওয়ানেওয়া করতে পারে কিন্তু বাইরের জীবাণুদের সাথে পারে না, তাহলেই তো প্রজাতির সংজ্ঞা হয়ে গেল। জিন শেয়ারিং-এর ঐ সীমানা বরাবরই প্রজাতির রেখাগুলো টানা হবে।

এই কায়দাতেই এখন প্রজাতির সংজ্ঞা দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। কাজ এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু চলছে। বেশ কিছু গবেষক দল জীবাণু, ভাইরাস মায় তাবৎ জীবজগতকে এই জিন শেয়ারিং-এর ভিত্তিতে প্রজাতিবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।

জীবজগত সাংঘাতিক জটিল, তাতে সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু তার সাথে যেন পাল্লা দেয় বিজ্ঞানীদের ধুরন্ধর বুদ্ধি।


Writer: Hassan Uz zaman Shamol

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম