(১)
আধো আলো আধো অন্ধকার একটা ঘর। আসবাব বলতে শুধু একখানা টেবিল আর একটা চেয়ার। চেয়ারে যিনি বসা তার দু হাত টেবিলে রাখা, চোখ বাধা, উপরন্তু চোখে অর্ধডিম্বাকৃতির
লোকটা অপহৃত না। তার হাত বাধা না। তবে তিনি একটা পরীক্ষার অংশ। তার সামনে টেবিলে পচিশটা কার্ড আছে। তাকে এই কার্ডগুলো থেকে পাচটা কার্ড নিজের ইচ্ছেমত বেছে নিতে হবে। তবে এখনই নয়। পাচ মিনিট পর।
অপর ঘরে তারই মত আরেকজন ব্যক্তি বসে আছেন যার কাজ হল উনি কোন কার্ডগুলো বেছে নিয়েছেন সেটা অনুমান করা। তবে এখানে ছোট্ট একটা টুইস্ট হল, অপর ঘরের ব্যক্তিটি আগেই অনুমান করবেন যে এই ব্যক্তি কোন কার্ডগুলো বেছে নেবেন। ওনার অনুমান শেষ হলে এই ব্যক্তি কার্ডগুলো পছন্দ করবেন। উক্ত সময়ে কেউ কারো সাথে কোনো ধরণের যোগাযোগ করবেন না।
দ্বিতীয় ঘরে যে আছেন তিনি একজন স্বঘোষিত আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। তিনি দাবী করেন তার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা বা Extrasensory perception আছে। সেটা পরীক্ষা করার জন্যেই প্রফেসর জন এনেট এসব ব্যবস্থা করেছেন।
(২)
এই ইএসপি কী? একে ভাল্ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে বলা যায়, এক্সট্রাসেন্সরি
Clairvoyance: এখানে দুটি ফ্রেঞ্চ শব্দ আছে। Clair অর্থ clear বা পরিষ্কার, আর voyant অর্থ দেখা। এই ক্ষমতাবলে মানুষ পঞ্চইন্দ্রিয় ব্যবহার না করেই কোনো নির্দিষ্ট জিনিস বা জায়গা সম্পর্কে তথ্য জানতে পারে।
Psychokinesis: টেলিকাইনেসিস এটার অংশ। মুভিতে অনেক দেখে থাকবেন মনের "শক্তি" ব্যবহার করে কোন বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করা।
Precognition: সহজার্থে ভবিষ্যৎ বলতে বা দেখতে বা সঠিকভাবে অনুমান করতে পারা। হাত দেখা, রাশিচক্র, কার্ড দেখে ভাগ্য নির্ণয় সবাই এই ক্ষমতার দাবী প্রত্যক্ষ কীংবা পরোক্ষভাবে রেখে থাকেন।
Telepathy: সবচেয়ে বহুল পরিচিত এবং ভুল ধারণাকৃত শাখা মনে হয় এটা। মনের কথা পড়তে পারার ক্ষমতা। অনেকে মনে করেন এটার সত্যিই অস্তিত্ব রয়েছে এবং এটা বিজ্ঞানস্বীকৃত।
এবার বিস্তারিত কথা বলা যাক। কোনো দাবী বিজ্ঞানে স্বীকৃত হতে হলে সেটাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া মেনে এমন একটা নির্ভরযোগ্য ফলাফল দিতে হবে যেটা পরীক্ষাটা পুনরাবৃত্তি করলেও প্রায় একই ফল পাওয়া যাবে।
শুরুতে যেই পরীক্ষার কথা বলেছিলাম সেটা precognition প্রমাণ করার জন্য। একই পরীক্ষা clairvoyance এর জন্যেও করা সম্ভব। এমনই এক পরীক্ষা করেছিলেন JB Rhine ১৯৩০ এর দিকে Duke University তে। তার এই এক্সপেরিমেন্টের
একই পরীক্ষা ১৯৩৬ সালে Princeton University তে WS Cox করেন। তার ১৩২ জন সাবজেক্ট এর মধ্যে ২৫,০৬৪ টা কার্ড পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে E.T. Adam, J.C. Crumbaugh, C.P. Heinlein ও R.R. Willoughby আলাদা আলাদাভাবে এক্সপেরিমেটটি পুনরায় করেন এবং সকলেই কক্সের সাথে এবিষয়ে একমত হন যে অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার পক্ষে কোনোই প্রমাণ পাওয়া যায়নি। J.B. Rhine এর এক্সপেরিমেন্টের
(৩)
বৃদ্ধ পিয়ার্স তার ছেলে জনের দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলে দিলেন যে তিনি জনের অহেতুক রিসার্চের জন্য ব্যবসা থেকে আর অর্থ খরচ করতে দেবেন না। জনের উচিৎ এসব ফালতু ব্যাপারে পয়সা নষ্ট না করে কোন সত্য বিজ্ঞানভিত্তিক কাজে মন দেয়া আর নয়তো শুধু ডাক্তারি চেম্বার খুলে সকাল বিকাল রোগী দেখা।
মাথা নিচু করে বাবার আবেগহীন ব্যাঙ্গাত্বক কথাগুলো শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল প্রফেসর সার্জন জন এনেট। তার মনে কী কোনো ক্ষোভ তৈরী হচ্ছে? নাকি হতাশা? সে প্রমাণ করেই ছাড়বে অতীন্দ্রীয় ক্ষমতা আসল এবং মানবকল্যাণস্বার
(৪)
সন ১৯৮০
জেমস হাইড্রিক। পুরো বিশ্ব তাকে এক নামে চেনে। কী অদ্ভুত ক্ষমতা মানুষটার। শুধুমাত্র নিজের মনের শক্তি দিয়েই সে নষ্ট ঘড়ি ঠিক করতে পারে, চামচ বাকা করতে পারে। বই না ছুয়েও বইয়ের পাতা ওল্টাতে পারে। আজ ইনি এক সুপরিচিত টেলিভিশন শো তে আমন্ত্রিত।
শোয়ের নাম "দ্যাট'স মাই লাইন"। জেমস র্যান্ডি- যিনি এসবে বিশ্বাস করতেন না- বইয়ের পাতার ওপর ছোট ছোট ফোমের টুকরো রেখে দিলেন। উদ্দেশ্য? হাইড্রিক যদি কোনো চাতুরি করে ফু দিয়ে পাতা ওল্টানোর চেষ্টা করেন তাহলে সবার আগে পাতা ওল্টানোর বদলে ফোমের টুকরোগুলো সরে যাবে। প্রমাণ হয়ে যাবে হাইড্রিক একজন ফ্রড।
হাইড্রিককে সব জানানো হল। বলা হল এখন মনকে ব্যবহার করে পাতাখানা ওল্টাও দেখি। হ্যাড্রিক বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হতে লাগল, উপস্থাপক, দর্শক, সবাই আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন আর হাইড্রিক একেবারে জবুথুবু হয়ে বসে থাকলেন। এরপর বললেন আজ কেন জানি তার ক্ষমতা ঠিক কাজ করছে না। অন্যদিন চেষ্টা করবেন।
পরে অবশ্য হাইড্রিক স্বীকার করেছিলেন যে তার কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তি নেই। তিনি একজন ধোঁকাবাজ।
চামচ কীভাবে বাকিয়ে ফেলতেন? চামচের সবচেয়ে দুর্বল অংশে ঘষে ঘষে অল্প তাপ আর অল্প আঙুলের বল ব্যবহার করে একটু একটু করে বাকানো হয়। এসময় ম্যাজিশিয়ান কথা বলতে থাকেন আর দর্শকদের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে রাখেন। যখন যথেষ্ট বাকা হয়ে যায় ম্যাজিশিয়ান সেটা এমন এঙ্গেলে ধরেন যে মাধ্যাকর্ষণই যথেষ্ট হয় সেটাকে বাকা করে ফেলতে।
অনেক ম্যাজিশিয়ান গ্যালিয়ামের তৈরী চামচ ব্যবহার করতেন। গ্যালিয়ামের মেল্টিং পয়েন্ট শরীরের তাপমাত্রার কাছাকাছি।
এখানে নোট করা জরুরি যে সব ম্যাজিশিয়ানেরই মুলতন্ত্র হচ্ছে দর্শকের মনোযোগ অন্যত্রে সরিয়ে রাখা।
(৫)
অনেক বছর পর।
প্রখ্যাত প্রফেসর এবং সার্জন জন এনেট এক লাইভ টেলিভিশন টক শো তে আমন্ত্রিত। টকশো তে আরো আছেন নিউরোস্পেশালিস্
উপস্থাপক শুরু করলেন জনকে দিয়েই। কীভাবে জন কয়েক বছর আগে তার পারিবারিক ব্যবসার একাংশ বিক্রি করে নিজের ব্যক্তিগত রিসার্চ ইউনিটে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা নিয়ে রিসার্চ করতেন, এবং কীভাবে তিনি এখনও এ বিষয়ে যথাযত কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেন নি।
জন খুবই ধৈর্যের সাথে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। সে জানত আজ তাকে এখানে নানান কথা শুনতে হবে। তবে পৃথিবীর সবার কাছে পৌছানোর এই প্ল্যাটফর্ম সে খুব কমই পাবে।
-"প্রফেসর, আপনি গত কয়েক বছর ধরে দাবী করে আসছেন যে আপনার Precognition বা ভবিষ্যত দেখতে পারার ক্ষমতা আছে। এবং আপনার বেশ কিছু অনুমান সঠিকও হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অভিনেতা উইকের সেই মর্মান্তিক এক্সিডেন্ট, বা রাজনীতিবিদ খানের ইলেকশনের হার। এমনকি কৃষক আর্থারের খামারে দামী কিছু থাকা। এ ব্যাপারে কিছু আমাদের জানাবেন কী?"
-"আসলে, আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারব না আপনাকে। ব্যাপারটা স্বপ্নের মত। আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমি হঠাৎ কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যৎ দেখতে পারি এবং তখন তা তাকে জানিয়ে দিই। আমার আলাদা কোনোই কৃতিত্ব নেই আসলে। ব্যাপারটা পারিবারিক হতে পারে। আপনারা জানের বিখ্যাত লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের দ্বিতীয়া স্ত্রী, লেডি জিন এনেটের ঘরের বংশধর আমি। আর কে না জানে লেডি জিনের মৃতের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা ছিল।"
-'আর সেজন্যেই আপনি আপনার পিতাপ্রদত্ত পদবি বদলে নিজের নামের শেষে এনেট রেখেছেন?"
-"জ্বী, অবশ্যই। তার সম্মানার্থে।"
-"মাফ করবেন প্রফেসর।" পায়াম গোলশামি তার মাথার সেলাই করা অংশে হাত বুলাতে বুলাতে শুরু করলেন। "লেডি জিনের সম্মানার্থেই বলছি, উনি যে ছলচাতুরি করতেন, বিভিন্ন তার এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ব্যবহার করে সবাইকে ধোকা দিতেন এটা অনেক আগেই প্রমাণিত। এমনকি তিনি হ্যারি হুডিনিকেও বোকা বানাতে পারেননি।"
-"আপনি এভাবে বলতে পারেন না। তার দ্বারা অনেক দু;খী মানুষ তাদের মৃত আত্নীয়দের সাথে কথা বলেছেন। দ্যাট ইজ আ হিস্টোরিকাল ফ্যাক্ট!" জন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
-'আর আপনার কথাই বলি। অভিনেতা উইক যে মদ্যপ হয়ে প্রায়ই গাড়ি চালাতেন এটা কে না জানে? ওনার এক্সিডেন্ট করার কথা না তো কার? আর রাজনীতিবিদ খানের ব্যাপারটা। পরিসংখ্যানের ডাটা ঘেটে একটু প্যাটার্ন দেখলেই হয় যে ওনার জনপ্রিয়তা বিগত বছরগুলোতে কীভাবে কমেছে। একটা বাচ্চাও বলতে পারত এবারের ইলেকশন উনি হারবেন। আপনি হাসালেন প্রফেসর! জোকারের মত!"
জনের মাথায় আগুন ধরে গেল। রাগে কাপতে লাগলো। রক্তিমবর্ণের চোখের দিকে তাকালে যে কেউ ভয় পেয়ে যেত। কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। এরপর প্রফেসর জন ভারী কন্ঠে বললেন,-
"পায়াম, আমি আপনার মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি। আপনার ঘাড়ের ওপর মাথা নেই। চারিদিকে রক্ত আর রক্ত।"
হো হো করে হেসে উঠলেন পায়াম গোলশামি এবং হ্যারি মজুমদার। উপস্থাপক একটু বিব্রত হলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জনকে শান্ত হতে বললেন। হঠাৎই জন টেবিলে জোরে ঘুষি মারল। আর অমনি আশে পাশের লাইটগুলো বিস্ফোরিত হল।
সবাই চুপ। সবার দৃষ্টি জনের দিকে। জন তার হাত ধীরে ধীরে উঠালো। দর্শকদের সিটের সামনে রাখা ড্রামের দিকে হাত প্রসারিত করল। হাতের মুঠি আস্তে আস্তে বন্ধ করতে লাগল। এবং হটাৎই একমুহুর্তের ভেতর হাত বন্ধ করে ফেলল।
অমনি ড্রাম দুমড়ে মুচড়ে গেল! যেন কোনো বিশাল শক্তিশালী দানোর হাত ড্রামটা ধরে ভেঙে দিয়েছে।
এবার সবাই ভয় পেয়ে গেল। পায়াম গোলশামিই একমাত্র যে অপ্রস্তুত হল না। "আরেহ বাহ প্রফেসর! বিনা টিকিটে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন দেখি!"
জন শান্ত অথচ ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে পায়ামের দিকে তাকাল। প্রসারিত হাতের মুষ্টি পায়ামের দিকে করে মুষ্টি খুলে ফেলল আর শুধু উচ্চারণ করল একটা মাত্র শব্দ।
"মর।"
পায়ামের মাথা বিস্ফোরিত হল। পুরো স্টেজে রক্ত ছড়িয়ে পড়ল। শরীরটা সিটেই বসে রইল আর গলার ওপরের ফাকা মুন্ডুহীন জায়গা থেকে রক্তের ফোয়ারা ছুটতে লাগল।
সহসাই শব্দে মশগুল হল পিনপতন নীরবতায় ডুবে গেল।
(৬)
টেলিপ্যাথি কী সম্ভব?
আগে বুঝে নেই টেলিপ্যাথি কী। মনের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অন্যের মনের কথা পড়তে বা বুঝতে পারার নামই হল টেলিপ্যাথি। অনেকে এটাকে বৈজ্ঞানিক সাজ দিতে চান। তারা বলেন, এটা এমন এক ক্ষমতা যার ফলে অন্যের মস্তিষ্কের তরঙ্গ নিজের মস্তিষ্কে রিসিভ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলেন মা যেমন সন্তানের মনের কথা বুঝতে পারেন, বা প্রিয় কাউকে খুব মিস করলে দেখা যায় সে ফোন দিয়েছে, এসবই টেলিপ্যাথি।
আসলেই কী তাই?
একটা বাচ্চার কখন কী প্রয়োজন এটা জানার জন্য টেলিপ্যাথির প্রয়োজন নেই। আপনি একটা বিড়াল পালা শুরু করুন ঠিক সেটার প্রয়োজন বুঝে যাবেন। কারণ আপনি তাকে বেশি বেশি দেখবেন, তার বিভিন্ন এক্টিভিটি, মুখায়ব ইত্যাদি আপনার অবতেচন মন খেয়াল করবে এবং একটা অনুবাদ দাড় করাবে। কাউকে মিস করলেই তার ফোন আসাটা স্রেফ কাকতালীয়। আপনি কখনোই একটা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এক্সপেরিমেন্ট করলে বিশ্বাসযোগ্য ফল পাবেন না।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে একটা অভিনব পদ্ধতিতে ইএসপির পরীক্ষা চালানো হয়। তারা ভলান্টিয়ারদের মস্তিষ্কের স্ক্যান নেন এবং দেখেন ইএসপি "ব্যবহারের" সময় তাদের মস্তিষ্কের প্যাটার্নে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ভিন্ন কোনো পরিবর্তন আসে কী না।
তাদের নিকট আত্নীয়, মেয়েবন্ধু, এমনকি যমজ ভাইদের অন্য একটা ঘরে রাখা হয়েছিল। শুরুতে সাধারণ অবস্থায় তাদের মস্তিষ্কের প্যাটার্ন নেয়া হয়। এরপর তাদের আত্নীয়, যারা অন্য ঘরে আছে, তাদের একটা ছবি দেখানো হয় আর ভলান্টিয়ারকে বলা হয় তার ক্ষমতা ব্যবহার করে দেখার চেষ্টা করতে যে অন্যঘরে তার আত্নীয়দের কী ছবি দেখানো হচ্ছে।
এখন যদি সত্যিই এমন কোনো ক্ষমতা থাকে তাদের তাহলে অবশ্যই তাদের মস্তিষ্কের প্যাটার্নে পরিবর্তন আসবে। তবে এমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি।
মেন্টালিস্ট বা কন আর্টিস্টরা যে বুঝাতে চায় যে তারা আপনার মনের কথা পড়তে পারে বা মনের কোনো চিন্তা বুঝতে পারে সেটা আসলে একটা এডুকেটেড গেস ছাড়া কিছুই নয়। তাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অনেক ভাল, এবং তারা অনেক সময় আপনার ব্যাপারে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে রাখে। আর এমনকি কথা বলার সময় আপনার মুখায়ব দেখেও তাদের উত্তর পরিবর্তন করতে থাকে। এটাকে ফ্রড না বলে আমার মনে হয় দক্ষতা বলা উচিৎ।
(৭)
জন এবেট টকশো থেকে পালিয়ে এল। সিকিউরিটি যদিও তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল, সে হাত উচিয়ে তাদের ভয় পাইয়ে দেয়। বাইরে বের হয়েই নিজের গাড়ি নিয়ে ফুল স্পীডে রাস্তায় নেমে পরে।
নিজের রিসার্চ ইউনিটে আসে সে। সবকিছু পুড়িয়ে দেয়। এরপর একটা ভিডিও রেকর্ড করে নিজের। অতঃপর লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে নিজের মাথায় ধরে এক সেকেন্ড ইতস্তত করে ট্রিগারে টান দেয় সে।
"পরিকল্পনা ছাড়া লক্ষ্য স্রেফ ইচ্ছা ব্যাতীত কিছুই না"
(৮)
কারা বিশ্বাস করে ইএসপিতে? অন্তত আমেরিকার অর্ধেক জনসংখ্যা টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করে। পৃথিবীতে এমন হাজারো মানুষের মাঝে অনেক শিক্ষিত, গণমান্য ব্যক্তি এসবে বিশ্বাস করে, কিন্তু কেন?
এটা নিয়েও গবেষণা হয়েছে। সাধারণত মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, পরিবেশ, মৃতদের হারানোর বেদনা থেকে এমন জিনিসের প্রতি বিশ্বাস জন্ম নেয়। মৃত্যুর বা মৃত্যুভয়ের সাথে ইএসপিতে বিশ্বাসের যোগসূত্র প্রবল।
(৯)
কন্সটেবল ফিদা ঘরে ঢুকেই বলল, " স্যার, আপনি দেখছি কোনো আগ্রহই প্রকাশ করছেন না প্রফেসর জন এনেটের আত্নহত্যা কেসে?"
ডিটেক্টিভ হুডিনি চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন। তিনি ভিডিওটা দেখছিলেন যেটা জন মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেই রেকর্ড করেছিল। জন সেখানে বলেছে সে অনেক দেরিতে তার অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার কথা জানতে পারে এবং এটা নিয়ে গবেষণা করা শুরু করে। তার অনেক ক্ষমতার মাঝে সাইকোকাইনেসিস সে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না তাই তার দ্বারা পায়াম গোলশামির মৃত্যু হয়। সে অনুতপ্ত এবং তার দ্বারা যাতে আর কারো ক্ষতি না হয় তাই সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।
-"আমি কেসটা সলভ করে ফেলেছি। ব্যাটা একটা ফ্রড।"
-"কী বলেন স্যার! আপনি এখানে বসে বসে সলভ করে ফেললেন আর আমরা ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছি!"
-"কোনোটাই প্রমাণ করতে পারব না। তবে সম্পুর্ন ঘটনাগুলোকে একে অপরের সাথে সাজাতে পারব। বেশ ক'বছর ধরেই জন নিজের ভবিষ্যৎ বলতে পারার ক্ষমতা আছে বলে প্রচার করতে থাকে। সে নানা ধরনের ভবিষ্যৎবাণী করেছে।অন্য ফ্রডদের সাথে জনের পার্থক্য হল যে তার কোনো অনুমান ভুল হয়নি কখনোই, তবে সেটা কখনোই বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। অভিনেতা উইকের এক্সিডেন্ট যে ট্রাক দ্বারা হয় তার চালক এক ভাড়াটে সন্ত্রাস। যদিও প্রমাণ করার উপায় নেই কিন্তু আমি ধারণা করছি জন তার ভবিষ্যৎবাণী করার পর ওই সন্ত্রাসকে টাকা দিয়ে এক্সিডেন্ট করতে বলে।
রাজনীতিবিদ খানের বিষয়টার ব্যাপারে আমি পায়াম গোলশারির সাথে একমত। পরিসংখ্যান রেকর্ড দেখেই বলে দেয়া যায়। আর কৃষকের ব্যাপারে যদি বলি আমি বলব জন নিজেই কৃষকের খামারে তার বংশানুক্রমে পাওয়া উনিশ শতকের সার্জিকাল জিনিসপত্র রেখে দিয়ে কৃষককে হালকা হিন্ট দেয় কোথায় খুজতে হবে। কৃষক পেয়ে যায় আর এভাবেই তার ভবিষ্যৎবাণী মিলে যায়।"
--"সেগুলো ঠিক আছে স্যার। তবে সেদিনের টকশোর ব্যাপারটা কীভাবে ব্যাখা করবেন?"
--"সেটারও উত্তর আছে আমার কাছে। ড্রামের ভেতর অল্প গরম পানি ছিল। আর বাইরে গায়ের সাথে লাগানো পকেটে ছিল লিকুইড নাইট্রোজেন, প্রেসারাইজড করা। পকেটে কোনো সুইচ চেপে সে প্রেসার চেম্বার খুলে দেয়। ঠান্ডা নাইট্রোজেন ড্রামের গায়ে ছড়িয়ে গেলে ভেতরের বাষ্প সংকুচিত হলে ড্রামটা মুচড়ে যায়। সেদিনের ভিডিওতে দেখোনি কেমন সাদা ধোয়াও বের হয়েছিল? উপস্থাপকের সাথে কথা বলে জেনেছি জন টকশোর আগের রাতে স্টেজে এসেছিল তবে কী কারণে সেটা বলতে পারে না। আমার ধারণা ড্রামটা তখনই সেখানে রেখে দেয়। এরপর সবকিছু স্রেফ টাইমিং আর চমৎকার অভিনয়ের ব্যাপার।"
--"আর মাথা উড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারটা?"
--"ফরেনসিক রিপোর্ট দেখেছ তুমি?"
--"না স্যার। আমি মাত্র আসলাম বাইরে থেকে।"
--"রিপোর্টে বলা হয়েছে মাথার ভেতরে কোনো বিস্ফোরকের মাধ্যমে মৃত্যু হয়েছে। আর ধারণা করতে পারো ঠিক কোন কেমিক্যাল পাওয়া গেছে মস্তিষ্কে?"
--"না।"
--"পটাশিয়াম নাইট্রেট, পটাশিয়াম ক্লোরেট, এমোনিয়াম ডাইনাইট্রামাইট।
--"মাই গড! বোম?!"
--"ঠিক। মাইক্রো এক্সপ্লোসিভ। এতটাই ছোট যে মস্তিষ্কে লাগানো সম্ভব এবং অন্তত দুইসপ্তাহ পর থেকে পয়জনিং এর লক্ষণ বোঝা যায়। টকশোতে আসার বারোদিন আগে পায়াম গোলশারির ব্রেইন টিউমার অপারেশন হয়। আর সেদিন অপারেশনে ছিলেন জন এনেট নিজেই। আমার মনে হয় পায়াম অপারেশনের জন্য এপয়েন্টমেন্ট নেয়ার দিন থেকেই জন এসব প্ল্যান তৈরি করে। পায়ামের মাথায় ছোট্ট একটা আরসি বোম ফিট করে আর টকশোর দিনে ডেটোনেট করে।"
--"ওর উদ্দেশ্য কী ছিল?"
--"জনের মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই জন মনমরা হয়ে যায়। সে প্রাণপণে তার মায়ের সাক্ষাৎ লাভ করতে চায়। তবে বিজ্ঞান এটাকে কখনোই সাপোর্ট করে না। সে নিজের পারিবারিক ইতিহাস ঘেটে লেডি জিনের ব্যাপারে জানতে পারে। সে মনে করে এসব আসলেই সম্ভব আর তাই এসবের পেছনে রিসার্চ করতে শুরু করে। বছরের পর বছর কোনো প্রত্যাশিত ফলাফল না পেয়ে মুষড়ে পরে সে। তবে সে মনে করত সমগ্র বিশ্বে সবার উচিৎ এগুলো নিয়ে গবেষণা করা তাতে কোনো না কোনো দিন অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা সম্পর্কে বিজ্ঞান জানবে। কিন্তু বিজ্ঞানের এসব বিষয়ে থোড়াই কেয়ার দেখে সে ঠিক করে সে এমন কিছু করবে যাতে বিশ্ববাসী ইএসপিতে আবার মনোযোগ দেয়। যাতে সে বিংশ শতাব্দীর মত আবার এসব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। একদিক দিয়ে সে হয়তো সফল।"
--"কী অবস্থা! সত্যিই, অস্কার উইল্ডির একটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, 'a thing is not necessarily true..'
-"Because a man dies for it." ডিকেক্টিভ হুডিনি কথাটা শেষ করলেন।
(সমাপ্ত)
বিঃদ্রঃ গল্পটা দেয়ার দুইটা উদ্দেশ্য। এক, এটা দেখানো যে এমন যদি কোনো ঘটনা ঘটেও যেটা দেখে মনে হতে পারে হয়তো অতীন্দ্রিয়র অস্তিত্ব সত্যিই আছে তাও এটা জানতে হবে যে এর পেছনে অবশ্যই কোনো কারসাজি আছে। সেটা খুজে বের করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমি দেখাতে চেয়েছি একজন মানুষ কেন শিক্ষিত হওয়ার পরেও এমন কিছুতে বিশ্বাস করতে পারে। কীভাবে তার মনের আকাঙ্খা তাকে সত্যন্ধ করে দিতে পারে। আর তার নিজ বদ্ধসংস্কারের কারণে সে কতদূর যেতে পারে।
Writer: Monif Shah Chowdhury