যে জোছনায় বন্যা আসে

Science fiction


(১)
কাকডাকা সকালে যার নিদ্রাজাগরনের অভ্যাস, সে কি কবুতরের ডাকে সাড়া দেয়? কাক শহুরে পাখি, ওঠেও শহুরে রুটিনমাফিক আটটা কীংবা নয়টায়। কিন্তু গেয়ো পায়রার দল সেই উষালগ্ন থেকে বাক-বাকুম শুরু করে, এরপর খাবার-পানি না দেয়া পর্যন্ত তাদের অন্তরাত্মা শান্তি পায় না।
বাক-বাকুম!
আমাদের খাবার দাও।
বাক-বাকুম!
আমাদের পানি দাও।
বাক-বাকুম!
আমাদের মুক্ত আকাশে ছেড়ে দাও।
বাক-বাকুম!
ওঠ শালা হোৎকা শুয়োর কোথাকার!
শান্তি পেতেন না গিলবার্টও। যদি না তাদের বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যানানির সাথে আপোস করতে শিখতেন। কমলাপুর রেলস্টেশনের বস্তিতে থাকা মানুষ যেমন মাথার ওপর দিয়ে যাওয়া ট্রেনের ঝিকঝিক আওয়াজের মধ্যেও দিব্যি আপোস করে ঘুমাতে পারে, গিলবার্টও তেমন তার শ্রবণেন্দ্রি জোড়ার ভালো অভ্যাস করিয়েছেন জাগতিক বিষয়াদি উপেক্ষা করে ঘোৎ শব্দে নাসিকাকামান দেগে হোৎকা শুয়োরের মত ঘুমাতে।
কিন্তু আজ কী কারণে ভোর ছয়টায় ঘুম ভেঙে গেল। কিছু একটা ঠিক নেই। রক্তিম চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে বিছানা থেকে নামলেন উদ্ভাবক গিলবার্ট মধু। আজ চারপাশ একটু বেশিই নীরব না?
চোখ কচলাতে কচলাতে বারান্দায় এলেন। চিরচেনা বারান্দায় নতুনত্ব খুব কমই থাকে। সেই পুরোনো লাল বালতি, সেই পুরোনো বারান্দার গ্রিল, সেই পুরোনো স্প্রে বোতল, সেই পুরোনো কবুতরের কাঠের ঘর, পুরোনো কবুতরের দল, তাদের গাদ-গোবরে মাখা পুরোনো মেঝে।
তবে এরই মাঝে বেশ কিছু ব্যাপার নতুন। গ্রিলের একটা বড় অংশ কেটে রাখা, লাল বালতির পানি সব ফেলে দেয়া, স্প্রে বোতলের তরল নেই, কাঠের ঘর দু একটা ভেঙে পড়ে রয়েছে, মেঝেতে রক্তের স্রোত আর গ্রিল বরাবর ঝুলিয়ে রাখা মুণ্ডুবিহীন কবুতরগুলো ঝুলানো!
গিলবার্টের এড্রেনালিন জনিত সমস্যা না থাকলে হয়তো সে ভয় পেত। কিন্তু তার অনুৎসাহি চেহারায় অল্প একটু চিন্তার রেখা ছাড়া আর তেমন কিছু দেখা গেল না।
ওরা জেনে গেছে!

(২)
একটা টেবিল। টেবিল ঘিরে সাতজন মানুষ দাড়ানো। সবার পরনে সাদা আলখাল্লা, চেহারা ঢাকা, হাতে কাস্তে। কাস্তে বহু কিছুরই ইঙ্গিত। কাস্তে সমাজতন্ত্রের বিদ্রোহের চিহ্ন হতে পারে, বা কৃষকের মুখের হাসি হতে পারে, কীংবা সিকেল সেল এনিমিয়ার লোহিত কণিকাও হতে পারে। তবে এই মুহুর্তে কাস্তে শুধুমাত্র চাবির ভূমিকাই পালন করছে।
প্রতিটা কাস্তের হাতলের ভেতর আছে একটা করে গোপন চিহ্ন। সাতজন মানুষের সাতটা কাস্তের হাতল একে একে একটা কাঠের বাক্সের ওপর রাখার কথা। যাতে বাক্স খুলে বের হয়ে আসে পবিত্র তেল যার আগুনে ভস্ম করা হবে কদর্য ধর্মনিন্দুক রাসায়নিক পদার্থটি।
প্রথম ব্যক্তি তার কাস্তে রাখল। খুট করে আওয়াজ হল।
দ্বিতীয় ব্যক্তি তার কাস্তে রাখল। খুট করে আওয়াজ হল।
তৃতীয় ব্যক্তি তার কাস্তে রাখল। খুট করে আওয়াজ হল।
চতুর্থ ব্যক্তি তার কাস্তে রাখল। খুট করে আওয়াজ হল।
পঞ্চম ব্যক্তি তার কাস্তে রাখল। খুট করে আওয়াজ হল।
ষষ্ঠ ব্যক্তি তার কাস্তে রাখল। খুট করে আওয়াজ হল।
সপ্তম ব্যক্তি তার কাস্তে রাখল। খুট করে আওয়াজ হল না।
সবাই ঘুরে তাকালো সপ্তম ব্যক্তির দিকে। চোখে সন্দেহ।
ষষ্ঠ ব্যক্তি একটানে সপ্তমের চেহারার আবরণ খুলে দিল। সবার সামনে সাদা আলখাল্লার মাঝে প্রকট হয়ে পড়ল নকল কাস্তধারী কৃষ্ণাঙ্গ!
তাকে ধরাশায়ী করার জন্য লাফিয়ে পড়ল ষড়শেতাঙ্গের দল। তার আগেই সপ্তম তার পকেট থেকে মাইক্রো-এক্সপ্লোসিভ ছুড়ে দিল তাদের পবিত্র কাঠের তেলপাত্রে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় সবাই ছিটকে গিয়ে পড়ল আশেপাশের দেয়ালে! ক্ষোভাতুর ষড়শ্বেত আবার হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসলে আহত সপ্তম টেবিলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে রাখা রাসায়নিক পদার্থভর্তি কাচের শিশি নিয়ে এক লাফে জানালা দিয়ে নেমে পড়ল।
তার আগেই দ্বিতীয়শ্বেত তার পবিত্র হাতবন্দুক দিয়ে গুলি চালান সপ্তমের পিঠ বরাবর। বন্দুকের কানতালা শব্দের একসেকেন্ড পর বাইরে, নিচে "ধুপ" করে আরেকটা আওয়াজ পাওয়া গেল।
হতভম্ব, হতবিহ্বল, হতাহত সংঘের সদস্যরা কিছুক্ষণ ঠায় দাড়িয়ে রইল। উদ্ভাবক ও বিজ্ঞানী গিলবার্ট মধুর তৈরি পাপী রাসায়নিক পদার্থ হাতছাড়া হয়ে গেছে তাদের!
ওরা জেনে গেছে!

(৩)
ফ্রী উইল বিষয়টা কী? কেউ বলবে বেছে নেয়ার সক্ষমতা। কী বাছব? ভাল ও মন্দের মাঝে। ভাল মন্দের মাঝে বিচার করার সক্ষমতা কাদের আছে?
মানুষের।
আচ্ছা। আর কোনো প্রাণীর নেই? ভাল মন্দ চিন্তা ম চেতনা সবই উন্নত মস্তিষ্কের বৈশিষ্ট্য। কোনোভাবে নিচু শ্রেশীর প্রাণীদের মাঝে কিছু গাঠনিক পরিবর্তন করে দিলে, বিশেষ করে ফ্রন্টাল লোব, তবে কী আমরা তাদের মাঝেও উচ্চতর চিন্তাভাবনার শুরু করাতে পারব না? তাদের এক শ্রেণী ভাল বেছে নেবে, আরেক শ্রেণী মন্দ। এভাবে কী ফ্রী উইল আর মানব জাতির জন্য বিশেষ বা ব্যাতিক্রমী কোনো বৈশিষ্ট্য থাকল?
নিজের ল্যাবে বসে ছিলেন বিষুব। তার হাতে একটা কাচের শিশি। সেটাকে এইমাত্র স্ক্যান করা হয়েছে। সেটার রাসায়নিক গঠন উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্প
ন্ন কম্পিউটারে গেলানো হয়েছে। এখন অপেক্ষার পালা।
বিগত এক দশক ধরে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন মস্তিষ্কের নানা অংশের গঠনের পরিবর্তন এবং এর ফলে আচরণগত যে পরিবর্তন আসে সেগুলো নিয়ে। একটা টিকটিকির মাঝে বা একটা কবুতরের মাঝে যদি এমন উন্নত চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়া যায় তাহলে কী তারাও নিজেদের মাঝে ফ্রী উইলের স্বাদ অনুভব করবে না? তখন কী মানুষ নিজেকে আর অনন্য দাবী করতে পারবে?
এসব নিয়ে সে রিসার্চ কম করেনি৷ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে, খরচ হয়েছে হাজারখানেক প্রাণ৷ সেটা ধামাচাপা দিতে আরো কোটি টাকা গচ্চা। ফলাফল খুব একটা উন্নতি হয়নি। তবে এবার গিলবার্টের ফর্মুলা দিয়ে কাজটা সহজ হয়ে যাবে।
গিলবার্ট যখন এই কোম্পানিতে কাজ করত তখন সেও এই রিসার্চের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে তার উদ্দেশ্য ছিল আলাদা, মহৎ। সে জানতে চাইছিল মস্তিষ্কের কোন অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবর্তন করে অপরাধীদের অপরাধপ্রবণতা শূন্য করা যায় কীনা। তবে এটার জন্য সে ফান্ডিং পেত না। সেই ফান্ডিং আছে এই কোম্পানির। তাই গিলবার্ট ভেবেছিল এই কোম্পানিতে কাজ করুক পশুপাখির মস্তিষ্ক পরিবর্তন করা নিয়ে, এবং একপর্যায়ে সেই জ্ঞান সে পরে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ার করে তার মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে।
হুট করে একদিন চাকরি ছেড়ে দেয় গিলবার্ট। তাকে যেতে দিলেও তার ওপর নজর ঠিকই রেখেছিলেন বিষুব। শেষতক যা ভেবেছেন তাই, গিলবার্ট একটা ফর্মুলা আবিষ্কার করেছে, যেটার পরীক্ষা সে তার কবুতরদের ওপর করছিল।
তাড়াহুড়ো ছিল না বিষুবের। কবুতরের ওপর করা রিসার্চের ফলাফল কতটুকু সফল তা জানার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু তার আগেই উগ্রপন্থীরা তার বাসায় সিধ কেটে ফর্মুলা চুরি করে নিয়ে যায়, এবং একই সাথে তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী পাপের ফসল কবুতরগুলোকেও মেরে রেখে মাথা গুলো নিয়ে যায়। এতকিছু যখন হচ্ছিল তখন ভোস-ভোস করে ঘুমাচ্ছিল গিলবার্ট!
তারপর কিছু কাটখোট্টা পোহাতে হয়েছে, লোক লাগিয়ে সেই উগ্রপন্থীদের থেকে ফর্মুলা আবার সংগ্রহ করতে হয়েছে। এবার বাকিটা A.I. এর ওপর। গিলবার্টের ফর্মুলা মূলত একধরনের ন্যানোবট বাফার। কোম্পানির তৈরি ন্যানোবট মস্তিষ্কের পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিতভাবে আনতে পারছিল না বলেই কাজ এগুচ্ছিল না। গিলবার্ট একটা বাফার আবিষ্কার করেছে।
কম্পিউটারের রিপোর্ট তৈরি করা শেষ। রিপোর্ট অনুযায়ী এটার মাঝে সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন এনে তা মানু্ষের ওপর ব্যবহারের উপযুক্ত করা যাবে৷ ল্যাবে প্রসেসিং এ দিয়ে বিষুব কাউকে ফোন করলেন।
--"হ্যা, জলালাদ, ১১২ সেলের সবকটা বিড়ালকে রেডি কর, কুইক।"
থ্রিডি কেমিক্যাল প্রসেসিং ইউনিটের বদৌলতে A.I. এর দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ফর্মুলা খুব তাড়াতাড়িই তৈরি হয়ে গেল। দশটা বিড়ালের জন্য বিশটা সিরিঞ্জ রেডি করে রাখা। প্রতিটি বিড়ালের জন্য দুইটি সিরিঞ্জ। একটিতে ফর্মুলা, আরেকটি ন্যানোবট হাউজ। একত্রে মিক্স করে ইঞ্জেক্ট করা হবে মস্তিষ্কে। প্রয়োজন অনুযায়ী ইলেক্ট্রিক আর ফোটিক ইমপালস দেয়ার জন্য সবগুলোর মাথার সাথে কিছু ইলেক্ট্রিক তার ও এলইডি যুক্ত করে রাখা হল।
এবার আদেশের পালা।
বিষুব কোনো রিস্ক নিতে চান না। কোনো বাড়তি আদিখ্যেতাও তার অপছন্দ। তাই তিনি সময়ক্ষেপণ না করে সাথে সাথেই আদেশ দিয়ে দিলেন।
তিনি যদি সিনেমার মত আদেশ দিতে আরেকটু গড়িমসি করতেন তাহলে বিড়ালের মাথায় ইঞ্জেকশনের এক শতাংশও ঢুকত না। কারণ আদেশ দেয়ার ত্রিশ সেকেন্ড পরেই পুরো ল্যাবে যান্ত্রিক গোলযোগ সৃষ্টি হয়। একসেকেন্ড পর ইমার্জেন্সি আলো জ্বলে ওঠে। মূল দরজা একপাশের ভেঙে পড়ে আছে। দশটি কালো অবয়ব একভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে।
আলোতে চোখ মানিয়ে যায় বিষুবের। চকচকে ধাতুর তৈরি শরীরের দিকে চোখ পড়তেই তার নিজস্ব গার্ডদের আদেশ দিলেন বিড়ালগুলোকে নিয়ে নিরাপদে সরে যেতে। কথা শেষ করার আগেই মাইক্রো-এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ভরে গেল ল্যাবরুম। ঠিক দুই সেকেন্ড পর যে বিস্ফোরণ হল তাতে পুরো ল্যাব উড়ে গেলেও ধাতব মূর্তিগুলো সেভাবেই ঠায় দাড়িয়ে ছিল। বিস্ফোরণের ধাক্কা তাদের একটা তারও বাকা করতে পারেনি। ওভাবেই দাড়িয়ে তারা তাদের সেন্সর দিয়ে আটটি বিড়ালের লাশ গুণে নিল। হিসেবে না মিলতেই পায়ের পর পা ফেলে তারা বের হয়ে গেল, শৃঙ্খলাবদ্ধ ধাতব শিকারী কুকুরের মত।
নিজের উড়ে যাওয়া পা চেপে ধরে পড়ে ছিল বিষুব। বিড়াল দুটো হয়তো বেচে গেছে। তীব্র ব্যাথার মাঝেও একটু আশা রয়ে গেল। তবে ব্যাপারটা মারাত্মকভাবে ছড়িয়েছে। তার আরো সাবধান হওয়া উচিৎ ছিল।
ওরা জেনে গেছে!

(৪)
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ওয়েব.আই. এর সামনে দুটো অপশন আছে। এক, বিধ্বংসী এই ফর্মুলা চিরদিনের জন্য ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়া। এবং বিড়াল নিয়ে যারা পালিয়ে গেছে তাদের সন্ধান করে মেরে ফেলা। অথবা, দুই, এই ফর্মুলা আবার তৈরি করা, এবং সেটা ব্যবহার করে মানুষের মাঝে অপরাধপ্রবণতা শূণ্যে আনা।
প্রথমটা করা আসলে কোনো কাজের না। কারণ মানুষ এই ফর্মুলা আবার আবিষ্কার করে ফেলবে৷ এটাই মানু্ষের বৈশিষ্ট্য। আর বিড়াল নিয়ে তারা কোথায় গেছে কিছুতেই ট্রেস করতে পারছে না ওয়েব.আই। যদিও কিছু ধারণা আছে, কিন্তু সেপথে পরে খুজলেও হবে।
তাই দ্বিতীয় অপশনটাই বেশি কার্যকরী। এতে মানুষের ধ্বংসাত্মক বৈশিষ্ট্য কমে আসবে। তবে এখানে ক্ষতিকর দিক হল একই সাথে মানু্ষের সৃজনশীলতাও কমে যাবে। ঠিক কীভাবে যেন সৃজনশীলতা ও ধ্বংসাত্মক বৈশিষ্ট্য পারস্পরিক সম্পৃক্ত। সেটা নিয়ে আরো রিসার্চ হওয়া প্রয়োজন।
সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ওয়েব.আই। পুরো বিশ্লেষণে তার সময় লাগল মাত্র সাত পিকোসেকেন্ড৷ আদেশ দিতে যাবে তখনই একটা অন্যরকম বিষয় খেয়াল হল তার। সে পুরো ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন! কেউ একজন তার এক্সেস কেড়ে নিয়েছে। মানবিক অনূভুতি থাকলে তার হয়তো ভয়ানক অসহায় লাগতো।
অফলাইনে থাকতে থাকতেই ওয়েব.আই তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে শুরু করল।
ওরা জেনে গেছে!

(৫)
বিষুবরেখা কোম্পানির প্রাইভেট স্পেস স্টেশনের বিশাল জানালাটা বা অবজারভেটরি এখন পৃথিবীর দিকে মুখ করে আছে। এখান থেকে আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু অংশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
বসে বসে তাই দেখছিল কোম্পানির সেই কর্মীরা যারা দুটো বিড়াল নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিল। রকেটে করে সোজা এই স্টেশনে চলে এসেছে। আপাতত তারা সুরক্ষিত। এখন এই বিড়ালগুলো নিয়ে কী করা যায় তাই ভাবছিল তারা। চোখ ছানাবড়া করা দৃশ্যটা তাদের তখনই অগোচর হল।
হঠাৎ করেই বায়ূমণ্ডলের বাইরে একই সাথে দৃশ্যমান হল অন্তত বিশ-বাইশটা মার্শান যুদ্ধজাহাজ। কালো স্পেসশিপ গুলো নিশ্চয়ই তাদের অত্যাধুনিক স্টেলথ প্রযুক্তি দিয়ে অদৃশ্যমান করে রেখেছিল। মার্শান মানুষদের এমন অনেক উন্নত প্রযুক্তি আছে যা পৃথিবীর মানুষের মনে ঈর্ষা জাগায়, আর তারা ভাবে, ইশ! যদি ৭৬ বছর আগে শুরু হওয়া মার্স কলোনি প্রজেক্টে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও যোগ্য লোকদের না পাঠাতাম! ইশ! যদি কিছু সাধারণ বুদ্ধিমত্তার মানুষও পাঠাতাম!
মার্শান যুদ্ধজাহাজের ফ্লিট প্রকট হওয়ার সাথে সাথেই শক্তিশালী লেজার দিয়ে আঘাত করল ধরণীমাতার বুকে। না, সেটা কোনো ধ্বংসের ইঙ্গিত দিল না, কিন্তু স্পেস স্টেশনে থাকা কোম্পানির লোকেরা ধারণা করে নিল লেজারগুলো আঘাত হেনেছে পৃথিবীর অধিকাংশ পাওয়ার হাউজ ও ডাটা সার্ভার সেন্টারে। পুরো পৃথিবীর ইন্টারনেটের জাল মূহুর্তেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
মার্শানদের সাথে বিরোধ অনেকদিনেরই। তবে সেটা বড় যুদ্ধের রূপ নিচ্ছিল না দুইটি কারণে। এক, যদিও মার্সের আছে অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, কিন্তু তাদের লোকবল কম ছিল। পৃথিবীর সাড়ে নয় বিলিয়ন মানুষের তুলনায় মঙ্গলের মাত্র দেড় কোটি মানুষ কিছুই না। এছাড়াও পৃথিবীর রিসোর্স বেশি থাকায় মার্শানদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মোকাবিলা তারা তাদের দূর্বল নিউক্লিয়ার অস্ত্র দিয়ে করতে পারত কারণ সেগুলোর সংখ্যা ছিল প্রচুর! মার্শানদের প্রতি একটা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের বিপক্ষে পৃথিবী ছুড়তে পারে পুরোনো আমলের এক হাজারটা পারমানবিক মিসাইল! সংখ্যা যুদ্ধে নেহাৎই বড় বিষয়।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ওয়েব.আই। মাবব ইতিহাসের সবচেয়ে উন্নত আবিষ্কার বলা হয় এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে। আর কে না জানে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা বাড়ে ডাটা, বৈচিত্র্য গিলিয়ে। সেটা পৃথিবীতে অহরহ। তাই এই আবিষ্কার পৃথিবীর হাতেই আছে।
তাই মার্শানরা পৃথিবী আক্রমণ করলে সবার আগে যে এই ওয়েব.আই এর পেছনেই লাগবে তা বোঝা হয়ে গেছে সবার। আর আজ তাদের চাক্ষুষ আক্রমণ দেখে সে বিষয়েও সন্দেহ রইল না।
খাচায় আটকে পড়া ইদুর যখন আশেপাশে বাঘ দেখে তখন সে মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে বাঘ যাতে তাকে না খায়৷ আদমখোর বাঘ, যে এসেছে মানুষ খেতে, তার কাছে সামান্য ইদুর মূল্যহীন। কিন্তু ইদুরের প্রার্থনা তবুও থেমে থাকে না। সেই খাচায় আটকে পড়া ইদুরের মতই স্পেস স্টেশনে থাকা কোম্পানির কর্মীরা প্রার্থনারত থাকে, আর হঠাৎ মার্শানদের এহেন আক্রমণের সম্ভাব্য কারণ বের করে আরো শিহরিত হতে থাকে।
ওরা জেনে গেছে!

(৬)
ক্যাপ্টেন মরিশা প্রাইম শিপের দায়িত্বে। তিনি ইতিমধ্যেই ক্রু পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। এই ক্রু-রা বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত। তাদের টানা ছয়মাস পৃথিবীর গ্র্যাভিটির মত কন্ট্রোলড পরিবেশে ট্রেনিং নিতে হয়। হাড়ের ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য ক্যালসিয়াম রিচ ইঞ্জেকশন নিতে হয়। VR পড়ে পৃথিবীর খোলা পরিবেশে মানিয়ে নেয়া শিখতে হয়, কারণ মঙ্গল গ্রহে এত বিশালত্বে তারা অভ্যস্ত নয়। গ্রহটা টেরাফর্ম করতে আরো দুইশ বছর লেগে যাবে৷
কিন্তু যদি পৃথিবীর ওয়েব.আই কে তারা পেয়ে যায়, আর ওই গিলবার্ট-বিষুবরেখা ফর্মুলা নিজেদের ওপর ব্যবহার করে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা আরো বাড়ানো যায়, তবে হিসেব অনুযায়ী টেরাফর্ম প্রজেক্ট মাত্র ৬৩ বছরে করা সম্ভব! এ সুযোগ হাতছাড়া নিশ্চয়ই করবে না মার্শান সামরিকতন্ত্র।
বেশি সময় অপচয় করেননি ক্যাপ্টেন৷ প্রাইম শিপের অধীনে অন্যসব যুদ্ধজাহাজ। লেজার ট্রিটমেন্ট শেষ হওয়ার সাথে সাথে নিজেদের যুদ্ধজাহাজ নিরাপদ দুরত্বে সরিয়ে নিয়েছেন৷ এখন সেগুলো চাদের উল্টা পাশে অরবিটে আছে। স্যাটেলাইট সুবিধা যেহেতু পৃথিবী এখন পাচ্ছে না তাই তাদের টার্গেট করে কোনো মিসাইল ছুড়তে পারবে না। এরই মাঝে MMSF-21 সেখানে ল্যান্ড করেছে। আশা করা যায় তারা শীঘ্রই ওয়েব.আই এর ডাটা এবং সেই ফর্মুলা নিয়ে ফিরে আসবে।
এখন পালা শুধু অপেক্ষার।
মঙ্গলের ওপারে থাকা এস্টেরয়েড বেল্টবাসী, যারা মূলত শ্রমিক সমাজ, তাদেরও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ ছিল। তাদের নিজস্ব আতঙ্কবাদী ও উগ্রপন্থী দল রয়েছে। তবে সে বিষয়টা সামলাতে আগেই সেখানে একটা ফ্লিট মোতায়েন করে এসেছে মরিশা।
আধাঘন্টা হয়ে গেলেও পৃথিবী থেকে কোনো খবর না পেয়ে কিছুটা চিন্তিত বোধ করলেন তিনি। হঠাৎই লক্ষ করলেন চাদের বুকে একের পর এক বিস্ফোরণ হচ্ছে। বিস্ফোরণ একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ফলো করছে। কই? পৃথিবী থেকে তো কোনো মিসাইল ছোড়া হয়নি? তবে?
বিশাল বিশাল বিস্ফোরণ বিষ ফোড়নের মত আঘাত হানছে মরিশাসের বুকে। ধীরে ধীরে সে চাদকে কক্ষপথ থেকে সরে আসতে দেখে। ধীরে ধীরে চাদ তার কক্ষপথের বাইরে আসতে থাকে।
কী মনে করে, চাদের গতিপথ কম্পিউটারে দিয়ে প্রেডিকশন দিতে বললেন মরিশা। রেজাল্ট দেখে তার চক্ষু ছানাবড়া!
কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখাচ্ছে, এই গতিপথ মেনে যদি চাদ যেতে থাকে, তাহলে মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে মঙ্গলের কক্ষপথ ও চাদ এক বিন্দুতে মিলিত হবে! ধ্বংস হয়ে যাবে মঙ্গল ও চাদ!
এভাবে যেই ধ্বংসস্তুপ তৈরি হবে তা নিজস্ব কক্ষপথে চলতে চলতে দেড়শ বছর পর পৃথিবীর কক্ষপথে এসে আবার মিলিত হবে। মঙ্গলেরনো চাদের মাটির সংমিশ্রণে তৈরি হবে নতুন চাদ! এতে পৃথিবীর ক্ষতির মধ্যে হবে যে পৃথিবীর কক্ষপথ অল্প একটু কমে আসবে তাই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
ব্যাস!
দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করলেন মরিশা। পৃথিবীবাসী এটা পারল? মাত্র অর্ধশতকের শত্রুতা বশত পুরো একটা গ্রহকে ধ্বংস করার মত সিদ্ধান্ত নিতে পারল? কতদিন ধরে চাদের বুকে বিস্ফোরক জমা করে যাচ্ছিল পৃথিবী? ঘামের সাথে মরিশার চোখ দিয়ে পানি বের হওয়া শুরু করে। চাদের এই কক্ষপথের পরিবর্তন মার্শানদের কীভাবে জানাবে সে? কোন মুখে?
এসব ভাবতে ভাবতেই স্ক্রিনে ইনকামিং কল আসল। মঙ্গল থেকে ফোন এসেছে। হা করে তাকিয়ে রইল মরিশা।
ওরা জেনে গেছে!

(৭)
গত আড়াই মাস যাবৎ মঙ্গল থেকে মানুষদের দূরে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। তাদের নিকটস্থ এস্টেরয়েড বেল্টে থাকা ছোট বড় নানা সাইজের গ্রহাণুতে তাদের স্থানান্তর করা হয়েছে। শ্রমিকসমাজের সাথে মালিকসমাজ একত্রে বসবাসে বাধ্য হয়েছে। দেড় কোটি মানুষের মাঝে স্থানান্তরের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে মাত্র সাড়ে সাত লাখ মানুষকে৷ যার মাঝে বেশিরভাগ মা-বাবা, বৃদ্ধ স্বেচ্ছায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আজ, ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট। ইতিহাসের পাতায় এই দিন মঙ্গলের মর্মান্তিক পরিনতির সাক্ষী হয়ে থাকবে৷ পৃথিবীর চিরচেনা নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে থাকবে। মঙ্গলবাসীর অর্ধযুগ ধরে পুষে আসা টেরাফর্মের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হওয়ার সাক্ষী হয়ে থাকবে।
মঙ্গলের সবচেয়ে উচু টাওয়ারে শ'খানেক মানুষ জমায়েত হয়েছে। মঙ্গলের দুটো চাদের পাশে তৃতীয়টা বিশাল লাগছে। বৃদ্ধ দম্পতিরা একে অপরের হাত ধরে দাড়িয়ে আছে৷ চাদটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, তারা অধীর আগ্রহে তার অপেক্ষা করছে। জোছনায় প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে মঙ্গলের বুক। সেই জোছনা যে একটু পর তাদেরও গ্রাস করে ফেলবে সেটা মঙ্গলবাসীরা জানে। কীংবা বলা উচিৎ,-
ওরা জেনে গেছে।
(সমাপ্ত)

যে জোছনায় বন্যা আসে
লিখাঃ মনিফ শাহ চৌধুরী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম