ইনসেস্ট সম্পর্কঃ বিজ্ঞান কি বলে?

 

(সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ - এই পোস্টে যৌনতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বয়সের দিক দিয়ে এবং মানসিকতার দিক দিয়ে আপনি যদি যথেষ্ট ম্যাচিওরড না হন,তা হলে এই আর্টিকেল এ্যাভয়েড করুন, প্লিজ)

রাজশ্রী সেলভাকুমার নামক কোনো এক মেয়ের একটি টুইটের স্ক্রিনশট গত কয়েকদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ার আনাচে কানাচে ঘুরছে। টুইটে বলা হয়েছিল, "বিধবা হওয়ার অনেকদিন পর, ২০১৬ সালে আমার আপন ছেলে আমাকে বিয়ে করেছিল। আমরা এখন সুখে শান্তিতে বসবাস করছি। আমাদের একটি ৩ বছর বয়সী সন্তান ও রয়েছে।"

টুইটের সাথে দুইটা ছবিও যুক্ত করা ছিল। ছবিতে লাল শাড়ি এবং সাদা পাঞ্জাবি পরে দুইটা ছেলেমেয়েকে দেখা যায়। ছবি দেখে তাদের বয়স অনুমান করার উপায় নেই। কিংবা তাদের চেহারায় তেমন মিল ও দেখা যাচ্ছেনা।

টুইটারে এই নাম সার্চ করে কোনো একাউন্ট খুজে পাওয়া যায়নি। সম্ভবত, যে এই একাউন্ট টা চালাচ্ছিল, সে এখন একাউন্ট টা ডিলিট করে দিয়েছে।

তবে ছবি দুইটির সত্যতা পাওয়া যায়। মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী Prithylasmi Selvarajah এবং Rsela Rajandra সুখী দম্পতির ছবি এটা। তারা বহুদিন ধরেই বিবাহিত। তারা কোনো মা-ছেলে নয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজশ্রী সেলভাকুমার এর একাউন্ট থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ছবিটা দেখতে পান মূল পৃথ্বিলক্ষী সেলভারাজা এবং রাসেলা রাজেন্দ্র। তারা এর তীব্র নিন্দা জানান। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। একাধিক নিউজ পোর্টালের কমেন্ট সেকশনেও তাদেরকে কমেন্ট করে এই ছবির প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়।

সেলভারাজা এবং রাজেন্দ্র'র দাবির সত্যতা পেয়ে একে একে অন্যান্য নিউজ মিডিয়াও ফ্যাক্ট চেকিং রিপোর্ট প্রকাশ করে। তারা জানিয়েছে, রাজশ্রী সেলভাকুমার নামে কারো অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। এটা ফেক একাউন্ট, ২০২০ এর জুলাইতে একাউন্টের জন্ম । হুদাই কিছু লাইক কমেন্ট পাওয়ার জন্য এই ছবি পোস্ট করেছিল। মাঝখান দিয়ে সামাজিকভাবে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে মালয়েশিয়ার সেলভারাজা আর রাজেন্দ্র দম্পতির।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্ট পড়ুন এই লিংকে --

https://ttvindia.com/fact-check-heres-truth-behind-viral-story-of-incestuous-marriage-between-son-and-his-mother/

https://gossip.dekhnews.com/rajashree-selvak

umar-wiki-marriage-age-story-instagram/

২.

এই ফেক নিউজটা নিয়ে গত কয়েকদিন বিভিন্ন জনে বিভন্ন ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয়, আইনগত, মানসিক, মানবিক ইত্যাদি দিক থেকে এই ধরনের সম্পর্ক কে কিভাবে দেখা হয়, সেটা নিয়ে কমবেশি আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে।

আসুন,জানার চেষ্টা করি।,এই ধরনের সম্পর্কের ব্যাপারে বিজ্ঞান আমাদের কি জানাচ্ছে।

ওয়েল, বিজ্ঞান খুব কঠোরভাবে নিষেধ করছে ফ্যামিলি ম্বরদের মধ্যে বিয়ে কিংবা যৌন সম্পর্ককে। কারন,বিজ্ঞান বলছে, রক্তের সম্পর্কের ( অর্থাত ভাই-বোন, বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে ইত্যাদি) কারো সাথে যৌন সম্পর্ক হলে পরবর্তী প্রজন্মের বাচ্চাদের মধ্যে অনেক জেনেটিক অসুখ-বিসুখ দেখা যায়। এই বাচ্চারা শারীরিকভাবে খুব দুর্বল হয় । অনেকে জন্মগতভাবেই প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মায়। অনেকে জন্মের পর বিভিন্ন রোগে ভুগতে থাকে কারন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ার কারনে সহজেই অসুখ বিসুখ আক্রমন করে । সব মিলিয়ে এই বাচ্চারা বেশিদিন বাচে না।

বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক সিনেমায় বা সাহিত্যে এই ধরনের ক্লোজ ফ্যামিলি মেম্বরদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক দেখা যায় অনেক।একে পরিভাষায় Incest বা অজাচার বলা হয়।

তবে সিনেমা-সাহিত্যে দেখা গেলেও, বাস্তবে এমন সম্পর্ক খুবই কম।

যারা যারা এই ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন,তাদের বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, তারা খুবই অসূস্থ।

যেমন ধরুন - জার্মানির প্যাট্রিক স্টুবিং এবং সুসান ক্যারোলস্কি এর কথা। এরা একটা ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান। জন্মের পর এদের বাবা - মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বায়োলজিকালি এরা আপন ভাই বোন হলেও, সুসান আর প্যাট্রিক আলাদা আলাদা জায়গায় আলাদা ভাবে বড় হতে থাকে। এদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল না।

২৩ বছর পরে,২০০১ সালে, দীর্ঘদিন পরে এদের মধ্যে পুনরায় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরা একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। শারীরিক সম্পর্ক ও হয় একসময়। একে একে এদের সংসারে আসে ৪ টি সন্তান।

তবে, মেডিকেল সায়েন্সের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে এখানে। ৪ টা বাচ্চার মধ্যে ৩ টা বাচ্চাই গুরুতরভাবে অসূস্থ।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Patrick_St%C3%BCbing

প্রাচীন মিশরে দেখা যায়, ফারাও রাজবংশের মধ্যে ভাই-বোনের বিয়ে প্রচলিত ছিল। রাজা আখেনাতেন (ওরফে আমেনহোতেপ) এবং তার এক রাণী ( নাম জানা যায়নি) ছিলেন আপন ভাই বোন। এদের ইনসেস্ট সন্তান ছিল তুতেনখামুন। এই তুতেনখামুন সিংহাসনে বসে মাত্র ৮ বছর বয়সে। এবং মারা যায় মাত্র ১৭ বছর বয়সে। একগাদা অসুখ বিসুখ ছিল তার। gynecomastia,Marfan syndrome, Fröhlich syndrome , Klinefelter syndrome ইত্যাদির নাম পাওয়া যায় উইকিপিডিয়া তে। সেই সময়ের ডাক্তাররা রোগের কারন না জানার কারনে তুতেনখামেনের মৃত্যু এবং তার মমি নিয়ে অনেক গুজব তৈরি হয়েছিল। তবে এখন, চিকিতসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির এই ধাপে এসে আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, ভাই-বোনের ইনসেস্ট সন্তান হওয়ার কারনেই তার এত জেনেটিক রোগ হয়েছিল।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Tutankhamun

৩.

কাজিনদের মধ্যে বিয়ে বা শারীরিক সম্পর্কের ফলে সন্তান জন্ম নিলে, সেই বাচ্চাদের মধ্যেও অনেক সমস্যা দেখা যায়। তবে ফার্স্ট ডিগ্রি ইন্সেস্ট ( আপনা ভাই বোন, মা-ছেলে, বাবা-মেয়ে) সন্তানদের যত সমস্যা হয়, সেকেন্ড ডিগ্রি ইন্সেস্ট ( চাচাতা-মামাতো-খালাতো-ফুফাত ভাই বোন,কিংবা মামা-চাচা-কাকা-খালা-ফুফুর সাথে ছেলে-মেয়ে) বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সমস্যা একটু কম হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রফেসর, ডাক্তার প্রনব কুমার চৌধুরী প্রথম আলোর এই আর্টিকেলে জানাচ্ছেন, কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হলে বাচ্চাদের মধ্যে এই রোগ গুলা খুব বেশি হয় --

১.গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব

২. শারীরিক ত্রুটিসংবলিত শিশুর জন্ম স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি হয়

৩. প্রথম বছর বয়সে শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু

৪. হঠাৎ অজানা কারণে শিশুমৃত্যু

৫. যথাযথভাবে শিশু বৃদ্ধি না হওয়া

৬. শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা

৭. মৃগী রোগ

৮. অজানা রোগ

৯. নানা রকমের রক্তরোগ যেমন সিকেল সেল ডিজিজ ও বিটা থ্যালাসেমিয়া


ডাক্তার ছাড়াও অন্যান্য পেশাজীবিরাও এই ধরনের বিয়েকে নিরুৎসাহিত করেন। যেমন - জনপ্রিয় ম্যারেজ মিডিয়া, বিয়েটা ডট কম তাদের ওয়েবসাইটের এই আর্টিকেলে জানাচ্ছে -" কাজিনদের জীনগত মিল প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ, অর্থাৎ তারা বংশপরম্পরায় অনেক জীন একইভাবে বহন করে চলেছেন। এ কারণে যে সব রোগবালাই তাদের বংশে রয়েছে, সে সব তাদের সন্তানদের মধ্যে আরও প্রকটভাবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে অটোসোমাল রিসেসিভ কিছু রোগ (যেমন, থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস) পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তীব্রতর হয়ে দেখা দিতে পারে। নিজ বংশ এবং নিজ গোত্রে বিবাহরীতির কারণে থ্যালাসেমিয়া ও জিনগত রক্তরোগ মধ্যপ্রাচ্যে একসময় এত প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে, আরব সরকার বিয়ের আগে বর-কনের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে দেয়।"

যারা এখনো বিয়ে করেননি বা কোনো সম্পর্কে জড়াননি, তারা এই ধরনের সম্পর্ক থেকে একশো হাত দূরে থাকুন। আর যারা যারা এই ধরনের সম্পর্কে অলরেডি কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, তাদের উচিত হবে, ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে তারপর সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

৪.

মানুষ ছাড়াও, অন্যান্য পশুদের ক্ষেত্রেও এই ধরনের ইনসেস্ট সম্পর্কের খারাপ প্রভাব দেখা যায়।

অনেক চিড়িয়াখানা রয়েছে, যেখানে খুব বেশি পশু নাই। মনে করেন, বাঘ আছে মাত্র দুইটা, তারা আপন ভাই বোন। অন্য কোনো বাঘ না পেয়ে, চিড়িয়াখানার কিউরেটর রা এই আপন ভাই বোনের মধ্যেই এক সময় মিলন ঘটিয়ে দেন। কিন্তু এর ফলে নতুন যে বাচ্চা কাচ্চাগুলো জন্মায়, তারা খুবই দুর্বল হয় এবং বাচে না বেশিদিন। অনেকে আবার জন্মের সুযোগ ও পায় না। প্রি ম্যাচিউরড অবিস্থাতেই মিস ক্যারেজ হয়।

Nayeem Hossain Faruque ভাই তার বিজ্ঞানে অজ্ঞান বইতে খুব ইন্টারেস্টিং আরেকটা উদাহরন দিয়েছেন। সাভারের প্রাণিসম্পদ গবেষনা ইনস্টিটিউট এ উন্নতজাতের বেশ কিছু গরু আছে। এই গরুগুলো থেকে বীর্য (sperm) সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গাভীদের কাছে পাঠানো হয়। ওই স্পার্মের সাহায্যে তারা গর্ভবতী হলে, সেই নতুন বাচ্চাটা হবে হাইব্রিড জাতের গরু।

এই স্পার্ম পাঠানোর সময় খুব সতর্কতার সাথে সব তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। কোথায় কোন গ্রামে যাচ্ছে, গরুর মালিকের নাম, খামারের ঠিকানা,গরুর বয়স ইত্যাদি সব কিছু লিখে রাখে। গরুর যদি নাম আর জাতীয় পরিচয় পত্র নাম্বার থাকত,তাহলে সেই গুলাও লিখে রাখত

এত সাবধানতার কারন হচ্ছে, ওরা নিশ্চিত করতে চায়, একই পুরুষ ষাড়ের স্পার্ম দিয়ে যেন কোনোভাবেই কোনো মা গাভী এবং মেয়ে গাভী গর্ভবতী না হয়। এমন ঘটনা ঘটলে, মেয়ে গাভীটার ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যাবে ইনসেস্ট মিলন। ফলে ওই বাচ্চাটা হবে দুর্বল। বা গর্ভপাত হয়ে যাবে, বাচ্চাটা নষ্ট হবে।

এমন যেন না ঘটে সে কারনেই এত ডাটা সংরক্ষন করা হয়।

মানুষ হোক, কিংবা অন্যান্য প্রাণী হোক, সব ক্ষেত্রেই নিকটাত্মীয়ের সাথে মিলন পরিহার করা উচিত। যত দূর-সম্পর্কের লোকের সাথে নতুন আত্মীয়তা করা যাবে, ততই ভাল। নতুন জন্ম নেওয়া বাচ্চারা তত বেশি বিচিত্র ভ্যারাইটির জিন নিয়ে জন্মাবে। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তত বেশি হবে।


Writer: Jahirul Islam

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম