এতক্ষণ ধরে জান হাতে করে দৌড়ুনোর পরও অ্যালিস দেখল- তারা যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই আছে, এক চুলও নড়েনি। এরকমটা তো হওয়ার কথা নয়। তার দেশে অনেকক্ষণ ধরে দৌড়ুলে আশেপাশের স্থান পরিবর্তিত হয়ে যায়, মানুষ নতুন জায়গায় পৌঁছে।
রাণী শুনে খানিকটা বিরক্ত হলেন- তোমাদের দেশ তাহলে একদমই ঢিমে তেতালা। আমাদের রকমসকম ভিন্ন। এখানে মোটামুটি বেগে দৌড়ুলে জায়গা পরিবর্তন হবে না, বরং তুমি যেখানে আছ সেখানেই থাকবে। পিছিয়ে না পড়ার জন্যই এখানে দৌড়ুতে হয়। এর পর যদি আবার চাও জায়গা পরিবর্তন করতে, তাহলে কমপক্ষে আরও দ্বিগুণ বেগে দৌড়ুতে হবে। [Lewis Carroll, Through the Looking Glass]
বিবর্তনশাস্ত্রের Red Queen Hypothesis-এর নামকরণের কারণ হচ্ছে এই। প্রকৃতিতে জীব ও পরজীবিকে যদি একই সাথে টিকে থাকতে হয়, তাহলে তাদেরকে শুধু দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না, ক্রমাগত দৌঁড়ুতে হবে- অর্থাৎ বিবর্তন চালিয়ে যেতে হবে।
ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসের সমান্তরাল বিবর্তন এর সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ। প্রকৃতিতে ব্যাকটেরিয়ার পরজীবী হচ্ছে ভাইরাস- কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যাকটেরিয়ার পেছনে না হলেও দশটা করে ভাইরাস লেগে থাকে। এদের আক্রমণ থেকে যদি ব্যাকটেরিয়ার নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে তাকে বিবর্তন করে কোন একটা অ্যান্টিভাইরাস বানাতে হবে। আবার সেই অ্যান্টিভাইরাসের আক্রমণ থেকে যদি ভাইরাসকে বাঁচতে হয়, তাকে পালটা অ্যান্টি-অ্যান্টিভাইরাস বানাতে হবে। এই পাল্টাপাল্টি arms race চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে। এক মুহূর্তের জন্যেও বিবর্তন থামিয়ে রাখার সুযোগ নেই।
এই যুদ্ধের গল্পটা দেখুন-
Attack: ল্যাবরেটরির সবচেয়ে পরিচিত ব্যাকটেরিয়া E. coli কে আক্রমণ করে ভাইরাস পরজীবী T4 phage।
Counter-attack: E. coli এই ভাইরাস পরজীবীর হাত থেকে বাঁচতে একটা বিশেষ ধরণের ডিফেন্স মেকানিজম ব্যবহার করে। যখনই ভাইরাসটা ব্যাকটেরিয়ার কোষের মধ্যে তার ডিএনএ প্রবেশ করা শুরু করে, সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়া একটা ডিএনএ-কাটিং ছুরি ব্যবহার করে ভাইরাসের ডিএনএ ফট করে কেটে দেয়। ডিএনএ শেষ তো আক্রমণ শেষ।
ব্যাপারটা আসলে এর চেয়ে আরেকটু কমপ্লেক্স, কারণ ডিএনএ শুধু ভাইরাসেরই থাকে না, ব্যাকটেরিয়ার নিজেরও থাকে। কাজেই সেই ডিএনএ-কাটিং ছুরি ভাইরাসের ডিএনএ তো কাটেই, সেই সাথে ব্যাকটেরিয়ার নিজের ডিএনএও ফালা ফালা করে দেয়। বেশ মুশকিল। এই ঝামেলা এড়ানোর জন্য ব্যাকটেরিয়া যে বুদ্ধিটা করে তা হল নিজের ডিএনএকে সে একটা রাসায়নিক প্রলেপে মুড়ে রাখে (মিথাইল গ্রুপ দিয়ে)। ছুরি প্রলেপ ভেদ করে কাটতে পারে না, কাজেই ব্যাকটেরিয়ার নিজের ডিএনএ থাকে সুরক্ষিত, কিন্তু ভাইরাস পড়ে বেকায়দায়।
Counter-counter-attack: ভাইরাস আবার এই ছুরির হাত থেকে বাঁচার জন্য যেটা করে- সে তার নিজের ডিএনএকে একটা বিশেষ উপায়ে পরিবর্তন করে ফেলে। আমরা মোটামুটি সবাই জানি ডিএনএর বর্ণমালায় অক্ষর চারটি- A, T, G এবং C। কিন্তু ভাইরাস ব্যাটা ছুরির হাত থেকে বাঁচার জন্য ডিএনএ থেকে C বাদ দিয়ে তার জায়গায় অন্য অক্ষর নিয়ে আসে। এই প্ল্যান একদম নিখুঁত- কারণ ডিএনএ-কাটার ছুরি শুধু ডিএনএর চার অক্ষরই চেনে, এই বিজাতীয় বর্ণমালা সে চেনে না। কাজেই ভাইরাসের ডিএনএকে চিনতেই পারে না, কাটা দূরে থাক।
Counter-counter-counter-attack: ভাইরাসের রক্ষে নেই, কারণ ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের এই স্ট্র্যাটেজি জানতে পেরে নিজেও একটা অন্যরকম ছুরি ব্যবহার করা শুরু করে, যাতে ঐ বিজাতীয় বর্ণমালার ডিএনএকে কাটা যায়।
Counter-counter-counter-counter-attack: ভাইরাস এবার এই ঝামেলা থেকে বাঁচতে ব্যাকটেরিয়ার মত নিজের ডিএনএতেও একটা রাসায়নিক প্রলেপ মাখিয়ে নেয়।
Counter-counter-counter-counter-counter-attack: ব্যাকটেরিয়া আরেকটা নতুন ধরণের ছুরি ব্যবহার করা শুরু করে, যেটা এই প্রলেপ ভেদ করেও ডিএনএ কাটতে পারে।
Counter-counter-counter-counter-counter-counter-attack: ভাইরাস এবার একটা প্রোটিন বানানো শুরু করে, যেটা ব্যাকটেরিয়ার এই তিন নম্বর ছুরির সাথে আটকে ছুরিকে অচল করে দেয়।
যুদ্ধের এখানেই শেষ নয়, কারণ কিছু ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ভাইরাসের এই নতুন প্রোটিনকে অচল করার কায়দাও খুঁজে পাওয়া গেছে, যদিও সেটা কীভাবে কাজ করে কী বৃত্তান্ত তা আমরা এখনো জানি না।
Red queen hypothesis বলছে এই যুদ্ধের শেষ হবেও না।
-------------------------------------------
বায়োলজিস্টদের জন্য ব্যাপারটা বাংলায় বলি- E. coli তার রেস্ট্রিকশান এন্ডোনিউক্লিয়েজ দিয়ে T4 এর ডিএনএকে কাটতে যায়, একই সাথে নিজের ডিএনএকে মিথাইলেট করে রাখে। ভাইরাস কাউন্টার হিসেবে সাইটোসিনকে হাইড্রোক্সিমিথা
ইলসাইটোসিন বানিয়ে ফেলে। E. coli এবার McrBC বলে একটা অন্য ধরণের রেস্ট্রিকশান এন্ডোনিউক্লিয়েজ ব্যবহার করে। প্রত্যুত্তরে ভাইরাস তার নিজের জিনোম গ্লুকোজাইলেট করে ফেলে। E. coli এর কিছু স্ট্রেইনের আবার GmrS-GmrD সিস্টেম থাকে, যেটা গ্লুকোজাইলেটেড ডিএনএকেও রেস্ট্রিক্ট করতে পারে। ভাইরাসের IPI প্রোটিনের ম্যাচিউর ফর্ম GmrS-GmrD সিস্টেমকে অচল করে দেয়। কিছু E. coli স্ট্রেইনের মধ্যে IPI এর অ্যাটাক থেকে বাঁচার এভিডেন্স পাওয়া গেছে, যদিও মেকানিজম এখনো অজানা।
Writer: Hassan uz Zaman Shamol