(ঘুম গবেষণার ইতিকথা)
মানষের জীবনে যে কয়টি নিয়মিত ঘটনা ঘটে তার মধ্যে ঘুম একটি। কেউ ৫ ঘন্টা ঘুমায় কেউ ১০ ঘন্টা; কেউ দিনে কেউ রাতে। কেউ না ঘুমিয়ে থাকতে পারবে না। হোক তা ১দিন বা ২ দিন, তাকে ঘুমাতে হবেই। একজন সাধারণ মানুষ তার জীবনের ৩৬% সময় কাটিয়ে দেয় শুধু ঘুমের জন্য। অর্থাৎ যদি কোনো ব্যাক্তি ৬০ বছর জীবিত থাকে তবে সে প্রায় সাড়ে একুশ বছর কাটিয়ে দিবে ঘুমের জন্য। এখন কথা হলো ঘুম কী? এটা খায় নাকি মাথায় দেয়? আর কেন আমাদের দৈনিক ঘুমাতে হয়?
ঘুম কোনো খাওয়ার জিনিস না। এটা একটা জৈবিক চাহিদা। আমরা জাগ্রত অবস্থায় অনেক শক্তি খরচ করি। এর মধ্যে ২০% শক্তিই আমাদের মস্তিষ্ক খরচ করে। তাই একটা সময় আসে যখন আমাদের শরীর কম শক্তি খরচ করতে চায়। ফলে আমরা ঘুমাই। ঘুমকে সহজ বিষয় মনে হলেও এটা মোটেও তেমন সহজ নয়। চলুন আপনাদের আগে ইতিহাস থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ সালের দিকে গ্রীক চিকিৎসক আল্কমেয়ন বলেছিলেন যে,আমাদের শরীরে অধিক রক্ত ব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কে রক্তের অভাব হয়। ফলে আমাদের শরীরর এক ধরনের অসাড়তার সৃষ্টি হয়। যার ফলে আমাদের ঘুম আসে। ঘুম নিয়ে মানুষ শত শত বছর গবেষণা করলেও ঘুমের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত করা হয় ২০ শতাব্দীর দিকে। ১৯১৩ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি পিয়েরন “Le probleme physiologique du sommeil” নামক একটি বই রচনা করেন। যা ঘুমের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। তার এই কাজ কে অনেকে আধুনিক ঘুমের গবেষণার শুরু হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ড. নাথানিয়েল ক্লেইটম্যান যিনি আমারিকান ঘুম গবেষণার জনক হিসেবে পরিচিত ১৯২০ সালে শিকাগোতে ঘুম ও জাগ্রত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এবং স্লিপ-ওয়েক সাইকেল অথবা সারকেডিয়ান রিদম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে ঘুমের প্রভাব এবং ঘুম বঞ্চনার বিষয় তার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে একটা। ১৯৩১ সালে হ্যান্স বার্গার নামের একজন জার্মান মনোবিজ্ঞানী প্রথমবারের মতো মানুষের মাথায় ইলেকট্রোড লাগিয়ে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলো মাপার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখলেন যে জাগ্রত অবস্থায় মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোর কম্পন খুবই দ্রুত হয়। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় কম্পন কম হয় এবং সিগনালগুলো বড় হয়। ১৯৩৫ সালে হার্ভাড ইউনিভারসিটির গবেষকরা ঘুম নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করলেন। তারা দেখলেন যে ঘুমের বিভিন্ন স্তর আছে এবং স্তরগুলোতে মানুষের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোর পার্থক্যও রয়েছে। তবে তারা ঘুমের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি উদ্ঘাটন করতে পারেন নি। ১৯৫৩ সালে সেটা সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন ক্লেইটম্যান এবং ইউনিভারসিটি অফ শিকগোর "ঘুম লেবরেটরি"র ইউজিন আজেরিনস্কি নামের এক গবেষক যিনি ক্লেইটম্যানেরই ছাত্র ছিলেন। তারা আবিষ্কার করলেন যে, গভীর ঘুমের পর আবার ঘুমের প্রথম স্তর চালু হয়। তারা আরো লক্ষ্য করেন যে ঘুমের একটা নির্দিষ্ট স্তরে চোখ খুবই দ্রুত নড়তে শুরু করে। আর এই স্তরকে বলে দ্রুত চোখ সঞ্চালন বা REM(Rapid eye movement)। ক্লেইটম্যানের অন্য এক ছাত্র ড. ওয়িলিয়াম সি. ডিমেন্ট তার গবেষণার এই পথকে আরো প্রশস্ত করেন। তিনি ১৯৫৫ সালে রাত্রিবেলা ঘুমের চক্রীয় অবস্থার ব্যাখ্যা করেন এবং ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে তিনি ঘুমের দেখান যে REM ঘুম ও স্বপ্ন দেখা পরস্পর সম্পর্কিত। ১৯৫৮ সালে ডিমেন্ট বেড়ালদের মধ্যে ঘুমের চক্রীয় আবর্তন নিয়ে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। তার এই সন্ধান (মানুষ ছারাও অন্যান্য প্রাণিতে ঘুমের চক্র) মৌলিক গবেষণার একটি বিস্ফারণ সৃষ্টি করেছিল। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত এই ঘুম নিয়ে গবেষণা চলছে।
(ঘুমের প্রক্রিয়া)
ঘুমের প্রক্রিয়াকে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা হয়। যথাঃ-
১. REM(Rapid Eye Movement) এই ধাপে চোখ খুব দ্রুত নড়তে থাকে। এটি প্যারাডক্সিকেল ঘুম হসেবেও পরিচিত। এই ধাপে আমরা স্বপ্ন দেখি।
২. NREM(Non-Rapid Eye Movement)এই পর্যায়ে আমাদের চোখ খুবই কম নাড়াচাড়া করে অথবা একেবারে স্থির থাকে। স্বপ্ন দেখার চান্স খুবই কম।
আবার NREM ঘুমকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়। যথাঃ-
i) Stage 1(N1) এইটা ঘুমের প্রথম ধাপ।
ii) Stage 2(N2) এটা ঘুমের দ্বিতীয় ধাপ।
iii) Stage 3 and 4(N3) এটা ঘুমের তৃতীয় ধাপ বা গভীর ঘুম। এটা SWS(Slow-Wave sleep) হিসেবেও পরিচিত।
এখন আসুন ঘুমের প্রতিটা স্তরের সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেই।
জাগরণঃ-
আমরা সাধারণত দিনের ৬০ শতাংশ সময় জাগ্রত অবস্থায় থাকি। এই সময়ে যদি কারো মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলো মাপার চেষ্টা করি অথবা ইলেক্ট্রোএনসেফ্
যালোগ্রাম(EEG) রিপোর্ট দেখি তবে সাধারণত আমরা দেখব তার মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোর কম্পন সেকেন্ডে ১২ থেকে ৩৮টা। এই কম্পাঙ্কের তরঙ্গকে বেটা তরঙ্গ বলে। একটা জিনিস আপনাদের ক্লিয়ার করে রাখি, জাগ্রত অবস্থার তুলনায় ঘুমে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোর কম্পন হয় কম।
Non-Rapid Eye Movement(NREM)
Stage 1(N1)
এটা ঘুমের অপেক্ষাকৃত হালকা ধাপ। এই ধাপ থেকে খুব সহজেই একজন মানুষকে জাগিয়ে তোলা যায়। এই ধাপে আমাদের শরীরের তাপমাত্রা এবং সামগ্রিক পেশিটান হ্রাস পায়। আমাদের শরীরের মাংসপেশিগুলো শিথিল হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদস্পন্দন দুটুই কম হয়। এই ধাপে একজন মানুষ তার আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে মোটামুটি সচেতন থাকে। তাকে যদি জাগিয়ে তোলা হয় তবে সে চট করেই উঠে যাবে। এই ধাপের প্রথম দিকে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোর কম্পন থাকে সেকেন্ডে ৮ থেকে ১৩টা। এই কম্পাঙ্কের তরঙ্গ কে আলফা তরঙ্গ বলে। এই স্তরে কয়েক মিনিট থাকার পর মানুষ ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে শুরু করে এবং মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোর কম্পন আরও কমে সেকেন্ডে ৪ থেকে ৮টায় নেমে আসে। এই কম্পাঙ্কের তরঙ্গকে থিটা তরঙ্গ বলে। একজন মানুষ এই স্তরে সাধারণত ৫ থেকে ১০ মিনিট থাকে। একজন মানুষ তার সম্পূর্ণ ঘুমের ৫ শতাংশ সময় এই স্তরে ব্যয় করে। তবে এই স্তরের সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি হল "Hypnic jerks"। এটা এমন এক ধরনের অনুভূতি যে আপনি ভাববেন, আপনি ছাদ থেকে বা অনেক উপর থেকে পরে গেছেন। এই টপিকটা আগামী পর্বের জন্য রেখে দিচ্ছি।
Stage 2(N2)
আমরা যখন এই ধাপে যাই আমাদের শরীর আরও শিথিল হয়। এটাকে সত্যিকারের ঘুমের শুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। থিটা তরঙ্গগুলো এখনও মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপে প্রাধান্য দেয়। অর্থাৎ এই ধাপে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোর কম্পন থাকে সেকেন্ডে ৪ থেকে ৮টা। যদি এখানেও থিটা তরঙ্গের প্রাধান্য থাকে তবে আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, স্তর দুইটা ভিন্ন কেন? আসলে এই স্তরের ভিন্নতার কারণ হলো স্লিপ স্পিন্ডল দ্বারা এই থিটা তরঙ্গের বাধাগ্রস্ত হওয়া ও K-complex তরঙ্গ। এখন, এগুলো আবার কি?
স্লিপ স্পিন্ডল হলো উচ্চতর কম্পাঙ্কের একধরনের তরঙ্গ যা শেখা ও স্মৃতির সাথে জড়িত। আর K-complex হলো খুব উচ্চ বিস্তারবিশিষ্ট তরঙ্গ বা প্যাটার্ন যা কিছুক্ষেত্রে পরিবেশগত উত্তেজনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিতে পারে। এই স্তরে একজন মানুষ ১০ থেকে ২৫ মিনিট থাকতে পারে।
Stage 3 and 4(N3)
২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরকে ভিন্ন ভাবা হত। এই স্তরদুটু একত্রে N3। NREM ঘুমের এই ধাপটি স্লো ওয়েভ বা ডেলটা বা গভীর ঘুম হিসেবে পরিচিত। ডেলটা তরঙ্গ হলো খুবই কম কম্পাঙ্কের তরঙ্গ যার কম্পন সেকেন্ডে ০.৫ থেকে ৩টা পর্যন্ত। এটা হচ্ছে এমন এক গভীর ঘুমের ধাপ যে ধাপটি একজন মানুষের অনেক প্রয়োজন। এই ডেলটা তরঙ্গগুলো আমাদের বাহ্যিক সচেতনতা স্থগিত করে এবং আমাদের সহানুভূতির উৎস। এই ধাপে আমাদের দেহের অনেক নিরাময় সাধিত হয় বলে গভীর ঘুম এত প্রয়োজনীয়। এই ধাপে একজন মানুষ দ্বিতীয় অর্ধেকের তুলনায় প্রথম অর্ধেক ঘুমে বেশি সময় ব্যয় করে আর এর কারণ এখনও জানা যায়নি। এই ধাপে একজন মানুষের শ্বসনকার্য ও হৃদস্পন্দন অনেক কমে যায়; রক্তচাপ কমে যায়(বিপজ্জনক পরিমাণে নয়); শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়; পেশির ক্রিয়াকলাপগুলো কমে যায় এবং চোখ কোনো নাড়াচাড়া করে না। এই স্তর থেকে একজন মানুষকে জাগিয়ে তোলা খুবই কঠিন। এই স্তরটি সাধারণত ২০ থেকে ৪০ মিনিট স্থায়ী হয়। আরেকটি মজার জিনিস আপনাদের বলে রাখা দরকার আর তা হলো, এই ধাপেই অনেকেরা ঘুমে কথা বলে অথবা ঘুমের মাঝে হাটে।
Rapid Eye Movement(REM)
এই স্তরটি ঘুমের সবচেয়ে চমকপ্রদ স্তর। যখন একজন মানুষ ঘুমের এই স্তরে পৌছে তখন তার চোখগুলো খুব দ্রুত নড়তে থাকে। তাই এই স্তরের নাম রেপিড আই মোভমেন্ট অথবা দ্রুত চোখ সঞ্চালন। একটা জিনিস আপনাদের বলে রাখা দরকার। সেটা হলো ঘুমের ৩য় এবং ৪র্থ স্তরের পর এই স্তর আসে না। ৪র্থ ও ৩য় স্তরের পর মানুষ আবার ঘুমের ২য় স্তরে চলে যায়। তারপর ঘুমের প্রথম স্তরে না পৌছে চলে যায় এই স্তরে। অর্থাৎ N1→N2→N3→N2→REM। এই ধাপটি প্রথম আসে ঘুমানোর প্রায় ৯০ মিনিট পর। প্রথম বার এই স্তর ১০ মিনিট স্থায়ী হয়। প্রথমবারের REM স্তর থেকে দ্বিতীয়বারের REM স্তর অধিক স্থায়ী হয়। তৃতীয়বারে আরো স্থায়ী। এভাবে একজন মানুষের সম্পূর্ণ ঘুমে ৪ থেকে ৫ বার ঘুমের এই পর্যায়ে যায়। নবজাতকরা দিনের প্রায় ৮০%সময়ই ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে দিতে পারে যেখানে ৫০% সময়ই REM স্তর। অন্যদিকে পূর্ণবয়স্করা তাদের মোট ঘুমের প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সময় এই স্তরে ব্যয় করে। একজন মানুষ যখন REM ঘুমের স্তরে পোছায় তখন তার মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে উঠে, রক্ত চাপ বেড়ে যায়। এই সময়ে যদি কোনো মানুষের EEG দেখা হয় তবে বুঝাই যাবে না যে সে ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে আছে। তাই এই স্তরকে প্যারাডক্সিকেল ঘুমও বলা হয়। আপনি সারাদিন যা যা শিখবেন আপনার মস্তিষ্ক এই স্তরে তাদের সাজাবে। এই স্তরে আপনি স্বপ্ন দেখবেন। প্রতি রাতে আমরা প্রায় ২ঘন্টার চেয়ে বেশি সময় স্বপ্ন দেখি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্বপ্ন কী? কেন আমরা স্বপ্ন দেখি?
একজন মানুষের ঘুমে এই প্রক্রিয়াগুলো ৪ থেকে ৫ বার রিপিট হয়। কিন্তু আমাদের ঘুম হতে হবে আদর্শ ঘুম। বিশেষজ্ঞদের মতে ৮ থেকে ৯ ঘন্টা ঘুম হলো আদর্শ ঘুম কিন্তু আমরা এই অতি প্রয়োজনীয় ঘুমকে অবজ্ঞা করি। আমরা একে সময় নষ্ট মনে করে মাত্র ৪ বা ৫ ঘন্টা ঘুমাই। আপনারা কী জানেন যে, আইনস্টাইন বলেছেন, যদি তিনি রাতে ১০ ঘন্টা না ঘুমাতেন তবে তিনি সঠিকভাবে কাজ করতে পারতেন না। যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি চালানোর সময় ঘুমিয়ে পরার কারণে বছরে প্রায় ২ লক্ষ এক্সিডেন্ট হয় এবং ৫ হাজার মানুষ মারা যায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, চেরনোবিলে নিউক্লিয়ার এক্সিডেন্ট হবার মূল কারণও ছিল না ঘুমানো। তাই বলে রাখছি, ঘুমান। বাঁচতে হলে ঘুমাতে হবে।
(স্বপ্ন)
আপনাদের এখন একটা গল্প বলবো। ঘুমের গল্প না, ঘুমে আমরা যে স্বপ্নগুলো দেখি সেগুলোর গল্প।
ঐদিন স্কুলে কয়েকজন ঘুম বিশেষজ্ঞ আসলো। তারা সব ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে একটা সভা করল। সেখানে তারা ঘুম নিয়ে আলোচনা করবে। সবার বক্তব্য শেষ করার পর এখন প্রশ্ন করার পালা। এক ঘাড়তেড়া ছাত্র সভার শুরুর দিকেই প্রশ্ন করে বসল।
"আচ্ছা স্যার, স্বপ্ন কী? কেন আমরা স্বপ্ন দেখি? কতবার আমরা স্বপ্ন দেখি? কতক্ষণ স্বপ্ন দেখি? কি রকমের স্বপ্ন দেখি? আমরা কি স্বপ্ন মনে রাখতে পারি?"
"হ্যা, ভালো প্রশ্ন করেছ। আসলে স্বপ্ন হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক ঘুমের সময় আমাদের যে ঘটনাগুলি দেখায় সেগুলো। আমরা সাধারণত স্বপ্ন দেখি ঘুমের REM স্তরে। আসলে স্বপ্ন নিয়ে এখনও ভালোভাবে জানা যায় নি। তবে এর সম্পর্কে অনেক থিওরি......"
স্যারের কথায় বাধা দিয়ে ঐ ঘাড়তেড়া ছাত্র বলল,"স্যার আপনি এখানে সাধারণত শব্দটা ব্যবহার করেছেন। তাহলে আমরা কি ঘুমের অন্যান্য স্তরেও স্বপ্ন দেখতে পারি?
কথায় বাধা পেয়ে স্যার কিছুটা বিরক্ত ফিল করা অবস্থায় বলে, "বেশিরভাগ সময় আমরা স্বপ্ন দেখি ঘুমের REM স্তরে সেটা মাঝে মাঝে মনে রাখা যায়। কিন্তু অন্যান্য স্তরেও স্বপ্ন দেখা যায়, তবে স্বপ্ন দেখার চান্স খুবই কম এবং আমরা খুবই কম মনে রাখতে পারি।"
সেই ঘাড়তেড়া ছাত্র আবার প্রশ্ন করল,"আচ্ছা স্যার, ঘুমে আমরা কতবার এবং কতক্ষণ স্বপ্ন দেখি?
স্যার এবারে বলল, "আমি বুঝেছি, তোমাদের বেসিক থেকে বলতে হবে।"
সবাই বলল," এটাই ভালো হবে।"
স্যার এক গ্লাস পানি পান করে বলতে থাকলো," স্বপ্ন হলো ঘুমের মধ্যে ঘটিত একটি স্টোরি বা কাহিনী যা আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের দেখায়। এটা কয়েক সেকেন্ড বা ২০ থেকে ৩০ মিনিট হতে পারে। স্বপ্ন আমরা কেন দেখি আর কি নিয়ে দেখি সেটা এখনও ভালোভাবে জানা যায় নি। তবে এটি নিয়ে কিছু থিওরি আছে। যেমনঃ
১. আমাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, মনের তীব্র ইচ্ছা বা অসম্পূর্ণ কাজগুলোকে আমরা আমদের স্বপ্নে দেখি।
২. স্বপ্ন অনেক সময় সাইকোথেরাপির একটা ফর্ম হিসেবে কাজ করে।
৩. আমরা সারাদিন যা যা শিখি আমাদের মস্তিষ্ক অনেক সময় স্বপ্নের মাধ্যমে সেগুলোকে রিপিট করে।
৪. ভবিষ্যতের ঝুঁকি নিয়েও অনেক সময় আমরা স্বপ্ন দেখি।
এছাড়া আরো অনেক কারণ রয়েছে। এখন আসল কথায় আসা যাক। আমরা আসলে কোন ধরনের স্বপ্ন দেখি?
১) দুঃস্বপ্ন - এই রকমের স্বপ্নগুলো খুবই বিরক্তিকর। এই স্বপ্নগুলো যেকোনো বয়সে হতে পারে। এই ধরনের স্বপ্ন ঘুমন্ত ব্যাক্তির মনে ভয়, স্ট্রেস, কিছু মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
২) লোসিড ড্রিম - এগুলো হলো সে সকল স্বপ্ন যেগুলো সম্পর্কে ঘুমন্ত ব্যাক্তি সচেতন থাকে। এমনকি অনেকে সে স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই ধরনের স্বপ্ন বেশিরভাগ সময় ঘটে যখন সে স্বপ্ন দেখার মধ্যে থাকে এবং সে বুঝতে পারে যে সে স্বপ্ন দেখছে।
৩) উপর থেকে নিচে পরার স্বপ্ন - দ্যা ইলাস্ট্রেটেড ড্রিম ডিকশনারির লেখক রাসেল গ্রান্ট বলেছেন, "এটা একটা অতি সাধারণ স্বপ্ন। এটা বাস্তব জীবনে ভয়ের প্রতিক।" একে বিজ্ঞানের ভাষায় "Hypnic Jerks" বলা হয়। এই ধরনের স্বপ্ন আমরা ঘুমের প্রথম স্তরে দেখি।
৪) নিজেকে নগ্ন দেখার স্বপ্ন - এটা সবচেয়ে অদ্ভুত স্বপ্নগুলোর একটা। ড্রিম ডিকশনারি ফর ডামিসের লেখক পেনি পিয়ার্স বলেছেন যে, জনসাধারণের মাঝে নিজেকে নগ্নতার স্বপ্ন দেখে ইঙ্গিত হতে পারে যে আপনি আপনার অসম্পূর্ণতা এবং ত্রুটিগুলি প্রকাশ করতে ভয় পান।
৫) আপনাকে কেউ তাড়া করছে এমন স্বপ্ন - এগুলো অতি সাধারণ স্বপ্ন। ড্রিম ডিকশনারির লেখক টম ক্রিস্প বলেছেন, ঘুমে তাড়া খাওয়ার অর্থ হতে পারে আপনি আপনার ভয় বা ইচ্ছা থেকে মুক্তি চান। যদি দেখেন কোনো জন্তু আপনাকে তাড়া করছে তার মানে হতে পারে আপনি আপনার রাগ, পেসন এবং অন্যান্য অনুভূতি থেকে লুকাতে চান। যদি আপনি দেখেন অন্য লিঙ্গের কোনো মানুষ আপনাকে তাড়া করে তাহলে এটা হতে পারে আপনি ভালবাসাকে ভয় পান
৬) আপনি উড়তেছেন এমন স্বপ্ন - অনেকেই এই রকম স্বপ্ন দেখে। টম ক্রিস্প বলেছেন, এটা দুইটা জিনিস তুলে ধরে। প্রথমত এটা মুক্তি ও স্বাধীনতা তুলে ধরতে পারে। অন্যদিকে এটা পালিয়ে যাওয়া বা জীবনের বাস্তবতা থেকে মুক্তি পেতে চান।
আমারা যে স্বপ্নগুলো দেখি তার পরিবেশ ৫৫ রকমের হতে পারে। সেগুলো নিয়ে আমরা আগামী সভায় আলোচনা করবো।" বলে তারা চলে গেল।
বিঃদ্রঃ এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এগুলো শুধু মনোবিজ্ঞানীদের ধারনা।
Writer: Jaber Hasan
Tags:
জানা-অজানা