১।
বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে একটা অদ্ভূত মিল আছে। মিলটা সমাজতাত্ত্বিক।
ধর্মপ্রাণ মানুষ সাধারণত ধর্ম জিনিসটাকে বেশ জটিল মনে করেন। সেটার কারণ যে নেই তা বলছি না। ধর্মের ভাষা এমনিতে বিদেশী, তার ওপর গেল হাজার বছরে ধর্ম নিয়ে কালিক্ষয় কম হয়নি। আমার চেয়ে অনেক বেশি জানলেঅলা মানুষ ধর্ম নিয়ে লিখেপড়ে কয়েক লাইব্রেরি ভরেছেন। এই প্রেক্ষিতে ধর্মগ্রন্থে যে আসলে কী লেখা আছে, বা ধর্মের রীতি বা আইনকানুন যে প্রকৃতপক্ষে কী, সেটা সম্পর্কে ছাপোষা বাঙালির কৌতূহল খানিক কম থাকে। ধর্ম নিয়ে পড়াশোনার জন্য তো আলাদা লোক আছেনই। তিনি নিজে পড়াশোনা করে আমাকে বিবি তালাকের ফতোয়াটা জানিয়ে দিলেই হল, এর জন্য আমার নিজের গিয়ে ফেকা-হাদিস চষে লাভ নেই।
এই মানসিকতা থেকেই সাধারণ মানুষ আর জ্ঞানীশ্রেণির (“আলেম সমাজের”) মধ্যে একটা অলিখিত (এবং কিছু ক্ষেত্রে লিখিত) চুক্তি গড়ে ওঠে- একপক্ষ দেখবে দুনিয়াদারী, আরেকপক্ষ দেখবে ধর্ম। ধর্ম দেখে এই দ্বিতীয় দল প্রয়োজনমাফিক আইনকানুন আমাদের জানিয়ে দেবে। আমরাও মোটামুটি তাদের বক্তব্য নতমস্তকেই মেনে নেব।
সিস্টেমটা এমনিতে হয়ত ঠিকমতই চলতে পারত, কিন্তু সমস্যাটা দাঁড়ায় যখন এই দুই শ্রেণীর মধ্যে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে সমাজে মকসুদুল মোমেনীন গোছের একটা ধর্ম তৈরি হওয়া শুরু করে। এই ধর্মের প্রবক্তাদের পরিচয় অনেক- হতে পারে সে পরিচিতদের মধ্যে একমাত্র দাঁড়িঅলা ব্যক্তি, হতে পারে একান্নবর্তী পরিবারের গনু মোল্লা, হতে পারে রাস্তার ক্যানভাসার। সাধারণ মানুষের যেহেতু সেরকম ধর্মবিষয়ক বোধবুদ্ধি নেই, কাজেই এই সহজলভ্য মানুষদের ওপরেই তারা ধর্মজ্ঞানের জন্য নির্ভর করা শুরু করে। এদের কাছ থেকে তারা শেখে ঘরে দারিদ্র্য আসার ছাপ্পান্নটি কারণ কী, কীভাবে পছন্দের মানুষের ছোহবত পাওয়ার জন্য গাছে তাবিজ ঝুলাতে হয়, বা গোপন রোগের পরীক্ষিত টোটকা ওষুধ বানানোর প্রণালী।
সাধারণ মানুষের ধর্ম অনেক ক্ষেত্রেই এরকম একটা ট্যাবলয়েড ধর্ম। এরকম পরিস্থিতির বিপরীতে একটা সময় বিপ্লবও আসে- খ্রিষ্টধর্মের জন্য সেটা ছিল প্রটেস্ট্যান্ট রেফর্মেশান, এই উপমহাদেশের মুসলিমদের ক্ষেত্রে আহলে হাদীস আন্দোলন। সে অন্য কথা।
বিজ্ঞানের সংস্কৃতি এর চেয়ে এমন কিছু আলাদা নয়।
ব্যাপারটা অবশ্য সবসময় এরকম ছিল না। ডারউইন তার অরিজিন অফ স্পিশিজ লিখেছিলেন আজ থেকে একশ’ ষাট বছর আগে। আপনার ইংরেজি জ্ঞান মোটামুটি কাজ চালানোর মত হলে সেই বই আপনি আজকে পড়েও স্বচ্ছন্দ্যে বুঝতে পারবেন। এর জন্য আপনাকে জীববিজ্ঞানী হতে হবে না। কিন্তু বিজ্ঞান যতই অগ্রসর হতে থাকল, ততই বিজ্ঞানীরা বুঝলেন- প্রত্যেক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের আলোচনার জন্য আলাদা একটা ভাষা দরকার।
এরকম ভাষার দরকার অবশ্যই ছিল। যেমন ধরুন আপনি আমাকে বললেন- ইদানিং বেশ শোনা যাচ্ছে কিছু রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। আমাদের বাপ-চাচাদের সময়ে এক পেনিসিলিন দিয়েই তো সব জীবাণু ঘায়েল হয়ে যেত। হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর যদি সত্যিকার অর্থেই বুঝতে চান, তাহলে আমার শুরু করতে হবে ডিএনএন কাহাকে বলে থেকে। তারপর আপনাকে বুঝতে হবে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে ডিএনএ দুইভাবে থাকে- বড় ডিএনএ আর ছোট ডিএনএ। তারপর বুঝতে হবে এই ছোট ডিএনএ মাঝে মধ্যে রোগজীবাণুর মধ্যে আদান-প্রদান হয়। তারপর বুঝতে হবে জিন কাকে বলে, আর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের জন্য যে আলাদা জিন থাকে। তারপর বুঝতে হবে সেই জিন কীভাবে ছোট ডিএনএর পিঠে চাপতে পারে। সবশেষে বুঝতে হবে বিবর্তন কীভাবে হয়। কমসে কম আধাঘন্টার একটা আলোচনা।
এই আলোচনার সম্পূর্ণটাই আমি আমার কোন কলিগকে শুধু তিনটি শব্দ উচ্চারণ করে বুঝিয়ে দিতে পারি- horizontal gene transfer।
এরকম কম কথায় কাজ সারার জন্য বিশেষজ্ঞদের তাই একটা আলাদা ভাষা ব্যবহার শুরু করতে হল। এই ভাষা সাধারণ্যের কাছে আরবি ল্যাটিন বা সংস্কৃতের চেয়ে বেশি সহজবোধ্য নয়। আপনি ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য একটা কাজ করতে পারেন- আপনার নিজের পড়াশোনার মধ্যে নয়, এমন কোন বিষয়ের একটা ভাল গবেষণাপত্র বের করে সেটায় দাঁত ফোটানোর চেষ্টা করতে পারেন।
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পক্ষে বিজ্ঞানী সমাজের কাজকর্ম, গবেষণাপদ্ধতি, ফলাফল কিছুই সরাসরি জানা সম্ভব নয়। এর জন্য তাই একটা মধ্যস্থতাকারী দলের সৃষ্টি হওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী।
এই মধ্যস্থতাকারীদে র একটা অংশের কাজ খুব চমৎকার। এরা হচ্ছেন সত্যিকারের সায়েন্স জার্নালিস্ট- তারা আসলেই কোমর বেঁধে বিজ্ঞানের গবেষণাপত্রগুলো পড়ে, গবেষকদের সাথে কথা বলে প্রকৃত বিজ্ঞানটা সহজপাচ্য ভাষায় পরিবেশন করেন। এই শ্রেণীর উদাহরণ হলেন সাংবাদিক কার্ল জিমার বা এড ইয়ং। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই তাদের গবেষণা মানুষের বোধগম্যতার জন্য সহজ ভাষায় নিয়ে আসেন- হতে পারে সেটা বই, সংবাদপত্রের কলাম কিংবা টেলিভিশন সিরিজের মাধ্যমে। এই মুহূর্তে এর যে উদাহরণটা মাথায় আসছে সেটা হল জিন এডিটিং পদ্ধতি CRISPR এর একজন আবিষ্কর্তা প্রফেসর জেনিফার ডাউডনার বই A Crack in Creation: Gene Editing and the Unthinkable Power to Control Evolution, যেখানে তিনি CRISPR আবিষ্কারের ইতিহাস গল্পের মত সাজিয়ে লিখেছেন। ডিএনএর ডাবল হিলিক্সের আবিষ্কর্তা জেমস ওয়াটসনের The Double Helix এই ঘরানার বইয়ের আরেকটা চমৎকার উদাহরণ। আরো অনেক উদাহরণ হয়ত আপনারা নিজেরাই দিতে পারবেন।
অন্যদিকে মধ্যস্থতাকারীদে র আরেকটা অংশ রাস্তার ক্যানভাসার গোছের। এদের বৈশিষ্ট্য- বিজ্ঞান নিয়ে লেখার আগে প্রাসঙ্গিক গবেষণাপত্র পড়ার কোন চেষ্টা এনারা করেন না। অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে সেই গবেষণাপত্র সম্পর্কে যে বক্তব্য এসেছে, সেটাই নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে পরিবেশনের চেষ্টা করেন। দৈনিক সংবাদপত্র বা অনলাইন নিউজ পোর্টালে এদের উপস্থিতি প্রকট- সাধারণ মানুষ এদের হাত ধরেই বিজ্ঞানের কাছে পৌঁছয়।
এর খুব ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই।
২।
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা খবর চোখে পড়ল- গরম চা খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। বিষয়টা নিয়ে আমার খানিকটা সন্দেহমিশ্রিত কৌতূহল হল। লেখাটাতে যদিও মূল গবেষণাপত্রের কোন নামনিশানা দেওয়া ছিল না, তবে খুঁজে বের করতে সময় লাগল না।
গবেষণাটা করেছেন ইরানের ফারহাদ ইসলামির গ্রুপ। চলুন আগে কাজটা নিয়ে একটু কথা বলি।
ইসলামিরা ইরানের পঞ্চাশহাজার মানুষকে দশ বছর ধরে গিনিপিগ বানিয়ে গবেষণাটা করেছেন। এটা শুনে যদি মহা এলাহী কাণ্ড মনে হয়- মনে রাখবেন, আপনার নিজের দেশেই আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানীরা চাঁদপুরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষকে নিয়ে তেপ্পান্ন বছর ধরে গবেষণা করে চলেছেন। সে যাই হোক, এমনিতে কাজটার চেহারা এরকম। ইরানের গোলেস্তানের মানুষ প্রচুর চা খান, অনেকক্ষেত্রে একদম আগুনগরম চা। গবেষকদের দেখতে ইচ্ছে হল, গরম চা খাওয়ার সাথে খাদ্যনালীর ক্যান্সার হওয়ার কোন সম্পর্ক আছে কিনা। সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়- আপনি যদি নিত্যদিন আপনার খাদ্যনালীকে আগুনের মত তাপ দিতে থাকেন, তাহলে একদিন না একদিন তো সে বিদ্রোহ করে বসতেই পারে। সেটার বাস্তবতাই এনারা গবেষণা করে খতিয়ে দেখতে চাইলেন।
এটা করার জন্য তারা পঞ্চাশহাজার মানুষের গ্রুপটাকে দুইভাগে ভাগ করে ফেললেন- যারা গরম চা খান, বনাম যারা তা খান না। আবার চা খাওয়ার পরিমাণের ওপরেও আরেকবার ভাগ করলেন- যারা অনেক বেশি চা খান, বনাম যারা অপেক্ষাকৃত কম খান। এরকমভাবে ভাগ করে তারা দশ বছর ধরে প্রত্যেক ভাগের মানুষকে পর্যবেক্ষণ করলেন। যদি বেশি গরম চা খাওয়া-গ্রুপের খাদ্যনালীর ক্যান্সারের হার কম গরম চা খাওয়া-গ্রুপের হার থেকে বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে গরম চা খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।
এ পর্যায়ে একটা মজার জিনিস বলে রাখি- গরম চা খাওয়া-মানুষ বনাম ঠাণ্ডা চা খাওয়া-মানুষ, এই ভাগাভাগিটা গবেষকরা কীভাবে করেছেন। এটার জন্য প্রথমে তারা কেতলিতে চা বানিয়েছেন। তারপরে সেটা দু'কাপে ঢেলে এককাপ রেখেছেন উত্তরদাতার সামনে, আরেককাপ গবেষকের সামনে। এভাবে রেখে তারা উত্তরদাতাকে জিজ্ঞেস করেছেন- চাচা, মাত্র চা চুলো থেকে নামালাম। এই তাপমাত্রার চা কি আপনি সচরাচর খান? চাচা হয়ত বলেছেন- না বাবা, এত আগুনগরম তো খেতে পারি না, আরেকটু জুড়োতে দিতে হয়।
দু'মিনিট পর গবেষক আবার প্রশ্ন করেছেন- চাচা, এবার একটু খেয়ে দেখুন। চাচা হয়ত এবার খেয়ে বলেছেন- হ্যাঁ, ঠিক এরকম গরম চা-ই আমি খেতে ভালবাসি। সচরাচর এই তাপমাত্রাতেই আমি চা খেয়ে অভ্যস্ত। তখন গবেষক তার কাপে ঢালা চায়ের তাপমাত্রাটা মেপে ফেলেছেন। আর চাচা যদি বলেন- না আরেকটু ঠাণ্ডা করে খাই, তখন গবেষক আরো দু'মিনিট অপেক্ষা করেছেন। তারপরেও না খেতে পারলে আরো দু'মিনিট। ইত্যাদি।
এই কায়দা করে তারা প্রত্যেক মানুষকে একটা স্কোর দিয়েছেন- মন্তু মিয়া পঞ্চাশ ডিগ্রিতে চা খান, মকবুল চাচা ষাট ডিগ্রিতে, আবুল পঞ্চান্ন ডিগ্রিতে, ফকিরের মা পঁয়ষট্টি ডিগ্রিতে। গরম চা বনাম ঠাণ্ডা চা ভাগাভাগিটা এই স্কোরের ভিত্তিতেই হয়েছে।
গবেষণার মূল ফলাফলগুলো এরকম। এমনিতে যারা ষাট ডিগ্রির ওপরে নিত্যদিন চা খান, তাদের খাদ্যনালীর ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বাকিদের থেকে বেশি। আর যারা এরকম আগুনগরম চা অনেক বেশি পরিমাণে খান, তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি- স্বাভাবিকের প্রায় নব্বই শতাংশ (অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ)।
এবার চলুন দেখি এই গবেষণার কথা বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলো তে কীভাবে এসেছে। শুধু শিরোনামগুলো উল্লেখ করছি, কারণ অধিকাংশ মানুষ শিরোনামটা দেখেই যা ভাবার ভেবে নেন।
কালের কণ্ঠ- অতিরিক্ত গরম চা পানে খাদ্যনালীর ক্যান্সার! (২০ মার্চ, ২০১৯)
জনকণ্ঠ- গরম চা পানে হতে পারে খাদ্যনালীর ক্যান্সার! (২৩ মার্চ, ২০১৯)
বাংলানিউজটোয়েন্ টিফোর- গরম চা পানে হতে পারে ক্যান্সার! (২৪ মার্চ, ২০১৯)
বাংলাদেশ টাইমস- অতিরিক্ত গরম চা পানে ক্যান্সারের ঝুঁকি (২৬ মার্চ, ২০১৯)
এছাড়াও আরো অনেক জায়গাতেই খবরটা এসেছে, কিন্তু এই চারটি রিপোর্ট অপেক্ষাকৃত ভাল বলেই আলোচনার জন্য এদের বেছে নিলাম।
শিরোনামগুলোর অন্তত চারটা দিক আলোচনার দাবি রাখে।
প্রথমত, গরম চা কথাটা শুনে অনেকে অনেক কিছু বুঝবেন। আগুনগরম থেকে কুসুমগরম পর্যন্ত সবকিছুই এর মধ্যে পড়ে। কিন্তু গবেষণায় কুসুমগরম চায়ের কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে আগুনগরম চায়ের কথা। ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরের চা সাংঘাতিক গরম- মুখে দিলে পাঁচ-দশ সেকেন্ড রাখলে ভেতরটা খানিক পুড়েও যেতে পারে। আমি মনে করি প্রতিবেদনের শিরোনামেই এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত। এদিক থেকে কালের কণ্ঠ আর বাংলাদেশ টাইমসের শিরোনামগুলো যথার্থ, কারণ এরা গরম চায়ের আগে "অতিরিক্ত" বিশেষণটা জুড়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গরম চা খেলে ক্যান্সার হবে এটা কোন কাজের কথা নয়। অনেকেই নিত্যদিন আগুনগরম চা খেয়েও দিব্যি ক্যান্সারবিহীন জীবন কাটিয়ে দেবেন। আসল কথাটা হচ্ছে অতিরিক্ত গরম চা খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। কালের কণ্ঠের শিরোনামটাতে ঝুঁকি বা সম্ভাবনার কোন উল্লেখ নেই।
তৃতীয় ব্যাপারটা আরেকটু সূক্ষ্ণ, কিন্তু এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
লক্ষ্য করুন, গবেষণাপত্রের বক্তব্য অনুযায়ী চায়ের সাথে কিন্তু ক্যান্সারের কোন সম্পর্কে নেই। কম তাপমাত্রায় বেশি চা খেলে তা ক্যান্সারের জন্য আলাদাভাবে দায়ী নয়। অর্থাৎ খাদ্যনালীর ক্যান্সারের কারণ আসলে চা নয়, বরং চায়ের তাপমাত্রা। ইসলামিদের গবেষণাপত্র বের হওয়ার সময় পর্যন্ত চায়ের সাথে খাদ্যনালীর ক্যান্সারের সম্পর্ক নিয়ে মোট পাঁচটা গবেষণা হয়েছে- চারটাতে বিজ্ঞানীরা দু'টোর মধ্যে কোন সম্পর্ক খুঁজে পাননি, আর একটাতে তারা দেখেছেন চা খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বরং কমে। আমি-আপনি হলে এ পর্যন্ত শুনে দিতাম চা আর ক্যান্সার নিয়ে আর চিন্তাভাবনার দরকার নেই। এনারা বিজ্ঞানী বলেই বিজ্ঞানীসুলভ সতর্কতার সাথে বলেছেন- এ ব্যাপারে আরো গবেষণা হওয়া দরকার।
এই জায়গাটাতে এসে আমার মতে চারটি শিরোনামই ব্যর্থ, কারণ "গরম চায়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি" কথাটা থেকে বোঝা যায় না সমস্যাটা কি চায়ের, নাকি গরমের। অনেকে এই শিরোনাম দেখে হয়ত বাসায় চা খাওয়াই বন্ধ করে দিতে চাইবেন। মজার ব্যাপার হল, এক বাংলাদেশ টাইমস ছাড়া বাকি তিনটি প্রতিবেদনের কোথাও এমনিতে চা খেলে যে কোন সমস্যা নেই, বরং গরম তাপমাত্রার পানীয়তে সমস্যা- সেটা পরিষ্কার করা হয়নি।
চতুর্থ এবং শেষ ব্যাপারটা হল গবেষণার প্রেক্ষিত।
প্রত্যেকটি গবেষণাই একটা নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্র ের প্রেক্ষিতে করা হয়। গরম পানীয় আর ক্যান্সারের ঝুঁকির এই গবেষণাটা করা হয়েছে ইরানের গোলেস্তানে। অর্থাৎ ইরানের গোলেস্তানে বসে যদি কেউ অনেক দিন ধরে অতিরিক্ত গরম পানীয় খেতে থাকে, তাহলে তার খাদ্যনালীর ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। কিন্তু একই কথা কি পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতেও প্রযোজ্য?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে খুঁজে বের করতে হবে, গরম পানীয় খেলে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ার কারণটা ঠিক কি।
এই প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন। তবে কিছু গবেষণা থেকে দেখা গেছে, আপনার খাদ্যনালীর ওপরে যে নরম থকথকে মিউকাসের একটা স্তর থাকে, অতিরিক্ত গরম পানি খেতে থাকলে সেই স্তরটা ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যায়। এর ফলে স্তরের নিচের সংবেদনশীল কোষগুলো বাইরে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যদি পরিবেশে এমন কিছু থাকে যা এই কোষগুলোর জন্য ক্ষতিকর, তাহলে তারা সুযোগ পেয়ে আপনার খাদ্যনালীর বারোটা বাজিয়ে দেয়। এই তত্ত্ব যদি ঠিক হয়, তাহলে কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্যান্সারের সাথে চায়ের তো নয়ই, বরং পানীয়ের তাপমাত্রারও সরাসরি যোগ নেই। যোগ আছে পরিবেশে থাকা ক্ষতিকর পদার্থগুলোর। কিছু প্রাণীর ওপর গবেষণা চালিয়ে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। এমনিতে গরম পানি দিলে ইঁদুরের খাদ্যনালীতে ক্যান্সার হয় না, কিন্তু যদি গরম পানি দেওয়ার সাথে সাথে যদি ঐ ক্ষতিকর পদার্থগুলো দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে পানি দিয়ে তৈরি ক্ষতগুলোর সুযোগ নিয়ে তারা খাদ্যনালীতে ক্যান্সার ঘটায়।
ইরানের গোলেস্তানের পরিবেশে এইরকম ক্ষতিকর পদার্থের পরিমাণ অনেক বেশি। কাজেই এমন হতেও পারে যে যেখানে পরিবেশে এসব জিনিসের পরিমাণ কম, তাদের আগুনগরম চা খেলেও খাদ্যনালীর ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে না।
কাজেই গোলেস্তানে যা ফলাফল দেখা যাচ্ছে তা যে ঢাকার গুলিস্তানেও দেখা যাবে তা আরও গবেষণা না করা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না। এই সম্ভাবনাটার কথা খবরের শিরোনামে আসা উচিত বলে আমি মনে করি- গরম চায়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে না, বরং বাড়তে পারে। সম্ভাবনা আছে।
এই চারটি বিষয় মাথায় রাখলে এই প্রতিবেদনের আদর্শ শিরোনাম হওয়া উচিত এরকম কিছু- "অতিরিক্ত গরম পানীয় দীর্ঘদিন খেতে থাকলে খাদ্যনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়লেও বাড়তে পারে"।
৩।
অনেকে পুরো ব্যাপারটাতে একটা কৌতুকের গন্ধ পাবেন।
সংবাদমাধ্যমের একটা মূল উদ্দেশ্য হল পয়সা উপার্জন। সেই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শিরোনাম হতে হয় ছোট এবং চটকদার, যেটা দেখেই মানুষের পড়তে ইচ্ছে করে। হালের ভাষায়- clickbait। বুঝলাম খানিকটা অবৈজ্ঞানিক কিংবা বিভ্রান্তিকর, কিন্তু মার্কেটের দৃষ্টিকোণ থেকে তো এ ধরণের শিরোনামেরই কাটতি বেশি। আমার দেওয়া বিকট শিরোনাম রাখতে গেলে কয়জন এই লেখা পড়তে চাইবে?
এই পর্যবেক্ষণের সাথে আমি একমত। সংবাদমাধ্যম এই ট্যাবলয়েড বিজ্ঞান প্রচারের মাধ্যমে তাদের দিক থেকে সার্থক। এজন্যই আমি মনে করি প্রাসঙ্গিক গবেষণাপত্র যত্নসহকারে পড়ে দেখার দায়িত্ব যতটা না প্রতিবেদন লেখকের, তার চেয়ে বেশি আপনার, অর্থাৎ পাঠকের।
আজকালকার যুগে কিন্তু ট্যাবলয়েড ধর্মের প্রভাব কমে এসেছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষের কাছে সোলেমানী ফালনামা বা তাবিজ-কবজের বিশেষ মূল্য নেই। এর কারণ সমাজ হিসেবে মানুষের মধ্যে ধর্মজ্ঞান বা সচেতনতা কিছুটা হলেও বেড়েছে, যার জন্য তারা গনু মোল্লার কথা শোনার আগে কিছুটা বাছবিচার করে নেয়।
এই একই উন্নতি আমরা বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রেও দেখতে চাই। মানুষ ট্যাবলয়েড বিজ্ঞান না পড়ে গবেষণাপত্রের প্রকৃত বিজ্ঞানের কাছাকাছি আসুক।
--------------- --------------- -------
পরিশিষ্ট ও তথ্যসূত্র
লেখা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে এখানে কিছু ব্যাপার উহ্য রাখা হয়েছে- যেমন ক্যান্সারের ঝুঁকি মানেই relative risk, এবং সেটা নির্ভর করে এন্ডেমিক প্রেভেল্যান্সের ওপর।
বাংলাদেশের চাঁদপুরের সার্ভেইলেন্স সিস্টেম নিয়ে জানতে এই গবেষণাপত্র দেখতে পারেন- Alam, Nurul, Taslim Ali, Abdur Razzaque, Mahfuzur Rahman, M. Zahirul Haq, Sajal K. Saha, Ali Ahmed et al. "Health and demographic surveillance system (HDSS) in Matlab, Bangladesh." International journal of epidemiology 46, no. 3 (2017): 809-816.
গরম চা ও ক্যান্সার সংক্রান্ত মূল গবেষণাপত্র এই- Islami, Farhad, Hossein Poustchi, Akram Pourshams, Masoud Khoshnia, Abdolsamad Gharavi, Farin Kamangar, Sanford M. Dawsey et al. "A prospective study of tea drinking temperature and risk of esophageal squamous cell carcinoma." International journal of cancer (2019).
Writer: Hassan uz Zaman Shamol
Writer: Hassan uz Zaman Shamol