দেহঘড়ির কারিগরি


আজ আপনাদের এক আশ্চর্যরকম ঘড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই, যে ঘড়ির উপর গবেষণা করে ২০১৭ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে গৌরবময় নোবেল পুরষ্কার জিতে নিয়েছেন তিন জন বিজ্ঞানী।
আমরা যেমন ঘড়ির সাথে সমন্বয় করে নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করে থাকি যেমন, সকাল ৬ টা কিংবা ৭ টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়বো তারপর ৯ টায় স্কুলে বা অফিসে যাবো, অথবা রাত ১২ টায় ঘুমিয়ে যাবো। ঠিক তেমনিভাবে জীবদেহও তার নিজের কার্যকলাপের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ অন্তর্জাত ঘড়িকে মেনে চলে- এ ঘড়ির নাম বায়োলজিক্যাল ক্লক বা দেহঘড়ি। আর এই ঘড়ির পেছনে আছে সার্কাডিয়ান রিদম (Circadian Rhythm)। "Circadian" শব্দটি "circa"- যার অর্থ around বা প্রায় এবং "dies" যার অর্থ day বা দিন, এ দুটি ল্যাটিন শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। অর্থাৎ Circadian মানে হলো "প্রায় এক দিন"। এই ছন্দটি প্রায় এক দিন ব্যাপী বজায় থাকে বলেই এমন নাম। "Circadian" শব্দটি ১৯৫৯ সালে সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন আমেরিকান ক্রোনোবায়োলজির জনক Franz Halberg ( Biological rhythm বা জৈবিক ছন্দময়তা নিয়ে গবেষণাকে Chronobiology বলে)। যদিও সার্কাডিয়ান রিদমের এই চমৎকার ছন্দময়তা অনেক বিজ্ঞানীই তারও অনেক আগে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ফঁরাসি জ্যোতির্বিদ Jean Jacques d'Ortous de Mairan, তিনি ১৭২৯ সালে মিমোসা বা লজ্জবতী গাছ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেখতে পান দিনের বেলায় গাছটি সূর্যের দিকে নিজের পাতাগুলো মেলে ধরে এবং সন্ধ্যা হলে পাতাগুলো চুপসে যায়। ব্যাপারটি তাকে বিস্মিত করে এবং তিনি দেখতে চান গাছটিকে সূর্যালোকবিহীন সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘরে রেখে দিলে কি ঘটতে পারে, কিন্তু দেখা যায় অন্ধকার ঘরেও এর পাতাগুলো আগের মতোই স্বাভাবিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ে মেলে ধরে এবং চুপসে যায়। গবেষণাটি থেকে বোঝা যায়, গাছের অভ্যন্তরীন স্বনির্ভর বায়োলজিক্যাল ক্লকের ছন্দ অনুযায়ীই পাতার স্বাভাবিক মেলে ধরা ও চুপসে যাওয়া নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
পরবর্তীতে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে সার্কাডিয়ান রিদমের ব্যাপারে আরোও তথ্য উঠে আসে, বোঝা যায় এই অন্তর্জাত ও স্বনির্ভর ঘড়িটি বাহ্যিক উদ্দীপনা যাদেরকে zeitgebers (জার্মান শব্দ zeitgeber অর্থ হলো timer বা সময় নির্ধারক) বলে, যেমন: আলো, তাপমাত্রা ইত্যাদি দ্বারা আশেপাশের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্যে একটু এদিক সেদিক হলেও এদের অনুপস্থিতিতেও সক্রিয় থাকতে পারে এবং শুধু গাছেই নয়, মানুষসহ অন্যান্য বহুকোষী জীবেও এই সার্কাডিয়ান রিদমের উপস্থিতি বিদ্যমান। জীবের নিদ্রা ও জাগ্রত থাকার চক্র, খাদ্যগ্রহণ, বিপাকীয় প্রক্রিয়াসহ আরোও বিভিন্ন প্রক্রিয়াই এই সার্কাডিয়ান রিদমীয় বায়োলজিক্যাল ঘড়ির প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
যেহেতু জীবের সকল বেশিষ্ট্যয়ের পেছনে থাকে কোনো না কোনো জিন। তাহলে জীবনের এই সার্কাডিয়ান ছন্দের পেছনেও তো নিশ্চয় কোনো জিন দায়ী থাকার কথা। ১৯৭১ সালে Seymour Benzer এবং উনার ছাত্র Ronald Konopka প্রথম ড্রসোফিলা নামক ফলের মাছিতে দেখতে পান যে ড্রসোফিলার একটি অজানা জিনের মিউটেশন বা অভিব্যক্তি এটির সার্কাডিয়ান রিদমীয় প্যাটার্নে ব্যাঘাত ঘটায়। তারা এই ক্লক জিনটিকে period বা per জিন নামে শনাক্ত করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে, Jeffrey Connor Hall এবং Michael Rosbash সর্বপ্রথম ড্রসোফিলার X ক্রোমোসোমের এই period বা per ক্লক জিনটিকে পৃথক করতে সমর্থ হন। তাদের গবেষণায় তারা মত দেন যে, পিরিয়ড জিন (per) থেকে সংশ্লেষিত PER প্রোটিনের পরিমাণ রাতে বাড়তে থাকে এবং দিনের শুরুতে কমতে থাকে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার একটি চক্রে ক্রমাগত উঠা-নামা করে। তারা এই উঠা-নামার চক্রের কারণকে একটি দমনমূলক প্রতিক্রিয়া লুপের ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করেন যেখানে PER প্রোটিন নিজেই পিরিয়ড (per) জিনের কার্যকারিতা থামিয়ে নিজের সংশ্লেষণ বন্ধ করে দিয়ে এই ২৪ ঘন্টা ব্যাপী উঠা-নামার ক্রমাগত চলমান ছন্দে নিজের পরিমাণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
পরবর্তীতে per জিনের আবিষ্কারের পথ ধরে সময়পরিক্রমায় সার্কাডিয়ান রিদম সম্পর্কিত আরোও বেশ কয়েকটি জিন আবিষ্কার হয়। যেমন, ১৯৯৪ সালে আরেক জিনবিজ্ঞানী এবং ক্রোনোলজিস্ট Michael Warren Young ড্রসোফিলায় "timeless" বা "tim" জিন আবিষ্কার করেন। "timeless" নামকরণের কারণ যেসকল ড্রসোফিলায় এই জিনের মিউটেশন বা অভিব্যক্তি ঘটে তাদের কোনো সার্কাডিয়ান চক্র থাকে না। এরপর ক্রমাগত নতুন জিন আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে মার্কিন নিউরোবায়োলজিস্ট Joseph Takahashi এবং তাঁর দল ইঁদুরে "clock" বা "clk" জিন, পরবর্তীতে Michael Rosbash ও তাঁর দল ড্রসোফিলায় "cycle" বা "cyc" জিন আবিষ্কার করেন, যা পূর্বে আবিষ্কৃত "clock" জিনের সংশ্লেষিত "CLK" প্রোটিনের সাথে বাইন্ড করতে পারে। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে আবার বিজ্ঞানী Michael Warren Young নতুন আবিষ্কার নিয়ে সামনে আসেন, এবার যে জিনটি তিনি আবিষ্কার করেন সেটির নাম "double-time" বা "dbt"। তাঁদের এই আবিষ্কার আমাদেরকে সার্কাডিয়ান রিদমের আদ্যপান্ত আরোও বিস্তারিতভাবে জানার নতুন দ্বার খুলে দেয়।

জীবদেহের জিনগুলোতে যেসকল বংশগতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকে সেগুলো সে প্রকাশ করে প্রোটিনের মাধ্যমে। এইজন্যে প্রথমে নিউক্লিয়াসে ক্রোমোসোমের ঐ নির্দিষ্ট জিনের অর্থাৎ DNA এর ট্রান্সক্রিপশনের মাধ্যমে প্রোটিন সংশ্লেষণের বার্তা বহনকারী বার্তাবহ RNA বা messenger RNA/
mRNA তৈরি হয়। DNA তে গ্রথিত রাসায়নিক তথ্যগুলোকে RNA তে কপি করার প্রক্রিয়াটিই হলো ট্রান্সক্রিপশন। এরপর নিউক্লিয়াসে সৃষ্ট এই mRNA সাইটোপ্লাজমে গিয়ে রাইবোসোম ও ট্রান্সফার RNA(tRNA)-যা জেনেটিক কোডন অনুযায়ী mRNA অণুতে অ্যামিনো এসিড সরবরাহ করে, এ দুটি উপাদানের সহায়তায় প্রোটিন সংশ্লেষণ করে। অর্থাৎ, mRNA DNA র ভাষাকে প্রোটিনের ভাষায় ট্রান্সলেট বা রূপান্তর করে বংশগতীয় তথ্যের প্রকাশ করে। রূপান্তরের এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ট্রান্সলেশন।
এখানে, জিন কতৃক সংশ্লেষিত প্রোটিনকে বড় হাতের ইংরেজি হরফ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন, tim জিন থেকে TIM প্রোটিন , clk জিন থেকে CLK, cyc জিন থেকে CYC প্রোটিন এবং dbt জিন থেকে DBT প্রোটিন সংশ্লেষিত হয়।
বর্ণনার সুবিধার্থেই জিনের আবিষ্কার ও জিন থেকে প্রোটিনের উৎপাদনের বিষয় দুটি আগেই উল্লেখ করা। যাইহোক, এবার আণবিক ঘড়ির সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিতে নজর দেওয়া যাক।
এই প্রক্রিয়াতে দুইটি আন্তঃসম্পর্কিত ফিডব্যাক লুপ রয়েছে। CLK ও CYC প্রোটিন অণু মিলে CLK/CYC ডাইমার গঠন করে, ডাইমার হলো দুটি রাসায়নিক অণুর সমাবেশ। দিনের বেলায় ও সন্ধ্যার শুরুতে CLK/CYC ডাইমারের ক্রিয়ায় per ও tim জিনের ট্রান্সক্রিপশন শুরু হয়। per জিন থেকে mRNA তৈরি হয় এবং নিউক্লিয়াস থেকে mRNA সাইটোপ্লাজমে গিয়ে PER প্রোটিন ট্রান্সলেশন করে। একইভাবে tim জিন TIM প্রোটিন সংশ্লেষিত করে। কিন্তু PER প্রোটিন দিনের বেলায় উৎপন্ন হলেও তখন-ই নিউক্লিয়াসে ফেরত যেতে পারে না। কারণ দিনের বেলায় doubletime জিন সংশ্লেষিত DBT প্রোটিন সক্রিয় থাকায় PER প্রোটিনের ফসফোরাইলেশন ঘটে অর্থাৎ, PER এর সাথে ফসফেটযুক্ত হয়। এতে করে PER প্রোটিন অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে এবং নিউক্লিয়াস ঢুকতে পারে না। তবে সন্ধ্যায় DBT অকার্যকর হয়ে যায়। তাই রাতে PER প্রোটিন ফসফেট মুক্ত হয়ে স্থিতিশীল হয় এবং TIM প্রোটিনের সাহায্য নিয়ে নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করে। অর্থাৎ, বুঝতেই পারছেন, জিনটির doubletime নাম দেওয়ার কারণ সে PER প্রোটিনের নিউক্লিয়াসে প্রবেশে দেরি করায়। গভীর রাতে PER ও TIM প্রোটিনের পরিমাণ সর্বোচ্চ হয় এবং PER/TIM ডাইমার নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করে তাদের নিজের সৃষ্টির কারণ CLK/CYC ডাইমারের কাজকে বন্ধ করে দেয় ফলে tim ও per জিনের ট্রান্সক্রিপশন বন্ধ হয়ে যায় এবং এভাবে ২৪ ঘন্টার চক্রের ছন্দময়তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এই লুপটি আবার CLK প্রোটিনের মাধ্যমে দ্বিতীয় লুপের সাথে যুক্ত। CLK/CYC ডাইমার per ও tim জিনের পাশাপাশি vrille ও pdp1ɛ (Par domain protein 1ɛ) নামক আরোও দুটি জিনের ট্রান্সক্রিপশন ঘটায়। এই জিন দুটি যথাক্রমে VRI নামক ঋনাত্মক ও PDP1ɛ নামক ধনাত্মক ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর তৈরি করে যারা আবার clk জিনের ট্রান্সক্রিপশন নিয়ন্ত্রণ করে। PDP1ɛ প্রোটিন clk জিনের ট্রান্সক্রিপশন শুরু করার মাধ্যমে CLK প্রোটিন উৎপাদন করে পুরো চক্রটির বারবার আবর্তন বজায় রাখে।
এই দুটি লুপ একত্রিত হয়ে একে অপরের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি করে।
ব্যাপারটি সহজভাবে বললে, জিনের ছন্দময় ট্রান্সক্রিপশন RNA এর ছন্দময় উৎপাদন করে, আর ছন্দময় RNA উৎপাদন প্রোটিনের ছন্দময় উৎপাদন ঘটায়। এই প্রোটিন আবার নিজের জিনের ট্রান্সক্রিপশন নিয়ন্ত্রণ করে ২৪ ঘন্টার একটি লুপ নিয়ন্ত্রণ করে, যা দিনব্যাপী জীবের ব্যবহারের ছন্দময়তা ঘটায়। পোস্টের সাথে সংযুক্ত ছকটি দেখলে লুপের পুরো ধারণাটি নিশ্চয়ই স্পষ্ট হবে।
এই সার্কাডিয়ান ফিডব্যাক লুপটি বাহ্যিক পরিবেশের উদ্দীপনার উপর নির্ভরশীল না হলেও পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট আলো-অন্ধকারে র ২৪ ঘন্টার চক্র ও তাপমাত্রা এই লুপটিকে প্রভাবিত করে।। যেমন, cryptochrome বা cry জিন সংশ্লেষিত নীল আলো সংবেদী CRY, সকাল বেলায় সূর্যালোক দ্বারা সক্রিয় হয়ে TIM প্রোটিনের ক্ষয় করে ফেলে। ফলে PER/TIM ডাইমার আলাদা হয়ে যায়, তখন এদের অনুপস্থিতিতে clk ও cyc জিন আবার সক্রিয় হয়ে যায় এবং আবার per ও tim জিনের ট্রান্সক্রিপশন শুরু করে এর ফলে আরেকটি প্রায় ২৪ ঘন্টার সার্কাডিয়ান রিদমের শুরু হয়।
ড্রসোফিলার সার্কাডিয়ান রিদমের আলোচনা থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে মানুষেও কি একইরকম অন্তর্জাত প্রক্রিয়া ঘটে? উত্তর হলো, হ্যাঁ। প্রতিদিন ২৪ ঘন্টায় মানুষের জেগে থাকা ও ঘুমানোর যে আবর্তন, খাদ্যগ্রহণ, দেহে হরমোন নিঃসরণ, বিপাকসহ নানাবিধ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় সার্কাডিয়ান রিদমের প্রত্যক্ষ জোরালো প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ড্রসোফিলার সার্কাডিয়ান রিদমের বিশ্লেষণকে এক্ষেত্রে একটি মডেল হিসেবে ধরা যেতে পারে। মানুষের সাথে ড্রসোফিলার সার্কাডিয়ান রিদমের জিনগুলোর ব্যাপক সাদৃশ্য আছে এবং কাজও প্রায় একই তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য ব্যবধান আছে। মানুষ অর্থাৎ স্তন্যপায়ীরা এবং এই ড্রসোফিলারা যেহেতু দুটি ভিন্ন পর্বের প্রাণি স্বাভাবিকভাবেই কিছু ব্যবধান তো থাকবেই।
তাই মানুষসহ অন্যান্য জীবের সুষ্ঠু শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে সার্কাডিয়ান রিদমের বিস্তর প্রভাবকে আমলে নিয়ে এই সার্কাডিয়ান রিদমের পেছনের আণবিক ক্রিয়াকলাপ উদঘাটনে ব্যাপক অবদানের জন্যে ২০১৭ সালে Physiology or Medicine ক্যাটাগরিতে Jeffrey Connor Hall, Michael Rosbash ও Michael Warren Young কে নোবেল পুরষ্কার প্রদান করা হয়।

লেখকঃ অমিত চৌধুরী  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম