টেলিপ্যাথি

টেলিপ্যাথি

আমেরিকান একটা হাসপাতালের ঘটনা ।
এক ভদ্র মহিলা হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছেন । রিসিপশনে এসে তিনি জোসেফ নামে কাউকে খুঁজছেন । জোসেফের বয়স আনুমানিক ৪০ । তিনি বারবার জিজ্ঞেস করছেন জোসেফ নামে কেউ এই হাসপাতালে এক্সিডেন্ট করে ভর্তি হয়েছে কিনা । রিসিপশনিস্ট জানাচ্ছেন জোসেফ নামে কেউ এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে আসেনি ।
কিন্তু ভদ্রমহিলা নাছোড়বান্দা । তিনি ভালোকরে খুঁজতে বললেন রেজিস্টার খাতা । কিন্তু সেই খাতা খুঁজেও জোসেফ নামে কোন রোগিকে পাওয়া গেলো না ।
ভদ্রমহিলা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসতে যাবেন এই সময় একটা এম্বুল্যান্স এসে দাঁড়ালো হাসপাতালের নামে । এম্বুল্যান্স থেকে রক্তাক্ত একটা শরীর বের করে স্ট্রেচারে করে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইমার্জেন্সির দিকে । এক্সিডেন্টে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া সেই শরীরটা আর কারো নয় । সেটা ছিল জোসেফের ।

(মূল গল্পে আসা যাক)
ভদ্র মহিলার নাম ক্যারোলিন । একটা সময় তিনি ছিলেন জোসেফের প্রেমিকা । গভীর সম্পর্ক ছিল তাঁদের মধ্যে । জোসেফের একটা বদভ্যাস ছিল এই যে সে অতিরিক্ত মদ পান করতো । অনেক বলে কয়েও তাকে মদের নেশা থেকে দূরে রাখা যায় নি । অনেকটা ঝগড়া করে রিলেশন চুকিয়ে ফেলতে হয় তাঁদের ।

ক্যারোলিন বিয়ে করে নেয় একজন ইঞ্জিনিয়ারকে । ৩৮ বছর বয়সী ক্যারোলিনের ঘরে দুটো সন্তানও আছে । অপরদিকে ক্যারোলিনের শোকে জোশেফ হয়ে যায় ছন্নছাড়া । ক্যারোলিন চলে যাওয়ার পর অনেক মেয়ের সাথে শুলেও মন থেকে ক্যারোলিনকে সে কখনোই সরাতে পারেনি ।
এইদিকে অভিমান নিয়ে জোসেফের সাথে ব্রেকাপ করলেও সেই মদ্যপ ছেলেটাকেই ক্যারোলিন এখনো ভালোবাসে । সারাটাদিন জোসেফের কথা চিন্তা করে ক্যারোলিন । তবে স্বামী আর সন্তানদের কথা ভেবে তার সাথে আর নতুন করে যোগাযোগ করে না । চাইলেও তার খবর নেয় না অথবা নিতে পারে না ।
ক্যারোলিন কিভাবে জেনেছে জোসেফ এক্সিডেন্ট করেছে কিনা । কেন হাসপাতালে ছুটে এসেছিল সেই ব্যাখ্যা একটু পরেও দেয়া যাবে । পাঠক তার আগে আমরা টেলিপ্যাথির ব্যাপারে একটু জেনে নিই ।

টেলিপ্যাথি হচ্ছে এক মস্তিস্ক থেকে অন্য মস্তিস্কে কোন মেসেজ প্রেরন করা । অথবা মগজ থেকে মগজে চিন্তা ভাবনার আদান প্রদান করা । ব্যাপারটা যাদের মধ্যে ঘটে তারা এটা সম্পর্কে অবগত থাকতেও পারে । আবার নাও থাকতে পারে । দুজন মানুষ সচেতনভাবে এই মেসেজের আদান প্রদান করতে পারে আবার অবচেতনভাবেও এই আদান প্রদান চলতে পারে ।
বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের জীবনেও এই টেলিপ্যাথির ঘটনা আছে । টয়েনের স্ত্রীর নাম ছিল লিভি । লিভির সাথে টোয়েনের সম্পর্কটা ছিল ভালোবাসায় পরিপূর্ন । মার্ক বলেছেন স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্ক এতোটাই গভীর ছিল যে একটা নতুন লাইনের অর্ধেক মার্ক নিজে বলে দিলে তার স্ত্রী একদম ঠিকভাবেই পরের অংশটা বলে দিতেন । মানে হলো মার্ক টোয়েন লেখার সময় নিজের মগজে যে চিন্তাটা করতেন তার স্ত্রী সেটা আগে থেকেই পড়ে নিতে পারতেন ।
স্ত্রীর জন্য যদি কখনো তার অস্থিরতা তৈরি হতো তখন মার্ক বুঝতে পারতেন তার স্ত্রীও তার জন্য অস্থির হয়েছেন । অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এর ঠিক সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্ত্রীর চিঠি পেতেন মার্ক টোয়েন ।

ঘটনা এখানেই শেষ নয় । তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করতেন তিনি নিজে যা যা ভেবেছেন তার স্ত্রীও সেই কথাগুলোই চিঠিতে লিখে তাকে পাঠিয়েছেন ।
আজকের দিনে বিজ্ঞান বলছে আমাদের নিউরন অন্য একটা মগজের চিন্তা ভাবনা পড়ে নিতে পারে । ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে কম্পিউটার গুলো যেভাবে যুক্ত থাকে ভালোবাসার মানুষগুলোও আমাদের মস্তিস্কের নউরনের সাথে ঠিক সেভাবেই যুক্ত থাকে । তারা একজন আরেকজনের ভাবনা গুলো পড়তে পারে । একজন আরেকজনের বিপদ আঁচ করতে পারে । একে অপরের অনূভূতি গুলো একদম ঠিক ঠাক পড়তে পারে । কোন কিছু না বলেও শুধু চোখের ভাষায় কথা চালিয়ে যেতে পারে ।

এই টেলিপ্যাথিক কমিউনিকেশনের কিছু লক্ষন আছে । যেমন -
১) দুজন মানুষ যখন ভালোবাসার মধ্যে থাকে তখন তারা মুখে কথা না বলেও একজন আরেকজনের অনূভূতি বুঝতে পারে ।
২) একজন আরেকজনের বিপদকে আঁচ করতে পারে । ঠিক যেমন ক্যারোলিন জোসেফের বিপদ আঁচ করতে পেরেছে যদিও তাঁদের মধ্যে কার্যত কোন যোগাযগই ছিল না ।
৩) বেশিরভাগ সময়ে তারা একই সময়ে একই চিন্তা ভাবনা করে । মানে হচ্ছে দুজন দুজনের জন্য একই সময়ে অস্থিরতা অনুভব করে । আপনি না চাইলেও কেউ যদি আপনার মনের মধ্যে ঢুকে যায় তাহলে বুঝবেন সেই সময়টা আপনাদের মধ্যে মেসেজের আদান প্রদান হচ্ছে । মনে মনে আপনি ওপাশের মানুষটা সম্পর্কে যা ভাবছেন তিনি ঠিক তাই ভাবছেন ।
৪) মুখে বলতে পারছেন না । কাউকে বুঝাতে পারছেন না । কিন্তু ঠিকই সেই স্পেশাল মানুষটা আপনার মগজের দরজায় হানা দিচ্ছে । মানে হচ্ছে তিনি এখন আপনার কথাই ভাবছেন । এবং সত্যিকার ভাবেই আপনার নিউরন তার দেয়া মেসেজগুলো সানন্দে গ্রহন করছে ।
৫) আপনার মাথায় তার কন্ঠটা বাজছে । আপনি নিজে থেকেই তার কথা ভাবছেন । এর মানে হলো আপনাদের মধ্যে ঠিক সেই সময়ে মেসেজের আদান প্রদান হচ্ছে । আপনি তাকে যা পাঠাচ্ছেন তিনিও তার উত্তর দিচ্ছেন । সেই কথাগুলোই আপনার মগজে বেজে চলেছে ।
৬) আচমকা কোন কারন ছাড়াই মন অস্থির হয়ে যাচ্ছে । কারো সাথে মন খুলে কথা বলেও অস্থিরতা যাচ্ছে না । এর মানে হলো ওপাশের মানুষটাও আপনার জন্য ঠিক সেই সময়েই অস্থির হয়েছে ।

শুধু যে কাপলদের মধ্যেই টেলিপ্যাথি থাকবে সেটা নয় । মায়ের সাথে ছেলের অথবা বাপের সাথে মেয়ের কিংবা দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যেও টেলিপ্যাথি থাকতে পারে । এই কারনে দেখা যায় মা সব সময় সন্তানের বিপদ আগে থেকে আঁচ করতে পারে । বাপ তার মেয়ের তার নিরাপত্তার জায়গাটা বোঝে ।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের যে রসায়ন বিধাতা তৈরি করে দিয়েছেন সেটা নিয়েই আজকে এতো এতো পেপার লেখা হচ্ছে । ভবিষ্যতে এই ব্যাপারে আরো তথ্য আমাদের হাতে আসবে ।

Writer: Arafat Abdullah
University Of Chittagong

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম