ভিসা হয়ে গেলে এবার ইন্ডিয়া যাওয়ার পালা। ভিসা এপ্লাই এর সময় এন্ট্রি বর্ডার সিলেক্ট করে দিতে হয়। যদি ট্রেনে যান তবে গেদে, বাই রোডে গেলে হরিদাসপুর, আর প্লেনে গেলে বাই এয়ার সিলেক্ট করে দিতে হয়। ট্রেনে বা বাসে গেলে কলকাতা হয়ে চেন্নাই যেতে হবে। ঢাকা থেকে শ্যামলী, গ্রিন লাইন, সৌহার্দ, দেশ ট্রাভেলস কিংবা সোহাগে যেতে পারেন। বাসগুলো নামাবে একেবারে কলকাতা নিউমার্কেট এর পিছনে মারকুইস স্ট্রিটে। হোটেল গুলো সব এখানেই।
এগুলো ঢাকা থেকে দুটি রুটে ছেড়ে যায় ।
একটি আরামবাগ > কলাবাগান > কল্যানপুর > সাভার > পাটুরিয়া হয়ে
আরেকটা মালিবাগ > উত্তরা > আব্দুল্লাহপুর > সাভার > পাটুরিয়া হয়ে বেনাপোল। সেখান থেকে বনগা হয়ে কোলকাতা মারকুইস স্ট্রিটে পৌছতে প্রায় সময় লাগে ১৫ /১৬ ঘণ্টা । মাঝে অবশ্য ২ ঘন্টা যাবে এপার-ওপার ইমিগ্রেশনে। বাস গুলো যাত্রীদের সুবিধার্থে খুব সকালে এবং বেশী রাতে এই দুই সময়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। ভাড়া মোটামোটি ১৫০০ থেকে ১৭০০ টাকার মতন। সাথে যোগ হবে ৫০০ টাকা ট্রাভেল ট্যাক্স।
আর বিমানে ভ্রমন করতে হলে ভিসাতে অবশ্যই বাই এয়ার থাকতে হবে। বাংলাদেশ বিমান, রিজেন্ট, ইউনাইটেড যেতে পারেন। আর ফিরতি পথে আরো যোগ হবে জেট এয়ার ওয়েজ, এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনও। ফ্লাইট টাইম এরাউন্ড ৪৫ মিনিট। নামবেন নেতাজী সুভাষ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে প্রি-পেইড টেক্সি করে চলে যাবেন মারকুইস স্ট্রিটে। ভাড়া নিবে নাইট টাইমে ২৭৫ টাকা, ডে টাইমে আরো কম। আর ডিরেক্ট ঢাকা চেন্নাই ফ্লাইট আছে। চাইলে সেটাতেও যেতে পারেন। সময় লাগবে ২.৩০ ঘন্টার মত।
আমি গিয়েছিলাম ট্রেনে। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে চলা মৈত্রি এক্সপ্রেসে করে। তবে অবশ্যেই সে ক্ষেত্রে আপনার ভিসায়
“গেদে” বর্ডার এনট্রি হিসেবে থাকতে হবে। ঢাকা ক্যান্টনম্যান্ট থেকে ছেড়ে যাবে সকাল ৮ টায় আর সন্ধ্যা ৭ টা নাগাধ আপনি পৌছে যাবেন চিতপুর স্ট্যাশনে। মাঝে দু পাড়ের বর্ডারে সময় যাবে ঘন্টা তিনেকের মত। দুইটি ট্রেন চলে সপ্তাহে ৬ দিন। একটি বাংলাদেশি রেক আরেকটি ইন্ডিয়ান রেক। ট্রেনের সময় সুচি ও ভাড়া নিচের লিংকে গেলেই মিলবে।
মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের ভাড়া ও সময়সূচি
চিতপুর থেকে অবশ্যই প্রিপেইড টেক্সি নিয়ে চলে যাবেন মারকুইস স্ট্রিটে। মুলত কলকাতায় বাংলাদেশীরা যে যায়গাটায় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি ভির করে সেটা হল মারকুইস স্ট্রিট।
এবার নিজের ইন্ডিয়া যাওয়ার দিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার পালা। আমি খুব ভোরে চলে যাই ক্যান্টনমেন্ট স্ট্যাশনে। সেখানে বিশাল লাইন ধরতে হয় আমাকে। একটু একটু করে লাইন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আমিও এগুই। মাঝে ব্যাগেজ চ্যাকিং হয়। পাসর্পোট-টিকেট দেখিয়ে একে একে আমরা সবাই প্ল্যাটফরমে ঢুকি। বলে রাখা ভাল আমি আম্মুর চিকিৎসার জন্য যাই। ট্রেন সময় মতই ছেড়ে যায়। কোথাও কোন স্টপেজ নাই। ২ টা নাগাদ দর্শনা পৌছে যাই।
সেখানে বাংলাদেশি পার্টের ইমিগ্রেশন সাড়তে সময় নেয় ঘন্টা খানেকের মত। যাওয়ার সময় এপারে ব্যাগেজ নিয়ে নামতে হয় না। এই অংশে তাড়াহুড়া করার কিচ্ছু নাই। আপনাকে রেখে ট্রেন যাবে না। সো আগে করলেও বসে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে ধিরে সুস্থে কাজ শেষ করাই ভাল। কাজ বলতে একটা ছোট ফরমে নাম-ঠিকানা সহ কিছু ইনফরমেশন লিখে লাইন ধরে অপেক্ষা করবেন। আপনার র্টান এলে কাগজটা সহ পাসপোর্ট জমা দিবেন ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে। উনি সব দেখে একটা সিল মেরে দিবে। ব্যাস কাজ শেষ। এবার ট্রেনে উঠে অপেক্ষায় থাকতে হবে গেদে পৌছানোর জন্য। ১৫-২০ মিনিট সময় লাগবে।
ট্রেনটা যখন বাংলাদেশের শেষ সীমানা পার করলো সাথে সাথে শরীরটা কেমন যেন করে উঠলো। কোন এক অজানা অনিশ্চয়তায় গাটা কেঁপে উঠলো। মনে হতে লাগলো এ বাতাস আমার নয়। এই বাতাসে নিঃশাস নিতে গেলেও আমার অনুমতি নিতে হবে। পায়ের নিচের মাটিতে আমার আমার ভাবটা আর নাই।
দর্শনা ইমিগ্রেশন পার করে দুপুর ৩.৩০টা নাগাদ গেদে স্টেশনে পৌছালাম। এখানে ব্যাগপাতি সব নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে লাইন ধরে ইমিগ্রেশনে ঢুকতে হয়। খুব সুন্দর সিস্টেম। সবাই সুন্দর করে লাইন মেইনটেইন করে এগুচ্ছে। ভাবতেই ভালো লাগে নিয়ম ভেঙে যে জাতির সবচেয়ে বড় আনন্দ সেই কিনা আজ নিয়মের পূজারী। খারাপ বিষয়ের মধ্যে ছিল শুধু ইমিগ্রেশনে ১০০ টাকা ঘুষ দেয়া। তবে ইমিগ্রেশনের মানুষগুলো সবাই খুব হেল্পফুল। যে কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে রিপ্লাই দেয়। যে বিষয়টি আমার সবচেয়ে নজর কেরেছে তাহলো সিনিয়র সিটিজেনদের প্রতি এদের শ্রদ্ধা।
এবার আসি সহ যাত্রীদের বিষয়ে। বেশির ভাগই বাংলাদেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বেশ কিছু ইন্ডিয়ান বাঙালিও ছিল। ভাষা সেইম। বাট একসেন্টে কি বিস্তর তফাৎ। শুনতে ভালোই লাগে ওপার বাংলার এক্সসেন্ট। ট্রেনের মধ্যে বাংলা টাকাই চলে। অবশ্য রুপি এক্সচেঞ্জ এর কোন সুযোগ এখানে নেই। এই সব কাজ গুলো ট্রেনে গেলে কলকাতাতেই করতে হয়।
রবিন্দ্রনাথ বাঙালির ভুঁড়ি নিয়ে কেন লিখেছিলেন সেটা গেদের পুলিশ না দেখলে জীবনেও বুঝতাম না। ইনাদের দৈর্ঘ্য প্রস্থ সমান বললেও ভুল হবে না। চোখে মুখে দেখলেই বোঝা যায় ইনারা অনেক সুখী। ভুঁড়ি অবশ্য তারই লক্ষণ।
গেদে থেকে ট্রেনে কলকাতা যেতে সময় লাগে ২ঘন্টার মতো। কলকাতা, এ এক আজব শহর। চারপাশের মানুষগুলো শুধু অপেক্ষায় আছে কিভাবে মেরে দুইটা টাকা বেশি খাওয়া যাবে। টেক্সি ড্রাইভার থেকে শুরু করে হোটেলওয়ালা, খাবার দোকানের লোক, এমনকি সিম কিনার দোকানের লোকটাও। সবগুলো মানুষ উৎ পেতে আছে। শহরে নতুন চিড়িয়া আসবে আর ঘাড় মটকে খাবে। তাই এসব থেকে সাবধান। শুরুতেই ফ্যাসাদে পরতে হবে চিতপুর থেকে মারকুইস স্ট্রিটে যেতে। বাইরের অটোওয়ালাদের সাথে কথায় পারবেন না। ওরা আপনাকে সেকেন্ডে কয়েকবার বেচে দিবে। তাই প্রি-পেইড টেক্সি করে যাওয়াই ভালো। এটলিস্ট সারা শহর ঘুরিয়ে বিল তুলার সুযোগ নাই।
তারপর দেখে শুনে মারকুইস স্ট্রিটে একটা হোটেলে উঠে যাবেন। আমি ছিলাম হোটেল এলিটে। ট্রিপল বেড রুমের ভাড়া নিয়েছিল ১৮০০ রুপি। পাশেই হোটেল টাইমস, সম্রাট, ওরিয়েন্টাল, ভিআইপি, ডিকে। যে কোন একটায় উঠে যেতে পারেন।
কলকাতায় গিয়েই প্রথম কাজ মানি এক্সচেঞ্জ করা। এক্সচেঞ্জ গুলো মারকুইস স্ট্রিটেই। অনেক গুলা আছে। যে কোন একটা থেকে ভাংগিয়ে নিবেন ডলার। রেটটা আগেই যাচাই করে নিবেন। DK হোটেলের সামনেরটা ভালো রেট দেয়। আমি ওদের কাছ থেকেই এক্সচেঞ্জ করি। তবে অবশ্যই পাসপোর্টের এন্ডর্স সম পরিমানের রিসিপ্ট নিবেন। ফিরার সমসয় ইমিগ্রেশনে চাইতে পারে।
এবার আসি খাবার দাবার এর ব্যপারে। কোলকাতার খাবার হোটেল গুলোর খাবারের মান অনেক ভালো। দামও ঢাকার মতোই। বিদেশি বলে কেউ কেউ একটু বেশিও চায়। এখানে সাদা ভাত থেকে বিরিয়ানী সবই বলতে গেলে বাসমতি চালের। ভেজ খাওয়াতে এরা উস্তাদ।যত রকম সবজি আছে সব ঘেটে এক অদ্ভুত রকমের ভেজিটেবল বানায়। খেতেও খারাপ না।নাস্তা শেষে মাটির পেয়ালায় চা খাবারটাকে একটা ফিনিশিং টাচ দেয়। প্রচন্ড রকমের খাবার প্রিয় মানুষ আমি। তাই কলকাতার খাবার আমার কাছে ভালোই লেগেছে। যে কয়টা হোটেলে খেলাম একটার চেয়ে আরেকটা ভালো।দাওয়াত রেস্টুরেন্ট এর মধ্যে বেস্ট। কস্তুরীও কম যায় না। রাধুনীও ফেলনা না।
এবার আসি সেখানকার স্থানীয় মানুষ কেমন সেইটা নিয়ে। আমি যতটুকু দেখলাম তাতে মনে হলো এরা বিশ্ব বাটপার। কলকাতার মানুষ যে বাটপার ঐটা নিজেরাই নিজেদের বলে। আর বাটপারি সবচেয়ে বেশি মার্কুইস স্ট্রিটে, যে জায়গাটাতে বাংলাদেশিরা সব উঠে। তবে মজার ব্যাপার হল, মনে করেন আপনি যদি কলকাতা থাকেন আর আপনার পরিচিত কেউ যদি একই সময়ে কলকাতা থাকে তাহলে কোন রকম যোগাযোগ ছাড়াই আপনাদের মার্কুইস স্ট্রিটে দেখা হতে বাধ্য। কলকাতার ভিতরে ছোট্ট ঢাকা শহর বলা চলে। বাকি এরিয়া গুলোতে বাটপারি কম, মানুষও তুলনামূলক ভাবে অনেক ভালো।
আরেকটা বিষয় লক্ষ করলাম কলকাতার স্থানীয়রা যেকোনো কারণেই হোক নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে বাগচিত করে আমাদের সামনে। ভাবটা এমন যে কথাবার্তাতেই বুঝিয়ে দিতে চান যে তোমরা যেখানে আসছো সেটা ইন্ডিয়া। থোৱা থোৱা বাংলা ছাড়েন। বহত বহত হিন্দি।
যেহেতু আমাদের যাওয়ার মুল গন্তব্য চেন্নাই সেহেতু কলকাতাতে দেরি করে লাভ নাই। বাসে কলকাতা গেলে দুপুর নাগাধ পৌছে যাবেন। তবে ২.৩০ এ চেন্নাইয়ের উদ্ধেশ্যে ছেড়ে যাওয়া করমন্ডল এক্সপ্রেস ধরা কঠিন। আমি ট্রেনে গিয়েছিলাম যেহেতু , তাই কলকাতা পৌছি সন্ধ্যায়। সে ক্ষেত্রে রাতের চেন্নাই মেইল ধরা যায়। ট্রেন ছাড়ে রাত পৌনে বারটায় হাওড়া জংশন থেকে। আর রাতের ট্রেন ধরলে হোটেলে উঠা লাগে না। বেচে যাবে হোটেল ভাড়াও। আর রাতের ট্রেনে না যেতে চাইলে পরের দিন ২:৩০ এ হাওড়া থেকে করমন্ডল অথবা সাত্রাগাছি স্ট্যাশন থেকে সন্ধ্যা ৭.৩০ এ সাত্রাগাছি সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস আছে। মোটামুটি সবগুলো ট্রেনই ২৮ ঘন্টার মত সময় নেয় চেন্নাই পৌছাতে। সে মতে পৌছার টাইম ক্যালকুলেট করে নিতে পারেন। ট্রেনের টিকেট চাইলে মারকুইস স্ট্রিটের ট্রাভেলি এজেন্সি গুলো থেকে করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা পার টিকেট বেশি গুনতে হবে। আর নইলে চলে যাবেন ফেয়ারলি প্লেস নামক জায়গায়। সেখান থেকে টিকেট কেটে নিতে পারবেন। ট্রেনে কয়েক ধরণের সিটিং এরেন্জমেন্ট আছে। নন এসি স্লিপার, থ্রি টায়ার এসি, টু টায়ার এসি, ওয়ান এসি। টিকিটের দাম যথাক্রমে ৬৬৫, ১৭৪৫, ২৫৪০, ৪৩৬৫ রুপি।
আর একটা মাধ্যম হলো প্লেন। ইন্ডিয়ায় ডমেস্টিক ফ্লাইটের ভাড়া খুব বেশি না। ট্রেনের টু টায়ার এসির থেকে কিছুটা বেশি পরবে যদি কয়েকদিন আগে মারকুইস স্ট্রিটের ট্রাভেলারদের থেকে টিকেট কাটতে পারেন। ওরা অনেক রকম অফার পায়। এসবের মধ্যে পরলে ৩৫০০ থেকে ৪৫০০ এর মধ্যেই মিলবে কলকাতা-চেন্নাই ফ্লাইট টিকেট। বিশেষ করে খুব সকালে কিংবা রাতের ফ্লাইট গুলোর। আর ভাগ্য খারাপ থাকলে ৭০০০-৮০০০ রুপি গুনতে হবে। ইন্ডিগো, স্পাইসজেট, জেট এয়ার ওয়েজের ফ্লাইট আছে অনেক। এর মধ্যে আমি ইন্ডিগোতে ফেরার সময় ফিরি। সার্ভিস খারাপ না। সময় লাগে ২ ঘন্টার মত।
আমি মারকুইস স্ট্রিটের এজেন্ট আসলাম ভাইয়ের কাছ থেকে পরদিন সন্ধ্যা ৭.৩০ এর সাত্রাগাছি এক্সপ্রেসের টিকেট কেটে নেই। কথাবার্তায় লোকটাকে ভালো লাগছে। আর সাচ্ছা মুসলমান। কথার বরক্ষেলাপ করে না। রাতে হোটেলে থেকে পরদিন কলকাতা কিছুটা ঘুরে বিকালে চলে যাই সাত্রাগাছি স্ট্যাশনে।
ইন্ডিয়ান রেলে সুপার ফাস্ট ট্রেনের আসল রহস্য হলো ইলেক্ট্রিক সিস্টেম। আমি যে ট্রেন এ চেন্নাই যাবো সেটার ফুলস্পিড নাকি ঘন্টায় ১৫০কিমি, এভারেজ ৬০কিমি+। মাঝে স্টপেজ আছে ২১ টা। এর মাঝে বিসাখাপথনামও আছে। ছোট বেলায় যখন ইন্ডিয়ার খেলা দেখতাম তখন সৌরভ গাঙ্গুলি বলতো "বাইরে থেকে টিম আসলে প্রথম ওখানে নামায়ে দেও। গরমে সব স্ট্যামিনা ফুরিয়ে গেলে পরের ম্যাচ গুলো এমনেই হেরে যাবে। " আমি সেই বিশাখাপথনাম নিয়ে খুবই এক্সাইটেড ছিলাম! কেমন হবে তার আবহাওয়া! কেমন তার পরিবেশ!
ঠিক সাড়ে সাতটায়ই ট্রেন ছাড়ে। পাশে এক পাঞ্জাবি আর এক তামিল নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয়। কি কয় নিজে নিজে কিছুই বুঝিনা। ভাষা কত কিছু বদলে দেয়।ট্রেনে গল্প হয় এক সদ্য বিবাহিত বাঙালি কাপলের সাথে। ছেলেটার মা বাংলাদেশি। ৭১ এ স্বামীর হাত ধরে চলে এসেছে এপার বাংলায়। ওদিকে মামারা সব সম্পদ দখল করে নিয়েছে মায়ের ডেথ সার্টিফিকেট দেখিয়ে।ছেলেটার মা এখনো কাঁদে দেশের কথা মনে করে। এ নিত্য দিনের গল্প। এপার বাংলার হাজারো পরিবারের গল্প।
ট্রেনের খাবার নিয়ে অনেক কাহিনী শুনেছি। খাবার যতটা অখাদ্য মানুষ বলে ততটা না। খাওয়া যায়।আমি রাইস আর ভেজিটেবল অর্ডার করি রাতের জন্য। রাইসটা ভালোই। ভেজিটেবলে চিজ দেয়া।কামড়ে পড়লে কেমন জানি লাগে।কিন্তু যখনই নতুন একটা প্যাকেট খুলে খাবারের সাথে মিসালাম তখনই স্বাদটা কেমন জানি টক টক হয়ে গেলো। তবুও খারাপ লাগে নাই।
আসলে আমি আবার কোন খাবারকেই খারাপ বলতে পারিনা। এতো গেলো খাবারের কথা।
এবার আসি ট্রেনে শোয়া নিয়ে। ট্রেনের বিভিন্ন টায়ারে মানুষ ঘুমানোর দৃশ্যতা সত্যি সুন্দর। একেবারে উপরের টায়ারে শুয়েছিলাম আমি। খারাপ না। খুব ভাল ঘুম হয়েছিল।
পরদিন সকালে ট্রেন বিশাখাপথনাম পার হচ্ছিল। প্রচণ্ড গরমের যে গল্প শুনেছিলাম তা ডিসেম্বরের শুরুর দিকে একে বারেই টের পেলাম না।ভালোই শীত পড়েছিল সেই দিন। আর সকালের আলোতে ঝকঝকে চারপাশ। নাস্তা সারি ট্রেনেই। ব্রেড বাটার আর কাকলেট।
জীবনে একবার হলেও সুযোগ আসলে ভারতীয় ট্রেনে ভ্রমণ করা উচিত। ট্রেনে কাটবে আপনার একটা লম্বা সময়। দেখা হবে নানান ভাষার, নানান বর্ণের মানুষের সাথে। কথা হবে, কুশল বিনিময় হবে। হয়তো কেউ কারো কথা বুজবেন না। তবুও ইশারা আঙ্গিকে গল্প এগিয়ে যাবে অনেকক্ষন।
পাশের তামিল দিদিটা মাফলার বুনছে ট্রেনে উঠার পর থেকেই। লাল আকাশি কালারের মিশ্রনে মাফলার। মনে হচ্ছে পৌঁছার আগেই কাজ শেষ হবে। বাঙালি কাপলটা মোবাইলে সিনেমা দেখছে আর হাসছে। আরেক পাশে আলাপ করছে ৬-৭জন বাঙালি। বেশি মানুষ এক হলে কোন টপিক নিয়ে কথা হবে সেইটা কিন্তু বলাই যায়। হুম, রাজনীতি। কামরার উপরে কোন এক জায়গায় বাচ্চা কাঁদছে। একটু পর পর হরেক রকমের খাবার নিয়ে ঢুকছে হকাররা। ভয়ে অবশ্য এসব ট্রাই করা থেকে বিরত আছি।
ট্রেন দুপুর নাগাধ অন্ধ্র প্রদেশ পার হচ্ছিল । নাম টা অন্ধ্র হলেও প্রদেশটা আমাদের দেশের ৪-৫ টা গ্রামের মতোই। যত দূর চোখ যায় শুধুই ফসলের ক্ষেত। ধানই এখানে মূলত বেশি চাষ হয় যা বুঝালাম।
দীর্ঘ ২৮ ঘন্টা ট্রেন জার্নি । অলমোস্ট ১৭০০ কিলোমিটার। এতো বড় জার্নি আমাদের দেশে কল্পনাই করা যায় না। চেন্নাই আসার পর প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো স্ট্যাশন থেকে হোটেলে যাওয়া। চারপাশের অটোওয়ালারা ঘিরে ধরবে এক্কেবারে। পিছ পিছ ঘুরতে থাকবে। আপনি কথাই বলতে পারবেন না কারো সাথে। ল্যাঙ্গুয়েজ বেরিয়ার তো রয়েছেই। আগে থেকে হোটেল বুকিং দেয়া থাকলে সুবিধা। সেটা হলে স্টেশন থেকে প্রিপেইড টেক্সি করে ডাইরেক্ট হোটেলে ফিরা যায়। কোন ঝামেলা থাকে না। কারণ রোড মেপে ভাড়া আগেই দিয়ে দিবেন। অতিরিক্ত ঘুরিয়ে বেশি নেয়ার কোনো চান্স থাকে না। আর বুকিং না থাকলেও প্রব্লেম নেই। যারা এপোলো কিংবা সংকরে আসেন মোটামুটি সবাই গ্রিমস রোড, মডেল স্কুল রোডেই উঠেন। অটো নিয়ে গ্রিমস রোডে চলে আসলে হাজারটা হোটেল, লজ দেখে উঠতে পারবেন নিজের পছন্দ মতো। আমি বেশ কয়েকটাতে ছিলাম। প্রথমে উঠেছিলাম মডেল রেসিডেন্সে। এইটা মডেল স্কুল রোডের উপর। ৪ জন থাকার রুম। বিশাল বড়। রান্না করে খাওয়ার ব্যাবস্থা আছে। হাড়ি-পাতিল, প্লেট, জগ, গ্লাস সবই মিলবে। রান্না হবে সিলিন্ডার গ্যাসে। আর খাবার পানির জন্য একটা বড় ২০ লিটারের জার কিনে নিবেন। দাম পরবে ৬০-৭০ রুপি। আমার এখানে ভাড়া দিতে হতো ৯০০ টাকা পার ডে।
ঝড়ের পর লজ চেঞ্জ করে উঠলাম হোটেল হোম স্টে ইন এ। এটা আগের টা থেকে ভাল। রান্নার ফ্যাসিলিটি এইটাতেও আছে। সাথে থাকবে ফ্রি ওয়াই ফাই আর ৩২ ইঞ্চি টিভি। এই হোটেলে ম্যানেজার বাংলা জানেন। তিনি আসামের লোক। মানুষও খুব ভাল। ভাড়া পরেছে ৮৫০ রুপি পারডে। এর আশে পাশে অনেক লজ , হোটেল আছে। এই এলাকা থেকে চেন্নাই এপালো ১ কিমি। হেটে যাওয়া যায়। আর সংকর নেত্রালয় ২ কিমি। অটোতে গেলে ৪০-৫০ রুপি নেয়। আপনি চাইলে গ্রিমস রোডের উপরও হোটেলে উঠতে পারেন। সেক্ষেত্রে অলিভ গ্যান্ডি ভাল অপশন। ডাবল বেড রুম ভাড়া পরবে ১২০০। আর উপরের ফ্যসিলিটি গুলো সবি পাবেন।
এই এলাকার মানুষ কিছু বাংলা পারে। আপনার সাথে কথা বলানোর জন্য মোটামোটি সব হোটেল লজ গুলোতেই বাংলা বুঝে এমন লোক রাখা আছে। এদের আসাম কিংবা উড়িষ্যা থেকে আনা হয়েছে। সুতরাং ভাষা গত সমস্যায়ও খুব একটা পড়তে হবে না। যদিও স্থানীয়রা বাংলার 'ব' টাও বুঝে না। একবার হোটেলে উঠে গেলে আর চিন্তা নেই।
আমি যখন চেন্নাই সেন্ট্রাল স্ট্যাশনে পৌছি তখন রাত সাড়ে এগারটা। অচেনা শহরে এতো রাতে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলাম। তার উপর আম্মু সাথে ছিল। ট্রেনে এক বাঙ্গালী পরিবারের সাথে পরিচয় হয়েছিল তাদের সাথেই স্টেশন থেকে হোটেল পর্যন্ত আসলাম। এই মধ্যরাতেও হোটেল পেতে সমস্যা হয় নি। নিজেরা দেখে শুনে একটাকে উঠে পড়ি। প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিলাম সেদিন। ২৮ ঘন্টার জার্নির দখল কাটাতে লম্বা ঘুম দিয়েছিলাম। পরের দিন আম্মু সংকর নেত্রালয়ে এপয়েনমেন্ট ছিল।
Oliur Rahman