অসাম্প্রদায়িকতাঃ আমরা সবাই মানুষ



আমরা মুসলমানরা হিন্দুদের "আসসালামু আলাইকুম" বলি, তারাও ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে। "কেমন আছেন" জিজ্ঞেস করলে অনেকেই "আলহামদুলিল্লাহ " বলে। আজানের সময় অনেক হিন্দু মেয়েরাই মাথায় কাপড় দেয়, ম্যাক্সিমাম হিন্দুই গান শোনা বন্ধ করে দেয়। রমজানে লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার খায় যাতে আমরা দেখলে আমাদের রোজা হালকা না হয়। সেহেরিতে উঠতে না পারলে ডেকে দেয়, ইফতারে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে।আজানের সময় অনেক পূজামণ্ডপে সাউন্ড সিস্টেম বন্ধ রাখে। এগুলা করার জন্য ওদের জোর করতে হয় না। মন থেকে করে। আমাদের ধর্মকে সম্মান করে বলেই করে।
হিন্দু স্যার ম্যামকে আদাব দিলেই যেমন আমরা হিন্দু হয়ে যাই না তেমনি হিন্দু বন্ধুর সাথে মিশলে, এক প্লেটে খাবার খেলেই আপনি হিন্দু হয়ে যাবেন না। আপনি যদি আপনার ধর্ম সম্পর্কে খুব সচেতন থাকেন তাহলে আপনার ধর্মে যতটুকু মিশতে,যা করতে মানা আছে তা করবেন না। ব্যাস।
কোনো ধর্মেই বলা নেই অন্য ধর্মকে ছোট করে দেখো। সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক বা লঘিষ্ঠ সবার কাছে সবার ধর্ম সমান। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার সবার আছে।
আমাদের কাছে গরু, খাসি,দুম্বা জবাই যেমন কোরবানি, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, রোজা রাখা যেমন ত্যাগ ওদের কাছেও মাটির তৈরী মূর্তি পানিতে ভাসিয়ে দেওয়াটাও অনেক বড় একটা ত্যাগ। আপনি অন্য ধর্ম নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে পারেন না। আমার জানামতে প্রায় প্রত্যেক হিন্দু বন্ধু বান্ধবীই জীবনে একবার হলেও এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়
"গরুর দুধ খাও ঠিক ই, মাংস খাও না কেন?" আমি জানি অনেকে অনেক বিকৃত করে এই প্রশ্নটা করে। আমি আমার ধর্ম নিয়ে সচেতন থাকলে অন্য ধর্ম নিয়ে কটু কথা বলব কেন?
মানুষ কিছু জায়গায় বিবেক নয়, আবেগ দিয়ে বিচার করে।
যেমন - ধর্ম, খেলাধুলা, চিকিৎসা। তাই এসব ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই কিছু মানুষ একপ্রকার তেড়ে আসে। ধর্ম সবার কাছে সেন্সিটিভ বিষয়। আমাদের কারোরই উচিত না অন্য ধর্মকে ছোট করে দেখা, অন্য ধর্মের মানুষকে খুঁচিয়ে কথা বলা, তিরস্কার করা। কিন্তু ছোট থেকেই যখন একটা বাচ্চাকে শিখানো হয়, "হিন্দুরা মালো। ওদের সাথে মিশবি না। বন্ধুত্ব করবি না। হিন্দুরা কখনো ভালো বন্ধু হতে পারে না " এই বাচ্চাগুলো বড় হয়ে কি করে অন্য ধর্মকে সম্মান করবে? প্রায়ই আমার হিন্দু বন্ধুদের কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়,
"মাটি দিয়ে মূর্তি বানায়া আবার পানিতে ফেলে দাও, এই মূর্তি কি কোনো কাজের?"
"বিদ্যার দেবির কাছে বই রাখলে যদি ভালো রেজাল্ট হয় তাহলে পড়াশোনা করার কি দরকার? "
"তোমরাও তো জানো ইসলাম একমাত্র পবিত্র ধর্ম। তাহলে ফালতু ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকো কেন?"
আমার ছোট মাথায় কখনো ঢুকে না আসলেও কি এই প্রশ্নগুলো করা যৌক্তিক? যাকে জিজ্ঞেস করছেন সে কষ্ট পাবে না? কোথাও কি বলা আছে অন্য ধর্মের মানুষকে কষ্ট দিয়ে কথা বলো?
ক্রিকেটার লিটন দাস আর সৌম্য সরকার খারাপ খেললেই কিন্তু আমরাই ফেইসবুকে পোস্ট করি, কমেন্ট করি,
"ওই শালা মালাউনের বাচ্চা। ওকে দল থেকে বের করে দেওয়া হোক। শালা শূকর খায়। আরও কত কি!"
মুসলমানরা হিন্দুদের মালো বলে ডাকে, হিন্দুরা ডাকে জঙ্গি। এই জাতিবিদ্বেষ কবে শেষ হবে?
হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা যে একেবারেই শান্তিতে আছে তা কিন্তু নয়। ওদের উপর অত্যাচার হয়নি একথা আপনি বলতে পারেন না। নিচে কিছু তিক্ত সত্য ঘটনা তুলে ধরছি।
ডিসেম্বর 1992 সালে থেকে মার্চ 1993 পর্যন্ত সহিংসতার জের ধরে 28,000 হিন্দু ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে, 2,700 ব্যবসা এবং 3,600 মন্দির ও পূজার অন্যান্য স্থানে ধ্বংস করা হয়েছে। মোট ক্ষতির হিসেব 2 বিলিয়ন টাকা থেকে বেশি। 8 ডিসেম্বর, হিন্দু কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার হামলা চালানো হয়। মুসলমানদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত 14 হিন্দু মন্দির, তাদের আট জন দগ্ধ হয় ।চট্টগ্রাম জেলায় ফটিকছড়ি এবং মিরসরাই গ্রাম সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়া হয়। পঞ্চানন ধাম এবং তুলসী ধাম সহ পাঁচ হিন্দু মন্দির আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চট্টগ্রামে ধাম হিন্দু মহিলাদের অপহরণ করা।প্রথম কমেন্টে লিংক দিয়ে দিচ্ছি।
পূর্ণিমা শিলের কথা মনে আছে? ১৩ বছরের হিন্দু মেয়েটা। তাকে যে গণধর্ষণ করা হয়েছিল? তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।তার বড় ভাইকে পিটিয়ে চোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিছু টাকা তার বাবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মামলা খালাস করতে বলা হয়েছিল। এই ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। ২০০৩ সালের ২০ জুন বিদেশি পত্রিকা The guardians এই নিউজ প্রকাশ করে।
"Nearly 30 people came to our house. I recognised many of them as my neighbours. They beat my mother almost senseless. I begged them to stop. They dragged me outside. I resisted but they hit me with sticks. I shouted to my sister to save me but they beat her too. I cannot tell you what happened next."
Purnima was gang-raped and her family found her unconscious three hours later in a field a mile from the village. Four young men, all supporters of the government and its coalition partner, the fundamentalist Jamaati-e-Islami party, were arrested but have not been charged.
আপনি গুগলে সার্চ দিলেই পাবেন কত মন্দির ভাঙা হয়েছে, বাড়ি,জমি দখল করা হয়েছে। এসব অস্বীকার করার উপায় নেই।
দেশের ভাবমূর্তি বাহিরের দেশের কাছে বহু আগেই নষ্ট হয়েছে। দিনেদুপুরে খুন, ঘুষ, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল, প্রতিদিন ধর্ষণ আর হত্যার এই মিছিলে দেশের ভাবমূর্তি যা নষ্ট হবার তা অনেক আগেই হয়েছে।
প্রিয়া সাহার অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উনি অনেককিছু বাড়িয়ে বলেছেন। নিশ্চয়ই উনার অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে আপনি ঢালাওভাবে বলতে পারেন না অন্য ধর্মাবলম্বীরা আসলেই সুখে শান্তিতে আছে। তারা আসলেই সুখে আছে কিনা সেটা তাদের মুখ থেকেই শুনুন। তাদের কিছু বলতে দিন। বাকস্বাধীনতা না দিয়ে হুট করেই আক্রমণ -প্রতিআক্রমণ করতে পারেন না।
মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মারমা সহ আরও যত উপজাতি আছে সবাইকেই আমি ভাই,বোনের মতো ভাবি। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি অন্ধকার রাস্তায়,নির্জন গলিতে আমার মুসলমান বোন যেমন আমার কাছে নিরাপদ তেমনি অন্য ধর্মের বোন ও আমার কাছে নিরাপদ।
"সে হিন্দু, তাকে রেইপ করে দিতে হবে, ওর পোশাক ভালো না"- এইসব চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি আমাদের ধর্ম ভালোভাবে মানতাম তাহলে দেশে এত ধর্ষণ,খুন হতো না।
ফেইসবুকে ধাওয়া পালটা ধাওয়া না করে আসুন নিজেরা ঠিক হই। আমাদের চিন্তা ভাবনা উন্নত করি। হাসপাতালে যেমন রক্ত লাগলে কে হিন্দু,কে মুসলিম না দেখেই রক্ত দেওয়া হয় রোগীর জীবন বাঁচাতে, অসুস্থ্য মায়ের বুকের দুধ না আসলে যেমন হিন্দু মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বাচ্চা বেঁচে যায় তেমনি দিনশেষে আমরা সবাই মানুষ। সবাই সবার ধর্মকে সম্মান করি।তাহলেই শান্তি ফিরে আসবে।

Jahirul Hoq Jabed

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম