মঙ্গল গ্রহের আটটি দর্শনীয় স্থান : ভবিষ্যতের মার্শিয়ানদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু



মঙ্গল হল বিশাল আগ্নেয়গিরি, গভীর গিরিখাত এবং গর্ত সম্বলিত গ্রহ। ভবিষ্যতের পর্যটকদের জন্য এটি একটি আশ্চর্যজনক স্থান হবে এবং মানুষ এই লাল গ্রহের উপনিবেশগুলিকে গতিশীল করে তুলবে। ভবিষ্যতের মঙ্গল মিশনের জন্য অবতরণ সাইটগুলি সম্ভবত নিরাপত্তা এবং ব্যবহারিক কারণে সমতল সমভূমি হতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রহ মঙ্গলে সবার আগে মানুষ পৌছানোর জন্য ইতিমধ্যেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। স্পেস এক্সের সিইও ইলন মাস্ক ২০৫০ সালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে ১০ লাখ মানুষের জন্য বসবাসযোগ্য শহর তৈরির ঘোষণা দিয়েছেন। আজকে বলব মঙ্গলের আটটি দর্শনীয় স্থানের কথা যেখানে ভবিষ্যতে মার্শিয়ানরা ঘুরে দেখতে পারবেন!


১. অলিম্পাস মনসঃ

এটি হলো সৌরজগতের সবচেয়ে চরম আগ্নেয়গিরি। নাসার মতে , এটি থারসিস আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি বাংলাদেশের আয়তনের দ্বিগুণ আকারের । ১৬ মাইল ( ২৫ কিলোমিটার) উচ্চতা যা পৃথিবীর মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার প্রায় তিনগুণ, যা প্রায় ৫.৫ মাইল ( ৮.৯ কিমি) উঁচু। অলিম্পাস মনস একটি বিশাল আগ্নেয়গিরি , যার লাভা আস্তে আস্তে তার উদগিরণ পরে গঠিত হয়েছিল। এর মানে হল পর্বতটি সম্ভবত ভবিষ্যতের অভিযাত্রীদের জন্য আরোহণ করা সহজ , কারণ এর গড় নমনীয়তা মাত্র 5 শতাংশ। এটা ৫৩ মাইল (৮৫ কি.মি.) প্রশস্ত । এটি ম্যাগমা চেম্বার দ্বারা গঠিত এবং লাভা পতন হওয়ার সময় একটি আকর্ষণীয় দৃশ্য তৈরি করে !


২. থারসিস আগ্নেয়গিরিঃ

যখন আপনি অলিম্পাস মন্সের চারপাশে আরোহণ করছেন, তখন থারসিস অঞ্চলের অন্যান্য আগ্নেয়গিরির দিকে তাকানো আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। নাসার মতে , থারসিস প্রায় ২৫০০ মাইল (৪০০০ কিলোমিটার) প্রশস্ত একটি অঞ্চল যা ১২টি বিশাল আগ্নেয়গিরি ধারণ করে আছে। অলিম্পাস মনসের মতো, এই আগ্নেয়গিরিগুলি পৃথিবীর তুলনায় অনেক বড় । মঙ্গলের দুর্বল মধ্যাকর্ষনের কারণে সেখানকার আগ্নেয়গিরি গুলো খুব লম্বা হয়। এই আগ্নেয়গিরিগুলি সম্ভবত দুই বিলিয়ন বছর ধরে বা মঙ্গলের ইতিহাসের অর্ধেক সময় পর্যন্ত বিস্ফোরিত হতে থাকে । অলিম্পাস মন্স থেকে বাম দিকে  আপনি তিনটি লাল আগ্নেয়গিরি দেখতে পাবেন যা প্রায় ১৬ মাইল (২৫ কিমি) উঁচু। এরা হলো অ্যাসক্রাইয়াস মন্স, পাভোনিস মন্স এবং আরসিয়া মন্স। ডানদিকে আরেকটি লাল আগ্নেয়গিরি রয়েছে যার নাম থারসিস থলাস।


৩. ভালেস মেরিনঃ

মঙ্গল কেবল সৌরজগতের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরি ধারণ করে না বরং বৃহত্তম গিরিখাত ও ধারণ করে। নাসার মতে,  ভ্যালেস মেরিন গিরিখাতটি মোটামুটি ১৮৫০ মাইল (৩০০০ কিমি) লম্বা । এটি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০০ মাইল (৮০০০ কিমি)। ভ্যালেস মেরিন কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সেই বিষয়ে গবেষকরা নিশ্চিত নন, তবে এর গঠন সম্পর্কে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী পরামর্শ দেন যখন থারসিস অঞ্চল গঠিত হয়েছিল, তখন তা ভালেস মেরিন এর বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। আগ্নেয়গিরি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলা লাভা ভূত্বকটিকে উপরের দিকে ঠেলে দেয়, যা অন্যান্য অঞ্চলের ভূত্বককে ভেঙে দেয়। সময়ের সাথে সাথে, এই ফাটলগুলো ভালেস মেরিনারিসে পরিণত হয়েছিল।


৪. উত্তর ও দক্ষিণ মেরুঃ

মঙ্গলের মেরুতে দুটি বরফযুক্ত অঞ্চল রয়েছে, যেখানে ভিন্ন পরিবেশের দেখা পাওয়া যায়। নাসার মতে, শীতকালে উত্তর এবং দক্ষিণ উভয় মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলের তাপমাত্রা এত হিমশীতল যে কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে বের হয়ে বরফে পরিণত হয়। গ্রীষ্মে প্রক্রিয়াটি বিপরীত হয়। যখন কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে তখন উত্তর গোলার্ধে কার্বন ডাই অক্সাইড সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং একটি বরফের ক্যাপ রেখে। কিন্তু কিছু কার্বন ডাই অক্সাইডযুক্ত বরফ দক্ষিণ বায়ুমণ্ডলে রয়ে গেছে। এই বরফ চলাচল মঙ্গল গ্রহের জলবায়ুতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং বায়ু প্রবাহ সহ জলবায়ুর সব উপাদানের উপর প্রভাব রাখে।


৫. গেইল ক্র্যাটার এবং মাউন্ট শার্প (এওলিস মনস):

২০১২ সালে কিউরিওসিটি রোভার অবতরণের মাধ্যমে বিখ্যাত "গেল ক্র্যাটার" অতীতে মঙ্গলে পানি থাকার প্রমাণকে জোরালো করে তোলে। কিউরিওসিটি রোভার অবতরণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটি প্রবাহ চিহ্নিত খাঁজ লক্ষ করে এবং গর্তের মেঝে বরাবর তার যাত্রা জুড়ে পানি থাকার আরও বিস্তৃত প্রমাণ পেয়েছে। কিউরিওসিটি রোভার এখন মাউন্ট শার্প (Aeolis Mons) নামে একটি কাছাকাছি আগ্নেয়গিরি পর্যবেক্ষণ করছে এবং তার প্রতিটি স্তরে ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ করছে। কিউরিওসিটির আরও উত্তেজনাপূর্ণ অনুসন্ধানগুলির মধ্যে একটি ছিল এই অঞ্চলে একাধিক স্থানে জটিল জৈব অণু আবিষ্কার করা। ২০১৮ সালের গবেষণার ফলাফল বলছে  যে এই জৈবগুলি ৩.৫ বিলিয়ন বছর বয়সী পাথরের ভিতরে আবিষ্কৃত হয়েছে। জৈবিক ফলাফলের সাথে গবেষকরা ঘোষণা করেছেন যে রোভারটি বায়ুমণ্ডলে মিথেনের ঘনত্বও খুঁজে পেয়েছে। মিথেন এমন একটি উপাদান যা জীবাণু এবং ভূতাত্ত্বিক ঘটনা দ্বারা উৎপাদিত হতে পারে, তাই এটি জীবনের চিহ্ন কিনা তা স্পষ্ট নয়।


৬. মেডুসা ফোসিঃ

মেডুসা ফোসি মঙ্গলের অদ্ভুততম স্থানগুলির মধ্যে একটি, কিছু মানুষ অনুমান করে যে এখানে একটি UFO ক্র্যাশের কিছু প্রমাণ আছে । আরো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল এটি একটি বিশাল আগ্নেয়গিরির স্তুপ যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকারের এক-পঞ্চমাংশ। সময়ের সাথে সাথে, বাতাস শিলাগুলিকে কিছু সুন্দর গঠনে পরিণত করেছে কিন্তু গবেষকদের আরও প্রমাণ পেতে হবে কিভাবে এই আগ্নেয়গিরিগুলি "মেডুসা ফোসি" তৈরি করেছে। ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে ৫০০ মিলিয়ন বছর ধরে শত শত বার সংঘটিত বিশাল অগ্ন্যুৎপাত থেকে এই গঠন গঠিত হতে পারে । আগ্নেয়গিরি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে প্রবাহিত হওয়ায় লাল গ্রহের জলবায়ুকে উষ্ণ করে দিত।

৭. হেল ক্র‍্যাটারের রেখাঃ

মঙ্গল গ্রহে পুনরাবৃত্ত লাল রেখা নামে একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা উষ্ণ আবহাওয়ার সময় খাড়া গর্তের পাশে তৈরি হয়।‌ যদিও এগুলো আরএসএল কি না তা নির্ণয় করা কঠিন। ২০১৫ সালে, নাসা প্রাথমিকভাবে ঘোষণা করেছিল যে হাইড্রেটেড সল্টগুলি অবশ্যই পৃষ্ঠের উপর জল প্রবাহিত হওয়ার লক্ষণ কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় বলা হয়েছে যে বায়ুমণ্ডলীয় জল বা বালির শুষ্ক প্রবাহ থেকে আরএসএল তৈরি হতে পারে । কিন্তু একটি অসুবিধা আছে , যদিও আরএসএল প্রকৃতপক্ষে এলিয়েন জীবাণু ধারণ করে, বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। নাসা তার অধীনে কীভাবে তদন্ত করতে পারে তা নির্ধারণ করে গ্রহ সুরক্ষা প্রোটোকল। ভবিষ্যতের মানব অনুসন্ধানকারীদের দূরবীন ব্যবহার করে দূর থেকে এই রহস্যময় বৈশিষ্ট্যগুলির তদন্ত করতে হতে পারে।


৮. হেলস বেসিনের পায়ের ছাপঃ

মঙ্গল এর মাটিতে অতিরিক্ত বায়ুপ্রবাহের কিছু অঞ্চল রয়েছে যেমন হেলস বেসিন, নোকটিস ল্যাবিরিন্থাস অঞ্চল। গবেষকরা বলছেন যে এই অঞ্চলে দশ মিটার লম্বা টিলার অবস্থানের ফলে এবং অতিরিক্ত উদগিরণ এর ফলে টিলাগুলি লাভা বা জলে প্লাবিত হয়েছিল । এর ফলে সৃষ্ট লম্বা নুড়ি পাথর এর ছাপ এর মাটিতে পায়েয় ছাপ এর মতো আকৃতি তৈরি করেছিল। পুরাতন টিলা গুলো মঙ্গলে বাতাস প্রবাহের একটি নিদর্শন যা জলবায়ুবিদদের লাল গ্রহের প্রাচীন পরিবেশ সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত দেয়। আরও উত্তেজনাপূর্ণ তথ্য হলো, এই টিলার আশ্রয়স্থলে জীবাণু লুকিয়ে থাকতে পারে যা বিকিরণ এবং বাতাসের সংস্পর্শে এলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে।


মঙ্গলের এই অঞ্চলগুলোতে একদিন বাংলাদেশর পতাকা উড়বে , এই আশা নিয়ে লেখা শেষ করছি। সবশেষে কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে চাই -

"বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেয়ো না তাহার কাছে,

নড়াচড়া করে, তবুও সে মড়া, জ্যান্ত সে মরিয়াছে ।

শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ইমান লয়েছে কেড়ে,

পরান গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে!"


সাদমান সালসাবিল সাদিব

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম